ফাগুন প্রেম পর্বঃ ৪০

0
452

#_ফাগুন_প্রেম_
লেখনীতে : Bornali Suhana
পর্ব: ৪০
💛
মাথার ফেটে যাওয়া অংশ দিয়ে পানির মত গলগল রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত পরে লাল হয়ে গেছে পুরো ওয়াশরুমের ফ্লোর। এদিকে রুমু বার বার ওর নাম ধরে ডাকছে আর দরজায় কড়া নাড়ছে। তবুও বর্ণালীর কোন সাড়াশব্দ পায় না। এক পর্যায়ে খুব জোরে জোরেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দেয়।
-“বর্ণালী প্লিজ দরজা খোল। বর্ণালী, বর্ণালী, দেখ বর্ণালী এখন দরজা না খুললে আমি বড় আম্মুকে ডাকতে বাধ্য হবো। দরজা খোল জান। আমাকে এভাবে ভয় দেখাস নে প্লিজ।”
দরজা খোলার কোন নাম-গন্ধ নেই। রুমু কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। একবার ভাবছে শারমিন বেগমকে ডাকবে আরেকবার ভাবছে ডাকলে বিষয়টা হয়তো বড় হয়ে যাবে৷ যা করতে হয় ওকেই করতে হবে। কিন্তু সেও কি করবে! কান্না থামছেনা ওর। এভাবে নিজের জানের চেয়ে প্রিয় বান্ধবীর অবস্থা দেখে কখনোই কেউ ঠিক থাকতে পারেনা। গায়ের সর্বোচ্ছ শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছেনা। ফোন বের করে সজিবকে কল লাগায়। এখন একমাত্র এই একটা মানুষ যাকে সে সব বলতে পারবে। সজিব কখনোই বর্ণালীকে ভুল বুঝবে না। কল যেতেই সজিব রিসিভ করে।
-“কিরে…..”
-“সজিব তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। যেখানে আছো তাড়াতাড়ি বাসায় এসো প্লিজ।”
-“কি হয়েছে রুমু? কার বাসায়? কি বলছিস এসব? ঠিক আছিস তুই?”
-“একটা কথা না বাড়িয়ে তোমার বাসায় এসো প্লিজ সজিব। বর্ণালী নিজেকে ওয়াশরুমে লক করে দিয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় এসো।”
-“বর্ণ!!! কি হয়েছে ওর? ও ঠিক আছে? মা কোথায়? রুমু কথা বল?”
-“বড় আম্মুকে আমি কিছুই বলিনি সজিব৷ তুমিও কিছু বলো না। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় এসে সোজা বর্ণালীর রুমে আসো।”
-“হ্যাঁ আমি রাস্তায় আছি। আসছি ১০মিনিট। বর্ণালীর যেনো কিচ্ছু না হয় রুমু।”
-“কিচ্ছু হবে না। বাসায় এসো।”
সজিব কল কেটে সিএনজিওয়ালাকে আরো দ্রুত চালাতে বলে। রুমু তখনও দরজা ধাক্কে যাচ্ছে। বর্ণালীর চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটজোড়া শুধু বিরবির করে একটা কথাই বলছে,
-“সব দোষ আমার, আমি পাপ করেছি। এই পাপের ক্ষমা নেই। সব দোষ আমার।”
রুমু এভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। কোন উপায় না ভেবে বেলকনি দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। ওয়াশরুমের জানালার গ্লাস দিয়ে উঁকি দিতে চেষ্টা করে কিন্তু পারছেনা। এক দৌড়ে গিয়ে বেলকনি থেকে চেয়ার এনে জানালা দিয়ে তাকাতেই আত্মা কেঁপে উঠে ওর। কান্নার আওয়াজ বেড়ে যায়।
-“ব…বর্ণ এ তুই কি করলি!”
প্রতিটা গ্লাস খুলে নিচে ফেলতে গিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলে। সেদিকে কোন খেয়ালই নেই ওর। কান্না করছে তো করছেই। গ্লাস খুলে নিচে রেখে অনেক কষ্ট করে জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় সে। ভেতরে ঢুকেই শাওয়ার বন্ধ করে বর্ণালীকে জড়িয়ে ধরে। বর্ণালী তখনো বিরবির করে এই একই কথা বলছে।
-“বর্ণ এটা কি করলি তুই? কি করলি বর্ণ?”
-“স….সব দ…দোষ আমার রে রুমু। আ….আমি পা…পাপ করেছি আমাকে শা…..শাস্তি দে।”
কথা বলতে পারছেনা তাও বারবার এই কথাই বলছে৷
রুমু উঠে দরজা খুলে দিয়ে বর্ণালীকে তুলে দাঁড় করিয়ে মাথা ওর কাঁধের মাঝে নেয়। ওর এমন অবস্থা দেখে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স এনে মাথার পাশ ওয়াশ করতে লেগে যায়। ওর হাত প্রচন্ড কাঁপছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সেই জল মুছছে তো আবার ওয়াশ করছে। বর্ণালী মুখ খিচে নিয়েছে। মুখ দিয়ে গুঙিয়ে আওয়াজ বের করছে। হয়তো প্রচন্ড ব্যাথায় এমন হচ্ছে ওর। রুমু আলতো করে মাথার পাশটা ড্রেসিং করে দেয়। তারপর আলমিরা থেকে ড্রেস বের করে চেঞ্জ করিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। এই অবস্থায় থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ঠিক বর্ণালীর বুকের উপর মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুমু।
-“তোর একবারও মনে হলো না যে তুই আমাদের কতটা কষ্ট দিবি? শুধু নিজের কষ্টটাই দেখলি? কেন এমন করলি? কতটা রক্ত ঝড়িয়েছিস নিজের? কিভাবে পারলি তুই? কিভাবে?”
দরজায় খট করে আওয়াজ হতেই রুমু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। সজিবকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। সজিবও অবস্থা বুঝতে পেরে রুমুকে জড়িয়ে ধরে করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। রুমু অনেকটা ভিজে গেছে। সজিব ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“রুমু চুপ কর। এভাবে কাঁদলে আমি কিভাবে বুঝবো কি হয়েছে?”
রুমু সজিবের বুক থেকে মাথা তুলে বলে,
-“দে…..দেখো না বর্ণালী কথা বলছে না। এভাবে শুয়ে আছে। ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে সজিব। প্লিজ ডাক্তারকে ডাকো।”
সজিব বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। বর্ণালীর এমন অবস্থা দেখে সজিব পাগলের মতো ওকে তুলে নিজের বুকের মাঝে ওর মাথা নেয়।
-“বর্ণ কি হয়েছে তোর? ভাইয়াকে বল? দেখ এভাবে চুপ করে থাকবিনা। প্লিজ বোন কথা বল।”
-“সজিব ডাক্তার ডাকো প্লিজ।”
বর্ণালী তখনই চোখ পিটপিট করে তাকায়। সজিবের হাত শক্ত করে ধরে বলে,
-“নাহ।”
-“কি না বর্ণ?”
-“ডাক্তার ডেকো না ভাইয়া।”
-“কিন্তু তোর এই অবস্থা।”
-“পি…..প্লিজ ভাইয়া।”
সজিব চোখের জল মুছে রুমুর দিকে অসহায়ভাবে তাকায়।
-“আ….আমি দেখছি কি করা যায় তুমি টেনশন নিও না।”
রুমু ফোন বের করে ফ্যামিলি ডাক্তারকে কল করে আসতে বলে। এভাবে বসে থাকলে হবে না। বর্ণালীর কথা শুনলে হয়তো কোন অঘটন ঘটে যাবে। আর তা রুমু কখনোই হতে দিবে না।
.
ধীরে ধীরে সবাই কলেজ থেকে বেরিয়ে যায়। ইভান ক্লাসের সামনে সিঁড়িতে বসে আছে। রাহাত, মালিহা আর মিথি ওর পাশেই নিশ্চুপ হয়ে আছে। শিমুল আর আসাদ খাবারগুলো পাশের এতিমখানায় দিতে যায়। এতো খাবার রয়ে গেছে যে নষ্ট হতো। কেউ খাবার খেতেই পারেনি নষ্ট তো হতোই। মালিহা আর নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারলো না।
-“ইভান তুই এভাবে মুড অফ করে বসে আছিস কেন?”
ইভান এখনো নিশ্চুপ হয়ে আছে কোন কথা বলছে না।
-“কিরে কথা বল? আর ওইসব ছবিগুলো…”
-“ছবিগুলো কোত্থেকে এলো মালিহা?”
খুব শান্ত গলায় কথাটা বলে ইভান। মালিহা বুঝেও কোন কিছু না বোঝার ভান করে বলে,
-“মানে?”
-“মানে ছবিগুলো কোত্থেকে এলো?”
-“কিসব বলছিস? আমি কিভাবে জানবো?”
ইভান হাত শক্ত করে মুঠিবদ্ধ করে দেয়ালে ঘুসি মেরে উঠে দাঁড়ায়।
-“ছবিগুলো কোত্থেকে এলো ড্যাম ইট। জবাব দে আমায়। কেন এমন করলি তুই?”
ইভানের চিৎকার শুনে সবাই ভয়ে কেঁপে উঠে। রাহাত এসে ইভানকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
-“ছাড় আমায় রাহাত। জবাব দে মালিহা। কেন এমন করলি? বর্ণালী কি এমন ক্ষতি করেছে তোর?”
মালিহা আর বসে না থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইভানের মুখের সামনে এসে বলে,
-“ও আমার ক্ষতি করেছে তাই আমি ওর সাথে এমন করেছি। আজ নয় ওর ক্ষতি আমি বারবার করবো। ওর সাহস কি করে হয় তোর কাছে যাওয়ার?”
মালিহা ইভানের কলার ধরে পাগলের মতো কথা বলতে শুরু করে,
-“তুই কেন আমায় বুঝিস না? আমাকে কি তোর চোখে লাগেনা? আমি কি তোকে আকর্ষণ করিনা। আমার মাঝে কিসের কমতি আছে? তাও কেন তুই তোর থেকে বড় ওই মিডলক্লাস বেহেঞ্জি টাইপের মেয়ের পিছু পড়ে আছিস?”
ইভান মালিহার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দূরে ঠেলে দেয়।
-“আজ যদি তুই মেয়ে না হয়ে ছেলে হতি না তাহলে বুঝতি ইভান কি জিনিস। ইভান মেয়েদের গায়ে হাত দেয় না নাহলে এতোক্ষণে তোর গালে কয়টা পড়তো তা তুই জানিস না। মিথি ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যা।”
-“হ্যাঁ ও যাবে কিন্তু তার আগে ওর প্রাপ্যটা নিয়ে যাক ইভান।”
মিথি কথাটা বলেই মালিহার গালে ঠাস করে দুইটা চড় বসিয়ে দেয়। রাগে মালিহার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।
-“মিথি তোর এতো বড় সাহস?”
-“হ্যাঁ আমার সাহস এতোটাই। আমার না ঘৃণা হচ্ছে যে তুই আমার বান্ধবী। আসলেই আজকে আবারো প্রমাণিত হলো একজন মেয়েই আরেকজন মেয়ের চরম শত্রু হয়। ছেলেরা তো নামে বদনাম। হ্যাঁ তবে কিছু সংখ্যক ছাড়া। ছেলেরা যদি বাইরে ৪০% মেয়ের সাথে খারাপ কাজ করে সেখানে এই মেয়েরাই ঘরে-বাইরে ৬০% মেয়েরদের সাথে খারাপ কাজ করে। কিন্তু তুই কিভাবে পারলি?
আমি না বিশ্বাস করতে পারিনি মালিহা তুই এতোটা নীচে নামবি। হ্যাঁ আমারও ভুল আছে। আমি তোর কথায় কথায় কাজ করেছি। শুধুমাত্র বন্ধুত্তটা টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু সত্যি কথা কি জানিস? তুই আমার কেন কারো বন্ধু হবার যোগ্য না।”
মালিহাকে কথাগুলো বলে মিথি ইভানের কাছে এসে বলে,
-“আমাকে ক্ষমা করে দে ইভান। আমি চাইলে এসব কিছু থামাতে পারতাম। আমি আমার বন্ধুত্ত রক্ষার জন্য এমন করেছি। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম বন্ধুত্তের যে মর্যাদা দিতে জানেনা তাকে হারানোর ভয় করার কোন মানেই হয় না। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
ইভান আর কোন কিছু না বলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে। আর সে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওর মুখ দেখতে পারবে না। ফোন বের করে রুমুকে বারবার কল দিয়েই যাচ্ছে।
.
শারমিন বেগম এই নিয়ে কয়েক গ্লাস পানি খেয়েছেন। শরীরটা ঠিক ভালো ঠেকছে না। বুকের মাঝে কেমন একটা অশান্তি করছে। মনে হচ্ছে প্রেসারটা আবার হাই হলো নাকি কো অঘটন ঘটলো। মেয়ে তো ঘরেই আছে। ছেলেটাও ভালোভাবে ফিরে এসেছে। শুধু তার স্বামী হাবিব হাসান বাসার বাইরে। তার কথা ভেবেই এখন তিনি পেরেশান হচ্ছেন। না জানি সে ঠিক আছে কিনা।
কলিংবেল বাজতেই চমকে উঠেন। গভীর ভাবনায় থাকলে এমনটাই হয়। বসা থেকে উঠে ধীর পায় দরজার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু দরজা খুলে ডাক্তারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শারমিন বেগমের কলিজার পানি শুকিয়ে যায়।
-“ডাক্তার সাহেব আপনি?”
-“জ্বি রুমু আছে?”
-“হ্যাঁ কিন্তু কি হয়েছে?”
রুমু পেছন থেকে এসে বলে,
-“বড় আম্মু আগে ভেতরে আসতে দাও।”
-“কি হয়েছে আমায় বলবি তো।”
-“আসলে বড় আম্মু বর্ণ…….”
-“বর্ণ? কি হয়েছে আমার মেয়ের?”
জিজ্ঞেস করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে এক দৌড়ে শারমিন বেগম মেয়ের রুমের দিকে যান। মেয়ের এই অবস্থা দেখে তার মাথাটা ঘুরে আসে। অল্পের জন্য পড়েই যাচ্ছিলেন কিন্তু রুমু পেছন থেকে এসে ধরে ফেলে। রুমুকে ছাড়িয়ে বিছানার উপর বসেই মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। ভেতর ফেটে যেনো কান্না আসছে। তার কান্না দেখে সজিব ও রুমুর কান্নার বেগটাও বেড়ে গেলো।
💛
#______চলবে……….

Previous
https://www.facebook.com/103632171307142/posts/129064012097291/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here