বর্ষা দুপুর (পর্ব-৯)
হালিমা রহমান
সকাল থেকে একটু একটু ঠান্ডা পড়েছে।সূর্যের আলোর ঝাঝালো তাপ নেই।নিস্তেজ তাপে মেঘনা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীরার বাবা, কামরুল হোসেন।এমনিতেই ঠান্ডা তার উপর নদীর পাড়।বেশ ঠান্ডাই লাগছে তার।ভয়ংকর বাতাসে হাঁড়ে কাপন ধরার জোগাড়। এ বাতাস যেন শীতের আগমনী বার্তা।
কামরুল সাহেবের নাজুক স্বাস্থ্য। বেশি ঠান্ডা বা বেশি গরম কোনোটাই তার সহ্য হয় না।চার ভাইয়ের মধ্যে মেজ হলেও সবার আগে বুড়িয়ে গেছেন তিনি।প্রতিদিন নদীর পাড়ে আসতেও ভালো লাগে না।ইচ্ছে করে সারাদিন কাঁথা মুরি দিয়ে অলস সময় কাটাতে।কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়।তার পিছুটান অনেক।দুটো মেয়ে, একটা স্ত্রী। কাজ না করলে তার চলবে কেন?তাই হাজার অসুস্থতা, হাজার শখ – আহ্লাদ মাটি দিয়ে প্রতিদিন চলে আসেন নদীর পাড়ে।একটু আত্মত্যাগে যদি স্ত্রী-সন্তান ভালো থাকে, তবে তাই হোক।
কামরুল সাহেব একটু অমনোযোগী হতেই একজন জেলে ফস করে একটা ঢাউস সাইজের রুই মাছ সরিয়ে ফেলল।এখানে যেই দামে বেচতে হবে বাজারে তারচেয়ে তিনগুন বেশি দামে বেচা যাবে।তবে দৃশ্যটি চোখ এড়ালো না কামরুল সাহেবের।এতো বছরের অভিজ্ঞতায় যদি এতুটুকু চালাকি না ধরতে পারেন, তবে তিনি কীসের মাছ ব্যাপারী?কামরুল সাহেব আসামি জেলেটাকে ডেকে বললেনঃ” মাছটা দিয়া দে।”
মুখের রঙ উবে গেল জেলের।তবুও অস্বস্তি চেপে রেখে বললঃ” সব মাছই তো দিলাম। আবার কীয়ের মাছ চান?”
—” যেই রুই মাছটা বদির পাতিলে লুকাইছোছ ওইটা।”
—” কসম কোনো মাছ লুকাই নাই।”
—” আচ্ছা, ঠিকাছে দিস না।ভাবছিলাম তোরে ওই মাছের লেগা দুইহাজার টাকা বাড়ায়া দিমু।তয় তুই যখন চাস না….
লোভে চকচক করে উঠলো জেলের চোখ।সে তড়িঘড়ি করে বললঃ” এবারের মতো মাফ কইরা দেন ভাই।ভবিষ্যতে আর এমন করুম না।এহনি মাছ আইনা দিতাছি।”
মনে মনে হাসলেন কামরুল সাহেব।ব্যাটার লোভ কত! এই মাছ বাজারে নিলে অনায়াসে চার হাজার টাকা বিক্রি হবে।দুহাজারের লোভেই তাকে দিয়ে দিল।গাধা কোথাকার।
বোধহয় সকাল এগারোটা বাজে। কামরুল সাহেব ও তার বড় ভাই ইদ্রিস আলী আড়তে বসে আছেন।তাদের দুজনের কাজ আপাতত শেষ।তবুও বাড়ি না যেয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন।এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন চেয়ারম্যান কাশেম খান।কামরুল সাহেব ও ইদ্রিস আলী অবাক হলেন খুব।তারা সাধারনত উঁচুস্তর ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের থেকে দূরেই থাকেন।অবাক হলেও তা প্রকাশ করলেন না ইদ্রিস আলী। এগিয়ে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন।
—” আসসালামু আলাইকুম ভাই।কি খবর?”
কাশেম খান এগিয়ে যেয়ে হাত মেলালেন।মুচকি হেসে বললেন,
—” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। আপনারা,কেমন আছেন?”
—” আমরাও আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।হঠাৎ এইদিকে যে? মাছ কিনতে আসছেন নাকি?”
—” না ভাই।আপনাদের কাছে অন্য একটা দরকারে এসেছি।একটু বসে কথা বলার সময় হবে?”
ইদ্রিস আলী অবাক হলেও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে বললেন বাহিরে তিনটে চেয়ার পেতে দিতে।ভিতরে অনেক আঁশটে গন্ধ।ইদ্রিস আলী ও কামরুল সাহেবের সহ্য হলেও কাশেম খানের সহ্য হবে না। তাই এই ব্যবস্থা।
কাশেম খান, কামরুল সাহেব ও ইদ্রিস আলী বসার পর, কাজের ছেলেটা তিনকাপ চা এনে দিল।কাশেম খান চায়ে লম্বা এক চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলেন।
—” আমি আসলে আপনাদের কাছে এসেছি আপনাদের বাড়ির বড় মেয়ে নীরার বিষয়ে কথা বলতে।ওতো কলেজে পড়ে শুনলাম।তার মানে আঠারো বছর হয়েছে।মেয়ের বিয়ে-সাদির চিন্তা – ভাবনা করছেন নাকি?”
ভয়াবহ অবাক হলেন দুই সহোদর। আজ বোধহয় তাদের অবাক হওয়ার দিন।কামরুল সাহেব অবাক কন্ঠেই বললেনঃ” হ, নীরার আঠারো বছর হইছে কিন্তু আমরা এহন তার বিয়া দিতে চাইতাছি না।তার মায়ের ইচ্ছা মাইয়া অনেক পড়ব,তারপর বিয়া দিব।আমারো ওই একই ইচ্ছা।কেন? কিছু হইছে?”
—” না,না কিছু হয়নি।আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলতে চাই।”
ইদ্রিস আলী শশব্যস্ত হয়ে বললেনঃ”অনুমতি নেয়ার কি আছে ভাই? আপনে কন কী কইবেন।”
—” আমি নীরা মাকে আমার মেহরাবের বউ হিসেবে নিতে চাই।”
সহসা কোনো কথা বলতে পারলেন না কামরুল সাহেব ও ইদ্রিস আলী। এ তাদের কল্পনাতীত।এটা এমন একটা প্রস্তাব, যা মেনে নিতে কষ্ট হবে আবার সরাসরি প্রত্যাখান করাও সম্ভব না।ইদ্রিস আলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেনঃ” আপনে চিন্তা-ভাবনা কইরা কইতাছেন? না মানে আমি বুঝাইতে চাইতাছি,আমগো ও আপনাগো মাঝে অনেক তফাৎ। তারউপর মেহরাব বাবা অনেক শিক্ষিত,চাকরি ভালো, অনেক বছর ঢাকা ছিল।আমগো নীরার এইসব কিছুই নাই।হয়তো একটু সুন্দর, এই আরকি।তাই বলতাছিলাম।”
কাশেম খান আশ্বাসের ভঙ্গিতে হাসলেন।
—” আপনি চিন্তা করবেন না।আমি সবকিছু চিন্তা করেই বলেছি।”
কামরুল সাহেব এবার মুখ খুললেন।
—” আপনে মেহরাব বাবার লগে কথা কন।এহনকার দিনে পোলাপানের মতামত না থাকলে সংসারে সুখ হয় না।আগে আমগো সময়ে তো বাপ – মা যেই মাইয়ার কথা কইছে তারেই বিয়া করতে হইছে।এখন আবার দিন-দুনিয়ার ভিন্ন স্বাদ।মেহরাব বাবা তো অনেক বছর ঢাকা ছিল সেখানে তার পছন্দ থাকতেই পারে।আপনে তার সাথে যদি আগে আলোচনা করতেন তাইলে ভালো হইতো আরকি।”
এক্ষেত্রে একটু মিথ্যা বলতে হলো কাশেম খানকে।কারণ,তিনি এখানে এসেছেন তা মেহরাব কেন কমলা বানুও জানে না।কাউকে না জানিয়ে একটা অপ্রিয় কাজ করতে এসেছেন তিনি।তবুও মাথা নেড়ে বললেনঃ” আমি সবার সাথে আলোচনা করেই এসেছি।মেহরাব রাজি না হলে এতো তাড়াতাড়ি ওর বিয়ের কথা ভাবতাম না আমরা।আমাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই।এখন আপনাদের ইচ্ছা।মেয়ে আপনাদের, চিন্তা-ভাবনাও আপনাদের।সময় নিন। সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে জানাবেন।আমি অপেক্ষা করব।”
কাশেম খান উঠে গেলে চিন্তায় পরে গেলেন দুই ভাই।কী করা উচিৎ এখন?
***
দুপুর বেলা দেবর,ভাসুর, স্বামী সবাইকে একসাথে বাড়িতে ফিরতে দেখে অবাক হলেন জয়নব বেগম।সাধারণত, তারা একসাথে বাড়িতে ফিরে না।তাছাড়া,কামরুল সাহেবের চেহারাটা কেমন যেন শুকনো শুকনো ঠেকছে।কামরুল সাহেব ঘরে ঢুকে গায়ের ফতুয়া পাল্টানোর সময় জয়নব বেগম জিজ্ঞেস করেই ফেললেনঃ” কী হইছে আপনের? কোনো সমস্যা? ”
—” না। দুপুরের খাবার একটু তাড়াতাড়ি দিও তো।আর তুমিও হাতের কাজ শেষ কইরা রাইখো।জরুরি কথা আছে।”
কি কথা তা আর জিজ্ঞেস করলেন না জয়নব বেগম।সময় হলেই বরং জানা যাবে।
নীরার বিয়ের কথা উঠলো খাওয়ার সময়।নীরা,কুসুম,ইরা,তোহা ছাড়া এখানে বাড়ির সবাই উপস্থিত।ইদ্রিস আলীই প্রথমে কথা পারলেন।
—” জয়নব, আমগো নীরার লেগা একটা সম্বন্ধ আইছে।”
—” মাইয়া বড় হইছে,এইগুলি আইবই।পোলা কে?”
—” চেয়ারম্যান বাড়ির পোলা মেহরাব।”
মেহরাবের নাম শুনে অবাক হলেন সবাই। নীরার সেজ কাকা,জাভেদ ভাত চিবোতে চিবোতে বললেনঃ” মাশাল্লাহ, পোলা তো ভালো।আমগো নীরারে দেখছেনি হেয়?”
পাশ থেকে কথা বলল তওসিফ।
—” ওই ছেলে কয়েকদিন আগে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়িতে উঁকি দিত।আমি নিজের চোখে দেখেছি।এরকম ছেলে ভালো হবে না।নিষেধ করে দিও মেজ কাকা।”
তওসিফকে ভয়ানক এক ধমক দিলেন জাভেদ সাহেব।আঙুল উঁচিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বললেনঃ” মাইনষের পোলারে খারাপ কওয়ার আগে নিজের দিকে তাকা হারামজাদা।ওর যেই যোগ্যতা তা আগে তূই পারলে অর্জন কইরা দেখা।তারপর বড় বড় কথা কইছ।”
বাবার কথার দিকে মনোযোগ দিলো না তওসিফ।সবাই বিশ্বাস করলেও তার বাবা এখনো তাকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি।তাই কিছু না বলে চুপচাপ ভাত খেতে শুরু করলো।জয়নব বেগম দেখলেন মূল কথা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সবাই।তাই ইদ্রিস আলীর মনোযোগ আকর্ষণ করে বললেনঃ” ভাইজান আপনেরা কথা-টথা দিছেন নাকি? না দিলে নিষেধ কইরা দেন।এতো তাড়াতাড়ি মাইয়া বিয়া দেয়ার ইচ্ছা নাই আমার।মাইয়ার ব্রেইন ভালো। পড়তাছে, পড়ুক।তাছাড়া, চেয়ারম্যান বাড়িতে গেলে মাইয়া মানায়া নিতে পারব? সম্বন্ধ করতে হয় সমানে সমানে।আমরা তাগো সমান না।এহন আপনেরা কী কন?”
শাহানা বেগম দূরে বসে ছিলেন।তিনি মাথার আঁচল সামনে টেনে দিয়ে বললেনঃ” বুইঝা শুইনা মত দিও ভাবি।মাইয়াগো চাহিদা থাকতে দিয়া দিতে হয়।তারা যহন এতো আগ্রহ করতাছে,তহন এতো ভাইব না।পোলা ভালো,পরিবার ভালো, তারাই কথা উঠাইছে।তাই, আমার মনে হয় অমত না করলেই ভালো হয়।মাইয়া তো বিয়া দিতেই হইব।আজ হোক আর কাল।”
ইদ্রিস আলীও শাহানা বেগমের কথায় তাল মিলিয়ে বললেনঃ”মেজ বউ, দেখ নীরার বিয়া তো দিতেই হইব।এর চেয়ে ভালো সম্বন্ধ আর পাইবা না।তাছাড়া, তারা খুব আগ্রহ করতাছে।স্কুল – কলেজ বন্ধ।পড়ালেখাও তো হইতাছে না।কামরুলের শরীরটাও খারাপ।একটা মাইয়ার যদি গতি করতে পারে তাও ভালো।এখন ভাইবা দেখ,কী করবা।”
জয়নব বেগম কিছু বললেন না।কেবল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন স্বামীর চিন্তিত মুখের দিকে।
***
চেয়ারম্যান বাড়িতে সবাই খেতে বসেছে।সবাই বলতে কেবল মেহরাব,কমলা বানু ও কাশেম খান।কমলা বানু বেছে বেছে মুরগির মাংসগুলো মেহরাবের পাতে দিচ্ছেন।ছেলেটা যে কেন শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন! কাশেম খান এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে মেহরাবকে উউদ্দেশ্য করে বললেনঃ”তোমার জন্য একটা সু-খবর আছে মেহরাব।”
—” কী বাবা?”
—” আজকে মাছের আড়তে গিয়েছিলাম।ইদ্রিস আলী, কামরুল হোসেনরে বোধহয় তুমি চিনো।চিনো না?”
—” জ্বি চিনি।”
—” ওনাদের সাথে কথা বললাম আজকে।তোমার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে আসলাম,ওই বাড়ির বড় মেয়ে নীরার সাথে।”
কমলা বানু প্রথমে অবাক হলেও পরে খুব খুশি হলেন।বউ হিসেবে নীরাকে তার খুব পছন্দ।তিনি সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললেনঃ” আলহামদুলিল্লাহ।মাইয়া হিসাবে নীরা খুবই ভালো।কোনো খারাপ রেকর্ড নাই।”
—” এই জন্যই কথা বলে আসলাম আজ।তারা বলেছে চিন্তা-ভাবনা করে জানাবে।
কাশেম খানের কোনো অভিব্যক্তি নেই।তিনি নির্বিকার।এখানে বিয়ে না হলেই তিনি বরং খুশি হতেন।তবে কমলা বানু খুশি হলেন খুব।এরকম একটা ফুটফুটে মেয়ে তার ঘরে সংসার করবে ভাবতেও ভালো লাগছে।
আর মেহরাব? সে কেবল অবাক চোখে বাবা – মায়ের দিকে চেয়ে রইলো।ভাত খাওয়া বন্ধ করে দুবার অস্ফুটস্বরে নীরার নাম জপ করলো।।
( চলবে)
(বি.দ্রঃ ভুল -ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)
আগের পর্বের লিংকঃ
https://m.facebook.com/groups/bdofficials/permalink/1041688229970006/