ফেরা পর্ব-৯

0
577

#ফেরা

৯.

সঞ্চয়ের হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিধিকে কয়েকবার ফোন দিয়ে পায়নি সে। শাজুর নাম্বারে ফোন দেয়ার সাহস পাচ্ছে না। আন্টির কাছেই যে ফোন সেটা বোঝা যাচ্ছে। সারাদিন তেমন একটা কথা হয়নি। এদিকে রিদ্দি ম্যাসেজের উপর ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে। সে যে বসে আছে হাত গুটিয়ে তাও নয়। একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও চিন্তাটা আপাতত মাথা থেকে যাবে। শাজু ওর মা’কে প্রচণ্ড ভয় পায়। নিধি ফোন রিসিভ করলেও একটা কিছু করা যেত। রিদ্দির সাথে চ্যাটিং করতে করতে কখন যে রাত একটা বেজে গেল তার খেয়ালই হয়নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজেই আৎকে উঠলো। আগামীকাল তার রসায়ন প্রথম পত্র এমসিকিউ পরীক্ষা।
এদিকে ক্লান্তিতে ঘুম আসছে… আবার পরীক্ষাও বটে। নাম্বার কম আসলে মা ফোনেই তাকে আস্ত গিলে খাবে। কড়া লিকারে চা বানিয়ে বই নিয়ে বসলো। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কোন সময় যে বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি সে। ঘুম ভাঙলো শাজুর ফোনে।
ফোন রিসিভ করতে ভয় ভয় লাগছিল। ফোন রিসিভ করে সালাম দিল। শাজু সালামের উত্তর না দিয়েই চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ” আম্মু কিছু বলেছে? ”
” ফোন দিতে না করেছে। ”
” আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। নাম্বারটা কার। আমি বলেছি, চিনি না। অচেনা নাম্বার বলে চালিয়ে দিয়েছি। ” সঞ্চয়ের মাথা ভাড় হয়ে আছে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। শাজুর কণ্ঠ শুনে তার মনে হলো সবকিছু ঠিক আছে।
” আমি বলেছি আমার ফুপুকে ফোন দিয়েছি। ”
” এখন থেকে সুযোগ বুঝে আমিই ফোন দিব। আপনার প্রয়োজন নেই। ” কথাগুলো বলার সময় শাজুর কেন যে খারাপ লাগলো না।
” ঠিকাছে ” ফোন ওপাশ থেকে কাটার পরে সঞ্চয় আবার ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেল। কিন্তু ঘুম আর আসলো না।

মুক্তা মেয়ের মোবাইল কখনো চেক করে না। গতকাল রাতে মেয়ের মোবাইল বন্ধ দেখে একটু অবাক হলেন। মেয়ে তো কখনো মোবাইল বন্ধ করে রাখে না। রাত দশটা বাজতেই মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লেগেছে তার কাছে। মেয়ের এমন আচরণে তার খটকা লেগেছিল। তাই না চাইতেও মেয়ের মোবাইল অন করলেন। মিসড কল এলার্ট চালু করা। পরাপর ম্যাসেজ আসাতে চোখে পড়লো তার। ওই নাম্বার সেভ করাও না৷ আগের কোনো কল হিস্ট্রিও নাই। ফোন করেও সুবিধা হলো না। মেয়ে আবার ফেসবুক একাউন্ট খুলেছে । ম্যাসেজ, ফ্রেন্ডলিস্ট চেক করেও লাভ হয়নি৷ হাতে গোণা কয়েকজন ফ্রেন্ড। প্রোফাইলে একটা সাদা বিড়ালের ছবি। মেয়েটার বিড়াল পোষার অনেক শখ। এসএসসির পরে একটা বিড়াল এনে দিলে কেমন হয়?

এক মাস পরে…

কোচিং-এ ক্লাস হবার কথা ছিল। কিন্তু কিছু একটা সমস্যা হওয়াতে ক্লাস হচ্ছে না। শাজু বাংলা বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। এইসময় সঞ্চয়ের সাথে একটু কথা বলা যেত। কয়েকবার ফোন দিয়েছিল কিন্তু ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। ফেসবুক একাউন্টের কথা সঞ্চয়কে সে বলেনি। যদিও বলার মতো তেমন সুযোগ হয়নি৷ এমনকি তার জন্মদিন পর্যন্ত ভুলে বসে আছে। নিধি বলল, পড়াশোনা নিয়ে নাকি ব্যস্ত।
রত্না আর ফারিয়া ফেসবুকে কিছু একটা দেখছিল আর বলাবলি করছিল, ” ইশ! কী কিউট কাপল। কী সুন্দর মানিয়েছে। ” নিধি ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ” কোনো মুভি নাকি?”
ফারিয়া মোবাইলের দিকে চোখ রেখেই বলল, ” না রে। রিদ্দি আপু আর ছেলেটার নাম… দাড়া আমি কমেন্ট বক্স থেকে দেখে বলছি। ” নিধি মনোযোগ দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিধি জিজ্ঞেস করল, ” ইংরেজি ভার্সনের আপুটা না? ”
ফারিয়া সম্মতি জানিয়ে বলল, ” হ্যাঁ, আপুটা সামনা-সামনি বেশি সুন্দর। আর এতো সুন্দর হাসি। তোকে বুঝাতে পারবো না। ভাইয়াটাকে দ্যাখ। দু’জনকে যা মানিয়েছে। ” নিধি বলল, ” ভাইয়াটাকে মনে হয় আমি চিনি। ” ওদের হাত থেকে মোবাইল নিতে যাবে তখন ফারিয়া বলল, ” ভাইয়াটার নাম সঞ্চয়। ইনবক্সে তো আইডিও মেনশন করা আছে। ”
শাজুর মন এদিকেই ছিল। ফারিয়ার কথায় অনেকটা ধাক্কা খেল। মনে হলো সে ভুল শুনেছে। নিধি বলল, ” কীসব বলিস, উনি ক্যান রিদ্দি আপুর সাথে প্রেম করতে যাবেন?”
রত্না ভেংচি কেটে বলল, ” ক্যান, তোর সাথে প্রেম করবে নাকি? ” নিধি চটে গেল এই কথায়।
” আমার সাথে করতে যাবে ক্যান? সঞ্চয় আমার ফ্রেন্ড। রিদ্দি আপুর সাথে প্রেম থাকলে আমি অবশ্যই জানতাম। ” শাজু অবাক চোখে ওদের কথোপকথন শুনছে। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না।
” তুই না বললে তো আর হবে না। ওদের কাপল ছবিও কমেন্ট বক্সে দেয়া। দাড়া সেভ করে তোকে দেখাচ্ছি। ” রত্না মোবাইলে ছবি সেভ করে নিধির চোখের সামনে ধরলো। শাজু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে ছবিটা ভালোভাবে দেখল। হ্যাঁ, এটা সঞ্চয়।
” দেখেছিস? পারফেক্ট কাপল। ” শাজু মুখে হাসি টেনে বলল, ” আসলেই আমি এতো সুন্দর কাপল কখনো দেখিনি। ”

*****

সঞ্চয়ের মোবাইল ফ্লাইট মোডে রাখা৷ রিদ্দি হুটহাট ফোন দিয়ে বসে। শাজু হঠাৎ এভাবে নিধির বাসায় দেখা করতে বলবে ভাবতেও পারেনি৷ নিধির বাবা, মা আর ছোট বোনটা বাসায় নেই। শাজুকে অন্য দিনের তুলনায় বেশি হাসিখুশি দেখাচ্ছে। অনেক দিন পরে একান্ত সময় পেয়েছে, এই কারণেই হবে। আজকে যদিও রিদ্দির সাথে নীলক্ষেতে যাওয়ার কথা।
” আপনার পাশে বসতে পারি?” কোন সময় তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি সে। অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ” হ্যাঁ, বসো। ”
সঞ্চয়ের পাশে বসে বলল, ” কেমন আছেন?”
” ভালো, তুমি কেমন আছ?”
” ভালো। আমি একটা ভিডিও সেভ করে রেখেছি। একসাথে বসে দেখবো বলে। আপনার পাঁচ মিনিটের মতো সময় হবে?” শাজুর কথায় অন্য ধরনের সুর ছিলো। সঞ্চয়ের মনে হলো, শাজু ঠিক নেই। কিছু একটা হয়েছে।
” হ্যাঁ , তোমার জন্য আমার অফুরন্ত সময়। ” শাজু জিজ্ঞেস করলো, ” আমাকে সত্যি ভালোবাসেন? ” এই প্রশ্নে নীরব আকুতি ছিল। যেটা সঞ্চয়ের সাধ্য নেই বুঝতে পারার।
” হ্যাঁ ”
কোনো কিছু না বলে ডাটা অন করে ফেসবুকে ঢুকে সেভ ফোল্ডারে গেল শাজু৷ সঞ্চয় অবাক হলো। ও ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছে কিন্তু তাকে একবারও বলেনি।
” তুমি একাউন্ট খুলেছ?” সে প্রশ্ন না করে পারলো না।
” হ্যাঁ, এক মাস হবে। ” কাঙ্ক্ষিত ভিডিও পেয়ে গেল সে। ওপেন করে সঞ্চয়কে বলল, ” আপনি দেখতে পারছেন?” সঞ্চয় ভিডিও এর দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। এই ভিডিও ওর পাওয়ার কথা ছিলো না।
” তুমি এই ভিডিও কোথায় পেলে?”
” রত্না দেখাল। ”
” রত্না জানে আমাদের কথা? ”
” না, আমি বলিনি। ভাগ্যিস বলিনি, তাহলে কী একটা লজ্জায় পড়তে হতো আমাকে। ” হাসতে হাসতেই বলল। সঞ্চয়ের অবাক লাগছে। মেয়েটা এমন ব্যবহার কেনো করছে?
” কেনো? ” প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ” কথা পরেও বলা যাবে। ভিডিও টা পুরো দেখতে হবে। আমার ডাটা ব্যালেন্স লো। ”
” অফ করো এটাকে। ও আমার ভালো ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ডের সাথে… ” শাজু কথার মধ্যে বলে বসলো, ” আমি কৈফিয়ত চাইনি আপনার কাছে। ”
” আমি তোমাকে বলছি। ”
” আমি আমাদের কথা কাউকে বলিনি। নিধি আর আমি কোনোদিন এই কথা প্রকাশ করবো না। আপনি রিদ্দি আপুর সাথে সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে পারেন। ”
” তাহলে তোমার কী হবে? তুমি এভাবে ব্রেকাপ করতে পারো না। ” শাজু কথায় কান না দিয়ে ভিডিও অফ করে গ্যালারিতে গতকাল রাতে সেভ করা ছবিগুলো খুঁজে বের করলো।
ছবিগুলো সঞ্চয়কে দেখিয়ে বলল, ” আমি আপনাকে কখনো আমার সাথে এভাবে মন খুলে হাসতে দেখিনি। আপনার যেমন মেয়ে প্রয়োজন সে আমি না। আপনার সুখ আমার সাথে নয়। আর এমনিতেই আমাদের মধ্যে কিছুই বাকি নেই৷ ফোনে এক মিনিটের বেশি কথা বলতে আমরা পারি না। কথা এগোয় না। আমাদের মাঝে কিছুই সম্ভব না। ” সঞ্চয় খেয়াল করলো শাজু হাসছে কিন্তু চোখ নোনাপানিতে ভিজে আছে। নিধি এতক্ষণ ওর ঘরে ঘাপটি মেরে বসে ছিল৷ এই পর্যায়ে এসে বাধ্য হয়ে ওদের মাঝে উপস্থিত হলো।
” শাজু, চল তোমার বাসায় দিয়ে আসি। আন্টি পরে আবার তোকে রাগ করবে। ”
শাজু উঠে দাঁড়ালে সঞ্চয় হাত টেনে ধরলো। শাজু ঠান্ডা স্বরে বলল, ” হাত ছাড়ুন। আমার আর আপনার মাঝে সবকিছু শেষ। আমি আপনাকে চিনি না আর আপনিও আমাকে চিনেন না। আমার ছবিগুলো ডিলিট করে দিবেন দয়া করে। ” হাত ঝাড়া দিয়ে নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো সে।
মাত্র ছয় সাত মাসের সম্পর্ক। ব্যাপার না, এসব ভোলা তার জন্য মোটেও কঠিন কিছু না৷ ভিডিও ক্লিপ আর ছবিগুলো তো আছেই। যখন খারাপ লাগবে তখন এগুলো তাকে সাহায্য করবে৷

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here