বর্ষা দুপুর (পর্ব-১৫) শেষ পর্ব হালিমা রহমান

বর্ষা দুপুর (পর্ব-১৫)
শেষ পর্ব
হালিমা রহমান

যাত্রাবাড়ি থানার মোড় থেকে একটু দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলেই একটা সরু গলি। সেখানে একটা সাত তলা ধূসর রঙা বাড়ি আছে।এই বাড়ির দোতলায় দুটো ফ্ল্যাট।যেই ফ্ল্যাটের বারান্দা বাড়ির পিছন দিকে,সেই ফ্ল্যাটেই থাকে নীরা-রেদোয়ান দম্পতি।দু-রুমের মাঝে একটুখানি ডাইনিং স্পেস।সেখানে চার চেয়ারের ছোট্ট একটা টেবিল পেতে রাখা।তার পাশেই মাঝারি আকারের একটা মেরুন রঙা ফ্রিজ।বড় রুমটা নীরা-রেদোয়ানের শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশাল জানালার পাশে সেগুন কাঠের একটা খাট।খাটের পাশে ছোট্ট টেবিল।টেবিলের উপর অগোছালোভাবে বরফ গলা নদী,দত্তা ও গৃহদাহ ;এই তিনটে বই রাখা।রেদোয়ান গত রাতে পড়েছিল বইগুলো।তারপর আর গুছিয়ে রাখা হয়নি।টেবিলের পাশে বারান্দার দরজা।দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেদোয়ান।পরনে একটা স্পোর্টস ট্রাউজার ও কালো রঙের টি-শার্ট।রেদোয়ানের চোখে-মুখে কেমন একটা অসহায়ত্বের ভাব।সন্ধ্যা হওয়ার সময় হয়ে এসেছে।হুজুর মাগরিবের আজান দিলো বলে।অথচ,এখনো ঘরের জানালাগুলো লাগানো হয়নি,বিছানাটা গোছানো হয়নি,ড্রেসিং টেবিলের উপরটা অগোছালো,টেবিলে বইগুলো এলোমেলো।এই কাজগুলো সবসময়ই নীরা করে।কিন্তু,আজ করবে না।নীরা বারান্দায় বসে আছে।শুধু বসে আছে বললে ভুল হবে। মোজাইক করা বারান্দায় লেপ্টে বসে মিনমিনিয়ে কাঁদছে।তার চুল এলোমেলো, পরনের সবুজ রঙা শাড়ির বিশাল আঁচলটা গড়াগড়ি করছে নয়নতারা গাছের টবের উপর।রেদোয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গলার স্বরকে একটু গম্ভীর করে নিল।
—” এবার বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে নীরা।তাড়াতাড়ি ঘরে এসো।মশা কামড় দিবে ওখানে।”
নীরা কিন্তু কানেও নিলো না কথা।যেরকম বসে ছিল, সেরকমই বসে রইলো।রেদোয়ান আরো একবার অসহায় চোখে তাকালো বউয়ের দিকে।এবার তার রাগ লাগছে কিছুটা।একটা মানুষ এতো একগুঁয়ে হয়!রেদোয়ান বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে রাগ গিলে নিলো।এখন রাগ করার সময় নয়।বারান্দার দরজার সামনে থেকে ঘরে এসে মাথায় টুপি চাপিয়ে দিলো।আজান হচ্ছে চারিদিকে। দ্রুত হাতে ঘরের জানালাগুলো লাগিয়ে দিলো। আরো একবার বারান্দার দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নামাজের উদ্দেশ্যে।
নীরা দরজা লাগানোর শব্দ পেয়ে ধরাম করে উঠে দাঁড়ালো মেঝে থেকে।ইশ! অভিনয় কীভাবে করে মানুষ।এই কতক্ষণ অভিনয় করে বারান্দায় বসেই নীরার জান যায় যায়। ঘরমে,ঘামে শরীর সিদ্ধ হওয়ার অবস্থা।তার উপর আছে যাত্রাবাড়ির বিখ্যাত মশার কামড়।নীরা দাঁড়িয়ে আগে অগোছালো চুলগুলো হাতখোপা করে নিলো।রেদোয়ান নামাজে গেছে। এই সময়টুকুতেই যা করার করতে হবে।নীরা দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে আগে ঘর ঝাড়ু দিলো।বালিতে চিকচিক করছে ঘর।তারপর,নামাজ পড়লো,তরকারি গরম করলো।সেই সকালে রেধেছে।এখন গরম না করলে নষ্ট হয়ে যাবে।এসব কাজ শেষ করে নীরা শোবার ঘরের পাশে যেই ঘরটা আছে, তার জানালার কাছে যেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়।রেদোয়ান যখনই এপথ দিয়ে আসবে,নীরা আবার দৌড়ে বারান্দায় চলে যাবে।নীরা এবার খুব রাগ করেছে রেদোয়ানের উপর।লোকটা অত্যন্ত বাজে।
তিনদিন ধরে নীরা-রেদোয়ানের মনোমালিন্য চলছে।যেমন-তেমন না একেবারে কঠোর মনোমালিন্য। দুজন দুজনকে বয়কট করেছে।কথা বলে না,একসাথে খায় না।এমনকি নীরা না ঘুমানো অবদি রেদোয়ান বিছানাতেও আসে না।তাদের এমন অবস্থার পিছনে বড়সড় একটা কারণ আছে।রেদোয়ান সবদিক দিয়েই খুব ভালো,কিন্তু একদিক দিয়ে খুব খারাপ।সে কখনো নীরাকে অনেকদিনের জন্য গ্রামে যেয়ে থাকতে দেয়না।হয়তো অফিস ছুটি দিলে নিজে নিয়ে যায় অথবা নীরা একা গেলে দু-তিনদিন পরেই আবার নিয়ে আসে।নীরা মেনে নিলো রেদোয়ানের এই বদঅভ্যাস।কোনোকিছুই সম্পূর্ণ ভালো হয় না।তেমনি রেদোয়ানের সব স্বভাব ভালো হবে না, এটাই স্বাভাবিক। সেদিন ইশরাক ফোন করেছিল নীরাকে।ইশরাকের একটা ছেলে হয়েছে এক বছর আগে।তার মুসলমানি করাবে এক সপ্তাহ পর।যেহেতু,বংশের বড় ছেলে তাই সবার ইচ্ছে একটু বড় করে অনুষ্ঠান করবে মুসলমানিতে।তাই নীরাকে কয়েকদিন আগেই চলে আসতে বলেছে ইশরাক।নীরা খুব খুশি হলো।অনেকদিন হলো গ্রামে বেড়াতে যাওয়া হয়না।সেই হেমন্তে গিয়েছিল,নতুন চালের পিঠা খেতে।এরপর, মাঘ মাসে যাওয়ার কথা ছিল।কিন্তু, নীরার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারণে আর যাওয়া হয়নি।এবার,অনুষ্ঠানের অজুহাতে দু-তিন সপ্তাহ বেড়াতে পারবে নীরা।অবশ্য,নীরা একটু চিন্তায় ছিল রেদোয়ান যেতে দেবে কি দেবে না তা নিয়ে।তাই রেদোয়ান অফিস থেকে আসার পর সেদিন নীরা খুব নরম কন্ঠে সবটা জানালো রেদোয়ানকে।কাতর কন্ঠে অনুরোধ করলো, এবার যাতে দু-তিন সপ্তাহের জন্য যেতে দেয় বাড়িতে।কিন্তু ফাজিল লোকটা কী বলল? নীরার নাক ডানহাতে টেনে দিয়ে বললঃ”অনুষ্ঠান হলে অবশ্যই যেতে হবে তোমাকে।”
নীরা খুব খুশি হলো।বাহ! শুরুতেই রাজি।আজ সূর্য কোনদিকে উঠলো? কিন্তু, রেদোয়ানের পরের কথা শুনে মাথায় রক্ত উঠে গেল নীরার।নীরার নাক ছেড়ে রেদোয়ান ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বললঃ” অনুষ্ঠানের দু’দিন আগে চলে যেয়ো।অনুষ্ঠানের দিন আমি যাব,তখন আমার সাথে চলে এসো।ইশরাক ভাই আমাকেও ফোন দিয়েছিল।”
বিরক্তিতে নীরার সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো।কি হয় একটু বেশি দিনের জন্য বেড়াতে গেলে? নীরা কি ঘর-বাড়ি মাথায় তুলে নিয়ে যাবে? এরপর দুজনে কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি করলো,তারপরেই শুরু একে অন্যকে বয়কট।সেই রাতে একসাথে খায়নি দুজনে,কথা বলেনি,এমনকি নীরার সাথে রাগ করে পাশের ঘরে যেয়ে শুয়ে পরেছিল রেদোয়ান।সারারাত কেউ ঘুমায়নি।নীরা-রেদোয়ান দুজনেই অন্তর্মখী।তাদের যত কথা দুজনের সাথে।নীরা সাধারণত বাইরে কারো সাথে তেমন একটা মিশে না।সারাদিনের সব কথা জমিয়ে রাখে তারপর রেদোয়ান বাড়িতে এলে তার সামনে সব উগরে দেয়।এই তিনদিন দুজনের কেউই একে অন্যের সাথে কথা বলেনি।নীরা ঘরের কাজ ঠিক মতো করেনি,পড়তে বসেনি।বেশিরভাগ সময় বারান্দায় বসে থাকতো।নীরা এবার পণ করেছে কিছুতেই রেদোয়ানের কাছে হার মানবে না।এই লোক যা করবে তাই সবসময় মেনে নিতে হবে কেন?

রেদোয়ান মসজিদ থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তায়।বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না।তার বউটা এতো বোকা! রেদোয়ানের ভালো লাগে না নীরা বাড়ি গেলে।পুরো ঘরটা কেমন খালি হয়ে যায়।খালি ঘরে থাকতে ইচ্ছে করে না,খেতে ইচ্ছে করে না,ঘুমাতে ইচ্ছে করে না।তাই, সচরাচর রেদোয়ান নীরাকে গ্রামে যেতে দেয় না।নীরাও প্রতিবার মেনে নেয়।তাই,এবারেও রেদোয়ান ভেবেছিল সবসময়ের মতো নীরা মেনে নেবে।কিন্তু,কে জানত নীরা এবার ভয়াবহ বিদ্রোহ শুরু করবে? রেদোয়ান কি এবার বেশি বেশি করছে? তার উপর কালকে আবার গ্রাম থেকে তওসিফ আসবে।একটু আগে তওসিফ ফোন করে জানালো।ও যদি দেখে ওদের দুজনের এই অবস্থা,তবে কি বিশ্রি একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে।নাহ,ঝামেলা আর বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না।যেভাবেই হোক আজ নীরার সাথে কথা বলতেই হবে।বউয়ের রাগ ভাঙানোর জন্য রেদোয়ান দু-পা এগিয়ে পাড়ার মোড়ের ভাজা ভুরির দোকানেত কাছে গেল।নীরার এটা খুব পছন্দ।শুধু ভুরি ভাজা না রাস্তার পাশে যেই অস্বাস্থ্যকর খাবারগুলো বিক্রি করে তার সবই নীরার পছন্দ।কিন্ত,রেদোয়ানের এগুলো একদম ভালো লাগে না।রাস্তার সব ধুলো- বালি লেপ্টে থাকে খাবারের সাথে।তাছাড়া,এই যে ভুরিগুলো ভাজছে তা মরা গরুর নাকি জ্যান্ত গরুর তা কে বলতে পারবে? তেলটাও নিশ্চয়ই বাসি।এগুলো খাওয়া কি উচিত?
তবুও, আজ রেদোয়ান বেশ খানিকটা ভুরি ভাজা কিনলো।বউয়ের মনটা যদি একটু ভালো হয়।রেদোয়ানকে বাড়ির রাস্তায় দেখে আবারো বারান্দায় চলে গেল নীরা।চুলগুলো খুলে দিল।আপাতত রাত পর্যন্ত এই অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে।নীরার বারান্দায় হরেক রকম গাছ আছে।একটা নয়নতারা গাছ,ক্যাকটাস গাছ,গোলাপি রঙা টাইম ফুলের গাছ,পাথরকুচি গাছ আর ছোট্ট একটা লেবু গাছ।বারান্দাটা নীরার খুব পছন্দ।রেদোয়ান যখন বাড়িতে থাকে না তখন নীরা এখানে বসে থাকে।ছুটির দিনের বিকালবেলাতে রেদোয়ানসহ বসে।নীরা বসে থাকে বলেই রেদোয়ান দুটো ছোট্ট বেতের চেয়ার এনেছে।কি দরকার ঠান্ডা মেঝেতে বসার? যদি ঠান্ডা লেগে যায়?
প্রকৃতিতে বর্ষা চলছে।টানা কয়েকদিন বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে বৃষ্টি ছিল না।নীরার ঢাকার বৃষ্টি ভালো লাগে না।এই বৃষ্টিতে কোনো প্রাণ নেই।টিনের চালে ঝুমঝুম করে বৃষ্টিরা পরে না,ভিজে মাটির গন্ধ পাওয়া যায় না,গাছ চকচক করে না।অবশ্য,আশেপাশে তো গাছই নেই।নীরা মাঝে মাঝেই ভাবে,ঢাকায় গাছ এতো কম অথচ মানুষ কত বেশি।এতো মানুষের অক্সিজেন আসে কোথা থেকে?রেদোয়ান ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।টুপিটা খুলে এঘর -ওঘর ধুপধাপ করে হাঁটা শুরু করলো।শব্দ করে প্যাকেট থেকে ভুরি ভাজা বের করে রাখলো।উদ্দেশ্য, বউয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ। কিন্তু,বেশ কিছুক্ষণ পরেও যখন দেখলো নীরার কোনো নাম-গন্ধ নেই;তখন খুব হতাশ হলো রেদোয়ান।আশ্চর্য! এইটুকুই তো একটা শরীর।এই শরীরে এতো রাগ আসে কোথা থেকে?রেদোয়ান ধীর পায়ে বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়ালো।গলাটাকে নরম করে কথাগুলো সাজিয়ে নিলো।তারপর মৃদু স্বরে ডাক দিলো নীরাকে।
—” নীরা।”
নীরা কথা বলল না।রেদোয়ান কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আরো দু’বার ডাকলো।
— ” নীরা,নীরা।”
—” কথা বলবেন না আমার সাথে।”
—” আচ্ছা,এরকম করার কী আছে?আমি কি তোমাকে নিয়ে কোথাও যাই না?সুযোগ পেলেই তো নিয়ে যাই।”
রেদোয়ানের কথায় ফুসে উঠলো নীরা।কি মিথ্যুক!এমনভাবে বলছে যেন,নীরাকে সব জেলা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।তাছাড়া,গ্রামের বাড়ি আর অন্য কোনো জায়গা কি এক?নীরা অভিমানী গলায় বললঃ”অফিস থেকে ট্যুরে গেলে নিয়ে যান।দুবার কক্সবাজার আর একবার সাজেক, এই তিনবার ঘুরতে নিয়ে গেছেন।তাছাড়া,গ্রামের বাড়ি আর এসব জায়গা কি এক হলো?আর কোনোদিন আমি আপনার সাথে ঘুরতে যাব না।গ্রামেও যাব না।বাসায়ই থাকব।কিন্তু, আপনার সাথে কথাও বলব না।”
কথা বলবে না বলেও কত কথা বলে ফেলল।মেয়েটা আসলেই পাগল।রেদোয়ান আস্তে আস্তে পা ফেলে বারান্দায় চলে আসলো।লেপ্টে বসে পরলো নীরার সাথে।নীরার কাঁধ জড়িয়ে বললঃ” আচ্ছা,আর রাগ করো না।যেয়ো গ্রামের বাড়িতে।”
—” না, দুদিনের জন্য কিছুতেই যাব না আমি।বাড়িতেই থাকব।দেখি আপনার হাত সরান।দূরে যেয়ে বসেন।শরীরের সাথে চিপকে বসে আছেন কেন?যান,ওদিকে যান।”
রেদোয়ান সরে গেল না।বরং, আরো এগিয়ে গেল।
—” উফ! দূরে যান তো গরম লাগে।”
—” গরম লাগলে এখানে বসে আছো কেন?ঘরে যাও।”
—” আপনি যান।আমি যাব না ঘরে।”
—” আমিও যাব না।”
নীরা নাক ফুলিয়ে তাকালো রেদোয়ানের দিকে।রেদোয়ান হালকা হেসে নাক টেনে দিল।এটা খুবই বাজে অভ্যাস তার।সময়ে -অসময়ে নীরার নাক ধরে টানবে।
—” আর রাগ করতে হবে না।তওসিফ আসবে কালকে।ওর সাথে চলে যেয়ো।যেই কয়দিন থাকতে ইচ্ছে হয় থেকো। বেড়ানো শেষ হলে আমাকে ফোন দিয়ো।আমি যেয়ে নিয়ে আসব।”
চকচক করে উঠলো নীরার চোখ।মনে মনে খুব খুশি হলে উপরে দেখালো না।অবিশ্বাসের সুরে বললঃ” মিথ্যে আশা দেবেন না।আপনি যে আমায় যেতে দেবেন না, তা আমি খুব ভালো করেই জানি।শুধু মিথ্যে কথা বলার দরকার নেই।”
—” আরে,মিথ্যে বলছি না। সত্যিই বলছি আমি।”
—“এহ!”
রেদোয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।সমস্যা কী এই মেয়ের? নীরার কেন যেন মনে হচ্ছে রেদোয়ান সত্যিই তাকে যেতে দেবে।তবুও, একবার নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললঃ” সত্যিই যেতে দেবেন?”
—” হুম।”
—” কসম ”
—” আমার মুখের কথা বিশ্বাস হয়না?”
—” হয়, তবুও বলেন আল্লাহর কসম।”
—” আচ্ছা,আল্লাহর কসম এবার তোমাকে আমি যেতে দেব।”
খুব খুশি হলো নীরা।আনন্দে মাথা এলিয়ে দিল রেদোয়ানের কাঁধে।তিনদিন পরে, এই প্রথম নীরার মাথায় বিলি কেটে দিলো রেদোয়ান।
—“তোমার চুলে ময়লা হয়েছে।শ্যাম্পু করো না কেন?”
—” কালকে করব।তওসিফ ভাইয়ের সাথে কী কথা বললেন?”
—” এই, বাড়ির ভালো-মন্দ।একটা খবর দিল তওসিফ।”
—” কী?”
—” তোমার ক্রাশ চাঁদ সওদাগরকে নাকি আবারো তোমাদের বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়।”
—” আমার ক্রাশ?”
—” ক্রাশই তো।চাঁদ সওদাগর তোমার বাল্য বয়সের ক্রাশ ছিল।মেহরাবকে তোমার কাছে তার মতোই লাগতো।তারমানে, সেও তোমার ক্রাশ।”
—” এসব গাজাখুরি যুক্তি পেয়েছেন কই?”
—” আরে, এটা সত্যি।তওসিফের মুখে শুনেছি,তুমি নাকি নাচতে নাচতে বিয়েতে রাজি হয়ে গেছিলে।”
—” এতো মিথ্যুক কেন আপনি? আপনার সব কথা আমি বিশ্বাস করি না।”
—” আচ্ছা, ঠিকাছে।করো না বিশ্বাস।কিন্তু, একটা কথা বলো মেহরাবের সাথে যদি তোমার বিয়ে হতো; তবে কেমন লাগতো তোমার?”
—” কেমন আর লাগতো।ভালো লাগতো।চাঁদ সওদাগরকে আমার খুব পছন্দ।ওনাকে তার মতো দেখা যায়,তাই তাকেও ভালো লাগতো।ওনার সাথে বিয়ে হলে আজ আপনার জায়গায় উনি থাকতো।”
রেদোয়ান কিছু বলল না।আরো ঝাপটে ধরলো নীরাকে।নীরার দম বোধহয় বন্ধ হয়ে আসবে। সে গা ঝারা দিয়ে বললঃ” আরে কি করছেন? সরুন তো।সেই কখন থেকে বলছি।আপনার জন্য ভুরি ভাজাগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।দেখি সরুন।”
—” গোল্লায় যাক তোমার ভুরি ভাজা।তোমার সাথে কখনোই মেহরাবের বিয়ে হতো না।”
—“কেন?”
—” তুমি সম্রাজ্ঞী। সওদাগরের সাধ্য নেই সম্রাজ্ঞীকে ভালো রাখার।সম্রাজ্ঞী শুধু সম্রাটের ভাগ্যেই থাকে।”
—” আপনি সম্রাট? ”
রেদোয়ান বেশ ভাব নিয়ে বললঃ” আবার জিগায়।”
নীরা হাসে।মনে মনে প্রার্থনা করে, যাতে এই মানুষটার কাছে আমৃত্যু সম্রাজ্ঞীর আসনেই থাকতে পারে।

***

ইশরাকের ছেলের নাম আবদুল্লাহ আল সাইম।সাইমের মুসলমানি হয়েছে দু-দিন হলো।বেশ খাওয়া -দাওয়া হয়েছে বাড়িতে।নীরার এই জিনিসটা ভালো লাগেনি।পিচ্চিটা ব্যাথায় কাঁদলো আর বাড়িভর্তি মানুষ আনন্দে গান্ডে-পিন্ডে গিললো।এটা কি ঠিক হলো?রেদোয়ান এসেছিল কালকে।নীরা এসেছে একসপ্তাহ হয়েছে।গত শনিবারে তওসিফের সাথে বাসে উঠেছিলো। অফিস খোলা থাকায় রেদোয়ান কাল এসে আবার কালকেই চলে গেছে।নীরা পুকুর পাড়ে হাঁটছিল।শ্রাবণ মাস হলেও এখানে এখনো বৃষ্টি চোখে পরে নি নীরার।তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।বর্ষাকালে যদি বৃষ্টি নাহয়, তবে কিসের বর্ষা?খরখরা মাটিতে একা একা হাঁটতে হাঁটতে নীরার মনে পরে যায় দু-বছর আগের বর্ষার কথা।দু- বছর আগে লকডাউনে নীরার বিয়ে হয়েছে।বাড়ির সবাই যখন জানতে পেরেছে যে নীরা রাজি,তখন বেশ খুশি হয়েছে সবাই।কামরুল সাহেবও চিন্তামুক্ত হলেন।প্রতিবেশীরা মুখ বাঁকালো।হুহ! এতিম ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয় কে?তাছাড়া, বিয়ের পর থাকবে শহরে।মেয়েকে মেরে রেখে দিলেও দেখার কেউ নেই।শুভাকাঙ্ক্ষীর দলেরা নীরার কানের কাছে সময়ে অসময়ে এসে গুনগুন করতে লাগলো এসব বলে।তবে, জয়নব বেগম বেশিদিন এসব চালাতে দিলেন না।শক্তহাতে দমন করলেন এদেরকে।নীরার সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি খুশি ছিল কুসুম ও তওসিফ। তারা দুজনে আগে থেকেই রেদোয়ানের ভক্ত।তাই তাদের খুশি দেখে কে! লকডাউনে দোকান- পাট বন্ধ বলে বিয়ে উপলক্ষে খুব বেশি কিছু কিনতে পারলো না রেদোয়ান। একটা লাল বেনারসি পর্যন্ত না।অনেকগুলো দোকান ঘুরে একটা মাত্র শাড়ি পছন্দ হলো।হালকা বেগুনি রঙা একটা শাড়ি।আঁচলে সাদা বড় ফুল।সাদার মাঝে একটু সোনালী রঙের কাজও চোখে পরে।খুব ভালো লাগলো রেদোয়ানের।দ্বিগুন টাকা দিয়ে বিয়ের জন্য ওটাই কিনে নিলো।বিয়ের শাড়ি দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো কুসুম।সাহস করে রেদোয়ানকে জিজ্ঞেস করেই ফেললোঃ” বিয়েতে বেগুনী রঙ কে পরে?”
—” কেন শাড়িটা ভালো হয়নি।”
—“ভালো কিন্তু রঙটা কেমন যেন।”
—” আমার তো ভালোই লাগলো।একদম কস্তুরি ফুলের মতো।তোমার বোনের না কস্তুরি ফুল পছন্দ।তাই তার শাড়িও এরকম।”
তাই তো! নীরার তো কস্তুরি ফুল পছন্দ।অবশেষে এক রোদেলা বর্ষা দুপুরে নীরার বিয়েটা রেদোয়ানের সাথে হয়েই গেল।বিয়ের পর লকডাউন খুললে ছয়মাসের মতো তারা চট্টগ্রামে ছিল।নীরা এখানে এসে জ্বরে পরলো।আবহাওয়া সহ্য হয়নি তার।খাবারও খেতে পারতো না।আশেপাশের মানুষের কথাও বুঝতো না।কি একটা অবস্থা।রেদোয়ান খুব চেষ্টা করলো বদলির জন্য।রেদোয়ানের ভাগ্য ভালো।কাজের রেকর্ড ভালো হওয়ায় বদলি হয়েও গেল ঢাকা।ঢাকায় এসে একটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো নীরা।সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত নীরারা জীবন কাটায় দূষিত, ব্যস্ত শহরে।
—” কি করো,নীরাপু?”
কুসুমের প্রশ্নে ঘোর কাটলো নীরার।
—” কিছু করি না।সাইম কী করে?”
—” ব্যথায় চিল্লায়।আচ্ছা, একটা কথা বলো।তুমি কি ভাইয়ার সাথে ঝগড়া কইরা আসছো?”
—“কেন?”
—” ভাইয়া তো তোমারে এতোদিন রাখে না।বগলদাবা করে নিয়া আসে আবার বগলদাবা করে নিয়া যায়।”
নীরা হাসে।রেদোয়ানের স্বভাব সবার জানা।কথায় কথা বাড়ে।নীরা- কুসুমের কথাও চলতে থাকে।কথার একফাকে নীরা প্রশ্ন করেঃ” মেহরাব ভাই নাকি আবার এদিকে আসে?”
মলিন হাসে কুসুম।
—” তুমি কার থেকে শুনলে?”
—” তওসিফ ভাই বললো।।”
—” সে যে আবার আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিছে ওইটা বলে নাই।গাধার বুদ্ধি দেখছো?”
কয়েক বছর আগে মেহরাবের চিঠি পড়ে নীরা আন্দাজ করেছিল, ভবিষ্যতে এমন কিছুই হবে।
—” বাড়ির সবাই কী বলেছে?”
—” বলেছে এ বাড়ির দিকে পা বাড়ালে পা ভেঙে রেখে দেবে।”
—” এরকম করার কি আছে? সে তো ভালো ছেলে।”
কুসুম অবিশ্বাসের চোখে তাকায়।তারপর অবাক কন্ঠে বলেঃ” বিয়ে পালানো ছেলেকে কেউ ভালো ছেলে বলে?বাড়ির সবাই রাজি হলেও তো আমি রাজি হব না।”
নীরার কুসুমকে সব বলে দিতে ইচ্ছে করে।আড়াই বছর আগে কুসুমের কারণেই নীরাকে প্রত্যাখান করেছিল মেহরাব।তবে বলে না।উল্টো প্রভাব পড়বে কুসুমের উপর।ওকে বুঝ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলেঃ”এক ভুল কি মানুষ বারবার করে?গতবার আমার সাথে যা করেছে তা তোর সাথে করবে না।মিলিয়ে নিস।”
—” পালানোর প্রতি মানুষের একটা নেশা থাকে,নীরাপু।দেখ না, ক্ষতি হবে জেনেও ছেলে-মেয়েরা স্কুল পালায়।যেই ছেলে তোমাকে ছেড়ে পালাতে পেরেছে,সে আমাকে ছেড়েও পালাতে পারবে।”
—” তবুও…
—” তুমি আমাকে এ ব্যাপারে বুঝিয়ো না, নীরাপু।তুমি শত বুঝালেও আমি বুঝবো না।”
নীরা আর বুঝায় না।ভবিষ্যতের সব নির্দিষ্ট করেই রাখা।সৃষ্টিকর্তা যেমন চাইবেন,মানুষের ভাগ্য সেদিকেই যাবে।এক্ষেত্রে, তাদের কোনো হাত নেই।ভবিষ্যতকে পরিকল্পনা করা যায়,কিন্তু পরিকল্পনায় বেধে রাখা যায় না।

নীরা গ্রামে এসেছে আজ নয়দিন।সকাল থেকেই ভালো লাগছে না কিছু।অস্থির লাগছে,পেট গুড়গুড় করছে।বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু নীরার দেখতে ভালো লাগছে না।কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।শুধু ঢাকার সেই দু-কামরার ফ্ল্যাট ও রেদোয়ানের কথা মনে পরছে।সারা সকাল অপেক্ষা করলো নীরা।দেখাই যাক অস্থিরতা কমে কিনা।কিন্তু না,সময়ের সাথে সাথে তা বেড়েই চলছে।দুপুরের খাবার খাওয়ার আগে নীরা তাই ফোন দেয় রেদোয়ানকে।
—” আসসালামু আলাইকুম। কোথায় আপনি?”
—” বাড়িতে যাচ্ছি।কি খবর তোমার?”
—” ভালো না।সকাল থেকে আপনাকে খুব মনে পরছে,অস্থির লাগছে।একদিনের ছুটি নিয়ে চলে আসেন তো।আমি বাড়ি যাব।”
আর কথা বাড়ায় না নীরা। খট করে ফোন রেখে দেয়।রেদোয়ান মুচকি হাসে।এই নাকি সে তিন সপ্তাহ থাকবে!রেদোয়ান শপিং ব্যাগে একটা শার্ট নিয়ে পা বাড়ায় বাস স্টেশনের দিকে।বউটা আসলেই পাগল।আরো একবার বর্ষা দুপুরে নীরাকে বাড়ি ফিরাতে ছুটে গেল রেদোয়ান।

আগের পর্বের লিংকঃ
https://m.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/1045828079556021/

( আমার কাঁচা হাতের পচা লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here