প্রবাসীর বউ পর্ব-৬

0
2036

#ধারাবাহিকগল্প
#প্রবাসীর গল্প
পর্ব-ছয়
মাহাবুবা বিথী

রুবেলের কথাটা হয়তো সঠিক।সারাজীবন একা থাকা যায় না।মাঝে মাঝে নিজের একজন মানুষের প্রয়োজন হয়।কিন্তু রহিমা এই মূহুর্তে এসব নিয়ে ভাবতে চায় না।
বাবা না থাকলেও মাকে অবলম্বন করে সন্তান বেঁচে থাকতে পারে।তখন মাকে তারা সম্পূর্নটা চায়।মাকে কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না।মায়ের ব্যাপারে সন্তান খুব সেনসেটিভ হয়।
বাবার কষ্ট সন্তানকে যতনা পীড়া দেয় মায়ের কষ্ট তার দ্বিগুন পীড়া দিয়ে থাকে।তাই রহিমা এই মূহুর্তে ওর সন্তান বেলাল ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবতে চায় না।এমনিতেই বাবা না থাকাতে ওর মনে অনেক কষ্ট।রহিমা আর কষ্ট বাড়াতে চায় না।

রহিমা ভাবে মানুষের বিচিত্রময় জীবন সুখ দুঃখ আনন্দবেদনার নকশিকাঁথার ফোড়ে রচিত।যাকে ছাড়া মানুষ ভাবে একমূহুর্ত থাকতে পারবে না,ফোনে কথা না বললে রাতে ঘুম আসে না অথচ একটা সময় দিব্যি সেই মানুষটাকে ছাড়া ভালো থাকে আবার বেঁচেও থাকে।হেলালকে ছাড়া রহিমাতো দিব্যি বেঁচে আছে।

মানুষের জীবনের বড় দুঃখ মানবজীবনকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তোলে।জীবনকে আলোকিতো করে দেয়।তাই দুঃখের পরশ পাথরেই মানুষের জীবনের সফলতা অর্জিত হয়।

রহিমা মাগরিবের নামাজ পড়ে নিলো।ওর শাশুড়ী জা সবাই ফেনী থেকে চলে এসেছে।ওর শাশুড়ী রহিমাকে বলে,
—–বউ তোমার কিছু জিনিস আমার কাছে আছে।
রহিমা বলে
—-কি জিনিস আম্মা? আমারতো মনে নাই।
ওর শাশুড়ী একটা গয়নার বাক্স রহিমার হাতে তুলে দেয়।আর বলে,
—-তুমি বাক্সটা খুলে দেখো বউ
রহিমার হাতে বাক্সটা দিয়ে ওর শাশুড়ী রুম থেকে বের হয়ে যায়।
রহিমা বাক্সটা খুলে দেখে একটা সোনার আংটি একজোড়া সোনার বালা আর নাকফুল।
আংটিটা রহিমা ওর আঙ্গুলে পড়ে আর সাদা কালো বায়োস্কোপে স্মৃতির পাতা উল্টায়।

সেদিন ছিলো পূর্ণশশীর জোৎস্না।শরৎকালের রাতের মেঘমুক্ত আকাশের আঙ্গিনায় রুপালী থালা থেকে জোৎস্নার ফুল মাটির পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। এ যেন মায়াবিনী রাত। এতো সুন্দর এতো স্নিগ্ধ সুবাসিত রাত রহিমার জীবনে আর আসেনি। রহিমা আর হেলাল সেদিন জল জোৎস্নার বাসরে ভিজে একাকার।একমাসের ছুটিতে হেলাল দেশে এসেছিলো।তাই খুব তাড়াতাড়ি ওদের বিয়েটা হয়ে গেলো।বেলী আর রজনীগন্ধার সুবাসে বাসর ঘর সুবাসিত।হেলাল বিয়ের আগে দুদিন রহিমার সাথে দেখা করে।বাসর ঘরে হেলাল যখন প্রবেশ করে রহিমা শিহরিত হয়।হেলাল আর রহিমা ওজু করে নামাজ পড়ে
নেয়। রহিমা শাড়ি চেঞ্জ করে খাটের কোনায় বসে থাকে।হেলাল এসে রহিমার পাশে ঘনিষ্ট হয়ে বসে।রহিমার কপালে আলতো করে চুমু খায়।তারপর ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।দুটো আত্মা যেন জীবনের পূর্ণতা পেলো।তারপর হেলাল পাঞ্জাবীর পকেট থেকে এই আংটিটা বের করে রহিমার হাতে পরিয়ে দেয়।সারারাত রহিমাকে আদর সোহাগে ভরিয়ে রাখে।এখনও সবকিছু রহিমার মনে আছে।

নাকফুলটার কথাও ওর মনে আছে।বিয়ের দিন সাতপাথরের নাকফুলটা শাশুড়ী নাকে পড়িয়ে দিয়ে বলেছিলো
—-শোনো বউ, নাকফুল যেন হারায় না।নাকফুল হারিয়ে গেলে স্বামীর অমঙ্গল হয়।কিন্তু বিয়ের দুদিনপর সকালে গোসল করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করছিলো।হঠাৎ নাকের দিকে চোখ পড়লো।নাকটা কেমন ন্যাড়া হয়ে আছে।রহিমা চমকে উঠলো।সারাঘর বাথরুম তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও নাকফুল পেলো না।খাটের কোনায় বসে চোখ দিয়ে জল ঝরতে লাগলো।হেলালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে অবাক হয়ে ওর কান্নার কারণ জানতে চায়।
রহিমা বলে,
—আমার নাকফুলটা খুঁজে পাচ্ছি না।মা বলেছিলো নাকফুল হারালে স্বামীর অমঙ্গল হয়।আমার খুব ভয় লাগছে।সে সময় ঘরের কোনায় টিকটিকি টিক টিক করছিলো।আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম।

হেলাল বলে
—-এগুলো কুসংস্কার।বিশ্বাস করতে নেই।ইমান দুর্বল হয়।মা আগের কালের মানুষ।বললেও মানতে চায় না।আচ্ছা আমি ফ্রেস হয়ে মার্কেট থেকে তোমার জন্য নাকফুল কিনে আনবো।তুমি ততক্ষণ মার সামনে যেও না।
আসলে রহিমা সেদিন প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো।ও গরীব ঘরের মেয়ে।অনেক অভাব অনটন দুঃখ যন্ত্রণায় বড় হয়ে কেবলি জীবনে সুখের দেখা পেয়েছে।সেদিন হেলালকে পেয়ে মনে হয়েছিলো আকাশের চাঁদ যেন হাতে পেয়েছে।হেলালকে ছাড়া ও বেঁচে থাকতে পারবে না।কিন্তু দিব্যি হেলালকে ছাড়া ও ষোল বছর বেঁচে আছে।এটাই জীবনের চরম বাস্তবতা।
আর এই বালা জোড়া ও শেষবার এনেছিলো।এটা নিয়ে ঘরে অনেক কাহিনী হয়ে ছিলো।শাশুড়ী সাতদিন রহিমার সাথে কথা বলেনি।আর জা ভাসুর আলালের সাথে ঝগড়া করে বলেছিলো,
—-ভাইয়ের টাকা দিয়ে নিজের নামে জমি কিনো।অথচ আমাকে একজোড়া বালা গড়িয়ে দিলে না।
হেলাল এই বালাজোড়া এনে বলেছিলো,
—-বউ আমার বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছা করে।রাস্তায় ভিখেরীর কোলেও দুটো তিনটে বাচ্চা থাকে অথচ আমাদের বিয়ে হলো সাত বছর।এখন ও সন্তানের মুখ দেখলাম না।আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে এবার তিন মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছি।
আল্লাহর রহমতে রহিমা বাচ্চা কনসিভ করে।এই খবর পেয়ে হেলাল রহিমাকে বালা জোড়া পরিয়ে দেয়।
রিতার ডাকে রহিমা সম্বিত ফিরে পায়।
—-চাচী ভাত খাইতে আসেন।অনেক রাত হইছে।
রিতা চলে যাবার পর রহিমার মনে হয়, রিতাকে বিয়ে দেওয়া দরকার।এতো অল্প বয়স।পুরো জীবনটা পড়ে আছে।
রহিমা সবার সাথে রাতের খাবার খেয়ে নেয়।তারপর এশার নামাজ পড়ে ঘুমাতে চলে যায়।

রহিমা জানে,শুধুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা।চোখের পাতা ভারী হয় তাও ঘুম আসে না।চারিদিকে শুধু শুন্যতা।অথচ ওর জীবনটা এমন নাও হতে পারতো।রঙ্গে রসে ভরপুর থাকতে পারতো।হঠাৎ করে রাতের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়।প্রচন্ড বাতাসে জানালার কপাটগুলো বাড়ি খায়।বৃষ্টির ছাট চলে আসছে।রহিমা চট জলদি জানালাগুলো লাগিয়ে দেয়।এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত বারোটা বাজে।রুবেল ফোন দিয়েছে।অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা ধরে।ওপাশ থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
—এখনও ঘুমাননি।
রহিমা বলে,
—-ঘুমাতে দিলেন কই।ফোনটা দিয়ে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলেন।
রুবেল বলে
—-সরি,রহিমা।আমি ফোনটা রাখি।আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
রহিমা বলে,
—-ঘুমটা যখন ভেঙ্গেই দিলেন কি দরকার ফোন দিয়েছেন সেটা বলুন।
এরপর রুবেল বলে,
—-আসলে বিকেলে আপনাকে ঐ ভাবে কথাগুলো বলা ঠিক হয়নি।আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি।নদী যেমন কোনো কিছু না ভেবেই সাগরের পানে ছুটে চলে তেমনি আপনার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে আমি কথা গুলো বলে ফেলেছি।আপনি যদি আহত হন কিংবা কষ্ট পেয়ে থাকেন সে জন্য আমি দুঃখিত।মানুষ হিসাবে অন্যের সিদ্ধান্তকে সম্মান করা উচিত।আমি আপনার হ্যাঁ বা না যে কোনো সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here