বর্ষা দুপুর (পর্ব-১৪) হালিমা রহমান

বর্ষা দুপুর (পর্ব-১৪)
হালিমা রহমান

নীরার ঘরের জানালা দিয়ে বাড়ির পিছন দিকটা দেখা যায়।নীরাদের বাড়ির পিছনে ছোট-খাটো একটা বাঁশঝাড় আছে।আর আছে কিছু কচুগাছ।লম্বায় এরা বোধহয় একহাত।নীরা বিছানায় শুয়ে একমনে সেদিকে চেয়ে ছিল।একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে।একদম মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার পরের সময়টুকু নীরার খুব ভালো লাগে।চারপাশটা কেমন ধোয়াশা হয়ে যায়! মনে হয় যেন কুয়াশা। একদম ঘোলা ঘোলা একটা পরিবেশ।নীরা যখন ছোট ছিল, তখন এরকম পরিবেশ দেখলে ভাবতো তার বোধহয় চোখে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।নাহয় ঘোলা কেন দেখবে সব? তারপর একটু বড় হয়েই বুঝলো, নাহ তার চোখে সমস্যা নয়।এটা প্রকৃতিরই আরেক রূপ।নীরা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় প্রকৃতির এতো রূপ দেখে।এতো রূপ একসাথে নিজের মাঝে কী করে ধরে রাখে?
বৃষ্টির পানিতে ভিজে বাঁশপাতা ও বাঁশগাছ একদম চকচক করছে।কচুপাতাগুলোর উপর পানি জমে আছে।এবড়োথেবড়ো মাটিতে কাদা জমে গেছে।আর কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলে নিশ্চিত পানি জমে যেত।নীরার নাকে ধাক্কা দিচ্ছে ভিজা মাটির গন্ধ।ভিজা মাটির গন্ধটা কি সুন্দর!নীরার খুব পছন্দ।তাই বৃষ্টির পরেই নীরার খুব ইচ্ছে করে, মাটি জড়িয়ে শুয়ে থাকতে।যাতে এই সুন্দর গন্ধ নীরার শরীরেও একেবারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায়।
অনেক সময় পর নীরার ঘরে কুসুম এলো।কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে থাকার কারণে সে ভেবেছিল নীরা বোধহয় ঘুমিয়ে আছে।তাই ভাবলো চলে যাবে।কিন্ত,যাওয়া হলো না আর।পিছন থেকে কুসুমকে ডাক দিল নীরা।
—” চলে যাচ্ছিস যে?”
—” তুমি ঘুমাও নি?”
—” নাহ।কিছু বলবি?”
নীরা উঠে বসলো শোয়া থেকে।কুসুমও খাটের কিনারায় এসে বসলো।কুসুমের চেহারাটা একটু শুকনো শুকনো ঠেকছে নীরার কাছে।কী ব্যাপার? বাড়িতে কি আবার কিছু ঘটলো নাকি?
—” তোর চেহারা এমন দেখা যায় কেন?মন খারাপ? নাকি বাড়িতে কিছু হয়েছে?”
—” কিছু হয়নি।বাড়িতে ঝামেলা হলে তোমার কানে আসতো না?”
—” তবে?”
—” তুমি অনেক নিষ্ঠুর নীরাপু।”
নীরা অবাক হয়ে গেল।ও কি প্রশ্ন করলো আর এই মেয়ে কি উত্তর দিচ্ছে।নীরা চিন্তিত মুখে ডান হাতের তালু চেপে ধরলো কুসুমের কপালে।
—” জ্বর এসেছে নাকি তোর?এরকম উল্টা পাল্টা কথা বলছিস কেন?”
কুসুম নিজের কপাল থেকে নীরার হাত সরিয়ে দিল।গলায় ক্ষোভ তুলে বললঃ”আমি ঠিকই আছি।কিন্তু, তুমি ঠিক নেই।কীহয় রেদু ভাইয়ার সাথে বিয়েতে রাজি হলে?জানো এই এক সপ্তাহে তার চেহারার কী হাল হয়েছে?আজকে আবারো মেজ কাকার সাথে কথা বলতে গেছে সে।মেজ কাকার সেই এক কথা।তার মেয়ে রাজি হলে সেও রাজি হবে।মানে, আমি অবাক হয়ে যাই।মেহরাবের মতো একটা হতভাগার সাথে যখন বিয়ে ঠিক করলো,তখন তো মেয়েকে জিজ্ঞেস করেনি।এখন রেদু ভাইয়ার সময়ই সব নিয়ম! যত্তসব।যাইহোক, রেদু ভাইয়া আজ চলে যাবে।তবে যাওয়ার আগে তোমার সাথে একবার কথা বলতে চায়।বলেছে বিকালের দিকে একটু পুকুর পাড়ে থাকতে।”
—” কোথায় যাবে সে? লক-ডাউনে কি ঢাকা যেতে পারবে?”
কুসুম মুখ ঝামটা দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললঃ”সে কথা তুমি জেনে কী করবে?তোমাকে যা বলা হয়েছে, তাই করো।ভুলেও কিন্তু ঘুমিয়ে যেয়ো না।যদি বিকালে পুকুর পাড়ে না থাকো,খবর আছে তোমার।সবকিছুতে তোমার খামখেয়ালি আমি মোটেও সহ্য করব না।”
নীরা কুসুমের হম্বিতম্বি দেখে অবাক হয়ে গেল।দুজনের মাঝে বড় কে?পৃথিবীতে আগে কে আসলো?আর আজ জোর কে দেখিয়ে গেল? আশ্চর্য! কুসুমটাও একদম অবুঝ।কিছু বুঝে না।

এই একসপ্তাহ যাবৎ নীরাদের বাড়ির পরিবেশ অনেকটাই এলোমেলো।দিন কয়েক আগে, রেদোয়ানের চাচা কামরুল সাহেবের কাছে ফোন করেছিল।প্রথমে নীরার বাবা খুব অবাক হয়েছিলেন।রেদোয়ানের চাচাকে তিনি দেখেছিলেন বহু বছর আগে।প্রায় ঊনত্রিশ বছর হবে বোধহয়।সিলেট যাওয়ার পরে আর কখনো দেখা হয়নি তার সাথে।তাই এতো বছর পর যোগাযোগ করায় অবাক হওয়ারই কথা।রেদোয়ানের চাচা বেশ অনেক্ষন কথা বলেছেন।প্রথমে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলেও পরে আসল কথায় আসেন।এতো বছর পরে যোগাযোগের মূল কারণ হলো নীরা।নীরা ও রেদোয়ানের বিয়ের কথা বলার জন্যই তিনি মূলত ফোন করেছিলেন।কামরুল সাহেব ভালো -মন্দ কিছু বলেননি।শুধু বলেছেন সবার সাথে আলোচনা করে পরে জানাবেন।সেদিন রাতে এ বিষয়ে সর্বপ্রথম তিনি আলোচনা করেন জয়নব বেগমের সাথে।সারাদিনের কাজ-কর্ম শেষে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিলেন সবে।কামরুল সাহেব আগে থেকেই ছিলেন বিছানায়।জয়নব বেগম শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর গলা ঝেরে বললেনঃ” জয়নব,ঘুমাইছো?”
—” উঁহু। ”
—” একটা কথা কইতাম তোমারে।”
—” কী?”
—” আসলে রেদোয়ানের কাকায় আজকে ফোন দিসিলো বুঝছো…
—” রেদোয়ানের কাকায়!”
—” হ।হেয় কল দিসিলো রেদোয়ানের লগে আমগো নীরার বিয়ার ব্যাপারে কথা কইতে।হের ইচ্ছা রেদুর বউ হিসাবে আমগো নীরারে নিব।”
সহসা কথাটা বোধগম্য হলো না জয়নব বেগমের।কয়েক সেকেণ্ড পরে যখন পুরো কথাটা বুঝলেন বিস্ময়ে উঠে বসলেন।
—” কী কইতাছেন আপনে?সত্যি?”
—” হ।রেদুর চাচায় তো তাই কইলো।আর আমার কী মনে হয় জানো?”
—” কী?”
—” রেদুই রেদুর চাচারে দিয়া কথা কওয়াইছে।নাহয়,হেয় তো নীরারে দেহেও নাই।এমনকি নীরার ব্যাপারে জানারও কথা না তার।”
জয়নব বেগমেরও মনে হলো তার স্বামীর কথাই ঠিক।তিনি চিন্তিত স্বরে বললেনঃ” কী কইছেন আপনে? আগের বারের মতো এবারেও কথা দিয়া ফালাইছেন? বিয়ার ডেট কবে?”
জয়নব বেগমের গলায় স্পষ্ট তাচ্ছিল্যের সুর।কামরুল সাহেবের ভিতর অনুশোচনা দেখা দিলো।ঘরের বাতি জ্বালানো থাকলে জয়নব বেগম তার কথার জন্য লজ্জিত হতেন।কারণ, অতীতের এক ভুলের জন্য তার দূর্বল স্বামীর চোখ ফেটে দু-ফোটা জল গড়িয়ে পরলো যে।কামরুল সাহেব গলা ঝেরে বললেনঃ” আমি কিছু কই নাই।কইছি সবার লগে আলাপ কইরা জানামু।এহন তোমার কী মত?”
—” দেহেন,রেদু বাবা অনেক ভালো।তারে নিয়া আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই।হের কাছে মাইয়া বিয়া দেওন যায়।কিন্তু,নীরা কী রাজি হইব?আর আমারো এতো ছোট বয়সে মাইয়া বিয়া দিতে মন চায় না।এহন দেহেন আপনে কী করবেন।”
জয়নব বেগম সব ভার দিয়ে দিলেন কামরুল সাহেবের উপর।কামরুল সাহেব আর কি করবেন? সবার সাথে আলোচনায় বসলেন।আরো একবার খাবার ঘরে নীরার বিয়ে নিয়ে কথা উঠলো।দেখা গেল, এবারে কেউ জোর দিয়ে কিছুই বলছেনা।সবার এক কথা।” মাইয়া তোমার, তুমি ভাইবা দেখ।তবে,পোলা ভালো।দিলে খারাপ হইব না।”
কামরুল সাহেব চোখে যেন সর্ষে ফুল দেখছেন।আশ্চর্য! কেউ একটু জোর দিয়ে কোনো মত দিতে পারছে না।গতবার এক ভুলের কারণে তিনি এখনো মেয়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন না।অথচ,আজ এতো বড় এক কাজের ভার তার একাই নিতে হবে!কি করে নেবেন তিনি সিদ্ধান্ত? যদি ঊনিশ-বিশ হয়? নাহ,ভাবতে পারেন না তিনি।চিন্তায় মাথা ব্যাথা হয়ে যায়।জানটা যেন বেড়িয়ে যাবে এই ব্যাথায়।কামরুল সাহেবকে এই অকূল পাথার থেকে উদ্ধার করে ইশরাক।সে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলেঃ” মেজ কাকা, এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে; তুমি জোর দিয়ে কিছু বলতেও পারবে না আবার বিষয়টা ঝুলিয়েও রাখতে পারবে না।পাড়া-পড়শীর কথাও খেয়াল রাখতে হবে।তারা তো নীরার সামনেই যত্তসব ফাউল কথা বলে।ওর মনেও কিন্তু প্রভাব ফেলে কথাগুলো।তুমি এক কাজ করতে পার,এই বিষয়টা আপাতত নীরার উপর ছেড়ে দেও।নীরা রাজি থাকলে বিয়ে হবে,না থাকলে হবে না।এমনিতে, রেদুরও যখন মত আছে বিয়েতে। রেদুও তো খুব ভালো ছেলে।তুমি ভেবে দেখ।”
কামরুল সাহেব যেন বাঁচলেন।অকূল পাথারের তীরের দেখা পেলেন অবশেষে।ইশরাকের প্রতি অত্যধিক খুশি হয়ে খাবার ঘরে সবার সামনে জোরে জোরেই দোয়া করে দিলেন।
—” তুই বাঁইচা থাক,বাবা।বছরের মাথায় আল্লাহ তোর ঘরে একটা ফুটফুটে সন্তান দেক।”
খুবই ভালো দোয়া।তবে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি,দেবর সবার সামনে এমন খোলামেলা দোয়া করায় খুবই লজ্জা পেল রিমা।আলগোছে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।
জয়নব বেগম ইনিয়ে বিনয়ে নীরাকে জিজ্ঞেস করলেন মতামতের কথা।নীরা অনেকটাই নিশ্চিত ছিল, তাকে এ বিষয়ের সম্মুখীন হতে হবে।তাই ভাবলেশহীনভাবে বললঃ” আমার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই, আম্মা।আমি কি তোমাদের উপর বোঝা হয়ে গেছি, যে একটার পর একটা বিয়ের সম্বন্ধ আনতে হবে?
এরপর আর কোনো কথা থাকে না।জয়নব বেগম বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে।”নীরা বিয়েতে রাজি নয়”— এই কথা রেদোয়ানের কানে গেল আজ সকালে।এই কয়েকদিন খুব অস্বস্তিতে ছিল সে।কয়েকমাস আগে নীরার বিয়ে ভেঙেছে, এই কথা শুনেছে রেদোয়ান। মনে মনে অসখ্য ধন্যবাদও দিয়েছে মেহরাবকে।ছেলেটা কী উপকারটাই না করল! তবে,রেদোয়ান একটু চিন্তায় ছিল নীরার পরিবার নিয়ে।তারা রাজি হবে কি হবে না।কিন্তু,আজ সকালে যখন রেদোয়ান শুনলো নীরা রাজি না বলে বিয়ে হবে না ; তখন অসহ্য বিরক্তিতে সারা শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নীরার ভাগ্য ভালো সে রেদোয়ানের সামনে ছিল না।থাকলে নিশ্চিত রেদোয়ান তাকে মাথায় তুলে একটা আছাড় মারতো।এই মেয়ে কি জানে না রেদোয়ানের দূর্বলতার কথা?কয়েকদিন আগেই তো নাচতে নাচতে বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিল।তখন কোথায় ছিল এসব কথা? নীরা কি রেদোয়ানকে বিয়ে পালানো ছেলে ভেবেছে? আশ্চর্য হয়ে যায় রেদোয়ান।কার জন্য এতোদিন অচেনা শহরে মাটি কামড়ে ছিল?দিন-রাত এক করে কাজ করলো কার জন্য?সবতো নীরা ও তার একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই।নীরা কি কোনো অনুভূতিই বোঝে না? এসবের কোনো মূল্য নেই তার কাছে?ইশ! কি হৃদয়হীনা।এরকম একটা মেয়ের প্রেমেই কেনো পরতে হলো রেদোয়ানকে? এতো মানবী না। এ এক মানুষের শরীরধারী রোবট।

***

আসবে না আসবে না করেও নীরা অবশেষে এসেই পরলো পুকুর পাড়ে।শুধু শুধু একটা বিষয়কে তো আর ঝুলিয়ে রাখলে চলে না।তবে, নীরা অস্বস্তিতে মনে হয় এগোতেই পারছে না।রেদোয়ান একসময় তার গৃহ শিক্ষক ছিল।এমন একটা মানুষের সাথে প্রেম-বিয়ে বিষয়ক কথা বলা সত্যিই অস্বস্তিকর। নীরা বুঝতে পারে না,রেদোয়ানকেই কেন তার প্রেমে পড়তে হলো।আপনি গৃহশিক্ষক, আপনি থাকবেন আপনার মতো।আপনাকে কেন ছাত্রীর প্রেমে পড়তে হবে? আপনাকেই কেন পা পিছলাতে হবে?
নীরা পুকুর পাড়ে পৌঁছে দেখলো, রেদোয়ান আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত।জামগাছে হেলান দিয়ে বসে আছে।নীরা কাছে যেয়ে গলায় হালকা কাশি তুললো।
—” আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন।”
রেদোয়ান নীরার দিকে ব্যাথিত চোখে তাকালো।লাল রঙা জামায় তাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে!তারমানে লাল বেনারসিতেও তাকে খুব ভালো দেখাবে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো রেদোয়ান। মেয়েটা কেন বোঝে না?
—” হুম,দেখা করতে বলেছিলাম তোমাকে।তুমি বোধহয় বুঝতে পেরেছো,আমি কেন ডেকেছি।”
—” জ্বি।”
—“তুমি রাজি না কেন?”
নীরা একটু থমকে গেল।সরাসরি এইরকম একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।
—” আসলে,ভাইয়া আমি এখন রাজি না।আমি আগে পড়াশুনা শেষ করতে চাই।তার আগে বিয়ের কথা ভাবতে চাই না।”
কপাল কুঁচকে ফেললো রেদোয়ান। বিয়ের পরে ওকে পড়তে দেবে না,একথা কখন বলল রেদোয়ান?মেয়েটা কত বেশি বোঝে,ভাবা যায়!
—” এই বন্ধে পড়েছ?”
—” জ্বি।”
মিথ্যে কথা বলায় জিভে দাঁত কাটলো নীরা।এই বন্ধে পড়াশুনা তো দূরের কথা, বইগুলো কোথায় রেখেছে তাই খেয়াল নেই।তবে,একদিক দিয়ে সুবিধা রেদোয়ানতো এখন আর ওকে পড়া জিজ্ঞেস করবে না।মনে মনে খুশিই হলো নীরা।কিন্তু,ওকে অবাক করে দিয়ে রেদোয়ান বললঃ” ঠিক আছে, তাহলে বলো প্রত্যয় কাকে বলে?সমাস কত প্রকার?অংশীদারী ব্যবসায়ে অংশীদারদের কয়ভাগে ভাগ করা যায়?বিজ্ঞাপন কাকে বলে? যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থার বিবরনী ছকে কী কী লিখতে হয়? মোডিফায়ার বর্ণনাসহ বুঝিয়ে দেও আমাকে।কাম্য জনসংখ্যা তত্বের মূলকথা কী?”
নীরার মাথা ঘুরিয়ে যাওয়ার অবস্থা।কোন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা বাকি রাখলো?ঠিক আছে,আবেগে নাহয় বলে ফেলেছে একটা মিথ্যে কথা। তাই বলে এতোগুলো প্রশ্ন একসাথে করতে হবে!আশ্চর্য মানুষ একটা।নীরা আমতা আমতা করে বললঃ” এখন কি আমার এতোকিছু মনে আছে?একবার রিভিশন দিতে পারলে ঠিকই সব পারতাম।”
—” ওমা,তুমি না পড়াশোনার জন্য বিয়েতে রাজি হচ্ছো না।তাহলে, এখনি পড়াশোনার এই অবস্থা।এই অবস্থা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে চাও! তুমি দেখছি খুবই ফাকিবাজ মেয়ে।ভাবে বিশ্বাসী কিন্তু কাজে নও।”
নীরা মুখ ফুলালো।রেদোয়ানের কথায় স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। নীরা মুখ ভোঁতা করে বললঃ”আমার বিয়ে-টিয়ে ভালো লাগে না রেদু ভাই।এসব অসহ্যকর।তাই আমি রাজি না।”
ঘরপোড়া গরু সিঁদূরে মেঘ দেখলে ডরায়— একটা প্রবাদ আছে না।নীরার এখন সেই দশা।রেদোয়ান মনে মনে প্রমাদ গুনলো।যা ভয় পেল ঠিক তাই।বড় একটা শ্বাস ফেলে বললঃ” শোনো নীরা,তোমাকে কিছু কথা বলি।খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে।আমরা যাদের সাথে কথা বলি,একসাথে চলি বা যাদেরকে বিশ্বাস করি– তারা কি সবাই আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখে? রাখে না কিন্তু।কেউ আমাদের প্রত্যাশার চাইতে বেশি করে আবার কেউ চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দেয়।তুমি এক্ষেত্রে কী করবে? বিশ্বাসঘাতকতার সামনাসামনি হলে বিশ্বাস করাই ছেড়ে দেবে? কাউকে বিশ্বাস করবে না?”
—” কেন করব না? সব মানুষ সমান নাকি?”
—” কিন্তু, তুমি তো এই কাজটাই করছো।মেহরাব বিশ্বাসঘাতকতা করলো বলে তুমি আমায় বিশ্বাস করছো না।এটা কি ঠিক হচ্ছে? তুমি কি আমার দূর্বললতার কথা জানতে না? কয়েকমাস আগে যদি আমি এরকম প্রস্তাব নিয়ে আসতাম,তখন কি তুমি নিষেধ করতে?মেহরাবের সময় কিন্তু তুমি নিষেধ করনি।”
নীরা ভেবে দেখলো।সত্যি, কয়েকমাস আগে হলে বিষয়টা বাবা-মায়ের উপরেই ছেড়ে দিত।কিন্তু, এখন পারছে না।নীরা মিনমিন করে বললঃ”আমার প্রতি আপনার যেই অনুভূতি আছে,আপনার প্রতি আমার তা বিন্দুমাত্রও নেই।এক্ষেত্রে আমি কী কতে পারি?”
—” বোকার মতো কথা বলো না।বাংলাদেশে কয়টা লাভ ম্যারেজ হয়? বেশিরভাগই তো এরেঞ্জ ম্যারেজ।সেক্ষত্রে,ছেলে- মেয়ে একে অন্যকে চিনেই না।তবুও তারা বিয়ে করে।শোনো নীরা,বিয়ে করার জন্য খুব বেশি অনুভূতির প্রয়োজন হয়না।অনুভূতিদের দরকার পরে সংসারে।এরেঞ্জ ম্যারেজে কি মানুষ সংসার করে না?”
উত্তরে কিছুই বলল না নীরা।চুপচাপ মানুষটা এতো কথা বলতে যানে!রেদোয়ান আবারো বলা শুরু করলো—” তৈরি হওয়া অনুভূতির চাইতে,তৈরি করে নেওয়া অনুভূতিরা বেশি সুন্দর।এক্ষেত্রে, কোনো খাদ থাকে না।প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।তুমি কি বুঝতে পারছো নীরা?এটা অনেকটা আবিষ্কারের মতো।আবিষ্কারের প্রতি যেমন মানুষের একটা ঝোঁক থাকে,আকর্ষণ থাকে ; এক্ষেত্রেও অনেকটাই এরকম হয়।প্রতিদিন আমরা একে অন্যকে ভিন্নভাবে দেখব,চিনব,জানব।আমাদের মধ্যে কোনো বাধা থাকবে না।তবে,একটু হয়তো সংকোচ থাকবে।আমাকে একটু একটু করে আবিষ্কারের সময় হয়তো তুমি আনন্দ পাবে অথবা কখনো বিরক্ত হবে আবার কখনো রোমাঞ্চিত হবে।সবটা জেনে নেওয়ার পর কী বলবে তুমি নীরা?হয়তো বলবে আপনি খুব ভালো অথবা বলবে আপনি খুবই খারাপ একটা মানুষ।আমি তখন কী করব জানো? মাথা ঝুকিয়ে বলব– ঠিকাছে, তুমিই ঠিক।”
নীরা যেন কল্পনায় সব দেখলো।একমুঠো স্বপ্নের সুন্দর একটা ছবি।আচ্ছা,এরকম হয়? কথাটা ভেবে নিজেকেই আবার উত্তর করলো নীরা–” হবে না কেন? নিশ্চয়ই হয়।ইশরাক- রিমাই তো এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ। হঠাৎ করেই নীরার খুব ভালো লাগলো।নীরার কিশোরী বয়সের আবেগী মন।এ বয়সে সবই ভালো লাগে।নীরার এখন সেই দশা।রেদোয়ানের কথাগুলো শুনতে তো খারাপ লাগছে না বরং ভালোই লাগছে।
—” একটা বিয়ের মাধ্যমে শুধু একটা সম্পর্ক তৈরি হয়না নীরা।এখানে অনেককিছু পাওয়া যায়।একজন অভিভাবক,একজন বন্ধু।আমি কিন্তু অভিভাবক হিসেবে খারাপ নই, বন্ধু হিসেবেও খুব বাজে নই।আর দশটা সাধারন মানুষের মতো আমিও একজন সাধারন মানুষ।স্বাভাবিকভাবেই আমি তোমাকে ভালোবাসি নীরা।আমি তোমাকে পেতে চাইব এটা যেমন স্বাভাবিক একটা বিষয়,তেমনি তুমি ধরা দেবে না এটাও স্বাভাবিক বিষয়।এখানে জোরজবরদস্তি নেই।আমি আবেদন করলাম।সিদ্ধান্ত তোমার।হয় তুমি গ্রহণ করবে নাহয় প্রত্যাখান করবে।এখন তুমিই বলো কি করব আমি? অপেক্ষা করব নাকি ঢাকা চলে যাব?”
সহসা কোনো উত্তর করতে পারলো না নীরা।” প্রত্যাখ্যান ” শব্দটা তার কানে ঝুমঝুম করে বাজতে লাগলো।নীরা জানে প্রত্যাখানের কষ্ট।তাছাড়া,রেদোয়ান খুব ভালো একজন মানুষ।আরেকজনের দোষের শাস্তি কি তাকে দেওয়া যায়?চিন্তায় পরে গেল নীরা।রেদোয়ান এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি।সময় দিয়েছে নীরাকে।কিন্তু, এখন তার মনে হলো আর সময় দেওয়াটা উচিত হবে না।এই মেয়ে এমনিতেই বেশি বুঝে।আবার কি থেকে কি ভেবে বসবে।রেদোয়ান দু-পা এগিয়ে গেল।নরম কন্ঠে বললঃ”একটা কবিতা শুনবে নীরা?আমার নিজের লেখা?”
নীরা মাথা নেড়ে সায় দিলে রেদোয়ান ভরাট গলায় আবৃত্তি করলোঃ
“আমার মন আঙিনায় রইলো
তোমার সাদর নিমন্ত্রণ,
আমার সর্বস্ব জুরেই হোক
তোমার অবাধ বিচরণ।”
এ যেন ছন্দ নয়,আবিষ্কারের নিমন্ত্রণ। নীরার হঠাৎ করেই খুব লজ্জা লাগতে শুরু করলো।কই এতোদিন তো এরকম হয়নি।রেদোয়ান কি একরাশ লজ্জার বীজ বুনে দিলো,কবিতার নাম করে?নীরার ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে।
—” প্রিয় নীরা,ভালোবাসি। ”
আহ! আবারো লাগামছাড়া কথা-বার্তা।নীরা আর পারবে না দাঁড়িয়ে থাকতে।পা ভেঙে আসছে।নীরা হঠাৎ করেই দু-হাতে মুখ ঢেকে নিচু স্বরে বললঃ”আমি কিছু জানি না রেদু ভাই।আপনি আব্বা- আম্মার সাথে কথা বলেন।তারা রাজি থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই।তবে একটা কথা,বিয়ে ছাড়া আমি আর আপনার সামনে দাঁড়াতেই পারব না।আপনাকে দেখে আমার খুব লজ্জা করছে।”
লজ্জা পেলে কে এতো কথা বলে?রেদোয়ান অদ্ভুত সুন্দর করে হাসলো।সেই হাসিতে মিশে ছিল একরাশ প্রাপ্তি ও সুখ।নীরা কিন্তু সত্যিই আর দাঁড়ালো না।একছুটে ঘরে চলে গেল সেখান থেকে।

(চলবে)
(বি.দ্রঃভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

আগের পর্বের লিংকঃ
https://m.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/1045199266285569/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here