বর্ষা দুপুর (পর্ব-৮)
#হালিমা রহমান
সময় কত দ্রুত চলে যায়! রেদোয়ান যাওয়ার পর কেটে গেছে ছয় মাস।ছয় মাস! অনেকটা সময়।সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে বহু কিছু।রিমার বিয়ে ভেঙে গেছে।রিমার বাবার প্রবল আগ্রহ থাকলেও অনিচ্ছুক ছিলেন রিমার মা।তিনি কিছুতেই বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন না।তাছাড়া, ছেলে বিদেশে ছিল বহু বছর।রিমার সাথে তার বয়সের পার্থক্য অনেক।রিমার মা যখন মেয়ে বিয়ে দিতে আপত্তি জানালেন তখন রিমার বাবা কি তান্ডবটাই না করেছিলেন।তিনি কষ্ট করে মানুষ করেছেন এখন বিয়েও দেবেন তিনি।এখানে রিমার মা কেন কথা বলবে? এতো বড় সাহস তাকে কে দিলো?ইশ! কী ঝামেলাটাই না হয়েছিল কয়েকটা দিন।
রেদোয়ান যাওয়ার পর কারো সাথে যোগাযোগ করেনি।এমনকি ইশরাকের সাথেও না।এ নিয়ে অবাকের শেষ নেই কুসুমের।একটা মানুষ এভাবে হাওয়া হয়ে যায় কি করে? ঢাকা কী জাদুর শহর? নীরা নির্বিকার।যেন এটাই হওয়ার ছিল।কুসুম প্রায়ই নীরার সামনে রেদোয়ানের কথা তুলে।সে অবাক কন্ঠে নীরাকে প্রশ্ন করেঃ” নীরাপু,তুমি কী ভবিষ্যতের কথা জানতে? তোমার কথা কীভাবে মিলে গেল?”
নীরা তখন মুচকি হাসে।বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলেঃ” এটাই হওয়ার ছিল, কুসুম।তিনি নিশ্চয়ই এতোদিনে চাকরি পেয়েছেন।চাকরি না পেলে গ্রামে চলে আসতেন।তিনি এখন তার সমকক্ষ একজন খুঁজবেন।আমি তো তার সমকক্ষ নই।”
ক্ষোভ জমে কুসুমের মনে।মাত্র ছয় মাসে যে ভুলে যায়,সে কী করে এতো ইনিয়ে বিনিয়ে চিঠি লিখে? আবার বলে ফিরে আসবে! এই কী ফিরে আসার নমুনা?রেদোয়ানকে এখন কুসুমের ঠকবাজ মনে হয়।চিঠি ভরে কেবল ছলনার কথা লিখে গেছে।মেয়েরা ছল করলে তাদেরকে ছলনাময়ী বলা যায়।কিন্তু পুরুষদেরকে কী বলা যায়?তাদেরকে কী প্রতারক বলা যায়? তবে কী রেদোয়ান প্রতারক? ভাবতে পারে না কুসুম।রেদোয়ানকে এখনো ঘৃণা করতে পারে না।তার কথা মনে হলেও শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে।
এই কয়েকমাসে অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে তওসিফের।আজকাল তাকে ঘরেই বেশি দেখা যায়।সবার সাথে সম্পর্ক ভালো হয়েছে।নীরা-কুসুম প্রথমে অবাক হয়েছিল খুব।এতো পরিবর্তন! অবিশ্বাস্য! তবে তারাও মানিয়ে নিয়েছে।আজকাল সন্ধ্যার পর ঘরে চায়ের আড্ডা খুব জমে।কোনোদিন চায়ের সাথে মুড়ি-চানাচুর,আবার কোনোদিন চিড়ে ভাজা।অথবা, ইশরাক বাজার থেকে ফেরার পথে নোনতা বিস্কিট নিয়ে আসে।সেই বিস্কিট চায়ে ভিজিয়ে গল্পে মাতে ছয় ভাই-বোন।ইরা- তোহা- টুনি এই তিনজন তওসিফের একনিষ্ঠ ভক্ত।কতোদিন পর তারা মেজ ভাইকে আগের মতো পেয়েছে।তাই আঠার মতো লেগেই থাকে তওসিফের সাথে।
মেহরাবের আচরণ এখন চোখে পড়ার মতো।আজকাল তাকে নীরাদের বাড়ির আশেপাশে প্রায়ই দেখা যায়।কখনো ব্যস্ত সকালে আবার কখনো অলস বিকালে।মেহরাবের সারাদিন কোনো কাজ থাকে না।তাই এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে কেবল টইটই করে বেড়ায়।তবে,এ গ্রামে থাকলে তাকে ঘুরেফিরে সেই নীরাদের বাড়ির পিছনেই দেখা যায়।বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।এই দৃশ্য অনেকের চোখেই পরেছে।নীরার চোখে পরেছে কয়েক মাস আগে।
বর্ষা তখন সবে বিদায় নিয়েছে।এমন এক বিকালে নীরা ঘরে বসে ছিল একা। হাতে কোনো কাজ না থাকায় জানালা দিয়ে বাইরের বাঁশ গুনছিল।এমন সময় কুসুম এলো ঘরে।
—” নীরাপু চল একটু ঘুরে আসি।”
—” কই যাবি?”
—” চল কবরস্থানের দিকে যাই।”
নীরা খুব ভীতু মেয়ে।তাই রাজি হয় না।
—” না সেদিকে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।মাগরিবের আগে কবরস্থানে যাওয়া ভালো না।”
—” আরে চল না।কবরের কাছে যাব না।কবর থেকে একটু দূরে একটা বকুল ফুলের গাছ আছে।গাছটা ওখান থেকে তুলে উঠোনে লাগাব।শুধু গাছটা তুলতে যতক্ষণ লাগে ততোক্ষণই থাকব।চল না।”
নাছড়বান্দা কুসুমের সাথে পেরে উঠে না নীরা।তাই পা বাড়ায় কবরস্থানের দিকে।
কুসুম গাছ তুলতে ব্যস্ত।নীরা ভীত চোখে চারদিকে দেখে।নীরা বরাবর কবরস্থান থেকে দূরে থাকে।চোখ বুলিয়ে আশপাশ দেখতেই, নজরে আসে মেহরাবকে।নীরা অবাক হয় খুব।তার মনে হচ্ছিল, মেহরাব নজর বাঁচিয়ে তাদেরকেই দেখছে।তবে খুব বেশি ভাবে না নীরা।মাগরিবের আগেই পা বাড়ায় ঘরের দিকে।এ তো গেল একদিনের কথা।এরপর থেকে প্রায়ই নীরার নজরে পরতো মেহরাব।নীরাদের পুকুরের বিপরীতে যে বড় রাস্তা আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকত সে।একদিন নীরা-কুসুম একসাথে পুকুর পাড়ের জামগাছের নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। মেহরাবও দাঁড়িয়ে ছিল বড় রাস্তায়। তাকে প্রথমে নজরে আনে কুসুম।সাথে সাথেই তার মেজাজ খারাপ হয়।সমস্যা কী এই লোকের?
—” নীরাপু,দেখ তো ওই লোকটা এতোক্ষণ আমাদেরকেই দেখছিল না?”
—” আমার মনে হয় আমাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল।”
—” কী দেখে এতো?”
—” মনে হচ্ছিল আমার নজর বাঁচিয়ে তোকে দেখছিল।”
—” আমার তো মনে হয় আমাকে পাহারা দিয়ে তোমাকে দেখছিল।ছেলে কী ট্যাড়া নাকি?”
ফিচেল হাসে নীরা।কৌতুক করে বলেঃ” তোকেই দেখছিল আমি নিশ্চিত।”
কুসুম কম কীসে? সেও হেসে বলেঃ” ফাইজলামির একটা লিমিট আছে,নীরাপু।তুমি সুন্দর, আমার চাইতে বড়, শিক্ষিত। তো তোমাকে রেখে আমাকে কেন দেখবে?”
এরকম প্রায়ই মেহরাবকে দেখে নিজেদের মধ্যে কথা বলে ওরা।মেহরাব শুধু ওদের নজরেই না একদিন তওসিফের নজরেও পরে।তওসিফ প্রায়ই দেখে চেয়ারম্যানের ছেলেকে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে।প্রথম প্রথম কিছু মনে করেনি সে।কিন্তু একসময় দেখলো নীরা-কুসুম যখন বাড়ির পুকুরপাড় বা কবরস্থানের দিকে যায়,ঠিক তখনই মেহরাবকে দেখা যায়।সেই সময় খটকা লাগে।প্রত্যেক দিন তো আর কাকতালীয় হতে পারে না।
তওসিফ তাই গোপনে জয়নব বেগমকে হুশিয়ার করে দেয় সে।জয়নব বেগম নিজেও সচেতন মা।বাড়ির মেয়েদের নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না।তাই এক রাতের বেলা নীরা-কুসুমের ঘরে যান।
—” তোরা কালকে থেকা পুকুরপাড়ে যাবি না।”
অবাক হয়ে যায় দুজনে।
—” কেন মেজমা?”
—” আমি না করছি তাই যাবি না।আর কুসুম কবরস্থানে যাইতে হইলে ভোরের দিকে যাবি।বিকালে যাতে ওইদিকে যাইতে না দেখি।আমার কথা না শুনলে দুইটার পা ভাইঙা ঘরে বসায়া রাখুম।”
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয় ওরা।কুসুম ভেবেই পায় না এতো কঠোর কেন মেজমা?
তার দুদিন পরে বিকেল বেলা,নীরা একা একা উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।কুসুম কোথায় যেন গেছে।এমন সময় নীরা দেখে মেহরাবকে।সদর দরজা দিয়ে ধীর পায়ে নীরাদের বাড়িতে ঢুকছে সে।নীরার কাছে এসেই নিসংকোচ আবেদন করে।
—” আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াবে নীরা?”
নীরা প্রথমে হতভম্ব হলেও পরে দ্রুত পায়ে পানি আনতে ছুটে। মেহরাব খুব সুন্দর করে পানি খায়।খাওয়ার পরে নীরাকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় সেখানে আসে কুসুম।কুসুমকে দেখে আর কিছু বলে না মেহরাব।গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে আবার সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়।নীরা নিশ্চিত হয় কুসুমকে দেখেই কিছু বলেনি মেহরাব।নাহয় বলতো।
সেদিন থেকেই কেন যেন নীরার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়,নীরাকে দেখতেই মেহরাব রোজ এদিকে আসে।মনে মনে একটু রোমাঞ্চ অনুভব হয় নীরার।আর দশটা সাধারন মানুষের মতো নীরাও সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট। তাই সহজেই মেহরাবের সৌন্দর্য দাগ কাটে নীরার মনের গভীরে।এমন সুন্দর একটা মানুষ যদি হয় ভবিষ্যত, তবে কিন্তু মন্দ হয় না।
***
রাত নয়টা।শহরে এটুকু রাতকে সন্ধ্যা হিসেবেই ধরে।তবে,গ্রামের হিসাব ভিন্ন।গ্রাম শহরের মতো এতোটা নিশাচর হয়নি এখনো।বাংলাদেশের প্রায় গ্রামগুলো ঘুমিয়ে পরে সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যেই।চেয়ারম্যান বাড়িতে আজ এখনো কেউ ঘুমায়নি।মেহরাব কী যেন করছে ঘরের দরজা লাগিয়ে।কমলা বানু রান্নাঘরে খাবার গরম করছেন।রাতে খাওয়া হয়নি কারো।ঘরের ছুটা কাজের লোকগুলো চলে গেছে।কমলা বানু কাজের লোক পছন্দ করেন না।ঘরে কাজের লোক কেন রাখতে হবে?কাজের লোকই যদি রাখতে হয় তবে ঘরের মহিলাদের কাজ কী?তারা কী পায়ের উপর পা তুলে খাবে নাকি? ছিঃ! কি বিচ্ছিরি ব্যাপার।তাই কমলা বানুর জন্য বাড়িতে স্থায়ী কোনো কাজের লোক নেই।দু-তিনটে ছুটা কাজের লোক আছে। তারা ক্ষেত-খামারের কাজ করে।কমলা বানুর অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেল রান্নাঘরের চুলা ঠেলে।
চেয়ারম্যান, কাশেম খান তার শোবার ঘরে। তার একটা ইজি চেয়ার আছে।এটা বড় শখের জিনিস।তিনি যখনই খুব চিন্তায় থাকেন,এখানে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে থাকেন।আজো বসে আছেন।ইদানিং একটা বিষয় নিয়ে তিনি খুব চিন্তায় আছেন।চিন্তার বিষয় দিন দিন বেড়েই চলেছে।
মেহরাবকে আজকাল শুধু মাছ ব্যাপারীদের বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়।ব্যাপারটা শুধু একদিন হলে কথা ছিল।প্রায়ই দেখা যায় ওকে।বিষয়টা দৃষ্টিকটু।কাশেম খানের শত্রুর অভাব নেই গ্রামে।তাদের অনেকের চোখেই পড়েছে।কানা-ঘুষাও করছে তারা।মাছ ব্যাপারীদের বাড়িতে বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে।মেহরাব জোয়ান ছেলে।তাই দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে কষ্ট হয় না কারো।এ নিয়েই চিন্তায় আছেন কাশেম খান।যদি একটা বদনাম তুলে দেয়,তখন কী হবে?কপালের ঘাম ছুটে যায় কাশেম খানের।বহুদিনের সঞ্চিত সম্মানের প্রাসাধ ভেঙে পরতে দু-মিনিট সময় লাগবে না।ছেলেটা যে আসলে কী করে!
কমলা বানু ঘরে ঢুকলেন ঘন্টাখানেক পর।পানদানী হাতে নিয়ে এসেছেন তিনি।কাশেম সাহেব ভাত খাওয়ার আগে প্রতিদিন পান খান।কমলা বানু খাটের উপর পানদানী রেখে এগিয়ে গেলেন ঘরের উত্তর দিকের জানালার দিকে।জানালার বাইরে অনেক ঝোপঝাড়। রাতের বেলায় অনেক জোনাকি পোকা দেখা যায় সেখানে।এরা চোখে দেখতে সুন্দর। কিন্তু যখন সমস্বরে কোরাস গায়,তখন তা মোটেও কানের জন্য সুখকর হয় না। কমলা বানু জানালার পাল্লা দুটো টেনে ভিতর থেকে লাগিয়ে দিলেন।জোনাকি পোকার ডাক তার সহ্য হয় না।
কাশেম সাহেব কমলাকে দেখতে পেয়ে বললেনঃ” কমলা, মেহরাব খেয়েছে?”
—” না।কি যেন করে,কইছে পরে খাইব।”
—” এদিকে এসে একটু বসো তো,কথা আছে।”
কমলা বানু স্বামীর কাছে এসে খাটের উপর বসলেন।চুন,সুপারি,জর্দা দিয়ে পান বানাতে বাবাতে কান দুটোকে খাড়া করে রাখলেন কাশেম সাহেবের কথা শোনার জন্য।
—” কমলা, মেহরাবের মতিগতি ইদানিং আমার ভালো লাগছে না।”
স্বামীর হাতে পান তুলে দিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেনঃ ” কেন,কী করছে হেয়?
—” তোমার ছেলে বোধহয় বিয়ে করতে চায়।”
অবাক হয়ে গেলেন কমলা বানু।কিন্তু তা কয়েকটা সেকেন্ডের জন্য। কয়েক সেকেন্ড পর অবাক পরিণত হল রাগে।মেহরাব বিয়ে করতে চাইলে নিশ্চয়ই তাকে বলত।এসব নিশ্চয়ই কাশেম সাহেবের চালাকি।ছেলেটাকে বিয়ে দেয়ার জন্য একেবারে উঠে-পড়ে লেগেছে।
—” আপনে অন্য কোনো কথা থাকলে কন।আমার পোলার বিয়ার বয়স হয় নাই।এডি আপনে বানায়া বানায়া কইতাসেন।”
রাগে ফুঁসে উঠলেন কাশেম সাহেব।এই মহিলা এতো বেশি কেন বুঝে! তিনি আছেন তার চিন্তায়,আর এই মহিলা আছে আজগুবি সব ভাবনা নিয়ে।হাহ! অসহ্য।কাশেম সাহেব থমথমে গলায় বললেনঃ” বাজে কথা যদি বলতে হয়, তবে উঠে যাও এখান থেকে।আমার চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।তোমাকে ডেকেছিলাম একটু পরামর্শ করতে। কিন্তু তুমি তো সেই মহিলা না।যাও এখান থেকে।মেজাজ খারাপ করো না আমার।”
কমলা বানু চিনেন এই কন্ঠ।তাই একটু দমে গেলেন।কাশেম সাহেব এমনিতে খুব ঠান্ডা মানুষ।তবে রাগ উঠলে তখন মানুষ খুন করার ক্ষমতা রাখেন।তাই কমলা বানু মিনমিনে সুরে বললেনঃ” রাগেন কেন?কী হইছে খুইলা কন? মেহরাব কী উল্টা – পাল্টা কিছু করছে?আমার পোলা তো ওইরকম না।”
—” মেহরাবকে আজকাল শুধু মাছ ব্যাপারীদের বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়।বাইরে থেকে ওদের বাড়ির দিকে উঁকি দেয়।”
প্রথমে বিশ্বাস করলেন না কমলা বানু।অবিশ্বাসের সুরে বললেনঃ” কি কইতাছেন এগুলি?আপনে নিজের চোখে দেখছেন নাকি কেউ আপনেরে কইসে?”
—” প্রথমে লালুর মুখে শুনেছি।তারপর একদিন নিজের চোখে দেখেছি।ঘটনা সত্যি।”
—” কী দেখতে যায় হেনে?”
—” বুঝো না কী এতো দেখতে যায়? সব ভেঙে বলা লাগবে কেন? ওদের বাড়িতে বড় একটা মেয়ে আছে,কি যেন নাম ভুলে গেছি।”
—” কার কথা কন? কুসুমের? ওই যে শ্যামলা কইরা মাইয়াডা,আমগো নূরের বান্ধবী?”
—” নাহ।কুসুম তো ছোট। ওর বড় একটা বোন আছে।”
—” নীরার কথা কন?”
—” নাম জানি না আমি।হতে পারে।”
কমলা বানুর চোখের উপর ভেসে উঠলো নীরার মুখখানি।কুসুমের একটা বোন আছে।বেশ সুন্দর চেহারা।যাক,ছেলের রুচি আছে তবে।
কাশেম সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।তারপর যখন কথা বলার জন্য মুখ খুললেন,তখন তার গলায় ফুটে উঠলো আক্ষেপের সুর।
—” কত আশা করেছিলাম, ছেলেকে বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে দেব।আনিসকে মনে আছে তোমার?ঐ যে আমাদের বাসায় আসতো,স্বর্ণের ব্যবসা করতো।ওর মেয়েটা কি সুন্দর।শিক্ষিত অনেক।অনার্সে পড়ছে বোধহয়।ঐ মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ ছিল।বউ করে ঘরে আনলে সারা গ্রামের মানুষ হুমরি খেয়ে পরতো।”
—” থাক কি করবেন এহন।পোলায় পছন্দ করছে।এর মাঝে তো আমগো কিছু করার নাই।আর নীরাও খারাপ না। সুন্দর,ভদ্র।চিনি আমি ওরে।”
—“তবুও,মেয়ের পরিবার আমাদের থেকে অনেক নিচু।মাছের ব্যবসায়ী, হাহ!আমার বেয়াই হবে মাছের ব্যবসায়ী!লজ্জার কিছু থাকবে না।বেয়াইকে নিয়ে আমি কোথাও যেতে পারব?”
—” থাক কী করবেন এহন।পঁচা শামুকে পাও কাটছে পোলায়।এহন কী করন যাইব? পাও কাইট্টা ফালায়া দিবেন নাকি হাঁটা বন্ধ কইরা পায়ের দিকে তাকায়া থাকবেন?”
—” সেটাই।”
—” আমি কী জিগামু মেহরাবরে?এমনো তো হইতে পারে,আমরা যা ভাবতাছি বা দেখতাছি তা ঠিক না।সত্যিডা হয়তো অন্যকিছু।”
—” না, কমলা।ওর আচরণ ঠিক লাগছে না।অনেক মানুষ কানাঘুষা করছে।এতোজনের একসাথে ভুল।হতে পারে না।”
***
নীরাদের ঘরে সবাই ভাত খেতে বসেছে।সবাই বলতে বাড়ির পুরুষেরা।নীরার বাবা-চাচারা চার ভাই ও তওসিফ।ইশরাক অনুপস্থিত এখনো।জয়নব বেগম ভাত বেরে দিচ্ছেন,শাহানা বেগম সব এগিয়ে দিচ্ছেন।নীরাদের খাবারের ঘরটা ছোট,তাই সবাই একসাথে বসে খেতে পারে না।
নীরা ঘরের এককোনে বসে পিটুশকে কথা শিখাচ্ছে।
—” পিটুশ বল, আমার নাম পিটুশ।আ মা র না ম পি টু শ।”
পিটুশ কি বুঝলো কে যানে! নীরার কথায় তাল না মিলিয়ে ঝিমাতে শুরু করলো।নীরা বিরক্ত হলো খুব।ওই পিটুশটা একটা পাজি।নীরা যা বলে পিটুশ কখনোই তা বলে না।অথচ, কুসুম যাই শেখাবে তাই বলবে।ফাজিল তোতাপাখি।
জয়নব বেগম নীরাকে হাঁক দিয়ে বললেনঃ” নীরা,যাতো ইশরাকরে ডাইকা নিয়ায়।পোলাডা কী খাইবো না?”
নীরা পা বাড়ালো ইশরাকের ঘরের দিকে।যদিও অন্ধকার রাতে অন্ধকার উঠোনের মাঝ দিয়ে ইশরাকের ঘরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই তার।তবুও মা যেহেতু বলেছে,তাই অগত্যা যেতেই হবে।
ইশরাক একা ঘরে রিমার সাথে কথা বলছে।রিমার বাবা ঘুমিয়ে গেছে তাই রিমা ফোন দিয়েছে ইশরাককে।ইশরাক ফোন হাসিমুখে ধরলেও এখন বিরক্তিতে ছেয়ে গেছে মেজাজ।রিমার বাবা আবার এক পাত্র ধরে এনেছে। ছেলে শিক্ষক।পাশের গ্রামের হাইস্কুলে চাকরি করে।ইশরাক ভেবে পেল না, রিমার বাবা এতো পাগল কেন হয়ে গেছেন,আশ্চর্য!আর তাছাড়া ছেলে খুঁজবে ভালো কথা। গ্রামে ইশরাকের মতো একটা সুপাত্র আছে,সেদিকে কেন চোখ দিচ্ছে না এই লোক? ইশরাককে কী তার চোখে পড়ছে না?
এমন সময় ঘরে এলো নীরা।
—” ভাইয়া তোমারে আম্মা ডাকে।”
—” কেন? ”
—” ভাত খাবা না?”
—” যা,তুই আসতেছি।”
—” এক্ষুনি যাইতে বলছে কিন্তু।”
—” আচ্ছা,যা তুই।”
নীরা আবার খাবার ঘরের দিকে ছুটলো নীরা।আজ নাকি অমাবস্যা। তাই চারদিকটা অন্ধকার।নীরা ভীত পায়ে উঠোনের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ পরলো রেদোয়ানের ঘরের দিকে।ঘরটা বাইরে দিয়ে আঁটকে দেয়া। কী যেন ভেবে নীরা সেদিকে গেল।আলতো হাতে খুলে দিল ঘরের দরজা। বন্ধ ঘর ভ্যাপসা গন্ধে ভরে আছে।নীরা বাতি জ্বেলে টেবিলের কাছে গেল। টেবিল ভর্তি গল্পের বই।রেদোয়ান খুব পড়ুয়া ছেলে।নীরা চোখ বুলিয়ে পুরোটা ঘর দেখলো।চেয়ারগুলোতে হাত বুলিয়ে দিল।তারপর হাতে তুলে নিল সবার উপরে থাকা চরিত্রহীন বইটা।রেদোয়ান শরৎচন্দ্রের বিশাল ভক্ত।নীরা বইয়ের পাতা উল্টে ফেললো।এই বইটা তার পড়া হয়নি।অবশ্য পাতা উল্টে খুব অবাক হলো নীরা।কারণ, সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল,
” তোমাকে দেখলে হাজারবার চরিত্রহীন হতে ইচ্ছে করে নীরা।।।”
( চলবে)
( বি. দ্রঃভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)
—আগের পর্বের লিংকঃ
https://m.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/1040641080074721/