প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-২১

0
674

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২১তম_পর্ব

মাহির কথাটা শেষ না হতেই দিগন্তের আগমণ ঘটলো। ছুটে এসে বলল,
“কুইজ ক্যান্সেল, অনল স্যারের শরীর খারাপ”

কথাটা কর্ণপাত হতেই থমকে গেলো ধারা। শরীর খারাপ, কিন্তু কেনো! আজ সকাল অবধি তো দিব্যি সে ফিটবাবুটি সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, তাহলে এই সামান্য সময়ে কি এমন হলো! অনলের অসুস্থতা শুনতেই ধারার ভেতরের সকল রাগ, ক্রোধ, অভিমান বিগলিত হতে লাগলো। বরং উদ্বিগ্নতা তৈরি হলো অনলের জন্য। এক অসামান্য হাহাকার তৈরি হলো অন্তস্থলে। চিনচিনে তীক্ষ্ণ ব্যাথা ছেয়ে গেলো হৃদয়ে। অস্থিরতা মস্তিষ্ককে গ্রাস করলো। অস্থির কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে তার?”
“সেভাবে তো জানি না, তবে যা জানি তা হলো তাকে ধরে টরে মেডিক্যালে নিয়ে গেছে। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন হয়তো সিড়ি থেকে”

দিগন্ত নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বলেই চেয়ার টেনে বসলো। কিন্তু শেষ কথাটায় বুক কাঁপলো ধারার। কেমন আছে সে! মাহি ধারার দিকে তাকালো। তাকে রক্তশূন্য লাগছে। মেয়েটি হয়তো ভেতরে ভেতরে বেশ চিন্তিত। কিন্তু দিগন্তের সামনে তা প্রকাশ করতে পারছে না। প্রকাশ করাটা বুদ্ধিমানেরও হবে না। তাই ফন্দি আঁটলো মাহি। ধারাকে বললো,
“যেহেতু কুইজ হচ্ছে না, চল ধারা অনল ভাই কে দেখে আসি”
“কেনো কেনো? তোদের যেতে হবে কেনো? সামান্য মাথা ঘুরে পড়েছে। এতে এতো আদিক্ষেতা কেনো?”

সাথে সাথেই দিগন্ত বাঁধ সাধলো। মাহিও কম নয়, উলটো চোখ গরম করে বললো,
“কেনো রে! মানবিকতা থাকতে নেই নাকি! স্যার আমাদের সে। হুট করে মাথা ঘুরে সিড়ি থেকে পড়ে গেছেন, ব্যাপারটা ভয়ংকর। কেমন আছেন জানবো না? আর ভুলে যাস না সে ধারার আপন জন, চল তো ধারা। এই পা’গ’লে’র কথা শুনে লাভ নেই”
“হ্যা, হ্যা। আমি পা’গ’ল, আর তুই কি! চু’ন্নী মাহি। আমি বুঝি না তাই না? তোর মতলব তো অন্যখানে, আর ধারাকে বানাচ্ছিস ঢাল”
“খুব বুঝছো তুমি! এবার অফ যেয়ে আমাদের ধন্য করো”
“তুই অফ যা”

এক কথায় দু কথায় ঝগড়া লাগলো মাহি এবং দিগন্তের। এই দুজনের জন্য এটা নতুন কিছু না। সর্বদা এদের মাঝে কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা চলবেই। দিগন্ত উত্তর বললে, মাহি দক্ষিণ বলবে। মাহি কোনো কথা বললেই সেখানে ভেটো দিবে দিগন্ত। আর দিগন্তের কথা একেবারেই সহ্য হবে না মাহির। তখনই লাগে তৃতীয় বি’শ্ব’যু’দ্ধ। আর সেই যু’দ্ধে আ’হ’ত হয় ধারা, নীরব এবং অভীক। আজও তাই হচ্ছে। ধারার মেজাজ বিগড়ে গেলো। একেই অনল ভাই এর চিন্তায় বুক কাঁপছে, ভেতরটা অস্থিরতায় অশান্ত হয়ে আছে। এর মাঝে এই দুটো মানব মানবী নিজের তর্কযুদ্ধ করছে। একটা সময় তীব্র স্বরে বলে উঠলো,
“থাম না তোরা, একটা মানুষ অসুস্থ আর এদিকে তোরা ঝগড়া করছিস! এমন কেনো রে তোরা?”
“আমাকে বকছিস কেনো! এই মা’থা’মো’টা দিগন্ত ই তো আমার সাথে তর্ক জুড়লো, তুই বরং উঠ। আমরা অনল ভাইকে দেখে আসি”

ধারা মাথা নাড়লো। তার পক্ষে বসে থাকাটা অসহনীয় লাগছে। সে দেরি করলো না, বই খাতা বন্ধ করে মাহির সাথে বেড়িয়ে গেলো। দিগন্তের কাছে ব্যাপারটা বড্ড অটপটে লাগলো। যে তীক্ষ্ম দৃষ্টির তাকিয়ে রইলো ধারা এবং মাহির যাবার পানে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“যত দোষ নন্দঘোষ”

ভার্সিটির মেডিক্যাল সেন্টারটি পশ্চিম দিকে বড় মসজিদের পাশে। লাইব্রেরি থেকে যেতে পনেরো মিনিট লাগে। সেই দূরত্বটি ধারা এবং মাহি দশ মিনিটে পার করলো। মাহির মনে হলো ধারার পায়ে যেনো কেউ রোলারস্কেটের চাকা লাগিয়েছে। সে হাটছে না ছুটছে। তার সাথে তাল মিলাতে যেয়ে হাঁফসে উঠলো মাহি। মেডিক্যাল সেন্টারে যেয়ে সামনের ডেস্কে বসা মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে রুম দেখিয়ে দিলো। রুমের সামনে যেতেই প্লাবণের দেখা পেলো ধারা। প্লাবণের দেখা পেতেই হন্তদন্ত হয়ে বললো,
“অনলভাই কেমন আছে?”

প্লাবণ মৃদু হাসলো। তারপর মজার ছলে বললো,
“বরের প্রতি কি টান! তা এতই যখন টান ওড়নায় বেঁধে রাখো না কেনো?”
“মজা বাদ দাও প্লাবণ ভাই। ভালো লাগছে না। সে কেমন আছে তাই বলে উদ্ধার করো তো!”
“ভেতরে যেয়েই দেখো না, আর শোন মান অভিমানটা মিটিয়ে নিও”

প্লাবণের শেষ উক্তির উত্তর দিলো না ধারা। হনহন করে ছুটলো ভেতরে। এদিকে মাহি বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকলো। পাহারা দেবারো একটা ব্যাপার থাকে। হুট করে কেউ চলে এলে ধারাকে সংকেত দিতে হবে তো! প্লাবণ হেসে শুধালো,
“তুমি যাবে না?”
“স্বামী স্ত্রীর মাঝে আমার কি কাজ? বরং বান্ধবীর প্রেমে যাতে বাধা না পরে সেই ব্যাবস্থা করি”
“সহমত প্রকাশ করলাম। আমারো সেই একই কাজ”

বলেই প্লাবণ হেসে দিলো। মাহির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো অনলকে শুভ্র, ছোট বিছানায় আধশোয়া অবস্থায়। বালিশটায় হেলান দিয়ে বা হাতখানা চোখের উপর দিয়ে শুয়ে রয়েছে সে। তার বা পায়ের গোড়ালির দিয়ে সফেদ ব্যান্ডেজ দেখা যাচ্ছে। ধারা ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়ালো। ধীর স্বরে বললো,
“কিভাবে হলো?”

ধারার চিকন কন্ঠ কর্ণপাত হতেই হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকালো অনল। নড়ে চড়ে উঠলো সে। কিভাবে হলো সে নিজেও জানে না। বাড়ি থেকে রওনা দেবার মাঝপথেই অঝোর বর্ষণের প্রকোপে পড়তে হলো তাকে। ছাতাও ছিলো না সাথে, বাইকের উন্মুক্ত থাকায় আপাদমস্তক কাকভেজা হলো সে। বৃষ্টির ধারা বাড়ার সাথেই সাথেই মাথায় এলো ধারারাণীকে বাসায় ফেলেই চলে এসেছে। আর তাদের গলির চিরন্তন নিয়ম, একটু বৃষ্টি হলেই আশেপাশের সকল রিক্সা যেনো গায়েব হয়ে যায়। অবশ্য হবে না কেনো একটু বৃষ্টিতেই তো তাদের রোড পানিতে টুইটুম্বর হয়ে উঠে। তাই এই অঝর ধারায় ধারারানীর জন্য রিক্সা খুঁজতে ব্যাকুল হয়ে উঠলো অনল। এদিকে নিজে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। বহু খোঁজার পর এক যুবকের রিক্সা পেলো সে। তাকে একশত টাকার নোট ধরিয়ে বললো,
“রহমত পাড়া চেনো? বা দিয়ে ঢুকে ডানে!”
“জ্বী চিনি”
“ওখানে ঢুকে একদম শেষে কালো কেঁচি গেটে দেখবে একটি মেয়ে দাঁড়ানো। ও যেখানে যাবে নিয়ে যেও”
“ভাড়া নিমু?”
“হ্যা, নিবে। কিন্তু আমি ঠিক করে দিয়েছি সেটা প্রকাশ করবে না। আর এই টাকাটা রেখে দাও”

যুবকের চোখ চকচক করে উঠলো। এই অক্লান্ত বৃষ্টিতে ফ্রি কাস্টোমারের সাথে একশত টাকা পেলে যে কারোর ই মন ভাল হয়ে যায়। যুবক উৎফুল্ল মনে অনলের বলা জায়গায় গেলো। অনল ও পিছু পিছু বাইক চালিয়ে গেলো। কিন্তু সামনে এলো না। লুকিয়ে থাকলো দু বাড়ি পেছনে। সে যা আন্দাজ করেছিলো তাই হয়েছে, ধারা মুখ লম্বা করে দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সাটি তাকে যাবার কথা বলতেই সে উঠে পড়লো৷ রিক্সাটি যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলো সে। যতই মান অভিমান চলুক নিজের বউকে তো বৃষ্টিতে ভিজতে দেওয়া যায় না। রিক্সা যাবার পর অনল ও রওনা দিলো ভার্সিটির দিকে। ভার্সিটিতে যখন পৌছালো তখন তার অবস্থা সুনামির সময় নদী পথে আটকে পড়া মাঝির ন্যায়। ভাগ্যিস নিজ রুমে এক্সট্রা এক জোড়া শার্ট, প্যান্ট ছিলো। তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় বদলে নিলেও ঠান্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচলো না। দুটো ক্লাস করার পর ই প্রবল মাথা ব্যাথা, সারা গায়ে অসহনীয় উত্তাপ। কড়া লাল চা পানির মতো পাঁচ ছ বার খেয়েও যেনো রেহাই হলো না। সিড়ি দিয়ে যখন নামছিলো তখন মনে হলো দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। শরীরের উত্তাপ যেনো দুটো চোখে এসে জমেছে। চোখ জোড়া যেনো হয়ে উঠেছে জ্বলন্ত কয়লা। রক্তিম চোখজোড়া ডান হাত দিয়ে ঘষলো অনল। কিন্তু লাভ হলো না। মাথাটা ভার হয়ে এসেছে। ফলে সিড়ি থেকে নামতে গিয়ে একটা সিড়ি অজান্তেই বাদ পড়ে গেলো। টাল সামলাতে না পাড়ায় অনল যেয়ে পড়লো একেবারে তিনসিড়ি পর। ওখানে উপস্থিত ছাত্ররা তাকে টেনে টুললো। উঠতেই টের পেলো পা টা মচকেছে। কোনো মতে ধরে তাকে মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে আসা হলো। উপস্থিত ডাক্তার কপালে হাত দিতেই বললেন,
“আপনার তো জ্বর, গা পুড়ে যাচ্ছে! ঔষধ খান নি?”
“জ্বরটা হুট করে হলো মনে হচ্ছে, টের পাই নি”
“বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন?”
“অসময়ের বৃষ্টি, ভিজতে না চাইলেও ভেজা হয়”
“বুঝেছি, ঔষধ দিচ্ছি। আর পা টা ভোগাবে দু একদিন। ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি, সিরিয়াস না তেমন”

অনল শুধু মাথাই দোলালো। অনলের সিড়ি থেকে পড়ে যাবার কথা কানে আসতেই প্লাবন ছুটে এলো। বন্ধুকে এই প্রথম এতোটা অসাবধান এবং দায়িত্বহীন দেখলো প্লাবণ। এদিকে অনলের এই পড়ে যাওয়ার কাহিনী আগুনের মতো ছড়িয়ে গেলো। কৃতিত্বটি দিগন্তকে দেওয়াই যায়। কারণ সেই সময় সে উপস্থিত ছিলো ঘটনাস্থলে। তবে অনলকে সাহায্য করার থেকে তথ্যটা ছড়ানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। যাকে অপছন্দের সারিতে রাখা হয় তাকে সাহায্য করার নীতি দিগন্ত রাখে না। অবশ্য তাতে লাভ একটা হলো, ধারা শোনামাত্র ছুটে এলো।

অনল এখনো নিশ্চুপ। ধারা এখনো অপেক্ষা করছে উত্তরের। কিন্তু উত্তরটি পাওয়া হলো না। অনল অন্য দিকে তাকিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে। ধারা মুখ গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর এগিয়ে এসে অনলের পাশে বসলো। ডানহাতটা আলতোভাবে তার কপালে রাখলো। তাপমাত্রা মাপলে পারদের থার্মোমিটারে ১০২ তো হবেই।এবার কোমল কন্ঠে বললো,
“তুমি জানো তোমার ঠান্ডার ধাঁচ আছে তাহলে কেনো বৃষ্টিতে ভিজলে?”
“শখে কি কেউ ভিজে?”

অবশেষে মুখ খুললো অনল। ধারা আর কিছু বললো না। কারণ কিছু বললেও সোজা উত্তর মিলবে না। হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিস্প্রভ কন্ঠে বললো,
“তুমি অসুস্থ হলে আমার উদ্বিগ্নতা বাড়ে। তাই দয়া করে অসুস্থ হয়ো না। যখন কানে এলো তুমি পড়ে গেছো, মাথায় অনেক অনর্থক চিন্তা এসেছিলো। এখন হয়তো এটা তোমার কাছে আবেগের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে। তবে আমি জানি আমার ভেতরে কি চলছিলো!”

অনল অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। ধারার ব্যাথিত চোখজোড়া তাকেও ব্যাথা দিচ্ছে যেনো। কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো! বুকের ভেতর জমা কথাগুলো দলা পেঁচিয়ে অন্তস্থলেই রয়ে গেলো________

******

প্লাবণের সহায়তায় অনলকে নিয়ে বাসায় ফিরলো ধারা। অনলের বাইকটি বাড়ি অবধি পৌছে দিলো অফিসের পিয়ন পিয়াস। বাড়িতে আসতেই দেখলো সদর দরজায় কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে জমজ বি’চ্ছু। অনল অবাক কন্ঠে শুধালো,
“এবার তোরা কি করেছিস?”

অনলের প্রশ্নে এশা হতাশ কন্ঠে বললো,
“আমরা সত্যি নিরপরাধ, অস্ট্রেলিয়ান চেরাগআলী আমাদের বিনা অপরাধে ফাঁসিয়েছে। আর আমাদের নির্দয় মা, আমাদের শাস্তি দিচ্ছে।

অনলের বুঝতে বাকি রইলো না তার প্রখ্যাত বোনেরা কিছু একটা কান্ড তো করেছে। নয়তো ছোট চাচীর শাস্তি দেবার কথা নয়। আসলে তখনের গোবরকান্ড ফাঁস হয়েছে। রোগাপটকা লোকটা ছিলো এশা আশার তৃতীয় শিক্ষক, যিনি তাদের সুনাম পুরো মহল্লায় ছড়িয়েছে। তাই তার উপর শোধ তুলতেই সেই কাজ করেছিলো তারা। কিন্তু দীপ্তের কারণে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেছে। লোকটি চেঁচামেচি করায় বাসায় মানুষ ও জড়ো হয়। ফলে সবাই জেনে যায় মুল ঘটনা। সেকারণেই রুবি দুটোকে সদর দরজায় কান ধরে দাঁড় করে রেখেছে। অনল বা ধারা পাত্তা দিলো না এশা আশার উপর। এদিকে অনলের পায়ের ব্যান্ডেজ দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সুভাসিনী বেগম। হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হলো তারা। মনে হলো কোনো ইন্টারোগেশন রুমে বসে আছে। সুভাসিনী বেগম বুলেটের মতো প্রশ্ন করছে, “কিভাবে হলো?” “কেনো হলো?” “জ্বর বাঁধালো কেনো?” “যখন শরীর খারাপ ছিলো বাড়ি ফিরে এলো না কেনো?”। অনল ধারা যেনো হাফসিয়ে উঠলো। শেষমেশ না পেড়ে অনল
বলেই উঠলো,
“মা, এবার থামো। ভুল হয়ে গেছে পা মচকালাম, এবার ক্ষান্ত হও। আর এই বাঁ’দ’র দুটোকে ভেতরে ঢোকাও। লাগছে কেমন? যেনো চিড়িয়াখানা থেকে উঠে আসা হ’নু’মা’ন”

অবশেষে ক্ষান্ত হলেন সুভাসিনী বেগম এবং অনলের জন্য এশা আশাও ঘরে প্রবেশ করতে পারলো। ধারা কোনোমতে অনলকে নিজ রুমে নিয়ে গেলো। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করলো, দীপ্ত নামক আগুন্তককে দেখা যাচ্ছে না। তবে ব্যাপারটা তাকে আনন্দ ই দিলো। যাক ব্যাটা হয়তো ভেগেছে। কিন্তু ধারা তো জানে না, সে গোবরকান্ডে এতোটাই ভয় পেয়েছে যে ঘর থেকেই বের হচ্ছে না। বলা তো যায় না, আবার কোন পরিস্থিতিতে তাকে ফাঁসিয়ে দেয় তারা।

*****

নিগুঢ় রাত, নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে ঘরটিতে। শুধু পুরোনো ফ্যানের ক্যাচর ক্যাচর শব্দ কানে আসছে। বাহিরে প্রবল আষাঢ়িয়া বর্ষণ। ঝমঝম বৃষ্টির মধুর শব্দ ক্ষীন ঢুকছে ঘরটিতে। কিন্তু ফ্যানের শব্দে তা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে দিয়ে পানির ছিটে আসছে। জানালাটা ঠিক করবে করবে করেও করা হচ্ছে না। এদিকে কাঁথা গলা অবধি টেনে ঘুমিয়ে আছে ধারা। বৃষ্টির কারণে অসহনীয় গরমটা আর লাগছে না। হঠাৎ চাপা আর্তনাদ ভেসে আসলো কানে। পাতলা ঘুমটা নিমিষেই চুরমার হয়ে গেলো। উঠে বসলো সে। হাতের কাছের ল্যাম্পটি জ্বালালো। পাশে তাকাতেই দেখলো কাঁপছে অনল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধারার ডান হাত চলে গেলো তার কপালে। উত্তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে যেনো। খাবার আগেও জ্বরটা ছিলো বললেই চলে। ঔষধ ও দিয়েছিলো সে অনলকে। তবুও আবারো কেনো জ্বর এলো বুঝলো না। উঠে গিয়ে ঔষদের বাক্সটা হাতে নিলো সে। পারদের থার্মোমিটার দিয়ে মাপলো জ্বরটা। পারদের মাত্রা ১০৪ ছুই ছুই। অনলকে মৃদু স্বরে ডাকলো, কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না। জ্বরের কারণে প্রবল ঘোরে যেনো ডুবে আসে সে। ধারা দেয়ালের ঝুলন্ত ঘড়ির দিকে তাকালো। তিনটে ছুই ছুই। এই সময় বাড়ির প্রতিটি প্রানী গভীর ঘুমে। সুতরাং কাউকে ডেকে লাভ নেই। যা করার নিজেকেই করতে হবে। কোনো মতে অনলকে ডাকলো সে। অস্পষ্ট স্বরে অনল বললো,
“হু”

ধারা গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। কোনো মতে পাহাড় সম মানুষটাকে তুললো সে। পেছনে বালিশ ঠেকিয়ে বসালো। দুটো প্যারাসিটামল খাওয়ালো কোনো মতে। ঘোরের মাঝে অনল তা খেলো ও। তারপর আবার তাকে সটান শোয়ালো। অনলকে উঠাতে আর শোয়াতে যেনো হাঁপিয়ে উঠলো ধারা। মানুষটির এতো ভার কল্পনাও করে নি। মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাঁড়লো সে। তারপর কাঁথাটা টেনে দিলো অনলের গলা অবধি। ফ্যান বন্ধ করে দিলো, যেনো ঠান্ডা না লাগে। ঠান্ডা পানির একটা মগ ওয়াশরুম থেকে আনলো। তারপর ছোটবেলার জ্বর কমানোর টেকনিক খাটালো, তা হল জলপট্টি। এভাবেই কাটলো রাত। ভোরের আলো পূর্ব আকাশে ফুটতেই দুনিয়ার ঘুম চেপে বসলো ধারার চোখে। অনলের জ্বর এখন নেই বললেই চলে। মানুষটি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তাই ধারাও ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে নিলো। অনলের রুক্ষ্ম, শক্ত হাতটা নিজের নরম হাতের মাঝে রেখেই ঘুমিয়ে গেলো সে_____

ব্যস্ত শহর, নরম সূর্যোলোক কাঠের জানালা ভেদ করে প্রবেশ করছে ঘরে। সারারাত বৃষ্টি হওয়ায় তার তাপ নেই এর কাছাকাছি। শীতল সমীরে উড়ছে জানালার গোলাপি পর্দাটি। কুসুম প্রভা চোখে লাগাতেই ঘুম ভাঙ্গলো অনলের। মাথায় এখনো প্রবল যন্ত্রনা। জ্বর নেই, তবে মনে হচ্ছে সারা শরীরে হাতি দাঁপিয়ে গেছে। অসহনীয় ব্যাথা। উঠে বসতেই বা হাতে প্রবল ভার অনুভূত হলো। পাশ ফিরতেই দেখলো কিশোরী বউ টি তার হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে নিবিড় ঘুমে মগ্ন। পাশের টেবিলের ঔষধের এলোমেলো বাক্স, অবহেলায় পড়ে থাকা মগ এবং অর্ধশুকনো রুমালটি দেখেই আন্দাজ করতে পারলো, কেনো তার এখন জ্বর নেই। ব্যাপারখানা ভাবতেই অজান্তেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। মনের আকাশে এক নবরঙধনুর আবির্ভাব হলো। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো প্রসন্ন, স্নিগ্ধ হাসি। অপলক নজরে দেখলো নিজের কিশোরী বউকে। তার কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিলো সে। কপালে উষ্ম ঠোঁটের আলতো পরশ বুলিয়ে নরম স্বরে বললো,
“আবারো ম’র’লাম আমি, আবারো হারলাম। তবে এই মৃ’ত্যুতে যে জন্মের শান্তি, এই হারে যে প্রবল প্রশান্তি। ভালোবাসি বউ, প্রচন্ড ভালোবাসি”..………….

চলবে

(গতকাল আমার একাউন্ট রে’স্ট্রি’ক’টে’ড হয়েছিলো। তাই আমি গল্প দিতে পারি নি। আজ অবশেষে আইডি ফিরে পেলাম। বড় করে লেখার চেষ্টা করেছি। পরীক্ষার প্রেসারও চলছে তাই এর চেয়ে বড় লেখাটা সম্ভব হলো না)

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here