ফেরা পর্ব-১৩

0
523

#ফেরা

১৩.

” কিছু বলছ না যে? আমাকে ভয় করো না৷ আমি আমার মায়ের মতো রাগী নই। ”
ঘোমটার মধ্যে থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না। মেয়েটা কি আবার বিষ টিষ খেল নাকি? পূর্ব প্রেমিকের সাথে বিয়ে না হওয়াতে প্রেমিকা বিষ পান করে আত্মহত্যা। এইরকম আর্টিকেল প্রায়ই চোখে পড়ে। কিন্তু বাসরঘরে যদি ডেডবডি উদ্ধার হয় তাহলে তো তার উপর নববধূ খুন করার অভিযোগ আসবে। হায় হায়, তার ক্যারিয়ারে লাল দাগ লেগে যাবে! বিছানায় শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠলো মামুন। ভয় লাগতে শুরু করেছে। সামনে থাকা ঘোমটা টানা বউকে দেখে তার একটু আগে কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না। কিন্তু এখন ভয় লাগছে। নতুন বউকে দেখে তার ভয় লাগছে! ব্যাপারটা হাস্যকর। তার ফ্রেন্ডরা জানতে পারলে ক্যাম্পাসে মান ইজ্জত থাকবে না কিছু! মোবাইল থাকলে ফ্রেন্ডদের সাথে যোগাযোগ করা যেত। বাসররাতে কীভাবে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। চারপাশের অন্ধকার বেড়ে যাচ্ছে। মোমবাতির আলোও কমে যাচ্ছে। ঝড়ের গতিও বাড়ছে। মনে হচ্ছে আশেপাশের সব কিছু ধ্বংস করে দিবে। একটা জানালার পাল্লা খোলা। আর সেটা দিয়ে পানি এসে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার ধারে এগিয়ে গেল। পাশের হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ নাকে আসলো। পছন্দের ফুলের ঘ্রাণ তাকে পুরনো স্মৃতিতে নিয়ে গেল। শাজু তার জন্য ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে হাসনাহেনা ফুল দিয়েছিল। এই ফুল জোগাড় করার জন্য বেশ কাঠকয়লা পোড়াতে হয়েছিল। সময় কতো দ্রুত যায়। মানুষটা এখন তার কাছে শুধুই কতগুলো স্মৃতি। স্মৃতি ছাড়া তার অস্তিত্ব এখন নেই। এখনো মেয়েটার হাসিমুখের ছবি ভাসে । তাকে সামনে পেলেও এখন আর লাভ নেই। সে অন্য এক মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে। এই মেয়ের তার উপর অধিকার আছে। এই অধিকার অন্য কারো ছিল কিন্তু এখন…

তাহিরার অসহ্য লাগছে। হঠাৎ করে সঞ্চয় এভাবে সামনে আসবে কল্পনাও করতে পারেনি। হ্যালুসিনেশনের কোনো অর্থ পাচ্ছে না। সামনে থাকা মানুষটার কথাবার্তার ধরন, হাঁটাচলা সঞ্চয়ের মতো। এমন কেনো হচ্ছে! এদিকে ঘোমটা খুলতেও পারছে না৷ চাচী কড়াকড়ি ভাবে বলে দিয়েছেন, ” জামাই ঘোমটা না খোলা অব্দি তুই কিন্তু আসন পেতেই বসে থাকবি। ”
অরগাঞ্জা সিল্কের উপর এম্ব্রয়ডারি করা শাড়িতে শরীর কুটকুট করছে। চুমকির কারণে হাতের কয়েক জায়গায় কেটেও গেছে। সকাল থেকে পেটে তেমন খাবারও পড়েনি। আর বিয়ের খবর পেয়ে তো আরো খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল। শ্বাশুড়ি আম্মা তাকে জোর করে কয়েক লোকমা পোলাও খাইয়ে দিয়েছিলেন। সেটুকুই ভরসা এখন। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসাতে তাহিরার ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। বিছানায় পায়ের কাছে নতুন কাঁথা রাখা। আসন থেকে উঠে কাঁথা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে বসলো। তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা তার স্বামী কিছু একটা বলল। সে না চাইতেও ওইদিকে তাকাল৷ ঠিক ওইসময় বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে কিছু একটা দেখলো। সঞ্চয়ের অবয়ব, সেই চোখ, মুখের গড়ন, নাক, ঠোঁট। শুধু চুলের ধরনটা ভিন্ন। সে পুরো পাগল হয়ে গেছে৷ এমন হতে পারে না৷ মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না৷ হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। হৃদস্পন্দন বেড়েই চলেছে৷ সে পুরোপুরি পাগল হয়ে যাচ্ছে।
তাহিরাকে মাথা চেপে ধরে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে মামুন এগিয়ে আসলো ।
মেয়েটা এমন করছে কেন? বাড়ির সবাইকে ডাকবে নাকি? কিছু হয়ে গেলে সে বিপদে পড়বে।
” তোমার কিছু হয়েছে? গরম লাগছে? ” কী বোকার মতো প্রশ্ন করে বসেছে সে। গরম লাগার কোনো কারণ নেই। মেয়েটার ঠান্ডা লাগছে তাই কাঁথা জড়িয়ে আছে।
” আপনি কেনো এসেছেন? ” মামুন স্বাভাবিকভাবে বলল, ” আজকে আমার বাসররাত তাই এসেছি৷ ” কণ্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগছে তার।
” আপনি আমার ঘোমটা খুলুন আর আমাকে ঘুমানোর অনুমতি দেন৷ ” খুব দ্রুত কথাগুলো বলল। মামুন পাশে বসে ঘোমটা খুলে দিল। ঘোমটা খোলার সাথে সাথে তাহিরা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে আলনার দিকে গেল। এই শাড়ি পালটে নিতে হবে। রাতে ঘুম ভালো হলে হ্যালুসিনেশন দৌড়ে পালাবে।

*****

মামুনের ঘুম ভাঙলো কড়া রোদ মুখের উপর পড়াতে। রাতে ঘুম ভালো হয়নি। তাহিরা পাশেই গভীর ঘুমে ছিল। মেয়েটা ওভাবে কথা কেনো বলেছিল আর অস্বাভাবিক আচরণও বা কেনো করেছিল বুঝতে পারছিল না। তার ভয়ও কাজ করছিল। উল্টো পালটা কিছু করে না বসে এই ভয়!
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ঘর থেকে বের হলো। বউকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। বাহিরে ঝড়ও থেমে গেছে৷ লায়লা ছেলেকে ডাকতে এদিকেই আসছিলেন। মামুনকে আসতে দেখে গলা নামিয়ে বললেন, ” এতো বেলা করে কেউ ঘুম থেকে উঠে?”
” আরে নতুন জায়গায় ঘুম আসছিল না। তাই আরকি! ”
” গোসল না করে বের হইছিস ক্যান? ”
” এখন গোসল কেন করবো? আজব তো! ” লায়লা ছেলের কান টেনে বললেন, ” বউ গোসল করেছে সাত সকালে। গোসল না করলে মানুষ কী বলবে? ”
” মা, ও গোসল করেছে ভালো করেছে। এর সাথে আমার গোসলের সম্পর্ক কোথায়?”
” আমি কি এখন তোরে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বোঝাব?” লায়লার কথায় মামুন এবার বুঝতে পারলো। তার মা কোন গোসলের কথা বলেছেন।
” কিন্তু আমি তো তার হাতও ধরিনি৷ ”
” তো তোমাকে বিয়ে করিয়েছি কি বউয়ের মুখ দেখার জন্য?”
” মোমবাতি শেষ হয়ে গিয়েছিল আর টর্চও ছিলো না৷ তাই চেহারা দেখতে পারিনি। চেহানা না দেখে কিছু করা যায় নাকি?”
” মোমবাতি চাইলেও তো পার‍তি। ”
” এরপর থেকে চেয়ে নিব। ”

*****

ঘুম থেকে উঠে পাশে যাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখেছে তার চেহারা সঞ্চয়ের মতোই। তাহিরা দ্রুত পাশ থেকে সরে গিয়ে গোসল করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। তারপর কড়া করে ব্ল্যাক কফি বানালো নিজের জন্য৷ যাতে নিজের মস্তিষ্ক ঠিক থাকে। কিন্তু কাজ হলো না। শ্বাশুড়ি আম্মা আর মামুনের কণ্ঠস্বর রান্নাঘরের দিকে ভেসে আসছে। আর সেই কথোপকথন শুনে তাহিরার মলে হলো সে পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। এখন কী করবে সে?

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here