ফেরা পর্ব-১০

0
525

#ফেরা

১০.

নিধি ওকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইল।
” চা খেয়ে যা। মা সিলেট থেকে চা পাতি আনিয়েছেন। ” শাজু অনেক কষ্টে কান্না চেপে কথাটা বলল।
ফ্ল্যাটে ঢোকার পরে দরজা আটকে দেয়ার সাথে শাজু কান্নায় ভেঙে পড়লো। দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে কাঁদছে যেন শব্দ না হয়৷ নিধি চোখ ফিরিয়ে নিল৷ তার সহ্য হচ্ছে না। কী করলো সে!
” নিধি… আমি কী করলাম রে! আমার সহ্য হচ্ছে না৷ আমার সাথে এমন করলো কেনো? আমি তার তো কোনো ক্ষতি করিনি। ” শাজু কান্না থামাতে পারছে না। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল কথাগুলো। তার অসহ্যকর যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথা মনে হচ্ছে এখনই ফেটে যাবে তার। নিধি কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারছে না। সঞ্চয় যে এমন হবে তার চিন্তার বাহিরে ছিল। এটা কী হয়ে গেল।

*****
শাজু তার আগের জগতে ফিরে গেল। তার মনে হলো আগের জগতের সবাই তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করছে। কেউ কেউ বলছে, ” খুব তো ঢং দেখিয়ে গিয়েছিলে! কী লাভ হলো?”
নিজেকে অনেক দিন পরে আবার চেনা চেনা লাগছে। সম্পর্কে জড়ানোর পরে এই জগতে তেমন আসা হয়নি৷ অবসর সময়ের পুরোটা জুড়ে তখন সঞ্চয় থাকতো যে! যা হয় ভালোর জন্য হয়৷ পরীক্ষার জন্য বেশ টাইট রুটিন তৈরি করেছে। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। মা ডিভোর্সের পরে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সবসময়। টেস্ট পরীক্ষা হতে দুই সপ্তাহ বাকি। ভয় হচ্ছে তার। যদি ফেল করে বসে? বোর্ড পরীক্ষা দিতে পারবে না৷ বাসায় মা আরেকজন টিচার রেখেছেন৷ যিনি ইংরেজি পড়ান। কোচিং-এর পড়া, বাসার দুজনের পড়া আর নিয়মিত ক্লাস করতে করতেই নিজের জন্য তেমন সময় হয়ে উঠে না৷ মোবাইলের সিম পরিবর্তন করে ফেলেছে সে৷ সঞ্চয়ের নাম্বার থেকে কয়েকবার ফোন এসেছিল। তার সম্পর্কিত সবকিছুই খুব পীড়া দেয় তাকে। এতো ব্যস্ততার মাঝে নীরবে কাঁদে সে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। নিশ্বাস নেয়ার সময় মনে হয় বুকের মধ্যে গভীর ক্ষতে কেউ সূচালো সুঁই দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করছে তাকে। এতো অসহ্য যন্ত্রণা কখনো সে অনুভব করেনি। ঘুমানোর সময় মন খারাপ নিয়ে ঘুমায় আর ঘুম ভাঙেও মন খারাপ নিয়ে। এতো বড় ভুল কীভাবে করলো সে? ভেবে পায় না। সে জানতো, সঞ্চয়ের মতো ছেলে তাকে ভালোবাসতে পারেনা। তারপরও…
ক্লাসে এমনিতেই সে চুপচাপ থাকে। এখন আরো বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে সে।
নিধি নিজেকে দোষারোপ করে। তার জন্যই একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডের আজকে এই অবস্থা।
সরি বলার মতোও মুখ নেই তার। একবারে ভেবেছিল পা ধরে ক্ষমা চাইবে সে। কিন্তু সে সেটাও করার সাহস পেল না। ওই প্রসঙ্গ তুলতেই ভয় লাগে তার।
শাজু মা’য়ের অনুমতি নিয়ে রিয়েল আইডি খুলল। সেখানে প্রোফাইলে নিজের একটা ছবি দেয়া। কভার পিকে মা মেয়ের ছবি।

*****

” শ্লা তোর জন্য সব হইছে। ”
নীরব সিগারেটে টান দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ” এখন আমার দোষ? তোমারে তো আমি টাইনা নিয়ে যাইনি। তুমি নিজে সেধে গেছ। তোমার উচিৎ ছিলো কোনো প্রমাণ না রেখে কাজ করা৷ ”
” বাল, আমি তো ইচ্ছা করে নাচতে যাইনি৷ রিদ্দি হাত টেনে নিয়ে গেছে। আর সেই ভিডিও দেখে শাজুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ” সঞ্চয় টেবিলের উপর থাপ্পড় দিয়ে বলল।
নীরব হেসে বলল, ” দ্যাখ ভাই, তুই জীবনেও ওই গাধীরে ভালোবাসিস নাই৷ বাসলে ভুলেও রিদ্দির দিকে পা বাড়াতি না। আর শাজু ঠিকই বলেছে৷ রিদ্দির সাথে যখনই থাকিস তখনই তুই ভালো থাকিস৷ মানে মন থেকে হাসি যেটাকে বলে। ”
” তুই কি আমার মনের মধ্যে ঘুরে আসছিস নাকি?”
” তাহলে তুই রিদ্দির সাথে গেছিস ক্যান বল? রাতের বেলা কার্জন হলের চিপায় গিয়ে চুমু খাইছিস ক্যান? নাকি আমি তোর ঠোঁট টাইনা ওর ঠোঁটের সাথে লাগায় দিছিলাম? ” নীরব হাসতে হাসতে বলল।
সঞ্চয় নীরবের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সাথে বলল, ” এই কথা যেন ফাঁশ না হয়। ওটা কিছু মুহুর্তের উইকনেস ছিলো। ”
” দোস্ত, তুই এখনো ভুলের মধ্যে আছিস। কিছু মুহুর্তের উইকনেস শাজু ছিল। আর তোর সাথে ওরে মানায় না৷ তুই একটা হ্যান্ডসাম রিচ কিড। আর শাজু? বাপ মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। না সম্পর্ক আছে নানাবাড়ির লোকের সাথে না আছে দাদাবাড়ির লোকের সাথে। ওইরকম মেয়ে তোর মা মানবে? আর রিদ্দিকে দ্যাখ! লক্ষ গুণ ভালো। ” সঞ্চয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। গলা চড়িয়ে বলল, ” তো ওকে মানায় কার সাথে? তোর সাথে? ”
” হ্যাঁ, আমার সাথে। আমি হ্যান্ডসামও না, রিচও না আর ব্রিলিয়ান্টও না। ”
” তুই সিরিয়াস?”
” হ্যাঁ, আমার ওকে অনেক আগে থেকে ভালো লাগে। আমারে দেখছিস কোনো মেয়ের সাথে ডেটিং এ যাইতে? ঘুর‍তে ফিরতে? ”
সঞ্চয়ের বিশ্বাস হচ্ছে না। তার মনে হলো ভুল শুনছে।
” কী? কীসব বলিস? ”
” তুই ওকে সত্যি ভালোবাসিস কিনা এটা জানা আমার দরকার ছিল। যদি সত্যি তুই ওরে ভালোবাসতি তাহলে আমি তোদের মধ্যে ভুলেও পা দিতাম না। কিন্তু তুই তোর আসল রূপ দেখায় দিলি। তাই আমি বাধ্য হয়ে ওই ভিডিও ক্লিপ, ছবি রত্না ও ফারিয়ার কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। কারণ, আমি যাকে ভালোবাসি। তাকে না পেলাম তাতে সমস্যা নাই৷ কিন্তু সে যেন কোনো ধোকা আর ভুলের মধ্যে জীবন পার না করে। এটাই আমি চেয়েছিলাম। সেটাই হয়েছে। তবে আমি অবাক হয়েছি শাজুর স্ট্রং পারসোনালিটি দেখে৷ ” নীরবের সহজ স্বীকারোক্তিতে কিছু বলার মতো পেল না সঞ্চয়৷ যেমনটা শাজুর তাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছিল।
নীরব আহত স্বরে বলল, ” দোস্ত, তুই আমার সবচেয়ে নরম জায়গায় ঘা দিয়েছিস। আমি তোকে কোনোদিন ক্ষমা কর‍তে পারবো না৷ আর রিদ্দিই তোর জন্য পারফেক্ট। কারণ একটা বারো ভাতারির সাথে তোর মতো পোলারেই মানায়। ”

*****
টেস্ট পরীক্ষার এক সপ্তাহ পরে ১-১৫ রোল পর্যন্ত মেয়েরা একটা পার্টির মতো আয়োজন করেছে৷ শাজুর ইচ্ছা ছিল যাওয়ার কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পার্টি হবে নিধিদের বিল্ডিংয়ের ছাদে। নিধি না করাতেও লাভ হয়নি। ভোটে হেরে যাওয়াতেও না করারও সুযোগ পায়নি । ওই ঘটনার পরে থেকে নিধির বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল শাজু। একই বিল্ডিংয়ে সঞ্চয় আর নিধিদের ফ্ল্যাট। হঠাৎ দেখা হয়েও যেতে পারে। পার্টির খবর মুক্তার কানে আসার পরে বাঁধল বিপত্তি। মেয়ে অনেক বেশি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আর মেজাজও কেমন খিটমিটে হয়ে গেছে। অতিরিক্ত চাপে এই অবস্থা। ক্লাসমেটদের সাথে কয়েক ঘণ্টা কাটালে হয়তোবা খিটখিটে মেজাজের পরিবর্তন আসতে পারে। নিধি অবশ্য ওকে আসতে বলেওনি। সঞ্চয় কয়েকদিন যাবত তাকে অনুরোধ করছে শাজুর সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য। আর যদি সন্ধ্যার পরের পার্টিতে শাজুকে আসতে দেখলে যে কী শুরু করবে চিন্তাও করা যায় না৷
মুক্তার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েই শাজুকে রাজি হতেই হলো। মেয়েক নিজ হাতে সাজিয়ে দিলেন৷ ব্যাগে যা যা প্রয়োজন সব নিজেই গুছিয়ে দিলেন৷ নিজে গিয়ে নিধির বাসায় রেখে এলেন। নিধির বাবা মা আছেন সেখানে নজর রাখার জন্য। মুক্তার মেয়ের আনন্দ দেখার খুব ইচ্ছাও করছিল কিন্তু সে পাশে থাকলে মেয়ে মন খুলে ক্লাসমেটদের সাথে গল্প করতে পারবে না৷ তাই ইচ্ছা থাকলেও বাসায় চলে এলেন।

****
রত্না বিস্মিত চোখে শাজুকে দেখছে। মাস্টার্ড কালারের কোটিসহ গাউন পরেছে। ঠোঁটে মেরুন রঙের লিপস্টিক। চোখে গাঢ় করে কাজল দেয়া।
” কে বলবে এটা আমাদের ফার্স্ট গার্ল? ” ফারিয়া বলল, ” কলেজে উঠলে তো সব ছেলেকে রিদ্দি আপুর মতো নিজের পার্সে ঢুকিয়ে ফেলবি রে। ” শাজু হাসতে চাইল কিন্তু হাসি ঠিক হলো কিনা বুঝতে পারলো না৷ নিধি বলল, ” আমার বান্ধবী বলে কথা! ”
” রাখ তোর বান্ধবী! ও আমাদেরও ফ্রেন্ড। তোর একার সম্পত্তি না। ” রত্নার কথায় সায় দিয়ে লোপা বলল, ” নিধি তুই কি লেজু নাকি?”
নিধি দুই গালে মেকি চড় দিয়ে বলল, ” নাউজুবিল্লাহ কীসব বলিস! ”
লোপা বিজ্ঞের ভান ধরে বলল, ” আমি একটা নতুন হট টপিক পেয়েছি। শুনবি তোরা?”
রত্না বলল, ” না চাইলেও তুই বলবি৷ বলে ফেল, হট টপিক শুনে আমরাও হট হয়ে যাই। ”
” রিদ্দি আপু নাকি সঞ্চয় ভাইয়াটার সাথে ইয়ে করেছে। ” শাজু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। মুখে মেকি হাসি লাগিয়ে রেখেছে এমনভাবে যেন ভুলেও খসে না পড়ে।
” ইয়েটা কি? সেক্স নাকি টুকটাক? ” পাশ থেকে রিমি জিজ্ঞেস করলো।
” সেক্স! ” সাথে সাথে রত্না হেসে বলল, ” বইন রে! এইটা তো প্র‍থম কিছু না৷ রিদ্দি আপায় যদি কনফার্ম এখানে সেক্স করে থাকে। তাহলে এইটা হবে তিন হালি তম সেক্স। মানে এক ডজন। ” শাজু হাসতে হাসতে বলল, ” প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়নি?”
” তুই আর কতকাল এমন গাধা থাকবি? দুনিয়ায় কি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উঠে গেছে নাকি? ” লোপার কথায় সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করলো৷ শাজুও তাদের সাথে যোগ দিল।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here