পুনম পর্বঃ২৬

0
1589

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৬

পাবনী ছাদের ফুলগাছ গুলোতে পানি দিচ্ছে।সাথে গুনগুন করে কিন্নরকণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতের সুর…..
পাবনীর মনটা আজ খুব খারাপ। অবশ্য পাবনীর মন কোনদিনই ভালো থাকেনা।মন খারাপের মাত্রা কোনদিন বেশি কম।এই যা!
আজকের মন খারাপের কারণ হলো সুমন ভাই। কেন যেন পাবনীর মনে হচ্ছে…. সুমন ভাই তার সাথে রাগ করে কুমিল্লা চলে গেছে…..ফুলগাছে পানি দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর নজর ছাদের চিলেকোঠার দিকে যাচ্ছে….
এমনটা হবার কথা নয়…তবুও হচ্ছে! এর জন্য পাবনীর একদিকে মেজাজ খারাপও হচ্ছে…. আর একদিকে বিষন্ন লাগছে!
নিয়াজ উদ্দিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে….
—-পাবনী
—জ্বি বাবা!
—তোমার কি কোন কারণে মন খারাপ?
পাবনী বাবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।যার মানে তার মন খারাপ না!
তিনি অবাক হলেন না।এই মেয়ে অসম্ভব রকমের চাপা স্বভাবের। নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগা খুব সহজেই চেপে রাখতে পারে।পুনম নিজের কষ্টের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে কিন্তু পাবনী নিজের কষ্ট চেপে রাখে!
—তোমার উচিত আবার পড়াশোনা শুরু করা।
—লেখা পড়া ভালো লাগে না বাবা।
বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়ের দিকে।
পাবনী বুঝতে পারে বাবা রেগে যাচ্ছে… কিন্তু ওর নিজের কি করার আছে?পড়াশোনা ভালো লাগে না এটা মিথ্যে কথা। কেননা পাবনী লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল….
কিন্তু স্কুল কলেজে এতটা বুলিইং শিকার হয়েছে পাবনী যা ওর মনোবলে প্রচুর আঘাত করেছে।সেই ভাঙা মনোবল কখনো জোড়া লাগেনি!পাবনীর চোখে জল এসে যায়….ভার্সিটিতে পড়ার সময় ওকে অনেকেই পিশাচী বলে ডাকতো ওর পায়ের জন্য! ওর ডান পা কিছুটা বাঁকানো, যা নাকি পিশাচীনীদের হয়!এরপর থেকে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় পাবনী।নিজেকে ঘরের চার দেয়ালের মাঝে বন্ধী করে রাখে।পাবনী কখনো পুনমের মত প্রতিবাদী হতে পারেনি।সবাই সব কিছু পারে না।যেমন পাবনী পারেনি….ছোটবেলা থেকে সবার কটু কথা শুনে পাবনীর ভিতরের স্বত্বাটা মরে গেছে!অনেকেই বলে লোকের কথায় কান দিতে নেই।কিন্তু যার উপর দিয়ে সেই লোককথা যায় শুধু সেই বোঝে কি অসহ্য যন্ত্রণামূলক কথার তীর বিদ্ধ করে তারা!
—-বাবা দেখেছো কত ফুল ফুটেছে আমার গাছে?
বাবার বুক ফুঁড়ে চাপা নিশ্বাস ছাড়ে।পাবনী কথা এড়াতে চাইছে।
—-আসলেই গাছ গুলো ভালো লাগছে দেখতে!লাবণ্যের থেকে ফুল সামলে রেখো।ফুলগুলো পুনম দেখলে খুব খুশি হতো।
—বাবা তোমার কি পুনমের জন্য খুব মন খারাপ লাগছে?
—হুম!
—আমারও!
********************
রুমা শব্দ করে চায়ের কাপ রাখে সুমনের সামনে।রুমার মন মেজাজ খুব খারাপ!হারুন কাল থেকে বাড়ি আসছে না। তার উপরে আবার এই সুমনের অত্যাচার… অসহ্য!
সুমন চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়েই নাকমুখ কুঁচকে ফেলে।চিনি দিয়ে শরবত বানিয়ে ফেলেছে চা!কাল রাতে বাসায় এসে পোঁছাইছে সুমন।খালিপেটেই ঘুমিয়ে ছিল।এখন সকালে নাস্তা খেতে এসে দেখে বুয়া লেট করে এসেছে তাই নাস্তা দিতে লেট হবে।তার বদলে চা চাওয়াতে এই বিদঘুটে চা জুটেছে ওর কপালে!পাবনীর হাতের চা পান করতে মন চাইছে সুমনের।মেয়েটা অসম্ভব ভালো চা বানায়।মনে হয় মেয়েটা চায়ের সাথে একচিমটি ভালোবাসা মিশিয়ে দেয়..না হলে এত সুস্বাদু চা হয় কি করে?
পাবনীর কথা মনে হওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে যায়। সেদিন এককাপ চায়ের বদলে কি কড়া কথাই না বললো?
সুমন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,….এর শাস্তি পাবনীকে সে দিবেই দিবে।বিয়ের পরে প্রতি দশমিনিট অন্তর চা বানানোর শাস্তি! তাতে যদি সুমনের ডায়াবেটিস হয়, হোক!তবুও পাবনীকে ছাড়বে না……
—-ভাবি তোমার গালে কি হয়েছে…..?হালকা দাগ পড়েছে কেন?
রুমা কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।সুমনের অবশ্য তাতে মন খারাপ হয় না।ও হচ্ছে এই পরিবারের আগাছা… আর আগাছা হলো মূল্যহীন! মূল্যহীন মানুষের সকল কথার জবাব জানতে হবে এমন কোন কথা নেই!
************
রিসোর্টের নামি দামি কক্ষে শুয়ে আছে হায়দার হোসেন।শরীরের অর্ধভাগ নগ্ন!কোমড়ের কাছে একটা তোয়ালে পেচানো। হাতে ওয়াইনের গ্লাস….নেশায় বুদ! চোখের সামনে ভাসছে নারী দেহের অঙ্গ! উফফ! এই বয়সে এসেও হায়দার হোসেন কামুকতা কোন যুবকের থেকে কম নয়!
মুন্নি নামের মেয়েটি ওয়াশরুম থেকে ভীত মস্তকে এসে সামনে দাঁড়ায়! মেয়েটির শরীর কাঁপছে….চোখে জল এসে জমা হয়েছে!ছুটে পালিয়ে যেতে মন চাইছে।সামনের পুরুষটির চাহনি ওর শরীরের প্রতিটি ভাঁজ পর্যবেক্ষণ করছে…অসহায়! মুন্নি চরমতম অসহায়! টাকার কাছে ও হেরে গেছে!ওর সন্তানটি হসপিটালের বেডে পড়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে…. ওকে পারতেই হবে….সব পথ বন্ধ ওর!
হায়দার হোসনে হাসছে…বড় বিশ্রী সে হাসি! মুন্নি দুচোখের পাতা বন্ধ করে….দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে….
—কাম ডার্লি!কাম….
মুন্নি ধীরপায়ে এগিয়ে যায় বেডের দিকে…..এই নরম তুলতুলে বেডে আজ ওর সমাধি রচিত হবে…..
মুন্নি চোখ বন্ধ রেখেই টের পায়… ওর শরীরের কাপড় খুলে পড়ছে….একটা বৃদ্ধ হাত সারা শরীরে ঘুরপাক খাচ্ছে…. বড় জঘন্য সেই স্পর্শ! ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে মুন্নি…এতটা অসহায় হয়ে কেন পৃথিবীতে আসলো?…..
—-এই মা..* চোখ খুল! এত টাকা দিচ্ছি তোর নখরা দেখার জন্য….
মুন্নি তাকায়…আশ্চর্য! কোন পুরুষ নয়, ও নিজেকে যেন বেশ্যা রুপে দেখতে পায়!

*********
সালেহা বেগমের শরীরটা ভালো লাগছে না।হাত পা আবার ফুলে উঠেছে।হাত পায়ে পানি এসেছে….একটু আগে মরিচা সরিষার তেল গরম করে মেজে দিয়ে গেছে হাত পা…নিয়াজ উদ্দিনের ভয় হচ্ছে! কেমন নিস্তেজ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে সালেহা…
—ও পুনমের মা,তোমার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
সালেহা চোখ মেলে তাকান।স্বামীর ভীত চাহনি দেখে মৃদু হাসেন…
—-পুনম কবে ফিরবো?
—তোমার স্বভাব পাইছে তোমার মেয়েরা।কথা একটা কইলে উত্তর দেয় আর একটা!
—এখন আমার মেয়েরা…
—মুখে মুখে কথা বলবা না…শরীর ভালো না তোমার!
সালেহা চুপ হয়ে যান…এত বছরের সংসারে এই মানুষটাকে তিনি বুঝতে পারেননা….সবসময় বকাঝকা করবেন কিন্তু একটু অসুস্থ হলেই আবার বিচলিত হন…বড়ই আজব মানুষ!
—-পুনমের বাবা?
—হুম!
—না থাক…
—শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? বলো চুপ হইয়া থাইকো না…
—-আপনেরে আমার একটা কথা বলা হয় নি….
—কি?
—-আপনেরে… গোঁফে পুরাই শজারুর মত লাগে!
নিয়াজ উদ্দিন বিরক্ত চোখে তাকান…মেজাজ খারাপ হয়!
সালেহা মুখের উপর কাঁথা চেপে হাসেন….নিয়াজ উদ্দিন উঠে পড়েন…অবশ্য যাওয়ার সময় সালেহার উদ্দেশ্য বলেন,বেক্কল মহিলা!
*********
মরিচা রাতের বেলা ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক দিয়ে ঘুরছে।ঝুমা অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে,
—-মাইজা আফা আমি আর ছুডু আফায় এখন টিকটক করুম…বুঝছেন…ওই যে গানের তালে নাচানাচি করা… সেই রহমের…
পাশ থেকে পাবনী বলে,
—কিছুদিন পর ওর পরিক্ষা আর এসব করে বেড়াচ্ছে… পুনম আসলে ওর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে যেতে বলবো।
সে কথা শুনে মরিচা ভেঙচি কাটে…এরা সবাই ওর আর ছুডু আফার শত্রু…হুহ! এত পইড়া হইবো ডা কি?
লাবণ্য কোথা থেকে ছুটে আসে। পাবনী ঝুমা অবাক হয় দেখে….লাবণ্য পুরাই গ্রাম্য সাজ দিয়েছে….মেয়েটাকে ভালো লাগছে…শ্যামগায়ে বড় বড় চোখে কাজলের ছোঁয়া…মারাত্মক! দুপাশে বেণী, তাতে লাল ফিতা…ঠোঁটে লাল রঙ….কি সুন্দর!
—-মেজ আপা দুলাভাই কই?
—কেন?
—-উফফ! বলোনা।
—সে তো রুমে…
—মরিচা বু দুলাভাইরে ডেকে নিয়ে আসো….

কিছুক্ষণ পর দেখা যায়,
ড্রয়িং রুমে জামাল বসে আছে আর তার দুপাশে লাবণ্য আর মরিচা বসে টিকটক করছে……মোবাইলে গান বাজছে….
দুলাভাই, ও আমার দুলাভাই
চলনা সিনেমা দেখিতে যাই
সিনেমার নাম নাকি তোমাকে চাই
তোমাকে চাই দুলাভাই!

পাবনী আর ঝুমা এই দৃশ্য দেখে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে….আর জামালের অবস্থা পুরাই কাহিল!
*************
রাত এগারোটা বাজে….কক্সবাজার হোটেলের ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই….কাল চলে যাবে সবাই যে যার গন্তব্য স্থানে…এরপর আবার সেই ধরাবাধা ব্যস্ত জীবন!।
এক্সাম শেষ হলেই সবাই একটা জবের পিছনে হন্যে হয়ে ঘুরবে…বন্ধুত্বরের এই বন্ধনে তখন না চাইতেও দুরত্ব এসে যাবে!
এই দুটো দিন সবচিন্তা বাদ দিয়ে বন্ধুরা সবাই প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেছিল।সবারই মনটা খারাপ!যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি দূর হয়েছে এখানে এসে পুনমের।প্রথমে আসতে না চাইলেও পরবর্তী সময়টা বন্ধুদের সাথে ভালো কেটেছে!
তানভীর বল্টুদের থেকে সিনিয়র হলেও এখানে এসে সবার সাথে ফ্রি ভাবে মিশেছে….সাকিবের হাতে গিটার টুং টাং শব্দ হচ্ছে… শিমুল বলে, সাকিব্বা গান ধর…চুপচাপ ভালো লাগে না। সবাই গাই বো….
সাকিব গিটারের তালে সুর তোলে সাথে নাহিদ গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে…সবাই হাত তালির সাথে কন্ঠ মিলায়,
আকাশে মস্ত বড় চাঁদ।পূর্ণিমার আলো আর হোটেলের ঝকমকায় আলোয় একদল ছেলে মেয়ের গাওয়া গানে অল্পতেই মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ….

ছোট ছোট কিছু টুকরো গল্পে বাঁধা
এলোমেলো কিছু স্মৃতিতে সাজানো
তুমি আমি আর ঐ হারামী সার্কেলটা
কিলো হেঁটে হেঁটে ভাবছি কত শত
টিনশেড ছায়া ছোট্ট টংটা ঘিরে
বসে মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলো
ক্লাস, ড্রপ আর হাজারো গানের ফাঁকে
মামা, শুধু চা, নাকি আরও কিছু?

হুট করে ট্যুরে সবগুলো রেডি
বাসে গলা ছেড়ে কেউ জেমস, কেউ AB!
পরদিন টার্ম টেস্ট, আরে পেরা নাই
আগে ফটো আপলোড শেষ করি!
ক্লাস দিয়ে ফাঁকি
সিনিয়রের ঝাড়ি
সিজির গুল্লি মেরে রাতভর পার্টি
হঠাৎ কাউকে দেখে ক্রাশ খেয়ে ফিদা
পাশ থেকে ফ্রেন্ড বলে ওটা তোর ভাবি!

এই সেদিনই তো র‍্যাগ খেয়ে চুরমার
মা’কে ফোন দিয়ে “থাকবোনা আমি আর!”
আজ দেখি কেটে গেছে হাজারো দিন
খুব চাইলেও ফেরা তো যাবেনা আর!…….

সবার চোখে অজান্তেই জল এসে যায়।বন্ধুরা তো এমনই…

চলবে,

আলহামদুলিল্লাহ জ্বর নেই এখন….তবে এবারের অসুখটা আমায় একদম দূর্বল করে দিয়েছে…এতটা অসুস্থ আমি কখনো হইনি! জ্বর না থাকলেও মাথা ব্যথা, কাশি, হাত পায়ের অসারতা আছে!
চাইছিলাম পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গল্প দিবো কিন্তু কেন যেন আপনারা অপেক্ষায় আছেন এই বিষয়টা আমাকে আরো বিচলিত করছিল…অনলাইন জগতে যে কজনই পড়েন আমার লেখা তারাই আমার খুব কাছের…. ব্যক্তিগত জীবনে আমার বন্ধুর সংখ্যা খুব কম! তাই আপনাদের মূল্য আমার কাছে অনেক….
বেশি লিখতে পারিনি যতটুকু লিখলাম দিয়ে দিলাম🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here