ফেরা পর্ব-১৪

0
513

#ফেরা

১৪.

লাল রঙের ব্লক প্রিন্টের হাফসিল্ক শাড়ি আর সুতার কাজ আছে। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে নিল তাহিরা। মামুনের চেহারার দিকে তাকানো যাবে না৷ সঞ্চয়ের অবয়ব এখন চোখে পড়লে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে এবার। এমনিতেই গতরাতে তার হ্যালুসিনেশনের কারণে স্বামীর সাথে বেয়াদবি করা হয়েছে৷ লোকটা তার আচরণে ভয় পেয়েছিল। ঘোমটা খোলার সাথে সাথে লাফ দিয়ে সে সামনে থেকে সরে গেছিল। শত হলেও তার স্বামীর। তার অধিকার আমার উপর আছে। কিন্তু মনের কোথাও এখনো অতীত ঘাপটি মেরে বসে আছে। সেই অতীত এখন বর্তমানের উপর জুড়ে বসে আছে৷ ভাবতেই কেমন অস্থির লাগছে। ভেতরের ধুলা জমা ক্ষতে নতুন করে কেউ একজন এসে…
মামুন ও লায়লা রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ মনো তাদেরকে আসতে দেখে বললেন, ” আপনারা এখানে কষ্ট করে আসতে গেলেন কেনো? ওকে তো এখনই নাস্তা দিয়ে পাঠাচ্ছিলাম। ” লায়লা ছেলেকে রেখে রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে তাহিরার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ঘোমটা খুলে দিয়ে বললেন, ” আমরা আমরাই তো। এতো বড় ঘোমটা টানার প্রয়োজন নেই। ” তাহিরা দ্রুত তার চোখ নামিয়ে ফেললো। মস্তিষ্কের কল্পনাকে পাত্তা না দিলে একসময় এই কল্পনা বন্ধ হয়ে যাবে৷ মামুন অন্য খেয়ালে ছিল। বউয়ের চেহারা দেখার প্রতি তার বিশেষ কোনো খেয়াল নেই। বিয়ে তো হয়েছেই। সারাজীবন এখন তাকে দেখতেই হবে৷ এখন যেহেতু তাহিরা লজ্জা পাচ্ছে। তাহলে তাকে আর লজ্জায় ফেলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার তাকাতে কষ্ট হচ্ছে৷ এই মেয়ের সাথে শাজুর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিতে মিল আছে৷ পুরনো স্মৃতি সে আর আসতে দিতে চায়না। সে রান্নাঘরের সামনে থেকে সরে বেলকনিতে গেল। সেখানে তার বাবা আর চাচা শ্বশুর গল্পে মেতে আছে। টি-টেবিলের উপর নিউজপেপার রাখা৷ বেতের সোফায় বসে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
” চাচা, আশেপাশে কোথাও মসজিদ আছে?” মামুনের প্রশ্নে আজহারুল খানিকটা অবাক হলেন৷ এখন তো নামাজের সময় না৷ তাহলে কী করতে যাবে?
” এই ডানের মোড় ঘুরলেই মসজিদ। নফল পড়তে চাইলে ঘরে পড়ো। তাহিরা তোমাকে সব ব্যবস্থা করে দিবে৷ ” মামুন খবরেরকাগজ রেখে বললেন, ” আমি একটু মসজিদ থেকে আসছি। হুজুর তো এইসময় থাকেন না?”
” কী ব্যাপারে জানতে যাও? আমারে বলো আমি উত্তর দেই। কষ্ট করে মসজিদে যেতে হবে না। ” মামুন মাথা নিচু করে বলল, ” চাচা, কিছু ব্যক্তিগত বিষয়৷ বুঝেনই তো প্রথম বিবাহ করেছি। আপনি শ্রদ্ধেয় মানুষ। আপনার কাছে এসব জিজ্ঞেস করি কীভাবে? ” মামুন মেকি লজ্জা পাওয়ার ভান ধরলো। মিজান মোল্ল্যা ছেলের লজ্জা পাওয়া দেখে বিস্ময়ের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেলেন। মনে হচ্ছে নতুন কাউকে দেখছেন ৷ বিয়ের এক রাতেই ছেলের এতো পরিবর্তন! মেয়ের হাতে জাদু আছে৷ লায়লা এই পরিবর্তন দেখতে পারলে কী করবে ভাবাই যায়না!
আজহারুল নিজেই লজ্জা পেলেন। ভাতিজীর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলার ইচ্ছাও তার নেই।
” তাহলে যাও। ইমাম সাহেব এই সময়ে থাকেন। ”

মামুন যা পরিধানে ছিল সেই অবস্থায় বের হয়ে গেলো।

*****

” ইমাম সাহেব, আপনার কাছে আমার ব্যক্তিগত একটা বিষয় সম্পর্কে জানাব৷ আপনি আমাকে এই বিষয়ে কোনো হাল বা উপায় খুঁজে দিতে পারবেন?” ইমাম সাহেব ষাটোর্ধ্ব একজন নরম স্বভাবের মানুষ। কথা কম বলতে পছন্দ করেন। কেউ পরামর্শ চাইতে আসলে তার সাধ্যের মধ্যে হলে তিনি কখনো ফিরিয়ে দেন না।
” বাবা, তুমি বলো তোমার গল্পটা। আমার সাধ্যের মধ্যে হলে আমি পরামর্শ দিব৷ ” ইমাম সাহেবের কথায় মামুন স্বস্তি পেল। ইমাম সাহেব মসজিদের পাশের ছোট্ট ঘরের খাটের ওপর বসে আছেন৷ ঘরে চা ছাড়া কিছুই নেই যে দিবেন। লাল রঙের টুলে বসা ছেলেটা খুবই দুশ্চিন্তায় আছে৷
” আমার বয়স যখন ১৮ তখন আমি একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলাম৷ মেয়েটাকে আমি অনেক বেশিই ভালোবেসে ছিলাম। ছিলাম বলা ভুল হবে, এখনো বাসি। কিন্তু আমার একটা ভুলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়৷ আর মেয়েটার সাথেও আমার সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আমি অবশ্য অনেক চেষ্টা করেছি সেই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করতে। তাকে ছাড়া আমি অন্য মেয়েকে কখনো জীবনসঙ্গী হিসেবে কল্পনাও করিনি। কিন্তু হঠাৎ করে মা’য়ের জোড়াজুড়িতে আমাকে গতকাল বিয়ে করতে হয়েছে। এখন সমস্যা হচ্ছে, আমি আমার স্ত্রী’র কাছে যেতে পারছি না। তার তো আমার উপর অধিকার আছে। কিন্তু আমি তো অধিকার পালন করতে পারছি না। আমি যখনই স্ত্রী’র কাছে যাই তখনই ওই মেয়ের কথা মনে পড়ে। আমি কোনোভাবেই ওই মেয়েকে ভুলতে পারছি না। উল্টো স্ত্রী’র দিকে তাকালে ওই মেয়ের কথা মনে পড়ে। আমি কী করবো এখন? ওই মেয়ের সাথেও আমার কোনো সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না। কারণ সে কোথায় আছে সেটাও আমার জানা নেই। আমি এখন কী করবো? আমি কীভাবে আগের মেয়েকে ভুলবো? ”
ইমাম সাহেব কিছু সময় চুপ থেকে বললেন, ” বাবা, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন৷ আল্লাহ জানেন কোথায় তোমার শান্তি। যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে সেহেতু তো আর কিছু করার নেই। তালাক দেয়া যায় কিন্তু এটা তো সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জায়েজ। যেহেতু তোমার মা পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছেন সেহেতু একটা বিষয় তোমাকে বুঝতে হবে। মা বাবারা তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জন্য পাত্র পাত্রী ঠিক করেন। যেসব অভিজ্ঞতা তোমার বয়সী যুবকদের থাকার কথা না। এই মেয়ের মধ্যে হয়তোবা তোমার জন্য আল্লাহ শান্তি রেখেছেন। তুমি ভাবছ যে, ওই মেয়েকে পেলে সুখী হতে পারবে। প্রেম করা আর বিয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য, বাবা। বিয়ে অর্থ শুধু ভালোবাসা না, দায়িত্ব, দু’জনের মধ্যের বন্ধুত্ব, একে অপরকে বোঝা আরো অনেক কিছু। একজন ভালো প্রেমিকা তোমার জন্য ভালো স্ত্রী নাও হতে পারে। এজন্যই আল্লাহ তোমার জন্য অন্য একজন নারীকে নির্ধারন করেছেন। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তোমার থেকে অনেক বেশি জানেন, বোঝেন। তাই যাকে পেয়েছ তাকে নিয়ে সুখী হওয়ার চেষ্টা করো। তার সাথে সময় ব্যয় করো, একসাথে খাওয়া দাওয়া করো, ঘুরতে যাও, ঘনিষ্ঠ সময় কাটাও। একটা সময় ওই মেয়ের কথা ভুলেই যাবে তুমি। ” ইমাম সাহেব থামার পরে মামুন অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকালো ।
মামুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ” বাবা, প্রেম করা হারাম। তুমি আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কে জড়িয়ে যাও। স্ত্রীকে সময় দাও। দেখবে আল্লাহ তোমাকে সুখী করবেন। ”
” আমি চেষ্টা করবো। ” কোনোমতে শব্দ তিনটা উচ্চারণ করলো।

*****

মামুন ঘরে ঢুকে দরজাটা ভালো করে আটকে নিল। যেহেতু ভাগ্যে শাজু তার নেই সেহেতু আর কী করার! সারাদিন তাহিরার সাথে সামনা-সামনি দেখা হয়নি৷ মেয়েটা তার থেকে এক প্রকার পালিয়ে বেড়িয়েছে। আজকেই তাদের চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মনোর অনুরোধে থাকতে বাধ্য হলো। জানালার ধারে গ্রিল ধরে তাহিরা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা আটকানোর শব্দ পেয়ে পেছনে তাকাল। মামুন চমকে গেল। চেহারার অনেকটা অংশ পুরো শাজুর। এটা যদিও সম্ভব হতে পারে কিন্তু তাই বলে তার স্ত্রী’র ক্ষেত্রে কেন এমন হবে? সে অতীতকে নিয়ে আর কতদিন এভাবে কাটিয়ে দিবে? কম তো চেষ্টা করেনি শাজুর সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু পারেনি! দুজনের ভাগ্য দুই দিকে চলে যাবে, এটাই লেখা ছিল।
” তুমি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলে কেন?” মামুন পরিবেশ হালকা করার জন্য প্রশ্নটা করলো হাসি মুখে৷। শাজু ঘোমটা পুরোপুরি খুলে দিয়ে বলল, ” আপনি এখানে কেন এসেছেন?” পালিয়ে থেকে লাভ হয়নি। হ্যালুসিনেশন এভাবে ঠিক হবেনা। তার এই কল্পনার মানুষের সাথে কঠোর হতে হবে৷ তাহলে সঞ্চয়ের অবয়ব পালাবে৷
” এই বাসায় আমাকে এই ঘর ছাড়া অন্য ঘর দেয়নি ঘুমানোর জন্য। আর তুমি আমার স্ত্রী। তোমার কাছে আমি আসবো না। ” তাহিরা কর্কশ গলায় বলল, ” আমার স্বামী হচ্ছেন মামুনুর রশীদ। আপনি নন। আপনি.. ” তাহিরা থামলো। হঠাৎ করে শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না সে।
মামুন কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে তাহিরার মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর বলল, ” আমিই মামুনুর রশীদ। যদিও এই নাম আমার পছন্দ না৷ ”
” না, আপনি সঞ্চয়। আমি আপনাকে ইগ্নোর করছি বলেই আমার স্বামীর নাম বলে আমার কাছে আসার চেষ্টা করছেন। ” মামুন আরেকটু কাছে গিয়ে স্ত্রীর কপালে ডান হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলো। অনেক মেয়ের বিয়ের ভয়ে নাকি জ্বর চলে আসে। আর সেই জ্বরের কারণে আবোলতাবোল বকতে শুরু করে। তার স্ত্রীর ক্ষেত্রেও হয়েছে কিনা এটা জানার জন্যই কপালে হাত রাখা। সাথে সাথে তাহিরা ধাক্কা দিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল, ” আপনি কেনো ফিরে এসেছেন অতীতের স্মৃতি থেকে? ছয় বছর আগের অতীত আমি বর্তমানে সহ্য করতে পারবো না। আপনি আমার হ্যালুসিনেশন থেকে চলে যান, সঞ্চয়। আপনার সাথে আমার কোনোদিনও কিছু হবে না। ” মামুনের মনে হলো সে ভুল শুনছে। এই মেয়ে এভাবে কেনো বলছে? ছয় বছর আগে…মানে কী? শাজুকে শেষ যেবার দেখেছিল তখন তার বয়স ষোলো বছর হবে। তাহিরার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে৷ তার মনে পড়লো, শাজু শেষ বার তার সামনে এভাবেই কেঁদেছিল!

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here