১.
বিয়ের আসরে নিজের হবু বরের গালে থা’প্পর বসিয়ে দিলো সুহানি! যা দেখে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেল। কবুল বলার পরিবর্তে যে হবু কনে এভাবে থা’প্পর মারবে সেটা কেউ ধারণাও করতে পারেনি।
সুহানি শুধু থা’প্পর মে’রেই ক্ষান্ত হলো না, কয়েকটা কি’ল ঘু’ষিও বসিয়ে দিলো নিজের হবু বর কাশেমের পিঠে। কাশেম ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সুহানির দেখে। বিয়ে করতে এসে যে এভাবে অসম্মানিত হতে হবে সেটা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি সে। সুহানি পুনরায় থা’প্পর দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই তার হাত ধরে ফেলল কাশেম। রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে সুহানিকে ধমক দিয়ে বলে,
‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে এভাবে থা’প্পর দেওয়ার সাহস কোথায় পেলে তুমি?’
সুহানি ক্ষোভে ফুসছিল। কাশেমের মুখে এহেন কথা শুনে তার রাগ সপ্ত আসমানে উঠে গেল। সুহানি নিজের ফোন বের করে একটি ছবি বের করে কাশেমকে দেখিয়ে বলল,
‘আমাকে কিছু বলার আগে এটা দেখুন। দু’শ্চ’রিত্র লোক একটা।’
কাশেম সুহানির ফোনের দিকে তাকালো। তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কাশেমের সাথে তার গার্লফ্রেন্ডের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি কেউ সুহানিকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কাশেমের মনে পড়ল গত রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সে। তখনই হয়তো কেউ ছবিটা তুলেছে। কাশেম বিরক্তিতে ‘চ’ জাতীয় শব্দ করে বলল,
‘এই সামান্য কারণে তুমি আমায় মা’রলে?’
‘এটা আপনার কাছে সামান্য ব্যাপার মনে হচ্ছে? আপনার লজ্জা বলতে কিছু নেই? নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে রাত কা’টিয়ে আবার এসেছেন আমায় বিয়ে করতে।’
কাশেম খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
‘আমি শুধুমাত্র আমার মা-বাবার কথায় তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমি সোনালীকেই ভালোবাসি। খুব ভালো হয়েছে আজ সবকিছু সামনে এসে গেল। এমনিতেও বিয়ের পর আমি তোমার হাতে ডিভোর্স পেপারস ধরিয়ে দিতাম।’
কাশেম কথাটা বলা মাত্রই সুহানির বড় ভাই সীমান্ত এসে কাশেমকে এলোপাথাড়ি মা’রতে লাগল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কাশেমের বন্ধু-বান্ধব ও কাজিনরা এসে তাকে রক্ষা করল। সীমান্ত চেঁচিয়ে উঠে বলতে লাগল,
‘শ’য়তান ছেলে তোকে ছাড়ব না আমি। আমার বোনের জীবন নিয়ে তুই ছিনিমিনি খেলতে চাইছিলি।’
পুরো ঘটনায় কাশেমের মা-বাবাও পুরো স্তব্ধ। কাশেমের বাবা মনে করলেন সেদিনের কথা যেদিন তিনি কাশেমকে বিয়ের ব্যাপারে বলেছিলেন। সেদিনই কাশেম স্পষ্ট করে বলেছিল সে অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে তাই এই বিয়ে করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই দিন কাশেমের বাবা অনেক চিৎকার চেচামেচি করেন। কাশেম যখন কিছুতেই বিয়েতে রাজি হয়না তখন তিনি তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, বিয়ে না করলে তিনি কাশেমকে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তখন কাশেম জেদের বসে বলেছিল সে বিয়েটা করবে৷ কিন্তু বিয়ের পর কি হবে তার জন্য সব দায় থাকবে কাশেমের বাবার।
সেই মুহুর্তে কাশেমের বাবা বুঝতে পারেন নি পরিস্থিতি এমন হতে পারে। তিনি তো শুধু নিজের কথা রাখার জন্য সুহানির সাথে কাশেমের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। সুহানি বাবার সাথে কাশেমের বাবার অনেক দিনের বন্ধুত্ব। সুহানির বাবা মৃত্যুর আগে কাশেমের বাবার থেকে কথা দিয়ে নিয়েছিলেন যেন তিনি সুহানির সাথে কাশেমের বিয়ে দেন। নিজের বন্ধুর শে’ষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে গিয়ে যে তিনি নিজ হাতে তিন তিনটে জীবন ন’ষ্ট করে দিচ্ছিলেন সেটা বুঝতে পারেন নি।
অবশেষে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে সীমান্তের কাছে এসে তিনি বললেন,
‘আমার ছেলের হয়ে আমি সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে এখানে সব দো’ষ আমার। আমি ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বাধ্য করেছিলাম এই বিয়েটা করতে। তুমি প্লিজ ওকে আর মে’রোনা। আর এখন আমি এই বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইছি। কারণ এই বিয়েটা হলে ওরা কেউ সুখী হবে না।’
সীমান্ত রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
‘এত ঘটনার পর আপনার ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে আমি এমনিও দিতে চাইনা আঙ্কেল। কিন্তু আপনাদের থেকে এটা আশা করিনি। বাবার কত কাছের বন্ধু ছিলেন আপনি।’
কাশেমের বাবা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলেন। অতঃপর বললেন,
‘আসলে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সব আল্লাহর হাতে। আমরা চাইলেও কিছু বদলাতে পারব না। আজ যা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ যেভাবে করা সম্ভব আমি করার চেষ্টা করব। তোমরা চাইলে আজই যোগ্য পাত্রর সাথে সুহানির বিয়ের ব্যবস্থা করব আমি।’
‘আপনি আমাদের যথেষ্ট উপকার করেছেন আঙ্কেল। আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আমার বোনের জন্য যোগ্য পাত্র আমিই জোগাড় করতে পারব। আপনারা এখন প্লিজ চলে যান এখান থেকে। নাহলে আমি খুব খারাপ কিছু করে ফেলবো।’
কাশেমের বাবা আর দাঁড়ালেন না। সকল বরযাত্রী নিয়ে বিদায় নিলেন। কনেপক্ষের যারা আত্মীয় তাদের অনেকেও বিদায় নিলো। আবার অনেক নিকটাত্মীয় এই পরিস্থিতিতে থেকে গেল।
সীমান্তর স্ত্রী মিরা সুহানির পাশে এসে দাঁড়ালো। সুহানি মিরার দিকে তাকাতেই মিরা বলে উঠল,
‘সাবাশ সুহানি, আজ তোমাকে এভাবে প্রতিবাদ করতে দেখে খুব ভালো লাগল। তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ ঐ ছেলেটাকে থা’প্পর মে’রে। কি সাহস, গার্লফ্রেন্ড রেখে তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আবার বলে বিয়ের পর তোমায় ডিভোর্স দেবে। কিন্তু আমি বুঝলাম না, এই ছবি তুমি কোথা থেকে পেলে?’
সুহানি বলল,
‘ভাইয়া তো বাবার কথা রাখার জন্য উঠে পড়ে লাগল আমার বিয়ে দিতে। কিন্তু আমি তো নিজের ভবিষ্যত নিয়ে উদাসীনতা দেখাতে পারি না। তাই আমার দুজন বন্ধুকে ঐ কাশেমের পেছনে স্পাইগিরি করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওরাই কাল এসব ছবি তুলে আমায় পাঠিয়েছে।’
‘তাহলে তুমি আগে আমাদের কিছু বলো নি কেন? এভাবে বিয়ের আসরে এসে..’
‘আগে বলিনি কারণ আমি ঐ কাশেমকে নিজের হাতে শা’স্তি দিতে চেয়েছিলাম। কত সাহস আমার সাথে প্রতারণা করার পরিকল্পনা করে। তাই আমিও সবার সামনে ওর মুখোশ উন্মোচন করে ওকে শায়েস্তা করলাম।’
‘এই না হলে আমার ননদ।’
‘পুলিশ ইন্সপেক্টর নুসরাত জাহান মিরার ননদ মুনতাহা ইসলাম সুহানি আমি। আমাকে এত সহজে কেউ পোল্ট্রি খাওয়াতে পারবে না।’
ননদ ভাবির কথার মাঝেই সীমান্ত তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। সুহানির সামনে দাঁড়াতেও সীমান্তর এখন বেশ লজ্জা লাগছে। বয়সে সুহানির থেকে পাঁচ বছরের বড় সে। সুহানির যখন দুই বছর বয়স তখনই তাদের মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর বাবাই একা হাতে দুই ভাইবোনকে মানুষ করেন। কিন্তু বছর তিনেক আগে তাদের বাবাও ইন্তেকাল করে। তখন থেকে দুই ভাইবোন একে অপরের সাথে আছে। আড়াই বছর আগে মিরার সাথে সীমান্তর বিয়ে হলো। তখন সেও এসে যোগ দিলো পরিবারে। কিন্তু সুহানি মিরার সাথে যতটা মেশে সীমান্তর সাথে ততোটা না। এরজন্য সীমান্তের এখন নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে।
মিরা সুহানিকে যতটা বোঝে সীমান্ত ততোটা বুঝে উঠতে পারে নি। ছোটবেলা থেকে কেবল শাসনই করে গেছে এমনকি এখনো কড়া শাসনে রেখে যাচ্ছে। তাই তো সুহানির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ওর বিয়ে দিতে চাইছিল৷ সেই সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল সেটা এখন স্পষ্ট। সীমান্ত জড়তার কারণে কিছু বলতেও পারছিল না। সীমান্তকে চুপ দেখে মিরা বলে,
‘কি হলো ডাক্তার সাহেব? আপনি কি কিছু বলবেন?’
সীমান্ত আড়ষ্টতা কা’টিয়ে সুহানিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আজ যা কিছু হলো সবকিছুর জন্য আমি দুঃখিত সুহানি। আসলে দো’ষটা আমারই। আমার ছেলেটার ব্যাপারে ভালো করে খোঁজ খবর নেওয়া লাগত।’
সুহানি অভিমানী সুরে বলে,
‘ক্ষমা চেয়ে এখন আর কি হবে? যদি বিয়েটা হয়ে যেত তখন তো কোন লাভ হতো না। ভাগ্য ভালো, আমার বন্ধুদের মাধ্যমে ঐ ছেলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিলাম। আচ্ছা বাদ দাও, বিয়েটা তো হলো না এবার আমার স্বপ্নের ব্যাপারে কথা বলা যাক।’
‘মানে?’
‘আমি ভাবছি এবার একজন এয়ার হোস্টেজ হিসেবে যোগদান করব।’
সীমান্তের চেহারায় রাগ ফুঁটে উঠল। সে বলে উঠল,
‘না। এই ব্যাপারে কোন কথা শুনব না।’
বলেই সীমান্ত সেই স্থান থেকে প্রস্থান করল। সুহানি মিরার কাছে বায়না করে বলল,
‘ভাবি, তুমি ভাইয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করো প্লিজ। এটা আমার ড্রিম।’
‘তুমি তো চেনোই নিজের ভাইকে কতটা একগুঁয়ে সে। তবুও আমি চেষ্টা করব ওকে বোঝানোর।’
সুহানি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমার ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ঐ আকাশে উড়ান দেওয়ার। তাই তো পাইলট হতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু আমার ব্যাড লাক পাইলট হতে পারিনি। পড়াশোনায় যে বেশি ভালো ছিলাম না। তবে আমি আকাশে উড়ান দেবোই। পাইলট হতে না পারি এয়ার হোস্টেজ হয়েই দেবো। এখন এটাই আমার স্বপ্ন যা আমি যেকোনো মূল্যে বাস্তবায়িত করব।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
#প্রেমের_উড়ান
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
[ফিরে এলাম নতুন গল্প নিয়ে। আশা করি এই গল্পটাতেও অনেক ভালোবাসা পাবো।]