#উপন্যাস
#প্রিয়তমা৷ (২৪ ২৫ তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
আনাস সামনে বসা লোকটার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কি শুনছে ও এসব নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা ও ঠিক শুনছেতো। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবারো সামনে বসা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো আপনি যা বলছেন ঠিক বলছেন তো???
-বাবা হয়ে নিজের একমাত্র ছেলের ব্যাপারে এতগুলো মিথ্যে আমি কেন বলবো বাবা?? আজ নিজেরই লজ্জা হচ্ছে ওই অমানুষটাকে সন্তান বলে পরিচয় দিতে।
-আপনি কি করে জানলেন ও এসব করেছে লামিয়ার সাথে??
-তাহলে তোমাকে খুলেই বলছি বাবা। ওর মা যাওয়ার পর থেকে এতো এতো স্বাধীনতা দিয়েছি যে ছেলেটা অতি আদরে বিগড়ে গিয়েছে। শুধু লামিয়া না অনেক অনেক মেয়ের সাথে এমন করেছে ও। কিন্তু যখন আটকানোর কথা ছিল তখন পারিনি আর বাঁধনছাড়া হয়ে যাওয়ার পরতো কিছুই করার ছিলনা। কাউকে মান্য করতোনা। খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে নেশাপানি করতো। কখনো এতো কড়াকড়ি দিতে পারিনি। কিন্তু লামিয়ার ব্যাপারে সরাসরি আমাকে বলেছে যে বাবা আমি ওকে বিয়ে করবো ব্যবস্থা করো।
কিন্তু সোহান সাজেব বলেছে উনার মেয়ে আরিফকে বিয়ে করবেনা। আর এতেই আরো ক্ষেপে যায়। লামিয়ার ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। অতিরিক্ত মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য বাহিরে পাঠিয়ে দিই তখনি তোমার সাথে লামিয়ার বিয়ে হয়ে যায়। ও দেশে ফিরেই অনেক পাগলামি শুরু করে দেই। অনেক বুঝানোর পরে চুপ হয়ে যায় ভেবেছি হয়তো সব ভুলে গেছে। কিন্তু এতোবড় একটা অন্যায় করবে জানলে ওই ছেলেকে আমি নিজের হাতে মারতাম।
-আপনাকে কি ওদের পরিবারের লোক এসব জানিয়েছে??
-না বাবা। ওদের পরিবার একটা ভালো পরিবার। ওদের মান সন্মানের ভয় বেশি ওদের পরিবার থেকে কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। আমার এক পরিচিত লোক বলেছে আমাকে। কথাটা শুনার পর একমুহূর্তে মনে হলো বাবা নামের কলঙ্ক আমি। আমার ছেলের জন্য ওইরকম পবিত্র একটা মেয়ের সংসার ভেঙে গিয়েছে। তুমি হয়তো জানোনা মেয়ের চিন্তায় সোহান সাহেব আবারো স্ট্রোক করেছে। আদরের মেয়েকে বিনা দোষে সংসার ভাঙার শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে বেচারা এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই যেদিন এসব কথা আমি শুনি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিই ওই অমানুষ কে নিজ হাতে খুন করবো। মানুষের মত মানুষ যখন করতে পারিনি তখন পকে মেরে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা হলেও করতে চেয়েছি।
কিন্তু কি দূর্ভাগ্য আমার!!!! সেই কাজটাও আমি করতে পারলাম না। আমি খুন করার আগেই কারা যেন ওকে মেরে লাশ ফেলে যায়। ভালোই হয়েছে আমার নিজের হাতটা নোংরা করতে হলোনা।
-কি বলছেন?? আরিফ মারা গেছে? কবে??
-আজ কয়মাস হলো। তবে মারা যায়নি অমানুষটাকে মারা হয়েছে।
-আপনি আমার খোঁজ পেলেন কি করে???
-বাবা এই কয়মাসে অনেক খুঁজেছি তোমাকে ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে কিন্তু খুঁজে পাইনি। একটা মেয়ের সংসার এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে এটা আমি কোনভাবে মানতে পারিনি।
আমি ইউএসে একটা কাজে এসেছি কয়দিন আগে। আর সেদিন তোমাকে দেখতে পাই এখানকার একটা কফিশপে। ওখান থেকেই তোমার পিছু নিই। আর আজ সরাসরি তোমার বাসায়। আমার মনে হয়েছে সত্যিটা তোমার জানা দরকার।
-আনাসের পুরো পৃথিবী যেনো ঘুরছে। পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে মনে হচ্ছে। মাথাটা কেমন ভনভন করে ঘুরছে। কি করেছি আমি?? ভালোভাবে না জেনে কি করে ওকে এতবড় ভুল বুঝলাম??? কেন সেদিন ওর কথা শুনিনি?? কেন… কেন.. কেন???
ওতো আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলো?? কি করেছি আমি?? রাগে নিজের মাথার চুল নিজেই টানতে লাগলো।
-আতিক সাহেব আনাসের দুহাত ধরে বললো,,,, বাবা আমার ছেলের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। সব দেষ আমার। লামিয়া মায়ের কোন দোষ নেই। ও খুব ভালো একটা মেয়ে। হাজারে একটা মেয়ে পাবেনা ওর মতো। ওর বদনাম কেউ করতে পারবেনা। মেয়েটাকে কষ্ট দিওনা বাবা। মিথ্যা অন্যায়ের শাস্তি ওকে দিওনা। আর পারলে এই বাবার মতো মানুষটাকে ক্ষমা করে দিও আসি বলে উনি বেরিয়ে গেলো।
আনাস পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে। কি করবে ও কি করার আছে?? নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,,, সত্য মিথ্যা না জেনে ওকে অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছি আমি এই হাত দিয়ে ওর গালে থাপ্পড় দিয়েছি। কতটা অমানুষ হয়ে গিয়েছি সেদিন আমি!!! ওরকম একজন স্ত্রীকে আমি কি করে ভুল বুঝলাম!!! আমি কখন এতোটা খারাপ হয়েছি??? কি করে হবো ওর সামনা সামনি???
লামিয়া কি কখনো আমাকে ক্ষমা করবে????
হে আল্লাহ তুমি আমাকে আমার পাপের শাস্তি দাও বলে কান্নায় ভেঙে পড়েছে আনাস। এতবড় অন্যায় আমার দ্বারা কি করে হলো???
আনাস তৎখনাৎ লামিয়ার নাম্বারে ডায়াল করলো এই মুহূর্তে ওর সাথে কথা বলাটা জরুরী। কিন্তু যতবার ডায়াল করছে ততবারই বন্ধ জানাচ্ছে। আনাসের একমুহুর্তে মনে হলো,, ও তো আমার দেয়া ফোনটা নিয়ে যায়নি তাহলে কি করে!!! ও আবার ওর শশুড়বাড়ির সবার নাম্বারে চেষ্টা করলো সবার নাম্বারই অফ জানালো। ব্যাপার কি!!! সবার নাম্বারই কেন বন্ধ হবে??
আনাস বললো,,,, আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাবো বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।তারপর নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে মায়ের ফোনে কল করলো,, সেদিনের পর লামিয়ার ব্যাপারে মায়ের সাথে আনাসের আর কোন কথা হয়নি আর রাশেদা চৌধুরী ও যেচে ছেলেকে কিছু বলেননি। আজ অনেকদিন পর মাকে এসব বলতে আনাসের সংকোচ বোধ হচ্ছে কিন্তু তারপরও আজ ওকে বলতেই হবে। রাশেদা চৌধুরী ফোন রিসিভ করতেই আনাস এপাশ থেকে সালাম দিয়ে বলে উঠলো ,,, মা আমি ভুল করেছি অনেক বড় ভুল। জানিনা এই ভুল কখনো শোধরাতে পারবো কিনা??
-কি হয়েছে বাবা তুই এমন করছিস কেন?? কি ভুল করেছিস তুই??
-মা আমি লামিয়ার প্রতি অন্যায় করেছি। একটা মিথ্যা কারণে ওকে ভুল বুঝে অনেক বড় অন্যায় করেছি আমি।।
-কি হয়েছে বলবিতো আমাকে??
-মা তুমি ওকে বাড়ীতে ফিরিয়ে আনো প্লিজ মা!!
-আমি কি করে আনবো??? আমি গেলেও ও আসবেনা জানি আমি।
-মা প্লিজ!!
-ওরা সবাই নোয়াখালী ছেড়ে চলে গেছে।
-কোথায় গেছে?
-জানিনা
-তাহলে ফারিহা আপু বা লাবিব ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করো ওদের কাছে থাকতে পারে হয়তো!!!
– ওরা সবাই ঠিকানা চেন্জ করে ফেলেছে??
-কি বলছো মা?? ওদের আত্মীয় স্বজন কারো সাথে যোগাযোগ করে দেখোনি বিশেষ করে পিয়াসের মায়ের সাথে??
-সবার সাথে যোগাযোগ করেছি কিন্তু লাবিব নাকি সবাইকে নিষেধ করে দিয়েছে ওদের ব্যাপারে কিছু জানাতে।
-মা এখন আমি কি করবো??? ওদের সবার নাম্বারে ট্রাই করেছি কিন্তু কোথাও কানেক্ট করতে পারছিনা।
-কি করবি তখন মনে ছিলনা?
-মা তুমি এসব বলছো?? তখন তো আমি ঘোরের মাঝে ছিলাম।
-আমও
-আমি রাখি পারলে নিজে খুঁজে নিস বলে রাশেদা চৌধুরী লাইন কেটে দিলো।
আনাস ফোন হাতে আবারো পরিচিত নাম্বার গুলোতে ডায়াল করলো কিন্তু না বারবার একটা নারী কন্ঠ একি কথা বলে যাচ্ছে। উফ!!!!! কি যন্ত্রনা!!!
নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে শাস্তি পাচ্ছে আজ। এমন অবস্থা এখন দেশেও ফিরতে পারছেনা। একেই বলে কপাল!! বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে।
আল্লাহ তুমি ছাড়া কেউ নেই এই মুহুর্তে আমার সাথে। একটা রাস্তা দেখাও!!!!
লামিয়ার অসুস্থতার জন্য লাবিব মা বাবা সহ লামিয়াকে ঢাকা নিয়ে এসেছে। লাবিবের জব এখন উত্তরাতে । আনাসদের বাসা ধানমন্ডিতে। লামিয়ার কথাতে ওর শশুড়বাড়ির লোকদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করতে হয়েছে। লামিয়া চায়না পুরোনো স্মৃতি গুলো বয়ে বেড়াতে। যতবার ওইসব মনে পড়ে কষ্টে বুকের ভিতরটা ফেটে যায় তাই নিজেকে একটু ভালো রাখতে যোগাযোগ বন্ধ করা।
লামিয়ার শরীরটা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সারাক্ষণ অজানা ভয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে থাকে। বাসার সবাই ওর মন ভালো রাখার জন্য সব সময় চেষ্টা করে। লামিয়া নিজে ও চায় ভালো থাকতে কিন্তু যার শরীরের ভিতর মিথ্যা অপবাদের তীব্র যন্ত্রনা সে কি করে ভালো থাকবে????
কিছুক্ষণ আগেই লামিয়াকে ওটিতে নেয়া হয়েছে। অবস্থা অনেক আশঙ্কাজনক। যেকোন সময় একটা অঘটন ঘটে যেতে পারতো ডাক্তার এসবই বলছে। লামিয়ার পরিবারের সবাই চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
ডাক্তার বললো,,,, আপনার কেমন মানুষ বলেন তো?? এরকম অবস্থায় রোগীকে সবসময় সুস্থ স্বাভাবিক থাকা দরকার আর আপনারা কি করেছেন কি। রোগীর উনার এখন হাই ব্লাড প্রেশার এ অবস্থায় তো উনার অপারেশন করাও সম্ভব না। মা আর বাচ্ছা দুজনের অবস্থা এখন আশঙ্কাজনক। দুজনের মৃত্যুর ঝুঁকি আছে।
আর উনার হাজবেন্ড কোথায়?? উনাকে ডাকুন এখানে একটা সই লাগবে উনার।
লাবিব বললো,,জী উনি তো দেশের বাহিরে।
-ডাক্তার হাতে থাকা না দাবি দেয়ার কাগজটা দেখিয়ে বললো,,,তাহলে এখানে সই কে করবে???
সোহান সাহেব এগিয়ে এসে বললো,,, আমি রোগীর বাব। সইটা আমি করবো বল উনি কাগজটা হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সই করে দিলেন।
জোবায়েদা নামাজের সেজদায় পড়ে আছে অনেকক্ষণ যাবত আজ তার মেয়ে জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে তারই হেফাজতের জন্য উনি আল্লাহর কাছে সেজদায় পড়ে অনবরত কেঁদে যাচ্ছেন।
অপারপশন রুমে লামিয়ার প্রেশার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে অপারেশনটা স্বাভাবিক ভাবে করা যায়। পরিবারের সবাই চিন্তিত মুখে হাসপাতালের করিডোরে কেউ বসে আছে কেউ পায়চারি করছে,,,যা কিছু হোক না কেন তাদের কাছে এখন লামিয়ার বেঁচে থাকাটা জরুরী
সোহান সাহেব রাহাতকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো,,,, বাবা আমার মেয়েটা বাঁচবেতো??
রাহাত শশুরকে সান্ত্বনার দিয়ে বললো বাবা আপনি চিন্তা করবেন না লামিয়ার কিচ্ছু হবেনা …..
#উপন্যাস
#প্রিয়তমা (২৫তম পর্ব)
লেখা – শারমিন মিশু
দুই বছর পরে
ভাবি আদিবাকে একটু নাওতো!! আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে লামিয়া একটু জোরেই ডাক দিলো।
কিচেন থেকে একটু তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো শায়লা। হাত বাড়িয়ে বললো,,,, দাও আমার মামনিকে আমার কাছে দাও!!! বলেই আদিবাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নিলো শায়লা। লামিয়া মেয়েকে শায়লার কাছে দিয়ে মাকে বলেই বেরিয়ে গেলো।
ভাবছেন শায়লা কে তাইনা??
বলছি- শায়লা হলো লাবিবের স্ত্রী আর লামিয়ার পরে আদিবার দ্বিতীয় মা ।
মেয়েটা যথেষ্ট সাংসারিক আর এডুকেটেড ও।শায়লার মত এ যুগে এরকম সাংসারিক আর আন্তরিক নম্র ভদ্র মেয়ে পাওয়া সত্যি কঠিন। মেয়েটা পুরো সংসারের দায়িত্ব একাই সামলাচ্ছে । শায়লা কখন কার কি লাগবে সব দিকে খেয়াল রাখে। বিশেষ করে আদিবার ব্যাপারে ও যথেষ্ট দায়িত্বশীল। ইংলিশে অনার্স করা সত্ত্বেও কোন চাকরি করেনা শায়লা। লাবিব অবশ্য বলেছিলো তোমার যদি ইচ্ছে থাকে চাকরি করার করতে পারো আমার দিক থেকে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
শায়লা বললো,,, আপনি যখন আমার সব প্রয়োজন পূরণ করতে পারছেন তখন আমি কেন বাহিরে যাবো। আপনি বাহিরের দায়িত্ব নিয়েছেন আর আমি সংসার সামলানোর দায়িত্ব নিলাম।
আদিবা হলো লামিয়ারই মেয়ে। হুম সেদিন লামিয়া মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছিলো পাঁচদিন আইসিউতে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করেছিলো । আর আল্লাহর রহমতে সন্তানটা ও বেঁচে গিয়েছে তবে দুজনের জীবনের উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে।
এ দুবছরে লামিয়ার জীবনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে আবার অনেক কিছু পেয়েছে।
লাবিবের বিয়ে হয়েছে পেয়েছে শায়লার মত একজন বোন।
পেয়েছে ছোট্ট একট এন্জেলকে যে সারাদিন গুটি গুটি পায়ে হেটে সারা বাড়ী মাতিয়ে রাখে। আধো আধো কথা বলতে শিখেছে মেয়েটা।বাড়ীতে সবার আদরের আরিবা। মামা মামি নানু সবার চোখের মনি মেয়েটা। আর লামিয়ার তো বেঁচে থাকার সম্বলই হলো মেয়েটা।
কিন্তু জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছে অনেক মূল্যবান একজন মানুষকে যিনি ছিল লামিয়ার পথ চলার অনুপ্রেরণা। হুম লামিয়ার বাবার কথাই বলছি। মানুষটা মেয়ের চিন্তুায় চিন্তায় তৃতীয় বার স্ট্রোক করে এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে আজ থেকে নয়মাস আগে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর মা ও অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। জোবায়েদার সারাদিন শুয়ে বসে কাটে। মন চাইলে উনি রান্না করবে নাহলে আদিবাকে নিয়ে পড়ে থাকে।
লামিয়া মাস্টার্স শেষ করে এখানেই একটা প্রাইভেট স্কুলে এখন জব করে। লামিয়া চেয়েছিলো আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে কিন্তু লাবিব তা মানতে নারাজ। ওর এক কথা আমি বেঁচে থাকতে তুই আলাদা বাসা নিয়ে কেন থাকবি??
লাবিব তো ওকে চাকরি করতে ও নিষেধ করেছে। কিন্তু লামিয়া নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে ও থাকবেনা। তাছাড়া আদিবার ও তো এটা সেটা দরকার হয়। সব সময় তো ভাইকে বলতে পারেনা ওর নিজের কাছেই খারাপ লাগে বলতে তাই এসব কিছু ভেবেই জবটা নেয়া। অবশ্য শায়লা আরিবার দায়িত্ব নিয়েছে বলেই সম্ভব হয় চাকরি করাটা। নাহলে মেয়েকে একা রেখে কখনোই সম্ভব ছিলনা।
তবে আজকাল লামিয়া অনেক কঠিন হয়ে গেছে৷ জীবনের কঠিন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে করতে আজ ও নিজেই পাথরে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বাবাকে হারানোর পর থেকে ও আরো বেশি কঠিন হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষকে হারানোর যন্ত্রণা যে অনেক বেশি । লামিয়া মাঝে মাঝে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে বলে,,, আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে আল্লাহ?? কেন আমার প্রিয় মানুষগুলোকে একে একে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছো?? জানিনা এ কোন কঠিন পরীক্ষা নিচ্ছো আমার??
মাঝে মাঝে লাবিব আর শায়লার সংসার দেখে ওর মনে আসে,,, আমার ও তো আজ এরকম একটা সুন্দর সংসার থাকতো। আমার সন্তান তার পরিবার পেতো বাবার ভালোবাসা পেতো। সব ঠিক থাকলেআমার মেয়েটাকে এভাবে বাবা বিহীন বড় হতে হতো কি??? একটা ভুলের জন্য আজ আমাকে আর আমার মেয়েকে পরিবার বিহীন একটা নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হচ্ছে।
প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে খুব একটা কথা বলেনা লামিয়া। স্কুলের পরের বাকি সময়টা মেয়েকে নিয়ে পার করে ভাবে এইতো আছি বেশ!!
লামিয়া স্কুল থেকে ফিরলো দুপুর দুইটায়। আদিবা ঘুমিয়ে আছে জোবায়দা নাতনীর পাশে শুয়ে আছে।লামিয়া বললো আম্মু তুমি এখানে,,ভাবি কোথায়??
-শায়লা বোধহয় নামাজ পড়তেছে ওকে ঘুম পাড়িয়ে। ঘুম থেকে হঠাৎ কান্না করে উঠলো দেখেই আমি আসলাম।
-লামিয়া বললো ও আচ্ছা বলেই বোরখাটা খুলে রেখে অযু করে আগে নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ শেষ করে বিছানায় মেয়ের পাশে বসতেই জোবায়েদা বললেন,,, আজ তোর খালামণি ফোন করেছে।
-ও কি বলেছে?
-আমাদের খোঁজখবর নিলো আর আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে।
-দাওয়াত!!! কিসের দাওয়াত??
-পিয়াসের বিয়ের। আমাদের সবাইকে বিয়ের এক সপ্তাহ আগে চলে যেতে বলেছে।
-ও দাওয়াত দিয়েছে যখন তখন যাও।
-যাও মানে কি তুই যাবিনা?
-আম্মু আমি কি করে যাবে আমার স্কুল আছেনা।
-স্কুল থেকে ছুটি নিবি!!
-আম্মু কি বলছো এখন আমি ছুটি টুটি মনিতে পারবোনা।
-সবসময় বেশি কথা না বললেই কি তোর হয়না। আমি এত কথা কথা শুনতে চাইনা আমরা শুক্রবারেই যাবো। এখন ছুটি কিভাবি নিবি তুই জানিস।
-আম্মু একটু বুঝতে চেষ্টা করো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
-কোন বুঝাবুঝি নেই আমার কথা মানে কথা বলে উনি চলে গেলেন।
জোবায়েদা চলে যেতেই শায়লা রুমে ডুকলো। লামিয়া জানো আমার না অনেক আনন্দ হচ্ছে।
-কেন এত আনন্দ কেন?
-পিয়াস ভাইয়ার বিয়েতে আমরা সবাই যাবো সেইজন্য। অনেকদিন পর দেশের বাড়ী তো
-সবাই যাবে তোমাকে কে বললো? আমি যাচ্ছিনা
তোমরা গেলে যাও।
-কেন যাবেনা??
-আমার ভালো লাগেনা তাই যাবোনা।
-ও। আচ্ছা আমার না কিছু কেনাকাটা করা লাগবে তুমি কি আমার সাথে আজ বিকালে একটু মার্কেটে যেতে পারবে??
– লামিয়া মনে মনে বলে এই মেয়েটার কোন জ্ঞান বুদ্ধি নাই পড়ালেখা করেছে ঠিকই কিন্তু কিসের মধ্যে কি বলে তার কোন ঠিক নাই যত্তসব!!
তারপর প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললো,,, আমি কেন ভাইয়াকে বলতে পারোনা তোমাকে নিয়ে যেতে।
-রাগ করছো কেন?? তোমার ভাইয়া তো বললো তোমাকে নিয়ে যেতে।
-আমি যেতে পারবোনা।
শায়লা মন খারাপ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। লামিয়ার মনে হলো একটু বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেলেছে। মায়ের উপরে আসা রাগটা এই নির্দোষ মেয়েটার উপর ফলিয়ে ফেলেছে। আমার কি হলো আজকাল আমি অযথা অকারণে সবার উপর রাগ দেখিয়ে ফেলি। দিন দিন কি আমি জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছি??? এটা মোটেও ঠিক হচ্ছে।
লামিয়া শায়লার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো,,, ভাবি বিকালে রেডি থেকো।
শায়লা এসে লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে লামিয়ার গালে একটা চুমু দিয়ে বললো,,, এইনা হলে আমার ননদীনি। আমি জানতাম তুমি যাবে। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু রাগারাগি করো এই আরকি!!
লামিয়া শায়লাকে সরিয়ে দিয়ে বললো,,, সর অসভ্য মেয়ে!!! একটু ভালো কথা বলেছি আর উনি অমনি নাচতে শুরু করেছে বলে নিজের রুমের দিকে গেলো। আদিবা উঠে পড়েছে লামিয়া ওকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আনাস দেশে এসেছে আজ ছয় মাসের মত হলো। এই ছয়মাসে লামিয়াকে পাগলের মত খু্ঁজেছে কিন্তু পাইনি। এতবড় ঢাকা শহর এতো মানুষের ভীড়ে কোথায় পাবে ওর প্রেয়সী কে। আধো কি ওরা ঢাকা আছে নাকি অন্য কোন জেলায় আছে তাওতো জানেনা। তারপরও নিজের সাধ্যমত খুঁজে চলেছে। রাশেদা ছেলের এরকম অবস্থা দেখে নিজেও অনেকভাবে খুঁজেছে বউমাকে। কিন্তু যে নিজেই ধরা দিতে চায়না তাকে হাজার খুঁজলেও পাওয়া যাবেনা।
আনাস অফিসে বসে কাজ করছিলো তখনি পিয়াসের ফোন।
আনাস ফোন ধরে সালাম দিয়ে বললো,,, কেমন আছিস??
-এইতো ভালো। তুই কেমন আছিস??
-আছি না থাকার মতই।
-মানে কি??
-কিছুনা। শুনলাম দেশে আসলি একবার দেখাও করলিনা আমার সাথে।
-নারে আসলে অনেক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি তো তাই আর সময় করতে পারিনি ঢাকায় আসার।
-পিয়াস বললেও আনাস জানে পিয়াস ইচ্ছে করে ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে। অবশ্য ও যা করেছে এড়িয়ে যাওয়ার ই তো কথা। পিয়াস অনেক বড় মুখ করেই তো লামিয়ার বিয়েটা আমার সাথে দিয়েছিলো। আর আজ আমার জন্যই ওর বড় মুখ ছোট হয়ে গেলো!!
তারপর ও বললো,,, ও তাই বল… তা কি মনে করে আজ ফোন করলি??
-আসলে আমার বিয়ে আগামী বুধবার ঠিক হয়েছে। তুই আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে চলে আসিস বিয়ের দুদিন আগে।
-তুই বিয়ে করছিস??? এতদিন তো বিয়ে করবিনা বলে বলে তো সবাইকে বলে বেড়িয়েছিস তা আজ আপনার সুবুদ্ধি হলো কেমনে???
-আর বলিসনা মায়ের জোরাজোরি তে আর পারলাম না বাধ্য হয়ে রাজি হতে হলো।
-হুম ভালো। তবে আমি বোধহয় আসতে পারবোনা।
-বাহানা দেখাবিনা একদম।
-নারে সত্যি
-আনাস বেশি কথা বলবিনা। তুই বিয়েতে আসছিস এটাই কথা আমি রাখছি।
আনাস কান থেকে ফোন নামিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো যাবে কি যাবেনা এই নিয়ে। কি করে ওদের সবার কাছে মুখ দেখাবে??
পরক্ষনেই মনে পড়লো আরে এখানে তো লামিয়া ও আসতে পারে আমি ভুলে গেলাম কি করে পিয়াস তো লামিয়ারও খালাতো ভাই । সিদ্ধান্ত পাল্টে নিলো আনাস। না আমি যাবো পিয়াসের বিয়েতে আসতে যা হয় হবে!! প্রয়োজনে ওদের সবার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবো। যা শাস্তি দিবে ওরা তাই মাথা পেতে নিবো। তারপর ও লামিয়াকে আমার জীবনে আবারো চাই।
আজ বিকালে আনাস উত্তরাতে গেলো অফিসের একটা কাজে। ওখান থেকে ফিরার পথে মার্কেটে ডুকলো কিছু কেনাকাটা করতে হবে তাই।
আনাস শার্ট দেখছিলো এমন সময় পিছন থেকে ওর প্যান্টে টান অনুভব করলো। আনাস পিছন ফিরতে দেখলো একটা পিচ্ছি মেয়ে ওর প্যান্ট টানছে। আনাস নিচু হয়ে বাচ্ছাটাকে হাত বাড়িয়ে নিলো। কি মিষ্টি একটা মেয়ে!!! কিন্তু কার বাচ্ছা,, কে এভাবে বাচ্ছাটাকে ছেড়ে দিলো?? আনাস চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো কাউকে দেখতে পেলোনা। মেয়েটা আনাসের কোলে উঠে ওর দাঁড়ি ধরে আপন মনে টানতেছে।
লামিয়া আর শায়লা কেনাকাটায় ব্যস্ত এদিকে আদিবা কখন পাশ থেকে সরে গেলো ওরা খেয়াল করেনি। লামিয়া পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো মেয়েটা কোথায় গেলো???
শায়লার দিকে তাকিয়ে বললো,,, ভাবি আদিবা কই???
শায়লা ও লামিয়ার কথায় তাকয়ে দেখলো সত্যিই তো মেয়েটা কোথায় গেলো?? ওরা দুজনে পুরো দোকানটা খুঁজে দেখলো কোথাও নেই আদিবা।
লামিয়া এবার কাঁদতে শুরু করলো। শায়লা ওকে থামিয়ে বললো কেঁদোনা তো আগে আমরা ওকে ভালো করে খুঁজে দেখি চলো তুমি ওদিকটা দেখো আমি এদিকটা দেখি বলে দুজন দুদিকে খু্জতে লাগলো। শায়লা আদিবাকে খুঁজতে খুঁজতে দেখলো একটা লোক আদিবাকে কোলে নিয়ে এদিকেই আসছে। শায়লা দৌঁড়ে গিয়ে আনাসের কোল থেকে আদিবাকে টেনে নিলো। আদিবাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে সামনের লোকটির উদ্দেশ্য বললো আপনি ওকে কোথায় পেলেন??
– আমি পাশের ওই দোকানটাতে কেনাকাটা করছিলাম তখনি ওকে দেখতে পাই। কাউকে ওর সাথে না দেখেই আমি এদিকে নিয়ে আসছিলাম।
-শায়লা বললো আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
-আনাস বললো না ঠিক আছে একটু খেয়াল রাখবেন ছোট বাচ্ছাতো….
লামিয়া পিছন থেকে বললো ভাবি আদিবাকে পেয়েছো??
হুম পেয়েছি বলে শায়লা চলে গেলো।
আনাস মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসলো। কিছুদূর যাওয়ার পর কেন জানি ওর মনে হলো ও লামিয়ার গলার স্বর শুনেছে।
আনাস তাড়াহুড়ো করে পিছন ফিরে আসলো। কিন্তু পুরো মার্কেট খুঁজেও ওই বাচ্ছাকে বা ওর সাথের সেই মহিলাটিকে ও পেলোনা।
তবে কি আনাস ভুল শুনলো???
কোনভাবেই না লামিয়ার কন্ঠস্বর ওর খুব ভালো মনে আছে। ও ঠিকই শুনেছে। এটা ভুল হতে পারেনা।
এটা লামিয়ার স্বর ছিলো আনাস বললো আমার কান ভুল শোনেনি।
কিন্তু এই একটু সময়ের মাঝে ওরা কোথায় হারিয়ে গেলো???
নাহ হয়তো আমার শুনার ভুল ভেবে আনাস বেরিয়ে গেলো……..
চলবে……..