বর্ষা দুপুর (পর্বঃ১৩) হালিমা রহমান।

বর্ষা দুপুর (পর্বঃ১৩)
হালিমা রহমান।

সেই বিকাল থেকে কুসুম শুধু নীরার পিছু পিছু ঘুরছে।একটা মানুষ পিছু পিছু ঘুরলে কেমন লাগে? নীরা মেনে নিলো।ঠিক আছে পিছন পিছন থাকবি, থাক।কিন্তু, এরকম মিটমিট করে হাসার কি আছে? আশ্চর্য! রেদোয়ান আসার পর থেকে নীরা যেখানে যাচ্ছে, কুসুমও সেখানেই যাচ্ছে।আর কিছুক্ষণ পর পর দাঁত কেলিয়ে হাসছে।অসহ্য,বিরক্তিকর সেই হাসি।হাসিতে যেন স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। নীরা আর সহ্য করতে পারলো না এই অত্যাচার। কপাল কুঁচকে বললঃ” সমস্যা কী তোর?”
—” কোনো সমস্যা নেই তো।”
—” সমস্যা না থাকলে আমার পিছু পিছু ঘুরার মানে কী?আর ঘুরছিস ভালো কথা, এরকম অকারণে হাসছিস কেন?”
—“অকারণে হাসছি না।একটা কারণে হাসছি।”
—” কী কারণ? ”
—” রেদু ভাইয়া ফিরে আসছে।”
—” তাতে তোর কী?”
—” আমার অনেক কিছু।আমি একটা বিয়ে খেতে পারব,বিয়ে উপলক্ষে কেনা-কাটা করতে পারব,শহরে একটা নতুন আত্মীয় বাড়ি হবে সেখানে বেড়াতে যেতে পারব…
কুসুমের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারল না নীরা।এই মেয়ে এতো কিছু ভেবে ফেলেছে!কোথায় আছে কি,পান্তা ভাতে ঘি; হুহ! যত্তসব।নীরা কি ওকে বলেছে, ও এখন বিয়ে করবে!ও এখন কিছুতেই বিয়ে করবে না।বাবা-মা বললেও না।নীরা অনেক পড়বে,অনেক বড় হবে।যতটুকু বড় হলে আকাশটাকে ছোঁয়া যায়, ঠিক ততো।আহ! আকাশ কি ছোঁয়া যায়? না, হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না।তবে মন দিয়ে তো ছোঁয়া যায়।নীরা মানসিকভাবে ঠিক ততোবড় হবে যাতে মনের ভিতর পুরো আকাশটাকে পুরে ফেলা যায়।মানসিক পরিপক্কতাই তো সব।
—” এই নীরাপু,কী ভাবো?”
—” ভাবছি,তুই যে এতোকিছু ভাবছিস তাতো কিছুই হবে না।তোর ছোট্ট মনটা ভেঙে যাবে।কী হবে তখন তোর কুসুম?তুই একটা মন ছাড়া মানুষে পরিনত হবি।অবশ্য, তোকে কি আর তখন মানুষ বলা যাবে?যার মন থাকে না তাকে রোবট বলে।তোকেও আমরা তখন রোবট বলব,কুসুম রোবট। ”
কুসুম ক্ষণিকের জন্য গাল ফুলালো।এই নীরাপুটা এমন কেন? কোনো পরিস্থিতি বুঝে না।কুসুম এতোদিন আল্লাহর কাছে কত দোয়া করল।প্রতি মোনাজাতে কেঁদে প্রার্থনা করল নীরার জন্য।নীরা বিয়ে ভাঙার পর যতোদিন নিজেকে একা ঘরে বন্দি করে রেখেছিল,প্রতিবেশিদের চিন্তার তোড়ে তাদের সামনে যেত না, হাসত না,খুব বেশি কথা বলত না;ততোদিন কুসুম কেঁদেছে।নীরার জন্য একটা ভালো ভবিষ্যতের দোয়া করেছে।কুসুমের সবসময়ই মনে হতো,রেদোয়ান নীরার জন্য ঠিক।একদম ঠিক।তাই, কুসুম রেদোয়ানের আগমনে এতো খুশি।কোনো বর্ষাদিন যদি নিয়ে আসে এতো খুশি,এতো আনন্দের বার্তা;তবে এরকম বর্ষা সবসময় থাকুক।বছরজুড়ে বর্ষা থাকুক,তার বর্ষণের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাক সবকিছু।
—” কুসুম,কুসুম।”
নীরার কন্ঠে বাস্তব থেকে ছিটকে এলো কুসুম।
—” বলো।”
—” এখন তুই কী ভাবছিস? তোর ছোট্ট মনের ভবিষ্যৎ পরিনতি?তাই বলছি,আগে আগে এতোকিছু ভাবিস না।এসব কিছুই হবে না।”
—” আমি অন্য একটা কথা ভাবছি,নীরাপু।”
—” কী?”
—” ভাবছি, তুমি অনেক আগে রেদু ভাইয়াকে নিয়ে যেই ভবিষ্যৎ বানী করেছিলে,তাতো সত্যি হলো না।তাহলে এখন যে বলছো,আমার ভাবনাগুলো সত্যি হবে না; এই কথা কি সত্যি হবে? মনে হয় না।তুমিই না জ্যোতিষগিরি ছেড়েই দেও।জ্যোতিষী হিসেবে তুমি খুব খারাপ।”
নীরা চরম বিরক্ত হলো।কুসুমের বাম পায়ের হাঁটুর নিচে পা দিয়ে লাথি মেরে বললঃ”রেদু ভাইয়ের চামচা,তুই আর কখনো আমার সাথে কথা বলবি না।কথা বলতে আসলে তোর পা ভেঙে দেব।ফাজিল মেয়ে।”

***

সন্ধ্যা ছয়টা।নীরাদের বাড়ির অবস্থা বেশ জমজমাট।জয়নব বেগম বরাবরই রেদোয়ানকে খুব ভালোবাসেন।তাই,রেদোয়ান আসাতে তিনি খুব খুশি।ছেলেটা প্রায় এক বছর পর পা রাখলো বাড়িতে।এতোদিন কোথায় কী খেয়েছে কে জানে!শুকিয়ে গেছে অনেক।রেদোয়ান বাড়ি ফিরেই সবার আগে জয়নব বেগমের সাথে দেখা করেছে।তিনি অবশ্য প্রথমে গাল ফুলিয়ে ছিলেন,বেশি কথা বলেননি।যেই ছেলে এক বছর পর যোগাযোগ করতে পারে,তার সাথে আবার এতো কীসের আদিখ্যেতা?কিন্তু এই ভাব বেশিক্ষণ বজায় রাখতে পারেননি।রেদোয়ান এতোদিন কোথায়, কীভাবে ছিল তার বৃত্তান্ত শুনে গলে গেছেন।খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছেন রেদোয়ানকে।ইশ! শহরে এই ছেলেটা খুব কষ্ট করেছে।তাই তো এমন হাল চেহারার।জয়নব বেগম রাতের খাবার রাঁধতে বসেছেন এখনি।অনেক কিছু রাঁধবেন।তাই তারই ব্যবস্থা করতে সন্ধ্যার দিকেই আসন গেড়েছেন রান্নাঘরে।
তওসিফের ঘরে সন্ধ্যার উত্তাল আড্ডা বসেছে।ইশরাক,রেদোয়ান, তওসিফ,ইরা,তোহা বসে আছে খাটের উপর।কুসুম দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে,ওদের কথা শোনার জন্য।সে মনে মনে খুব বিরক্ত নীরার উপর।নীরাপু এতোটা ফাজিল! সে থাকলে কুসুম এখন ভিতরে যেতে পারতো।নীরা ঘরের ভিতর কি যেন করছে।সে এখন কিছুতেই বাইরে বের হবে না।অগত্যা কুসুম একাই এলো।ইশরাক, তওসিফ একা থাকলে কুসুমও অবলীলায় ঘরে ঢুকে যেত।কিন্তু, এখন রেদোয়ানের জন্য পারছে না।কুসুমেরও আজ রেদোয়ানের সামনে যেতে কেমন একটু বাধ বাধ ঠেকছে।সে সবসময়ই রেদোয়ানকে সাধু-সন্ন্যাসী ভাবত।কিন্ত,এখন কেন যেন এরকম ভাবতে ইচ্ছে করে না।সবসময় চুপচাপ থাকা রেদোয়ানের সামনে যেয়ে কুটিল হেসে বলতে ইচ্ছে করেঃ”এই যে রেদু ভাই,এতো নিরীহ ভাব নিয়ে কেন বসে আছেন?আপনি তো এতো শান্ত-ভদ্র নন।আপনি যে একটা বিড়াল-তপস্বী তা আমার জানা আছে।”

ইশরাকের মন এখন খুব ভালো।রিমাটা নিশ্চিত একটা জাদুকরী।ইশরাক কতকিছু ভেবেছিল।রিমার সাথে কথা বলবে না,ইশরাকের রাগ ভাঙাতে আসলে রিমাকে উপেক্ষা করে বাইরে চলে যাবে,আজ রাতে তওসিফের ঘরে ঘুমাবে এরকম আরো কতকিছু।কিন্তু তা আর হলো কই।রিমা যখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললঃ”এবারের মতো মাফ করা যায় না?আর কখনো এমন করব না, কসম।”
ইশরাক আর পারলো কই রাগ করে থাকতে!ছোট্ট একটুখানি একটা মেয়ে ভুল করেছে।অবশ্য,খুব বেশি ভুল না।ঢাকা দেখতে গেছে।ওরই তো এখন বয়স সবকিছু ঘুরে দেখার।ইশরাক রাগ করেই ভুল করেছে।তাই সে রাগটুকু গিলে নিয়ে মুচকি হেসে বললঃ”কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে হলে আমাকে আগে থেকে বলবে।হুটহাট আবদার করবে না।বুজেছো?যাও ঘুমিয়ে থাক কিছুক্ষণ। ”
তওসিফ সামনে থাকা প্লেট থেকে একমুঠ মুড়ি মুখে দিয়ে বললঃ”এতোদিন কই ছিলেন রেদু ভাই?আপনার ফোনটাও বন্ধ ছিল। আমি অনেকবার কল করেছিলাম।”
—” আর বলো না।এই এক বছরে জাহান্নাম গেছে আমার জানের উপর দিয়ে।যেই বাসে উঠেছিলাম ঢাকা যাওয়ার জন্য,সেই বাস স্টেশনে পৌঁছে অন্য একটা বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করল।আমি পিছনে ছিলাম বলে ক্ষতি একটু কম হয়েছে।হাত-পায়ে কাঁচ ঢুকে গেছিল।ভীরের মধ্যে মোবাইলটাও কোথায় হারিয়ে ফেললাম।পকেটে হাত দিয়ে দেখি মানিব্যাগও নেই।বাস স্টেশনের পাশেই একটা ফার্মেসী ছিল, সেখানের লোকটা আমাকে ধরে নিয়ে গেল তার ফার্মেসীতে।কাঁচ বের করে দিল,প্রাথমিক চিকিৎসা যাকে বলে আরকি।বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিলাম সেখানে।প্রায় ঘন্টাখানেক পর ভাইয়ার শালা এসেছিল সেখানে।আমি যেহেতু তাদের বাড়ি চিনিনা, তাই তাদের একজনের থাকার কথা ছিল বাস স্টেশনে।ভাইয়ার শালা না এলে খবর ছিল সেদিন আমার।পরে তাদের বাড়ি গেলাম,বেশ অমায়িক তারা।টাকা ছিল না বলে সিম তুলতে পারলাম না।অন্যদিকে, তোমার বা ইশরাক ভাইয়ার নাম্বারও মুখস্ত নেই।তাই, যোগাযোগ করতে পারিনি।”
ইশরাক চিন্তিত স্বরে বললঃ”তারপর, চাকরি হয়েছিল তোমার?”
—” সেই আরেক মসিবত।যেই কোম্পানিটা আমার টার্গেট ছিল, সেখানে টিকলাম না। অভিজ্ঞতা ছাড়া সেখানে কেউ যোগদান করতে পারে না।আরেকটা যেই কোম্পানি ছিল, সেটাতে টিকলাম।তবে চাকরি অস্থায়ী। ওই কোম্পানির একটা শাখা আছে চট্টগ্রামে। আমার পোস্টিং পরলো সেখানে।এক বছর পর তারা কাজের রেকর্ড দেখবে।কাজ যদি ভালো হয় তবেই চাকরি স্থায়ী হবে,বেতন বাড়বে।চাচ্চু টাকা পাঠিয়েছিল সেই মাসে।সেগুলো খরচ করে নতুন সিম কিনলাম,মোবাইল কিনলাম,চট্টগ্রামে থাকার ব্যবস্থা করলাম।কি একটা অবস্থা,ভাই! আমি সেখানে রাস্তা-ঘাট কিছু চিনিনা,খাবার খেতে পারিনা,আবহাওয়া সহ্য হয়না। অসুখে পড়লাম প্রথম মাসেই,অথচ দেখার মতো কেউ নেই।অনেক কষ্টে মানিয়ে নিয়ে রাত-দিন খেটে কাজ করেছি।চাকরি স্থায়ী হলো,বেতন বাড়লো।এই লক-ডাউনে অফিস বন্ধ থাকবে,তাই ভাবলাম গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।অফিস থেকে আজ ছুটি নিয়ে বাস স্টেশনে এসেছি,দেখি রিমা ভাবি দাঁড়িয়ে আছে।তার পাশে দুটো লোক।ঘটনা কি তা বোঝার জন্য এগিয়ে যেতেই বুঝলাম, ভাবির বোন-জামাই ওই ছেলের সাথে পাঠাতে চাইছে।ব্যাপারটা ভালো লাগলো না।তাই ভাবির অনুমতি নিয়ে তার টিকেট কাটলাম আমার সাথেই।তারপর একসাথে পাড়ি দিয়ে আসলাম এতোটা পথ।”
তওসিফ এঁটো হাত ধুতে ধুতে বললঃ” এখন কোথায় আছেন?ঢাকা নাকি চট্টগ্রাম? ”
—” চট্টগ্রামে আছি।তবে ঢাকায় আসার জন্য আবেদন করেছি।লক-ডাউনের পরে বোঝা যাবে কি হয়।”
—” ভাই,বিয়েটা এবার করে ফেলেন।আপনার একজন সঙ্গী প্রয়োজন এখন।একা একা কি মানুষ থাকতে পারে?”
রেদোয়ান মুচকি হাসলো।কুসুম দরজার আড়াল থেকে সেই হাসি দেখে নিজেও হাসলো।কুসুমের মনে হচ্ছে রেদোয়ান এখন মনে মনে বলছেঃ” তোমার বোনটাকে বিয়ে দেও আমার কাছে।আমি তো রাজিই আছি।”

***

নীরা রান্নাঘরে যাচ্ছে।এতোক্ষণ ইচ্ছে করেই ঘরে বসে ছিল।ভালো লাগছে না কিছু।একদিকে রেদোয়ানের সামনে যেতে অস্বস্তি হচ্ছে,অন্যদিকে কুসুমের প্যানপ্যানানি। কুসুমের কথা শুনে নীরার মনে হচ্ছে, রেদোয়ানের প্রতি দূর্বল না হওয়া একটা পাপ।কুসুমের কথাই হচ্ছে—” তার মতো এতো ভালো মানুষ তোমাকে এতো ভালোবাসে, তুমি কেন বাসবে না?”
নীরা আশ্চর্য হয়ে যায় এই মেয়ের কথা শুনে।সে কুসুমকে বুঝাতেই পারে না,একপাক্ষিক কোনো সম্পর্ক হয় না। এ কি জোর-জবরদস্তি নাকি?
নীরা উঠোনের মাঝে যেতেই দেখা হয় রেদোয়ানের সাথে।অন্ধকার হলেও চিনতে অসুবিধা হয়না নীরার।দুজনেই হয়তো একটু থমকে যায়।বিকালের পর এই প্রথম দেখা।রেদোয়ান মুচকি হেসে বলেঃ” ভালো আছো, নীরা।”
নীরা নিজেকে সামলে নেয়।অস্বস্তিটুকু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মুচকি হাসে।
—” জ্বি,ভাইয়া।আপনি ভালো আছেন?”
—” হ্যাঁ। বিকেলের পর আর দেখলাম না তোমাকে।কোথাও গেছিলে?”
—” না,ভাইয়া।ঘরেই ছিলাম।আপনি কোথায় যাচ্ছেন?আপনার ঘরে?”
—“হ্যাঁ। ঘরটা একটু ঘুরে দেখব।”
—” ঠিক আছে,দেখুন।আমি ইরাকে বলছি ঘরের তালা খুলে দিতে।”
নীরা সামনে পা বাড়ালো। মনে মনে ধন্যবাদ দিল রেদোয়ানকে।ভদ্র-সভ্য মানুষটাকে সামনাসামনি ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে,সে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেনি বলে।নীরা দু-পা এগিয়ে যেতেই পিছু ডাকলো রেদোয়ান।নীরা পিছু ফিরতেই দেখলো রেদোয়ান দু-পা এগিয়ে এসেছে।এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললঃ” তুমি কি এখনো বাংলা দ্বিতীয় পত্রে অনেক কাঁচা নীরা?”
আহ! অস্বস্তিরা চক্রবৃদ্ধি হার ফিরে এসেছে।নীরা কোনো উত্তর না কতে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল।সবাই ঠিকই বলে,পুরুষ মানুষকে কখনো বিশ্বাস করতে নেই।

চলবে…
বি.দ্রঃ( ভুল -ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

আগের পর্বের লিংকঃ
https://m.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/1044540863018076/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here