ফেরা পর্ব-৮

0
511

#ফেরা

৮.

” কোন মুভিটা দেখবি? হেই বেবি? ” শাজু কাটা চামচ আর ছুড়ি প্লেটে রাখার সময় নিধির এই প্রশ্নে উত্তর দিল, ” আমার পছন্দ ভালো না। তুই ছবি পছন্দ কর। ”
” কে বলেছে তোর পছন্দ ভালো না? হ্যাঁ? আমি তো কোনোদিন বলিনি। ” নিধি অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে আছে। সঞ্চয়ের বিষয়টা নিয়ে খুব ভাবাচ্ছে তাকে। একটু আগেই ফেসবুকে সঞ্চয়কে ট্যাগ করা হ্যাং আউটের পোস্ট চোখে পড়েছে তাকে। হ্যাং আউটে না গেলে তো ট্যাগ করবে না৷ ভাগ্যিস শাজুর ফেসবুক একাউন্ট নেই। মুখে ঠিকই হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে কিন্তু… তার মনে হলো, শাজুকে রিলেশনে যেতে দেয়াটা অনেক বড় ভুল হয়েছে। সঞ্চয় তার ফ্রেন্ড কিন্তু মানুষের মনের ঠিক নেই।
” মনে নাই, সেই বার্গারের কথা? ছয়শ টাকা পুরোই পানিতে গেছিল। ওর চেয়ে তো রাস্তার পাশের চিকেন চাপ খেলেই ভালো হতো। ” কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে এক জায়গার রাগ আরেক জায়গায় ফেলছে।
” আরে মাঝেমধ্যে এমন হয়ই। তাই বলে চয়েজ খারাপ হতে যাবে কেন? আমার কথা মনে নাই তোর? আমি একবার বিফ কারি অর্ডার করে কী বিপদে পড়েছিলাম! বাপরে, আমার জীবনকার শিক্ষা হয়ে গেছে। ” নিধির বলার ধরনে শাজু হাসতে হাসতে বলল, ” রাতে সাত বার বমি করেছিলি। মনে আছে আমার। আল্লাহ, আন্টি তো আমাকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। ” দুটো হাফ প্লেটে চিকেন চাপ, আর একটা প্লেটে গার্লিক নান সামনের টি-টেবিলে রেখে শাজু জিজ্ঞেস করল, ” সস ছাড়া খাবি? নাকি সস আনবো?”
” সস ছাড়া এই জিনিস কীভাবে খাবো? ”
সস এনে নিধির পাশে ফ্লোরে আরাম করে বসলো।
” বাবাকে খুব মনে পড়ে রে। কতদিন আমাদের বাসায় হাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় না। আম্মুকেও প্রাণ খুলে হাসতে দেখিনা। প্রায়ই অনেক রাতে ঘুম ভাঙে আম্মুর কান্নার শব্দে। ” খুব সাবলীলভাবে কথাগুলো বলল শাজু। কেনো যেন, এই একজনের কাছে সবকিছু এলোমেলো ভাবে হোক আর গুছিয়ে হোক বলা যায়৷
” আন্টি ডিভোর্স দিলো কেনো রে? ” নিধি যতটুকু জানে, মুক্তা নিজেই ডিভোর্স দিয়েছিলেন। আঙ্কেল রাজি হচ্ছিলেন না৷ একপ্রকার জোর করেই ডিভোর্স নেয়া। কারণ কখনো শাজুকে সে বলতে দেখেনি।
” মা আর বাবা কখনোই আমাকে কারণ বলেননি। তবে মামীর কাছ থেকে শুনেছিলাম যে, আব্বু নাকি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। এখন কতটুকু সত্য আমি জানি না। ” নিধির কেন যেন বুক ধক করে উঠলো। শাজু খাওয়ায় ব্যস্ত। কিন্তু নিধির ঠিক খাবার পেটে যাচ্ছে না।

মুভি দেখার একটা বিশেষ মুহূর্তে শাজু টেলিভিশন থেকে চোখ নামিয়ে বলল, ” টেনে দে তো। ” নিধি অবাক হয়ে বলল, ” আমরা এখন বড় হয়েছি। এটুকু দেখতেই পারি। আর এসব জ্ঞান রাখা ভালো। ”
” আমরা এখনো এসএসসি পাশ করিনি। এখনো ছোট। ” প্লেটের শেষ চিকেনের টুকরো মুখে পুড়ে দিয়ে বলল, ” আর ওদিকে ক্লাস নাইনের ইনুটা যে… ” নিধির মুখ চেপে ধরে বলল, ” কে কী করলো জেনে আমাদের কাজ নেই৷ এখন ও গু খাইলে যে আমাদেরও খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ”
শাজুর কথায় নিধি হেসে বলল, ” বলবো না যা। এখন হাত সরা। ”
নিধির মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল, ” আমাকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিবি? নাম আর ঠিকানা গোপন রেখে। ”
” আন্টি জানলে রাগ করবে না?”
” আম্মুকে আমি বুঝিয়ে বলবো। আর সারাক্ষণ পড়তেও ভালো লাগেনা। কতক্ষণ একা একা সময় কাটানো যায়? ফেসবুক একাউন্ট থাকলে তোর সাথে কথা বলা যাবে। ” শাজুকে খোঁচা দিয়ে বলল, ” আসল কারণ সঞ্চয় তাই না?”
” না, ও ব্যস্ত পড়াশোনা নিয়ে। ” কথাটা বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
” কিছু হয়েছে তোদের মধ্যে? ”
” না তো। রিলেশনশিপ এর প্রথম প্রথম একটু বেশিই সবকিছু থাকে কিন্তু সময় গড়ালে একটু একটু করে কমতে থাকে। ” কথাটা বলতে গিয়েও বলল না শাজু।
” না, তো। ” বলে হাসলো।

*****

আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। সবাই সবার প্রতিভা তুলে ধরার চেষ্টায় আছে। নীরবের এক ফ্রেন্ড তার গিটার নিয়ে এসেছে। একসময় সঞ্চয়েরও গিটার বাজানোর শখ ছিলো। কিন্তু বাবার কারণে পারেনি। গিটারে সুন্দর সুর তুলেছে। সেই সুরের সাথে নীরব গান ধরলো ।
” তুই চিরদিন তোর দরজা খুলে থাকিস। অবাধ আনাগোনার হিসেব কেনো রাখিস? ” গান ভালো গায় নীরব৷ সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর নীরব ও তার বন্ধু সবার মাঝখানে বসা৷ রিদ্দি আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ” আমার এই গানে নাচতে ইচ্ছে করছে। ”
” তাহলে নাচ৷ সমস্যা কী?” সঞ্চয়ের কথায় রিদ্দি বলল, ” পার্টনার কই পাব? ”
সে কিছু বুঝে উঠার আগেই রিদ্দি তার হাত টেনে নিয়ে গেল সবার মাঝখানে৷ এই গানের তালে নাচা যায় সঞ্চয়ের ধারণা ছিলো না।

*****
” খাম্মিকে ফোন দিচ্ছ? ” রিদ্দির অদ্ভুত উচ্চারণেও তার বুঝতে সমস্যা হলো না যে, রিদ্দি তার মা’কেই নির্দেশ করেছে।
” না, আমার গফকে। ” তার কথায় রিদ্দি ধাক্কা খেল।
” গফ আছে তোমার? ”
” হ্যাঁ, অনেক কষ্টে ম্যাডামকে রাজি করিয়েছি। ” কিন্তু ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হচ্ছিল না ।
” ফোন রিসিভ করছে না? ”
” না, মনে হয় ঘুমুচ্ছে। ”
” এমনও হতে পারে, অন্য কারো সাথে ব্যস্ত। ” রিদ্দির কথায় সঞ্চয়ের বিরক্তির পাশাপাশি রাগ হলো। ভ্রু কুঁচকে ফেললো সাথে সাথে।
” অন্য কারো সাথে মানে? ” সঞ্চয় এমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে রিদ্দি ভাবতেও পারেনি। গলা চড়িয়ে যেভাবে কথাটা বলেছে তাতে মনে হলো, আর একটা উল্টো পালটা বাক্য উচ্চারণ করলে তাকে গিলে খাবে।
” মানে ইয়ে ওর তো ফ্রেন্ড থাকতে পারে। তাদের কথা বলছি আরকি। ” রিদ্দি অপ্রস্তুত হয়ে বলল। এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি৷ সঞ্চয় তার গফকে নিয়ে অনেক ইনটেনসিভ।
” ওকে নিয়ে কথাবার্তা বলার আগে ভেবেচিন্তে বলবা। ” দ্রুত ম্যাসেজ টাইপ করার সময় বলল।
” ঠান্ডা হও, আমি তোমার গফকে চিনিও না। নাম অব্দি জানি না। ” মুখ ফসকে এমন কথাও বের হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি।
” ওর ছবি দেখতে চাও? তবে প্রমিজ করতে হবে…” সঞ্চয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ” ওর ছবি আমি দেখেছি এটা প্রকাশ করা যাবে না, তাই তো?”
” হ্যাঁ ” ফোনের গ্যালারি ঘেটে একটা কাপল ছবি বের করে দেখালো। রিদ্দির অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল। সে ভেবেছিল, অনেক সুন্দরী কেউ হবে৷ কিন্তু ঠিক উল্টোটা বের হয়েছে। সঞ্চয় বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল, ” জানি, ও সুন্দরী না। আমি জানি। কিন্তু তাই বলে তোমার সত্য গোপন করার মানে হয়না। ”
” আমি ভেবেছিলাম আমার থেকেও সুন্দরী কেউ হবে। ” অবলীলায় কথাটা বলে দিল রিদ্দি। সঞ্চয় হাসতে হাসতে বলল, ” প্রেমিকার রূপের সাথে আমি তুলনা করতে পছন্দ করিনা। সে অনন্য। মান্না দে’র একটা গান আছে। যখনই ওকে দেখি ওই গানের একটা লাইন মাথায় বেজে উঠে। ”
” তুখোড় প্রেমিক তাহলে তুমি। ইশ, আমাদের কেনো যে আগে দেখা হলো না। ” আফসোসের ভান করে বলল রিদ্দি। সঞ্চয় কথা না বাড়িয়ে বলল, ” আমাদের এখন বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া উচিৎ । ”
” আমার তো যেতেই ইচ্ছা করছে না। ”
” তাহলে থাকো। নীরবরা তো আছে। ” সঞ্চয়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল, ” তুমি রাগ হয়েছ? ”
রিদ্দির হাত খুব সুন্দর। আঙুল গুলো দেখলেই লোভ জাগে। শাজুর হাত এতটা সু…তুলনা করাটা ভুল। হাত ছাড়িয়ে বলল, ” রাগ করার যথেষ্ট কারণ কি তুমি দাও নি?”
” সরি, সঞ্চয়। ”
” পরে দেখা হবে, ওকে?”

****
রাত এগারোটা বাজে। সঞ্চয় রাতের খাবার শেষ করে শাজুকে ফোন দেয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিল। কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। কয়েক বার চেষ্টা করে লাভ হলো না৷ ফোন বন্ধ।
হয়তোবা আন্টি ফোন নিয়ে গেছেন। সামনে এক্সাম তাই। আজকে বেশ সুন্দর একটা সময় কেটেছে। মন মেজাজ ফ্রেশ হয়ে গেছে। রিদ্দির প্যারাগ্রাফ আকারের ম্যাসেজ এসেছে কতগুলো পরাপর। এতো পড়তেও ভালো লাগছে না। বাধ্য হয়ে পড়লো সবগুলো ম্যাসেজ। এতো বড় বড় ম্যাসেজের সারমর্ম একটা মাত্র বাক্য। আর সেটা হচ্ছে, ” আমাকে মাফ করে দাও। ভুল হয়ে গেছে। ”
রিপ্লাই দেয়ার আগেই শাজুর নাম্বার থেকে ফোন আসলো। এতক্ষণ পরে ম্যাডামের খোঁজ নেয়ার ইচ্ছা হয়েছে আরকি। রিসিভ করে কিছু একটা বলতে যাবে তখন অচেনা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
” হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। ” সঞ্চয়ের বুঝতে বাকি রইলো না। এই কণ্ঠস্বর শাজুর মায়ের।
” অলাইকুম আসসালাম। ” উত্তর দেয়াটা ঠিক হলো কিনা বুঝতে পারছে না সে।
” এই নাম্বারে ফোন দিচ্ছিলেন কেনো?”
” আপনি বেগম ফুপু না?” এই নাম মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে। শাজুর মা কি সব জেনে গেছে? শাজুর কী অবস্থা তাহলে?
” না, আপনি কেনো ফোন দিয়েছিলেন? ” থমথমে গলায় প্রশ্ন করলো।
” আমি তো ফুপুকে ফোন দিয়েছিলাম। মনে হয় নাম্বার ভুল তুলেছিলাম। ”
” আর ভুলেও ফোন দিবে না। মনে থাকবে?”
সঞ্চয়ের মনে হলো এখন না বললে তাকে গুলি করে উড়িয়ে দেয়া হবে।
” অবশ্যই। ”

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here