প্রবাসীর বউ পর্ব-৪

0
1915

#ধারাবাহিকগল্প
#প্রবাসীর বউ
পর্ব-চার
মাহাবুবা বিথী

শাশুড়ী এবার যাওয়ার সময় রহিমাকে বলেছিলো,
—-বউ তোমার উপর কোনো জোর নাই।যে অপবাদে তোমারে ঘর ছাড়া করা হইছে কোন মুখে তোমারে যাইতে বলি।তবুও যদি মনে চায় তোমার স্বামীর ভিটায় বেড়াবার যাইও।
মহিপালে ওর শ্বশুর বাড়িতে যেতে রহিমার আসলে মাঝে মাঝে মনটা খুব চায়। তাই একটু সময় বার করে বেলালকে মায়ের কাছে রেখে ও দুপুরের খাওয়া সেরে চাঁদপুর থেকে ফেনীর মহিপালের পথে রওয়ানা হলো।
রহিমা মনে মনে ভাবে,প্রতিটি মানুষের আত্মশক্তি বিকাশের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা আসে।অন্যের উপর বেঁচে থাকাকে বলা হয় পরনির্ভরশীলতা।যার নিজের শক্তির উপর কোনো বিশ্বাস নেই সে আত্মনির্ভর হতে পারে না।পরের উপর নির্ভরতা বর্জন করতে হলে নিজের আত্মশক্তিকে কাজে লাগাতে হয়।এভাবেই জীবনে আত্মনির্ভরতা আসে।আত্মনির্ভরশীলতা মানুষকে সম্মানের সহিত বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।আজ রহিমার শ্বশুর বাড়ি বাবার বাড়ি দুজায়গাতেই সবাই সম্মান করে।এই সম্মান রহিমা আত্মনির্ভরশীলতার মাধ্যমে অর্জন করেছে।
মহিপালে পৌছাতে রহিমার সন্ধে হয়ে গেলো।মহিপাল থেকে ডিসির বাংলোর সামনে বিশাল বিজয় সিংহ দীঘি।রহিমা শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার আগে দীঘির পাড়ে বসে শরীরটা ঠান্ডা হাওয়ায় জুড়িয়ে নেয়।বিয়ের পর রহিমা হেলালের সাথে এই দীঘির পাড়ে এসে বসতো।রহিমা পানির দিকে তাকিয়ে আছে।কি স্বচছ পানি!ছোটো কচুরী পানার দল ভেসে বেড়াচ্ছে।অদ্ভূদ জলজ সুবাস রহিমার নাকে এসে লাগছে।দীঘির পাড়ে ঠান্ডা বাতাস রহিমার সব ক্লান্তি দূর করে দিলো।নীল আর সাদা মেঘের সংমিশ্রনে আজকের আকাশটাও খুব সুন্দর।চারিপাশে বড় বড় গাছ থাকায় ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়।

দশ বছর পর রহিমা স্বামীর ভিটেয় বেড়াতে এসেছে।রহিমার চোখের অশ্রু আজি অবাধ ও বাঁধনহারা।
গোধুলীর রক্তিম আভা লুকিয়ে যাবার পর রহিমা শ্বশুর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।শ্বাশুড়ি সালেহা বেগম রহিমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললো,
—আমার কি সৌভাগ্য!আমার ঘরের লক্ষী ফিরা আইছে।বউ বেলালরে নিয়ে আসতা।
রহিমা বলে,
—-বেলালের স্কুলে পরীক্ষা আছে।তাই আনি নাই।
আসলে রহিমা এখনও এদের বিশ্বাস করতে পারে না
ওর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বেলাল।এরা যদি বেলালের কোনো ক্ষতি করে সেই ভয়েই বেলালকে আনেনি।
রহিমার জা জরিনাও ছুটে আসলো,রহিমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-কেমন আছো বইন।তোমার সাথে আমি অনেক খারাপ ব্যবহার করছি।যে অন্যায় তোমার সাথে করছি তুমি আমারে মাফ কইরা দিও বইন।

রহিমা তাকিয়ে দেখলো হুইল চেয়ারে বসে আছে আলাল।রহিমাকে দেখে আলালের নিস্প্রান চোখের তারা নেচে উঠলো।
দশ বছর আগে উনি কতটা আলাদা মানুষ ছিলো আজও রহিমার মনে আছে।কতটা অসম্মান নিয়ে রহিমা এ বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে সেই দগদগে ছবিটা আজও স্পষ্ট হয়ে ভেসে আছে।আলালের চোখের সেই ধারালো কুটিল দৃষ্টিটা আর নেই।রোগে চামড়ার উজ্জ্বলতাও হ্রাস পেয়েছে।রহিমাকে দেখে আলালের চোখ জোড়া সিক্ত হয়ে উঠলো।রহিমার মনের মাঝে পুরোনো স্মৃতি আবার ভেসে উঠলো।
আলাল জড়িয়ে জড়িয়ে তীব্র অনুশোচনা নিয়ে রহিমাকে বললো,
—-রহিমা তুমি আমারে মাফ কইরা দিও।
রহিমা অবাক হয়ে ভাবলো,আলাল এমন অসহায় ভাবে রহিমার কাছে মাফ চাইবে এটা রহিমার ধারণার বাইরে ছিলো।
একজন বিধবাকে স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে,একটা এতিম বাচ্চাকে ঠকিয়েছে,আর সর্বোপরি একজন সতী নারীর চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়েছে।আর তার ব্যক্তিগত অপরাধের সীমা পরিসীমা নেই।
তারপর ও রহিমা আলালকে মাফ করে দিয়েছে।আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করেছে,আল্লাহপাক যেন ওনাদের মাফ করে দেন।জরিনাও রহিমার কাছে মাফ চেয়ে নিলো।এই জরিনাও সেদিন ধারালো মুখরা মহিলা ছিলো।
পাশাপাশি রহিমা আলাল আর জরিনার মুখটা দেখে মনে হলো যে শাস্তি ওনারা ভোগ করছেন এটা ওনাদের প্রাপ্য।রহিমার মুখ ফুটে কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।
রিতা লেবু দিয়ে এক গ্লাস সরবত বানিয়ে এনে রহিমাকে বললো,
—-চাচী ভালো আছেন।সরবতটা খাইয়া নেন। শরীর ঠান্ডা হইয়া যাবে।ভাদ্র মাসের গরমে মাথার তালুও গরম হয়ে যায়।
রহিমা রিতাকে বলে,
—-রিতা কেমন আছিস?
রিতা বলে,
—-আমার আবার ভালো থাকা।চাচী তুমি কতটা নিঃস্ব হয়ে এ বাড়ি থেকে বের হয়েছো সেটা সময় আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে।আমি যেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরে এসেছি সেদিন বুঝেছি।
সবাই রহিমার আদর আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হলো।

জীবনের কি নিদারুন বাস্তবতা।এই ঘর এখন অন্ধকার। এখানে কোনো আলো নেই।ভবিষ্যতের স্বপ্ন নেই।ঘরের মানুষগুলো এখন নিদারুণ বেদনার অংশীদার।অথচ রহিমা যখন এই ঘরে আসে ঘরের পরিবেশ অন্যরকম ছিলো। সুন্দর ভবিষ্যতের অফুরন্ত আলোয় ঘরখানি ভরা ছিলো। কথায় আছে,”অন্যের জন্য কূপ খুড়লে সেই কূপে নিজেকে আগে পড়তে হয়।

স্বামীর ঘর ছেড়ে রহিমার যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো না।হেলালের একমাত্র স্মৃতি বুকে লালন করে এখান থেকে জীবনযুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলো।অথচ জীবনের কি দুঃখজনক বাস্তবতা।

রহিমা চোখ বন্ধ করে হেলালের হাসি মাখা মুখটার ছবি মনে করলো।চিন্তা করতেই বুকের গহীনে তীব্র দহন হলো।কি নির্মমভাবে সেই মানুষটার মৃত্যু হয়েছে।
শেষবার হেলাল দেশে এসে রহিমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
—-রহিমা আমার খুব বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছা করে।
সেদিন রহিমাও হেলালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলো।হেলাল ওকে আদর ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়ে অন্য জগতে নিয়ে গেলো।যেখানে কোন দুঃখ বেদনা বিরহ নেই। আছে শুধু ভালবাসা।সারা রাত ভালবাসা আর আদরে ওদের দুজনের সময় কেটে গেলো।

শাশুড়ীর ডাকে রহিমা সম্বিত ফিরে পেলো।বউ খাইতে আসো।রহিমাও হাত ধুয়ে শীতল পাটির উপর খেতে বসে শাশুড়ীকে বললো,
—-আলাল ভাই খাবে না।
শাশুড়ী বলে,
—-আলাল শক্ত ভাত খাইতে পারে না।জরিনা ভাত গুলো একদম নরম করে মাখিয়ে নেয়।তারপর চামচ দিয়ে খাইয়ে দেয়।
শাশুড়ী দেশী মুরগীর ডিম টমেটো দিয়ে ভূনা করেছে।ডাল শুটকি ভর্তা আর বেগুন ভাজি দিয়ে রহিমা ওর শাশুড়ী আর রিতা আর জরিনা রাতের ভাত খেয়ে নিলো।রহিমার কপালের লিখন একসময় ডিম চুরির অপবাদ আজ দুটো ডিম দিয়ে ভাত খেলো।
ভাত খাওয়া শেষ করে রহিমা শাশুড়িকে বললো,
—-মা আমি কাল ভোরে রওয়ানা হবো।বেলালের পরীক্ষা আছে।ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে।
শাশুড়ী বললো,
—-আর দুটো দিন থেকে গেলে পারতে।
রহিমা বলে,
—-বেলালের পড়ার সমস্যা হবে।ওকে তো আমি পড়াই।এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে।পড়াশোনার বেশ চাপ আছে।

পরদিন খুব ভোরে উঠে রহিমা ফজরের নামাজ পড়ে চা খেয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।বাসে উঠার পর রহিমার দুচোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।অথচ এমনতো হবার কথা নয়।কেন নারীরা স্বামীর বাড়িতে নির্যাতিত হয়।এখনও আনাচে কানাচে প্রতিনিয়ত নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে।দিন বদলেছে কিন্তু মানুষ বদলায়নি।প্রকৃতিগত ভাবে মানুষ তার অন্যায়ের শাস্তি পেয়ে যায়।রিতা যখন ওর স্বামীর বাড়ি থেকে নিঃস্ব তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসেছে সেদিন হয়তো ওদের কিছুটা উপলব্ধি হয়েছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here