#ফাগুন_প্রেম_
লেখনীতে : Bornali Suhana
পর্ব: ৩৯
💛
সবাই যার যার জায়গায় বসে পরে। মালিহা ভিডিও প্লে করে। পিকনিক, কলেজের সব অনুষ্ঠানের ছবি একসাথে করে ভিডিও বানানো হয়েছে। হুট করেই এমন একটা ছবি আসে যা দেখে সবাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। বর্ণালী রুমুর হাতটা শক্ত করে ধরে দাঁড়ায়। ওর হাত-পা থরথর কাঁপছে। হৃদস্পন্দনগুলো দ্রুত চলছে। এসব কি দেখছে ওর চোখ। চোখের কোণে জল জমে গেছে। ইচ্ছে করছে মাটি ফেটে যাক আর ও মাটির নীচে ঢুকে যাক। ইভান একবার বর্ণালীর দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার ছবির দিকে তাকাচ্ছে। রাগে ওর কপালের দু’পাশের নীল রঙের শিরাগুলো দ্রুত উঠানামা করছে। সম্পূর্ণ ঘেমে গেছে মাথার পাশ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। চোখজোরা লাল হয়ে গেছে। হাত মুঠিবদ্ধ করে দ্রুত স্টেজে উঠে ভিডিও অফ করতে চলে যায়। কিন্তু অফ করার কোন অপশন খুঁজে পাচ্ছেনা। রাগে সব তার টেনে ছিড়ে ফেলে দেয়। মালিহা ওখানেই দাঁড়িয়ে হেসে যাচ্ছে। এমনভাবে ছবিগুলো তুলেছে যে শুধু বর্ণালীর মুখ দেখা যাচ্ছে আর পাশে থাকা ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু ছেলেটার ড্রেস দেখে বুঝা যাচ্ছে এই কলেজেরই স্টুডেন্ট। এটাই তো চেয়েছিলো মালিহা। বর্ণালী কাউকে মুখ দেখাতে পারবেনা। নিজের থেকে বয়সে ছোট একজন ছেলের সাথে তাও কলেজের স্টুডেন্টের সাথে এভাবে আপত্তিকর অবস্থায় দেখলে কেউই তাকে আর ভালো চোখে দেখবে না। আর ছেলেটা যে ইভান তা কেউ বুঝবেও না। তৃপ্তিভরে বিশ্বজয়ের একটা হাসি দিয়ে দু’হাত বটে আরাম করে দাঁড়ায় মালিহা। মিথিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“এখন মালিহা জমিয়ে নাটক দেখবে। না না নাটক না সি….সিনেমা। হাহাহাহা।”
মিথি কোন কিছু না বলে নিজের মুখটা ছোট করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আশেপাশের সব লোক কানাঘুষো করছে। স্টুডেন্ট গার্ডিয়ান সবাই বর্ণালীর দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে আর নানারকম কথাবার্তা বলছে।
-“ছিঃ ছিঃ এমন ম্যাডাম হলে ছাত্রছাত্রীদের কি শিক্ষা দিবেন?”
-“আমাদের সন্তানদের নষ্ট করার জন্যই বুঝি আমরা এখানে পাঠাই?”
-“এটা তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রইলো না এটা যেনো একটা প্রেমখানা হয়ে গেলো।”
-“কি মেয়ে একটুও লজ্জা করলো না এভাবে নিজের ছাত্রের সাথে!! ছিঃ ছিঃ আমার তো বলতেও লজ্জা লাগছে এর করতে লজ্জা লাগলো না?”
-“আরে আপা এসব মেয়েদের কাজই এমন বড়লোকের ছেলে দেখলেই নিজেকে লুটিয়ে দেয়।”
-“হ্যাঁ সবই টাকা খাওয়ার ধান্দা এদের। এসব নিম্নবিত্তরা হুটহাট টাকার মুখ দেখলে লুটেপুটে নিতে চায়।”
এসব কথা শুনে বর্ণালী আর নিজের অবস্থানে দাঁড়াতে পারলো না। ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে। গাল পাড় করে গলা বেয়ে টপটপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। রুমু আর সহ্য করতে না পেরে রেগে চিৎকার করে বসে।
-“চুপ করেন আপনারা। একদম চুপ। যা জানেন না তা নিয়ে কথা বাড়াবেন না। আর এই ছবিগুলো কোত্থেকে এলো তা জানার চেষ্টা করেন আগে। এখানে একা কেন বর্ণালীকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন? কেমন মানুষ আপনারা? আজ নিজের মেয়ে হলে কি এমন কথাই বলতেন?”
-“আর একটা কথাও না। একটা কথা না মানে একটাও না। কেমন মানুষ আপনারা? এতটুকু বিবেকবোধ নেই আপনাদের? এখানে ওর একা দোষ নাকি যে ওকেই দোষ দিয়ে যাচ্ছেন? এখানে তো একটা ছেলেও আছে সেই ছেলেটাকে কেন আপনারা কিছু বলছেন না?”
এতো মানুষের ভির থেকে কেউ একজন কথাটা বলে। সবার চোখ তার দিকে যেতেই দেখে ইভান অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,
-“আপনারা কোন সমাজের মানুষ? আসলে আমার না সন্দেহ হচ্ছে আদৌ কি আপনারা মানুষ? এখানে কি দেখলেন আপনারা? একা একটা মেয়ের দোষটাই? দোষ করলে সমান দোষ আমিও করেছি হ্যাঁ যে ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না সেই ছেলেটা আমি ইভান আহমেদ। আর দোষ কেন বলছি আমি! এখানে তো আমাদের কারো দোষ নয়। প্রেম, ভালোবাসা কখনোই দোষ হতে পারেনা। এটা আজকালের যুগে স্বাভাবিক জিনিস। কিন্তু দোষ হলো এখানে এই ছবিগুলো যে দেখিয়েছে তার। সে আমাদের ব্যাক্তিগত ছবি পাবলিক করেছে এটা তার অপরাধ। এটার বিচার পরে হবে। আচ্ছা আপনারা বলুন তো কখনো আপনারা আপনাদের ছেলে-মেয়ের জীবন সম্পর্কে খবর নিয়েছেন? সে প্রতিদিন কি করছে? কোথায় যাচ্ছে কখনো খবর নিয়েছেন? আরে যাওয়া আসা বাদ দিলাম। কখনো তার মোবাইল বা কম্পিউটার ঘেটে দেখেছেন? রাত জেগে ১৮+ ভিডিও দেখে উত্তেজিত হয়ে প্রেমিকার সাথে ফোন কলে, চ্যাটে সেক্স করছে তা কখনো দেখেছেন?
দিনে ঝোপেঝাড়ে তাদেরও আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি রুম ডেট পর্যন্ত করছে। তার খবর আছে?
কি আন্টি রাখেন খবর?
নো নো নো আপনারা কেন তার খবর রাখবেন।
আপনাদেরই ছেলের কারণে কত মেয়ে প্রেগন্যান্ট হচ্ছে তখন আপনার ছেলে নিজের গা ঝেড়ে দিচ্ছে। আপনারা নিজে এসব জেনেও ছেলের এসব কান্ডে বাঁধা দিচ্ছেন না। বরং ছেলেকে কিভাবে বাঁচানো যায় তার ভাবনা করছেন। প্রয়োজনে মেয়ের মুখে টাকা দিয়ে একটা নিষ্পাপ প্রাণ পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই কেড়ে নিচ্ছেন। আবার এই সমাজেই মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে হাঁটছেন। বাহ! অবশ্য এতে আপনাদের তো কিছুই আসে যায় না। উচ্চবিত্তরা এভাবেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছে।
আরে আপনাদের মুখে এসব মানায় না। আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখেন। তারপর পরের মুখ দেখতে আসবেন। আজ যদি বর্ণালীর জায়গায় আপনার মেয়ে হতো তখন কেমন লাগতো? তখনো কি এমন কথাই বলতেন? আজ যদি আমার জায়গায় আপনার ছেলে থাকতো তখনো কি এই একই কথা বলতেন? ওহ ওয়েট ওয়েট আমি তো ভুলেই গেছি আমার তো কোন দোষ নেই দোষ তো ওই যে ফ্লোরে বসে কাঁদছে ওই মেয়েটার। ওই মেয়েই তো বড়লোকের ছেলের উপর নিজেকে লুটিয়ে দিচ্ছে। বাহ! বাহ! কি সমাজে আছি আমরা। ধন্য আপনারা! আপনাদের থেকেই তো আমরা শিক্ষা নিচ্ছি। মনে রাখার মতো শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।”
ইভান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আবারো বলে,
-“জানেন, আপনাদের এসব বলে কোন লাভ হবে না। এসব কখনো পরিবর্তন হবে না। সবসময় একটা মেয়েকেই দোষীর কাতারে রাখা হবে। আর ছেলে? ছেলেদের বেলায় ওই যে চিরচেনা একটা কথাই আসবে, ছেলেরা তো এমন একটু আধটু করবেই। আর একটা কথাও না। আর একটা কথাও যদি আমি কারো মুখে শুনি তাহলে বলে দিচ্ছি তার চেহারার নকশা বদলে দিবো।”
প্রিন্সিপাল বর্ণালীর দিকে এগিয়ে যান।
-“মিস বর্ণালী, আপনি কাল সকাল ১০টায় আমার সাথে দেখা করবেন।”
কথাটা বলেই প্রিন্সিপাল কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে গাড়িতে উঠে চলে যান। বর্ণালী হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখ মুছে দৌড়ে কলেজ গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। রুমু, ইভান, রাহাত, শিমুল, আসাদ সবাই ওর পিছনে দৌড় দেয়। ফাহিমা ম্যাডাম এগুতে যেয়েও আগান না। কিন্তু ওর পিছনে গিয়ে কোন লাভ হয় না। কেউ ওর নাগাল পায় না। সিএনজি করেই বাসার দিকে এগিয়ে যায়। ইভান রুমুর দু’হাত ধরে বলে,
-“রুমু প্লিজ তুমি এখনই বর্ণালীর বাসায় যাও। ও সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। ওকে এই মুহুর্তে একা ছাড়া ঠিক হবে না। প্লিজ রুমু।”
-“হ্যাঁ আমি যাচ্ছি। তুমি টেনশন নিও না।”
রুমু আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে সিএনজি করেই ওর পিছু পিছু যায়। বর্ণালীর সিএনজি থেকে নেমে দেখে ওর ব্যাগ সাথে নেই। ব্যাগটা রুমুর কাছেই রয়ে গেছে। তখনই রুমুর সিএনজি এসে থামে। রুমুকে দেখেই বর্ণালী গেটের ভেতর চলে যায়। রুমু পেছনে বারবার ডাকে,
-“বর্ণালী দাঁড়া বলছি। আমার কথা শুন বর্ণ।”
কিন্তু না সে দাঁড়ায় না। একনাগাড়ে কলিংবেল বাজিয়েই যাচ্ছে। রুমু গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে ভেতরে আসে।
শারমিন বেগম হাতের কাজ রেখেই একরকম দৌড়ে আসেন।
-“কে এভাবে মরার বেল বাজাচ্ছে! একটু ধৈর্য্য কি রাখা যায় না! আসছি রে বাবা।”
দরজা খুলে নিজের মেয়েকে দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকান শারমিন বেগম।
-“এভাবে কেউ বেল বাজায়? বিরক্ত করে দিলি বর্ণ। আর তোর চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?”
রুমু পেছন থেকে ব্যাপারটা সামলানোর জন্য বলে,
-“আরে বড় আম্মু ওর প্রকৃতির ডাক পড়েছে। তাড়াতাড়ি সরেন। ওয়াশরুমে যাবে বেচারি।”
-“আরে রুমু তুই এসেছিস?”
-“না আমার আত্মা এসেছে।”
-“পাজি মেয়ে। আচ্ছা আয় ভেতরে আয়।”
শারমিন বেগম দরজা ছাড়তেই বর্ণ ধীর পায় রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে যেনো মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারছিলো না। পা চলছে না। ইচ্ছে করছে এখানেই বসে যাক। অনেক কষ্ট করে নিজের রুমে আসে। রুমুও পিছু পিছু এসে রুমের দরজা লক করে দেয়। দরজা লক করে পিছনে ফিরতেই দেখে বর্ণালী ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
-“বর্ণ দরজা খোল। বর্ণ তাড়াতাড়ি দরজা খোল বলছি। দেখ উলটা পালটা কিছু করবি না। বাইরে আয় নাহলে ভালো হবে না। বড় আম্মু বুঝতে পারলে সমস্যা হয়ে যাবে।”
এসব কোন কথাই যেনো ওর কান দিয়ে যাচ্ছে না। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। হাত-পা যেনো শরীর ছাড়া হয়ে গেছে। আলতো করে শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। বেখায়ালিভাবে বসাতে মাথা গিয়ে দেয়ালের সাথে লেগে খানিকটা জায়গা ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। ওর শরীরটা যে আর চলছিলো না। মাথা ফেটে রক্ত গাল বেয়ে পানির সাথে মিশে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু ওর একটুও ব্যাথা অনুভব হচ্ছেনা। বুকের ব্যাথার কাছে মাথা ফেটে কেন পুরো শরীর কেটেও যদি কেউ লবণ ছিটিয়ে দেয় তাও সেই ব্যাথাটা কষ্ট দেয় না। যতটা না এই বুকের ব্যাথাটা কষ্ট দিচ্ছে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কান্না যেনো গলা দিয়ে আসছেনা। গলায় কিছু একটা আটকে গেছে মনে হচ্ছে। কোন একটা ঘোরের মাঝে চলে গেছে। বারবার তাকে বলা কথাগুলো কানের মাঝে বাজছে। ধীরে ধীরে দেয়ালে মাথা ঠেকায়। বারবার দেয়ালের সেই একই জায়গায় মাথা মারছে। আর বিরবির করে বলছে,
-“সব দোষ আমার, সব দোষ আমার, আমি পাপ করেছি সব দোষ আমার।”
মাথার ফেটে যাওয়া অংশ দিয়ে পানির মত গলগল রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত পরে লাল হয়ে গেছে পুরো ওয়াশরুমের ফ্লোর। এদিকে রুমু বার বার ওর নাম ধরে ডাকছে আর দরজায় কড়া নাড়ছে। তবুও বর্ণালীর কোন সাড়াশব্দ পায় না। এক পর্যায়ে খুব জোরে জোরেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দেয়।
💛
#_____চলবে……….
Previous
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=129012092102483&id=103632171307142