ফেইরিটেল পর্ব-১৮

0
1326

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–18

— “কী হলো? কথা কানে যাচ্ছে না? বললাম না নিচে গিয়ে বস। এখনো আমার বেড থেকে উঠার নাম নিচ্ছো না! তোমাকে আমার বেডে বসার পারমিশন কে দিয়েছে? ”

ইমান ধমকের সুরে কথাগুলো বললো। তার ধমক খেয়ে মিরা হতবিহ্বল হয়ে যায়। আতকে উঠে সে, সামান্য ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে আইসক্রিম মাখা হাতটা বেডশিটে রাখে। এবং ভড়কে যাওয়া চাউনিতে তার পানে তাকায়। সবকিছুই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইমান নিশ্চয়ই মজা করছে। ছেলেটা এতো ফাজিল! অবশ্যই এটা নতুন কোন ফাজলামি তাকে ডিস্টার্ব করার৷

মিরাকে মূর্তির মত এককোণে বসে থাকতে দেখে, ইমান বলে উঠে, “তোমার জন্য আমার কোন অনুভূতি নেই, মিরা। কাজেই আমার রুম, আমার বাসা এবং আমার সংসারে তোমার কোন জায়গা হবেনা। আর এই বিয়েটাও শুধুমাত্র লোক দেখানো বিয়ে। এম আই ক্লিয়ার টু ইউ?”

তার কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌছানো মাত্র মিরা থ হয়ে যায়৷ ক্রমশ বোধশক্তি লোপ পায় তার। তার চোখ ভরে উঠতে লাগে। সে উঠে দাড়ালো বহু কষ্টে। সামান্য উঠে দাড়াতেই যেন তার সব শক্তি ফুরিয়ে গেল। কথা বলার জন্য একফোঁটা শক্তি সঞ্চিত রইল না।

সে কম্পনরত গলায় বলে, “কী বললেন আপনি?”

— যা তুমি শুনলে, সেটাই বলেছি। নিশ্চয়ই তুমি বয়রা নও।”

— আপনি যেসব কথা বলেছেন সেগুলো সব ভুল৷ মজা করছিলেন তাই না?

একথায় ইমান হাসল। ধারালো সেই হাসির রেখা। মিরা চমকে উঠে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে।

সে বলে উঠে, তোমার কী মনে হয় আমি মজা করছি?

মিরা মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে ধারণা করছে ইমান তার সঙ্গে দুষ্টুমি-ফাজলামি করছে এতোক্ষণ যাবত।

ইমান এবারে শব্দ করে হাসল। সেই হাসির শব্দ কেমন পৈশাচিক শোনালো। তার চোখ আপনা-আপনি ভরে আসতে ধরে৷ শ্বাসরুদ্ধদ্বার এমন পরিস্থিতিতে কান্না আটকে রাখা দায়। তবুও মিরা উদাসিন গলায় বলে, “আপনাকে আমি কখনোই চিনতে পারি না৷”

ইমান পকেটে হাত রেখে বলে, “আমার আসল রুপ কখনো দেখোনি জন্য আমাকে চিনতে পারছো না। আসল রুপ দেখলেই বুঝতে পারবে আমি কেমন৷”

— এতোদিন যা দেখলাম সেটা আপনার আসল রুপ ছিল না? সব মিথ্যা ছিল? নাটক করতেন আমার সঙ্গে?

ইমান একথার উত্তর দিল না। সে ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠে, “তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার কর্ম না।”

মিরা অদ্ভুত চোখে তাকালো তার দিকে। সে আক্রোশ মাখা কণ্ঠে বলে উঠে, “তোমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি।”

মিরার সারা শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হলো না তার। চোখ ফেটে নোনাজল গড়িয়ে পরে৷

সে নিস্তেজ গলায় বলে, ঘৃণা করেন আমাকে কিন্তু আমি কী করেছি? আমার মনে পড়ে না যে আমার দ্বারা আপনি কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন৷

ইমানের মুখে সুক্ষ্ম ও চাপা বেদনা ছেয়ে যায়। সে মিরার দিকে এগিয়ে এসে তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে, “খবরদার, ক্ষতি শব্দটা উচ্চারণ করবে না মিরা। যদি লাভ-ক্ষতির হিসাব করা শুরু করি না, তাহলে অনেককিছু হারাতে হবে তোমাদের৷ আমি যদি আমার প্রাপ্ত অধিকার চাই, তাহলে তোমাকে আর তোমার পরিবারকে মাথার উপরের ছাদ হারাতে হবে৷”

মিরা নিষ্প্রাণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমান বেশ আঘাত দিয়েই তার বাহু ধরে আছে৷ সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। ডাঙ্গায় ছটফট করা মাছের মতো সে নড়চড় করছে।

ইমান তাকে আরো জোরে শক্ত করে চেপে ধরে এনে বলে, মানুষ সাধারণত শান্তিতে থাকার জন্য বিয়ে করে আর আমি অশান্তি দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছি তোমাকে৷

এবারে মিরার সহ্যের বাধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। সে চোখ পাকিয়ে বেশ উচু আওয়াজে বলে উঠে, সবসময় ফান ভালো লাগে না ইমান। ঘৃণা করলে নিশ্চয়ই কেউ কাউকে বিয়ে করে না।আর আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন।

এবারে ইমান হেসে ফেলে। সে বলে উঠে, আমি যে তোমাকে ভালোবাসি সেকথা একবারও মুখে বলেছি?

তার খেয়াল হলো, আসলেই সে তো কোনদিন মুখে একবারও বলেনি। কিন্তু, কিন্তু তার কাজ-কর্ম, কথার ধরণ তো এমনই কিছু ইঙ্গিত করত৷ মিরার মাথা ঘুরে গেল। সে মাথা চেপে ধরে বলে, ইমান এইসব কী বলেই যাচ্ছেন সেই থেকে। আজকের এই রাত আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই স্মরণীয় রাতে এভাবে কারণ ছাড়া আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন?

— কষ্ট দেওয়া তো মাত্র শুরু।

— আপনার ধারণা আছে আপনি তখন থেকে কীসব আজেবাজে বকে যাচ্ছেন। হুশ আছে নিজের?

ইমান এবারে তার চুলের মুঠি ধরে ফেলে বলে, “আমার সামনে আওয়াজ উচু করবা না।”

মিরা নিজের চুল ছাড়ার বৃথা চেষ্টা করে ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “আমার লাগছে কিন্তু। ব্যথা পাচ্ছি, কষ্ট হচ্ছে। ছাড়েন৷”

সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,” কষ্ট দেওয়ার জন্যই তো এমন করছি৷ সুখে রাখার নিয়ত থাকলে এতোক্ষণে আদরে ভরিয়ে দিতাম৷ কিন্তু আমার নিয়ত তো আলাদা। আমার ধ্যানে-জ্ঞানে কেবল তোমার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার ভূত চেপেছে। আমি আমার মায়ের চোখের পানিকে সাক্ষী রেখে এদেশে শুধুমাত্র তোমাদের দ্বিগুণ কষ্ট ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ফিরে এসেছি৷”

মিরা যেন মাঝ সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া এক অসহায় নাবিক। যার একূলেও ঠাই নেই, ওকূলেও রেহাই নেই। ইমানের চোখে যে হিংস্রতা সে দেখছে এতে নিশ্চিত যে সে মিথ্যা বা ফাজলামি করছে না। তাহলে এতোদিন সে নিজে একটা ঘোরে ছিল? দিবাস্বপ্ন দেখছিল ভুল মানুষকে নিয়ে? তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকল। বুলিরা সব হাওয়ায় বিলিন হয়ে গেছে যেন৷

অনেকক্ষণ পর ইমান তার চুলের মুঠি ছাড়ে। এতো জোরে টেনে ধরে রেখেছিল যে মাথার ওইপাশ ব্যথায় চিনচিন করে উঠে। সে চোখের জলে নিরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তবুও অল্প সময়ের ব্যবধানে সে ইমানকে প্রশ্ন করে, ফুপুর সঙ্গে বাবার কী কোন ঝামেলা হয়েছিল? যার জন্য আপনার এতো ক্ষোভ?

ইমান পুনরায় তাচ্ছিল্য ও বেদনাভরা হাসি দিয়ে বলে, ঝামেলা!তোমার কাছে ওই ঘটনাকে ঝামেলা লাগে?

মিরা ইতস্তত করে বলে, কোন ঘটনার কথা বলছেন আপনি? আমি সত্যিই জানি না ইমান।

ইমান দ্বিতীয়দফায় তার উপর আক্রমণ করে। এবারে মিরার একটা হাত পেছন দিয়ে মুচড়ে ধরে, আরেক হাত দিয়ে তার গাল ভীষণ শক্তি দিয়ে চেপে ধরে বলে, তোর বাপ একটা প্রতারক। জানোয়ার একটা। এই ধরনের মানুষকে কেটে-কুটে কুত্তার ভোগ দেওয়া উচিত।

ইমানের বলা প্রতিটা কথা যেন মিরার বুককে ফালা-ফালা করে দিয়ে গেল৷ বাবাকে নিয়ে বানে কথা তার সহ্য হচ্ছে না। চূর্ণবিচূর্ণ এবং বিধ্বস্ত হতে থাকে তার মন। সে বাম হাত দিয়ে থাপ্পড় বসায় ইমানের গালে। সম্ভবত এমন কিছুর জন্য ইমান প্রস্তুত ছিল না৷ সে চরম অপমানিত বোধ করে৷ চোখ দুটো হিংস্রতায় আরো জ্বলজ্বল করে উঠে। সাপের মতো হিশহিশ করে উঠে বলে, তোমাদেরকে ধ্বংস না করা অব্দি আমি শান্তি পাব না।

— আপনি ভুলেও আমার বাবাকে নিয়ে আজেবাজে কিছু বলবেন না।

— বাপের আসল রুপ সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে?

মিরা কেঁদে ফেলে বলে, চুপ করুন৷ আমি এখনি বাইরে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনব। আজকে আপনার এই রুপ প্রকাশ পাওয়া দরকার। কতোটা হিংস্র আপনি তা সবার জানা উচিত।

ইমান যেন এতে আরো রেগে যায়। সে বলে উঠে, “আমাকে হুমকি দিবা না। আর হ্যাঁ, ভুলেও কাউকে কিছু বলতে যাবা না।”

এবারে মিরা শান্ত-শীতল দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে বলে, ভয় পাচ্ছেন?

ইমান তাকে অবাক করে দিয়ে শব্দ করে হাসা শুরু করে। এরপর বলে উঠে, যাও তোমার পরিবারের প্রতিটা মানুষকে গিয়ে বল, ইমান খান তাদের আদরের মেয়ের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। একরাতেই জীবন নরক বানায় ফেলেছে।”

— আপনার মাথা গেছে।

ইমান নিজ থেকে দরজা খুলে দিয়ে বলে, যাও। অপেক্ষা কেন করছো? কোলে করে তুলে নিয়ে যাব?

মিরা হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে।

ইমান বলে উঠে, বাট ওয়েট, তুমি যদি নিজ থেকে কাউকে কিছু বলে দাও, তাহলে এর পরিনাম খারাপ হবে৷

— আমাকে হুমকি দিলেন?

— নো, নো। আমি হুমকিতে বিশ্বাসী নই। আই লাভ একশন৷

— তাই নাকি? কী একশন নিবেন আপনি?

ইমান এবারে তার দিকে আগাতে থাকে। এরপর মুখোমুখি হয়ে বলে, এই বাড়িটা যেটা তোমাদের একমাত্র আশ্রয়। সেটা আমার নামে লেখা৷ নানাভাই আমার নামে লিখে দিয়ে গেছে। এইজন্য এই বাসায় আমার এতো কদর। তোমার মা এইজন্য আমার এতো যত্ন নেয়। বুঝলা সবাই স্বার্থ খুঁজে। আর সেখানে তোমরা এতো লোভী। টাকার জন্য রক্তের সঙ্গেও বেঈমানী করো৷

মিরা থমকে দাঁড়ায়। ইমানের কথা তার হজম হচ্ছে না।

ইমান অবলীলায় জানালো, আমি চাইলেই আমার বাসা থেকে যেকাউকেই অপমান করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি৷ কী পারি না?

— বলতে চাচ্ছেন আপনি আমাদেরকে বাসা থেকে বের করে দিবেন? তো দিন না। সমস্যা কোথায়?

— সমস্যা কোথায় তুমি জানো না?

— আমি সত্যিই কিছু জানি না। আপনি কেন আমার সঙ্গে এমন করছেন? বাবা দোষ যদি করেও থাকে সেই শাস্তি কেন আমার উপর চাপাচ্ছেন?

ইমান ধীরে-সুস্থে জবাব দেয়, যুদ্ধে নির্দোষ-দোষী দেখা হয় না। ইতিহাস সাক্ষী আছে, পিতার কর্মের জন্য সন্তানকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। রাবণের কর্মের জন্যই কিন্তু মেঘনাদকে শাস্তি পেতে হয়৷

মিরা তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমাদের উপর এভাবে শোধ নেওয়া ঠিক হবে না৷ বাসার সবাই আপনাকে কত শ্রদ্ধা করে।আর আপনি আমাদেরই ক্ষতি করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন৷ সেইম অন ইউ৷”

ইমান তার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলে, বন্ধু ভেবে যার জন্য ফুল দিয়ে ঘর সাজাইলা সে হলো তোমার শক্রু৷ সাপ হয়ে দংশন করব, এসিড হয়ে তোমার সব সুখ জ্বালিয়ে দিব।

চলবে৷

[ ভুল-ভ্রান্তি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। সবার এ পর্ব পড়ে মতামত কেমন? জানাতে ভুলবেন না কিন্তু।পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here