ফেরা পর্ব-৭

0
508

#ফেরা

৭.

-অন্য মেয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ওকে কষ্ট দিবে।
– ও জানবে কীভাবে? ও তো কোনো সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টেড নাই। তাহলে?
– বাদ দে না নীরব। একটা বুদ্ধি দে তো।
– বল।
– ওর জন্মদিন আগামী সপ্তাহে। কী গিফট দেয়া যায়?
– শিশু টিকা গিফট দিতে পারিস।
– ফাজলামি না।
– ওসব খ্যাত মেয়েদের পছন্দ আমার জানা নেই। কারণ আমি খ্যাত না।

নীরবের বলা শেষের কথাটা সঞ্চয়ের কাছে বেশ খারাপ লাগলো। শাহাজাদী খ্যাত হোক আর যাইহোক প্রচন্ড ভালোবাসে। এটা ঠিক ওর কাছে শাহাজাদী কিছুই না কিন্তু…… থাক এসব চিন্তা না করাই ভালো।

মানুষের মনের পরিবর্তন কখন আসে সেটা জানা মুশকিল। এমনও হয় সারাজীবনেও পরিবর্তন আসেনা আবার অনেকের সেকেন্ডের মধ্যেই পরিবর্তন চলে আসে।
রাফিয়া রিদ্দির প্রোফাইলে ঘোরাঘুরি করার সময় শাড়ি পড়া একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো সঞ্চয়ের। শাড়িতে যেকোনো মেয়েকেই সুন্দরী লাগে। রাফিয়াকে একটু বেশি সুন্দরী লাগছে। মেয়েটা তাকে নাকি পছন্দ করে? এতো সুন্দরী মেয়ে তাকে পছন্দ করে যেহেতু একটু কথা বললে সমস্যা কী? শাজু তো আর জানতে পারছেনা।
ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দেয়ার সাথে সাথেই একসেপ্ট হলো। সঞ্চয় নক করলো। বেশ সুন্দর করেই মেয়েটা কথা বলে। শাহাজাদী এতোটা পারেনা।শাহাজাদী লজ্জা পেয়েই তো কূল পায়না আর তো গুছিয়ে কথা বলা!
চ্যাটিং করার সময় শাহাজাদী ফোন দিলো। ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে শাজু বললো
– আপনি খুব ব্যস্ত তাই না?
মিথ্যে বলার আগে একটু নিজের ভেতরে গুছিয়ে নিতে হয়। সঞ্চয় গুছিয়ে নিয়ে বললো
– হ্যাঁ, সামনে এক্সাম বুঝতেই পারছো।
– আচ্ছা ঠিক আছে রাখি।
সঞ্চয় সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। শাজু অবাক হলো। ফোন রাখতে চাইলে সঞ্চয় রাখতে দেয়না। এই কথা সেই কথা বলে দেরি করিয়ে দেয়। কিন্তু আজকে বলার সাথে সাথেই কেটে দিলো?
আমার উপর রাগ হয়েছে নাকি? শাজু আবার ফোন করলো। সঞ্চয় ফোন কেটে দিয়ে চ্যাটিং এ ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
শাজু এবার আরো চিন্তিত হয়ে পড়লো। সঞ্চয় তো কখনো এমন করেনা। আবারও ফোন দিলো, সঞ্চয় রিসিভ করে প্রায় ধমকে উঠে বললো
– বললাম না ব্যস্ত আছি। বারবার ফোন কেটে দিচ্ছি। কারণটা মাথায় আসেনা?
শাজু ফোন কেটে দিয়ে মুখ বালিশে চেপে কাঁদতে শুরু করলো।
স্বাভাবিকভাবে বললেই পারতো। কিন্তু এভাবে ধমকে উঠার কী হলো?
ও আর সেধে ফোন দিবেনা। কথাও বলবেনা। থাকুক সে তার ব্যস্ততা নিয়ে।

মোবাইলের চার্জ যখন ১% তখন সঞ্চয়ের সাথে রিদ্দির চ্যাটিং অফ হলো। কারণ মোবাইলে চার্জ নেই। সঞ্চয়ের মন বলছিলো – ইশ এমন মোবাইল যদি থাকতো যার ব্যাটারির চার্জ কখনো ফুড়াবে না। রিদ্দিকে তার মনে ধরেছে। সমবয়সী হওয়াতে চিন্তাভাবনারও মিল পাওয়া গেছে। মোবাইল চার্জে দিয়ে রুম থেকে বের হওয়ার সময় বিছানার উপর পরে থাকা গিফটের দিকে চোখ দুটো আটকে গেলো। আগামী সপ্তাহে জন্মদিন। গিফট শপ থেকে একটা বার্থডে কার্ড আর ছোট্ট একটা টেবিল ঘড়ি কিনেছে সে। শাজুর পছন্দ হবে কিনা তার সন্দেহ হচ্ছে। রিদ্দির নাম্বার থেকে ফোন আসাতে শাজুর চিন্তা থেকে বের হয়ে এলো। ফোন রিসিভ করতেই রিদ্দি বলল, ” তুমি বিকালে ফ্রি আছো? ” সঞ্চয়ের আজকে বিকালের পড়া শেষ করে শাজুর কোচিং সেন্টারের সামনে যাওয়ার কথা। পাঁচ দশ মিনিটের মতো সেখানে পাশাপাশি হাঁটার পায় তারা।
” হ্যাঁ, ফ্রি আছি। ” কেনো মিথ্যা সে বলল জানে না। ভুল, সে আসলে মিথ্যা বলেনি। একদিন দেখা না করলে তেমন কিছু কারোরই যায় আসবে না। আর সে তো ফ্রেন্ড হিসেবে ঘোরাঘুরি করবে। প্রেম তো আর করছে না।
” তাহলে চলো না, আমরা ফুসকা আড্ডায় যাই? ” টিএসসির মোড়ে ফুসকা আড্ডার খবর ফেসবুকের পোস্টে দেখেছিল। পড়াশোনার চাপে তার অবস্থা খারাপ। দম বন্ধ লাগছে কয়েকদিন যাবত। একটু আড্ডা দিলে এই দমবন্ধ ভাবটা যাবে। যদিও তাকে নিষেধ করার কেউই ঢাকায় নেই। বাবা – মা গ্রামে থাকেন। বড় ফুপুর বাসায় পড়াশোনার জন্য থাকা। বড় ফুপু তাকে কলিজার টুকরো জানেন৷ বংশের একটাই ছেলে, তাকে কি হেলাফেলা করা যায়? ফুপা থাকেন চট্টগ্রামে। তাদের দুই মেয়ের কয়েক বছর আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখানে স্বাধীন দেশের নাগরিকের সুবিধা খুব ভালো ভাবেই ভোগ করে। ফুপু তাকে কখনো না করবেন না৷ শাজুকে একটা কিছু বলে দিলেই হবে।
” ঠিকাছে, আমার পড়া আছে। আমি ওখান থেকেই যাবো। ” রিদ্দি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলল, ” তাহলে তো সেখানে আমরা প্লেসই পাবো না। একদিনের জন্য পড়া বাদ দাও। নীরবও তো বাদ দিবে৷ সমস্যা কোথায়?”
” সামনে এক্সাম, এখন বাদ দিলে তো ঝামেলায় পড়বো। ” সঞ্চয়ের প্রাইভেট বাদ দেয়ার অভ্যাস নেই।
” একটা দিন মাত্র, সঞ্চয়। আমার জন্য একটা দিনের কিছু সময় কি তোমার হবেনা? ” কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল রিদ্দি।
” আরে আরে কাঁদছ কেনো? আচ্ছা ঠিকাছে আমি আজকে প্রাইভেটে যাবো না। ”
” আমার বাসা তো কাছেই তোমার বাসা থেকে। আমি রেডি হয়ে থাকবো। তুমি বাসার নিচে এসে ফোন দিও। ” সঞ্চয়ের বেশ বিরক্তি লাগছে। এখন একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? না’ই বা কীভাবে বলবে!
” ঠিকাছে, আমরা তিনটার পরপর বের হই?”
” থ্যাংক ইউ। ” রিদ্দি বাচ্চাদের স্বরে বলল। মেয়েটা দারুণ সুন্দর করে কথা বলে। কোন সময় কোন ধরনের ভঙ্গি করতে হয়, সেটাও তার জানা। নীরব ভুল কিছু বলেনি।

***

রিদ্দির বাসার সামনে রিক্সা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ যাবত অপেক্ষায় আছে সঞ্চয়। মেয়েদের এই এক সমস্যা। পাঁচ মিনিটের নাম করে পনেরো মিনিট পার করে দিয়েছে। রিক্সা ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে। টাকার সমস্যা নেই। কিন্তু মা’র কাছে তার কড়া জবাবদিহি করতে হয়। ঝামেলাটা এখানেই। বিশ মিনিটের মাথায় রিদ্দি গেটের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে তাকে হাত নেড়ে ইশারায় হাই বলল। সঞ্চয়ের মনে হলো সে চোখে ধাঁদা দেখছে। কচুরি রঙের কামিজের সাথে সাদা রঙের ওড়না আর পায়জামা। ওড়নায় আবার কচুরি রঙের ফুল আর সবুজ পাতার নকশা আঁকা। এক হাতে চিকন চেইনের সাথে হার্ট শেপের সাদা পাথরের ব্রেসলেট। আরেক হাতে ঘড়ি। চোখে গাঢ় করে কাজল নিয়েছে আর নাকে ছোট্ট পাথরের নাকফুল। কোমড় অব্দি চুল ছেড়ে দেয়া। এমনিতেই ফর্সা তার উপর এই রঙে তো স্বর্গের অপ্সরা মনে হচ্ছে। এতো সুন্দর মেয়ে তাকে পছন্দ করে? হাসতে হাসতে রিক্সার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ” সরি, একটু অপেক্ষা করতে হলো তোমাকে। ”
” একটু বিরক্তি লেগেছিল কিন্তু তোমাকে দেখার পরে মনে হলো অপেক্ষা করাটা বৃথা যায়নি। ” রিদ্দি সঞ্চয়ের গাল টেনে বলল, ” তোমাকে আজকে বেশ কিউট লাগছে। কারণ কী বলোতো? আর ফতুয়াটা তো দারুণ মানিয়েছে তোমাকে! ”
ফতুয়ার দিকে তাকাতেই সঞ্চয়ের মেজাজ পরিবর্তন হয়ে গেল। এই ফতুয়া শাজুর পছন্দ না । ওর কারণে এতো পছন্দ করে কেনা ফতুয়াটা পরাও হয়না।
” থ্যাংক ইউ ” রিদ্দি এখনো হাসছে। সঞ্চয়ের মোবাইলে টুং করে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখল গ্রামীণ অফিসের অফার ম্যাসেজ। দুপুরের দিকে প্রায়ই শাজু ম্যাসেজ দিয়ে খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে। আজকে করেনি। মনে হয় ওর মা বাসায়। একটা কিছু যুক্তি না দিলে তো নিজেকে দোষী হতে হয়! এই কথাটা মানুষ সরাসরি স্বীকার না করলেও, কাজে ঠিকই লাগায়।
বাসা থেকে টিএসসিতে যাওয়ার পুরোটা সময় দু’জন বেশ গল্প করলো। শৈশবের ঘটে যাওয়া মজার মজার ঘটনা গুলো শেয়ার করার সময় রিদ্দি হাসতে হাসতে সঞ্চয়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল, ” আমার ঘুম আসছে। ”
” তাহলে কি আড্ডায় যাবে না?” সঞ্চয়ের একটু অভিমান হলো রিদ্দির উপর। এভাবে আশা জাগিয়ে, সেই আশায় পানি ঢালার মানে টা কী?
” না, মাথা খারাপ নাকি৷ ওখানে সবাই আমাদের অপেক্ষায় আছে৷ ”

***
নীরব, সঞ্চয় আর রিদ্দিকে একসাথে দেখে মনে মনে হাসলো। শালা, শুধু নীতিমালা কপচাতেই জানে। দু’জন বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবে হেঁটে আসছে। একটা ছবি না তুললে হয়! শাজু নাকি কষ্ট পাবে৷ আমার চ্যাটের প্রেম করে আর সেই প্রেমে গলেও পড়ে।

***
” নিধি, আমার বাসায় একটু আসতে পারবি?” শাজুর কথায় নিধি মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ” তুই তো একটু পরেই সঞ্চয়ের সাথে চলে যাবি। আমি তোদের সাথে গেলে তো কাবাব মে হাড্ডি হয়ে যাবো রে। ”
” আজকে আসবে না রে। ম্যাসেজ দিয়েছিল, ওর ফুপু নাকি অসুস্থ। ” শাজুর কথায় নিধির খটকা লাগলো। ওর ফুপুকে তো সে বিন্দাস মেজাজে পাশের ফ্ল্যাটের আন্টির সাথে গল্প করতে দেখেছে৷ কোচিং এ আসার আগেই দেখেছে।
” ওহ, আচ্ছা তাহলে চল যাই তোর বাসায়। এবার কিন্তু আমি শুকনা নুডুলস খাবো না। অন্যকিছু খাওয়াবি। যাওয়ার সময় ফাস্টফুড কিনে নিয়ে যাবি। তারপর একসাথে বসে একটা জোশ মুভি দেখবো আমরা। ” শাজু হাসতে হাসতে বলল, ” যাতে আবার আমার ধোলাই হয় তাই না?”
” তো কী? মুভিটা তো সুন্দর ছিল। তুই তো হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছিলি। মানুষ আসলেই অকৃতজ্ঞ। উপকারের প্রতিদান দেয় না। ” শাজুর হাসির মাত্রা বেড়ে গেল। সকাল থেকে মন খুব একটা ভালো ছিল না। এখন মনে হয় ঠিক হয়ে গেছে। মন খারাপ একটা না একটা সময় ঠিক হয়েই যায়।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here