বিধবা_বিবাহ পর্ব-২৮

0
1210

#বিধবা_বিবাহ (ঊনত্রিংশ পর্ব)
ইট পাথরের শক্ত চৌহদ্দিতে মোড়া ঘরের এককোণে অরিন্দমের পেশীবহুল শরীরটা অসারের মতো পড়ে রয়েছে। খুঁটিয়ে না দেখলে যে কেউ ভেবে নেবে মানুষটা মৃত। কিন্তু সিসিটিভির অতন্দ্র প্রহরীর কারিকুরিতে চওড়া বুকের মৃদু ওঠানামা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। খাবারের থালাটা মেঝের এককোণে পড়ে আছে অবহেলায়। তরকারি রুটি কিচ্ছু স্পর্শ করেনি অরিন্দম, এমনকি বোতলে থাকা জলটাও কানায় কানায় ভর্তি।
“এতো মহা মুস্কিল! না খেলে কথা বার হবে কিকরে!” কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বদ্ধ ঘরে দৃশ্যপট দেখতে দেখতে বলে উঠলো অতনু। মাত্র একদিন পর বিয়ে ওর। নতুন জীবনে প্রবেশের উৎকণ্ঠা, দায়িত্ব-কর্তব্যের বেড়াজালের চিন্তা আপাতত মুছে গিয়েছে ওর মাথা থেকে। ভাসা-ভাসা তুই চোখের তলে জমে চলেছে রাতে জাগরণের ক্লান্তি। দিনভর রোদে ঘুরাঘুরির ফলশ্রুতিতে তেলতেলে মুখটায়
আজ গোটা দিন ঘুরেঘুরে অরিন্দমের ক্যারেক্টার হিস্ট্রি সংগ্রহ করেছে সে। পড়াশোনায় দুর্ধর্ষ এই ছেলেটি স্ট্যাটিসটিকসে গোল্ড মেডেলিস্ট। সাধারণ মানের স্কুলে পড়া এই ছাত্রটির দাদা ছিল ঠিক তার উল্টো। পড়াশুনো অপেক্ষা খেলাধুলা, আড্ডাগুজবই বেশি আকর্ষণ করতো তাকে। ফি বছর এদিক, সেদিকে ঘুরতে যাওয়াও নেশা ছিল তার।

“বড়োটার ঘোরাঘুরির নেশা ছিল প্রচণ্ড। যাকে বলে পায়ের তলায় সর্ষে। বন্ধু বান্ধবদের সাথে প্রত্যেক বছর দুই তিনবার করে ঘুরতে যেতো বাবু। সবার সাথে মন খুলে মিশতো” চোখের কোনে জমা হওয়া বাষ্পটাকে আঁচলের খুঁটে মুছে উর্দিধারী অতনুকে জবাব দিয়েছিল অরিন্দমের মা। পূর্বেকার তেজ, ব্যক্তিত্ব এক লহমায় ধুয়ে মুছে গিয়েছে ছেলের কুকীর্তিতে।
“বছরের দু তিনবার ঘুরতে যেতো!” খানিক অবাক হয়ে বলে ওঠে অতনু।”কলেজে পড়া একটা ছেলে এত টাকা পেত কিভাবে!”
“প্রথম প্রথম ওর বাবা দিত। তারপর টাকা পয়সা নিয়ে খানিক গন্ডগোল বেঁধেছিলো বাপ ছেলের মধ্যে। বাবু পড়াশোনা ভালো ছিলনা বলে আমার স্বামী একচোখাপনা করতেন। তাই বাবার টাকা না পেযে বাবু পার্টটাইম চাকরিতে ঢুকেছিল। নিজের খরচাপাতি চলে যেত ভালোভাবেই। কলেজ পাশের পর পার্মানেন্ট চাকরি পেয়েছিল, নিজের পছন্দমত বিয়েও করল। কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল!” চোখে আঁচল চাপা দিয়ে এবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। “বলেছিলাম এই মেয়েকে বিয়ে করতে না। মাঙ্গলিক দোষ আছে। আমার কথা শুনলে তো! শেষমেষ মরেই গেল আমার বাবুটা খাদে পড়ে!”
সন্তানহারা মায়ের বেদনা লাঘবের কোন ভাষা জানা নেই অতনুর। তবুও সান্তনা দেওয়ার ভঙ্গিতে নিজের হাতটা ভদ্রমহিলার কাঁধে রাখার উপক্রম করতেই ঐশীর প্রতি করা মানসিক অত্যাচারগুলো ফুটে উঠল তার মানসপটে। নিমেষেই দয়া, মায়া মমতার অস্থায়ী বুদবুদগুলো চুপসে গিয়ে তদন্তকারীর কঠোর খোলসটা পরে নিল অতনু। একবুক শ্বাস নিয়ে ঐশীর শাশুড়িমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ফের,”বাবু মানে অবিনাশ…
আর দুই ভাইয়ের এক রঙের পোশাক বাছাইয়ের কারণ?”
“অরিন্দম দাদাকে ভালোবাসতো ভীষণ। দাদার যা পছন্দ ওরও তাই পছন্দ। জামাকাপড়, জুতো, ঘড়ি সবকিছু মিলেমিশে কিনতো দুইজনে।” নাকটা টেনে বলে উঠলেন তিনি। ওনার বাচনভঙ্গিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে দুই ছেলের প্রতি করা পক্ষপাতিত্ব। একজনকে আবেগমথিত বাবু নামে সম্বোধন, অন্যজনের জন্য সাধারণ নামটি প্রযোজ্য।
“অরিন্দমও ঘুরতে যেতে ভালোবাসতো?” দুই ভাইয়ের মিল দেখে খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে উঠল অতনু। কারণ অরিন্দমের স্বল্পসংখ্যক বন্ধু বান্ধবদের সাথে কথা বলার পর জেনেছে অরিন্দম মোটেই ঘোরাঘুরি পছন্দ করত না, দাদার স্বভাবের ঠিক বিপরীতে থাকা এই ছেলেটি দিনভর বইয়ে মুখ গুজেই বসে থাকতো।
“নানা, অরু ঘুরতে যেতে ভালোবাসতো না। সারাদিন কেবলমাত্র বই আর বই। পড়াশোনায় দারুন মাথা ছিল। প্রত্যেক বছর স্ট্যান্ড করতো ছেলেটা। বন্ধু বান্ধবও ছিলনা সেরকম ভাবে, সঙ্গী বলতে কেবলমাত্র ছিল দাদা আর গল্পের বই।” অতনুর প্রশ্নের উত্তরে বলে উঠলেন ঐশী শাশুড়িমা।
“অবিনাশ তো দিনভর আড্ডার ঠেকে থাকতো। তবে নিজের ভাইকে সময় দিত কি করে!” বক্তব্যে অসংগতি দেখে অতনুর রোমশ ভ্রূ দুটো কুঁচকে উঠলো। “তাছাড়া এত ভালো মাথা হওয়া সত্ত্বেও অরিন্দমকে গড়পড়তা মানের একটা স্কুলে ভর্তি করলেন কেন?” অরিন্দমের রিপোর্ট কার্ডটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলে উঠলো অতনু। অক্ষরে অক্ষরে ফুটে উঠেছে অরিন্দমের সাফল্যের পরিচয়। উপযুক্ত গাইড, ব্যাকবোন ছাড়া এই সাফল্য সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
“সময় দিতে পারতো না সেইভাবে। তাই ভাইয়ের ইচ্ছামত খাবার-দাবার কিনে আনত বাবু।” অতনুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন ঐশীর প্রাক্তন শাশুড়িমা। “আর বড়টাকে ভালো স্কুলে দেওয়ার জন্য ওর বাবার হাতে বেশি কিছু থাকত না। ছোটটার মাথা ভালো ছিল তো! তাই…”
“তাই ছোট ছেলেকে ব্যাকবোন দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি তাই তো?” মহিলার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল অতনু। “ভালো মাথা, বুঝতে পারে তাড়াতাড়ি। তাই তার দিকে সেইভাবে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, আসলে মায়েরা বোধহয় দুর্বলের সঙ্গ দিতে বেশি পছন্দ করেন তাই না?”
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারের প্রশ্ন শুনে অবিনাশের মায়ের জোড়া ভ্রু দুটি কুচকে গিয়েছে। বোধহয় বুঝে নিতে চাইছেন অক্ষরসমষ্টিগুলোকে। মহিলার ভ্যাবাচ্যাকা দশা দেখে অতনুর রাগটা যেন আরো বেড়ে গেল।
“আপনার বড়ছেলে দুর্বল না। কুসঙ্গে বখে গিয়ে আড্ডাবাজি, পয়সা ওড়ানোর সিদ্ধহস্ত একজন গড়পড়তা মানের স্টুডেন্ট। আপনারা তার পিছনে নামিদামি স্কুল, টিউশনের ব্যাকবোন দিতে পারলেও লাভ হয়নি কেন জানেন? কারণ হাই স্ট্যাটাসে বিলং করিয়েও রাশ আলগা রেখেছিলেন। সারাদিন আড্ডা সেরে বাড়ি ফিরে আসলেও কোথায় গিয়েছিলে জানতে চাননি। মিথ্যে কথা বলে পার পেয়ে যাওয়া খুব সহজ, কিন্তু বাবা-মা চাইলেই ছেলে মেয়ের গতিবিধি নজর রাখতে পারে।”

“মানে?”অতনুর কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে বলে উঠলেন ঐশী শাশুড়িমা। “সারাদিন আড্ডা দিত! এসব কি বলছ তুমি!”
“আমি বলছিনা.. আপনার বড় ছেলের স্কুলের প্রিন্সিপাল বলেছেন। প্রায়দিনই স্কুল বানক করে ঘুরে বেড়াতো আপনার সুপুত্র। কয়েকবার ধরা পড়ার কারণে গার্জেন কল করলেও লাভ হয়নি। কারণ ‘ভাড়া করে আনা’ মায়েরাই শিক্ষক-শিক্ষিকার তিরস্কার হজম করতো। এবার বলুন তো নামিদামি স্কুলে দিয়ে কি লাভ হলো আপনার?” ব্যঙ্গোক্তি করে ওঠে অতনু, “ছেলে ঘুরতে যাচ্ছে বন্ধুদের সাথে। কিন্তু মা জানেনা কোথায় যাচ্ছে। হাতে কাড়িকাড়ি টাকা ভরে দিচ্ছে এক ছেলের হাতে। কিন্তু অন্য ছেলের ভালো রেজাল্ট দেখে সন্তুষ্ট মা ভাবছে দুর্বলের সাথে থাকলে উত্তরণ ঘটতে বাধ্য। স্কুল টিউশনের ব্যাকবোন ঠেসেই কি উত্তরণ সম্ভব? নাকি ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সব সন্তানের প্রতি সমপক্ষপাতিত্ব বজায় রাখা উচিত?”
অতনুর কথাগুলো গলন্ত উত্তপ্ত সিসার মত ঢুকে যাচ্ছে কর্ণকুহরে। মাথাটা কেমন জানি ভার ভার লাগতে শুরু করেছে তার। প্রথম সন্তান হওয়ার সুবাদে অবিনাশের প্রতি একটা আলাদা রকম টান তো ছিলই, উপরন্তু লেখাপড়ায় ভালো না হওয়ার কারণে মনোযোগ তার উপরেই পড়ে থাকতো সর্বক্ষণ। ছোটছেলে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে যেত সে। ভাবখানা ছিল ঠিক এমন, “অরিন্দম তো পারবেই। আমি বরং অবিনাশকে নিয়ে ভাবি।”
কিন্তু মায়ের শর্তসাপেক্ষ স্নেহ ভালবাসার অপব্যবহার যে এমন ভাবে হতে পারে, তা ভাবতে পারেন তিনি। চোখ দুটো কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করে উঠল ওনার। মনে পড়ে যাচ্ছে স্বভাবে চুপচাপ থাকা অরিন্দমের ন্যাওটাভাব… স্কুল ফিরে মায়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করা, খাবারের বাটিটা ছোটছেলের হাতে ধরে দিয়ে বড়ছেলেকে খাইয়ে দেওয়া।”দুর্বল নয়, দুষ্ট।” অস্ফুটেই বলে উঠলেন তিনি।
“একচোখা আপনার স্বামী নয়, আপনি ছিলেন।” নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো অতনু। “আপনার স্বামী কর্মসূত্রে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালেও কখনো চাইতেন না পরিবারকে ধোঁয়াশাতে রেখে অবিনাশ বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেড়াক। দূরদর্শী মানুষটা
বড়ছেলের হাতে টাকাপয়সা না দেওয়ার কারণ ছিল এইটাই। ছেলে হলেই ছেড়ে রাখতে হবে, এমন মনোভাব মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়!” অফিসার সুলভ দুর্দমনীয় ব্যক্তিত্ব যেন উপচে পড়েছে এবার। “অরিন্দম, অবিনাশ দুই ছেলেকেই সমান দৃষ্টিতে দেখা উচিত ছিল আপনার। দুর্বলের প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ সবলকেও ঠেলে দিতে পারে অবসাদের দিকে। আপনি ভাবুনতো একবার! কথা বলার সঙ্গী থেকেও নেই, বাবা কর্মসূত্রে বাইরে। মা বড়ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত, আর বড়ভাই ব্যস্ত বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে। ঘরভর্তি বই ছড়ানো ছিটানো। দামি দামি আসবাবে ঠাসা, কিন্তু প্রাণ নেই কোথাও। ছোটছেলে ভালো ফল করে আসলেও মায়ের দৃষ্টি বড়ছেলের দিকে নিবদ্ধ। এটা কি একচোখাপণা নয়..? দুজন সন্তান সবল, দুর্বল যাই হোক না কেন। মায়ের দৃষ্টিতে দুজনেই তো সমান থাকা উচিত!”
নিজের ছেলের বয়সী অফিসারের কথা শুনে ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলেছেন ঐশী শাশুড়িমা। মেঝের দিকে নিবদ্ধ দৃষ্টি বহন করছে আত্মগ্লানিকে। বড়ছেলের স্বরূপ জানার পর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছে তার। অবিনাশের পিছনে কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করলেও সময় খরচ করে একদিনও স্কুল-কলেজে গতর নাড়িয়ে দেখতে যাননি তিনি, তা বলাই বাহুল্য। বেহিসেবি ভালোবাসায় ভরে দিয়ে শাসন ছাড়া স্কুল টিউশনের ব্যাকবোনে সাফল্যলাভ কি আদৌ সম্ভব…? উত্তর পেলেননা তিনি।
“আপনি আপনার ছেলেকে নিজের অজান্তেই একাকিত্বের দিকে ঠেলে ফেলে দিয়েছেন। নিজের পছন্দে পাত্রী খুঁজে আনলেও কখনো জানতে চাননি মেয়েটি আদৌ তার পছন্দ কিনা। তাই বুঝতেও পারেননি কলেজের সহপাঠীনি ঐশীকেই ভালোবাসে ও।”
ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হলেও বোধহয় এতটা চমকাতেন না উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলা। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত ফুটে ওঠা সেই চাহনির দিকে তাকিয়ে ফের বলে উঠল অতনু,”বুঝতে পারবেন কি করে! বড় ছেলেকে ঘিরেই তো আপনার সংসার ছিল।”
“কিন্তু অবিনাশও যে আমাকে কোনদিন জানায়নি ঐশীকে তার ভাই অরিন্দমও পছন্দ করে।” অস্ফুটে বলে উঠলেন তিনি। তবে কি চ্যাটবক্সে দেখানো মেসেজগুলো সব সত্যি ছিল। সত্যিই কি অরিন্দম ঐশীকে ভালোবাসতো… কিন্তু ভালবাসলে এরকম বেহিসেবি আচরণ করবে কেন! কেন নোংরা প্রস্তাব দেবে ভাইয়ের বিয়ে করা বউকে…
“অবিনাশ নিজের স্বার্থ দেখেছিল যে! তাই ভাইয়ের ভালোলাগা চেপে গিয়েছিলো মায়ের কাছে। ঠিক যেমনটা স্কুল কলেজের শিক্ষকদের অভিযোগগুলো লুকিয়ে যেত মায়ের কাছ থেকে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল অতনু। তারপর পা বাড়িয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করতেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাটা মাথায় ভেসে এলো তার..”জানিয়ে রাখি ঐশীর জন্য অবিনাশ মারা যায়নি। তাই নিজের পুত্রবধূকে দোষী সাব্যস্ত করতে মাঙ্গলিক, অপয়া, ডাইনি এই শব্দগুলো জুড়ে দিবেন না দয়া করে। শুনেছিলাম আপনি ইংরেজিতে গ্র্যাজুয়েট। তাই আশা করেছিলাম শিক্ষার মান রাখবেন অন্তত, কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম ইংরেজি স্রেফ একটা ভাষা। মানসিক উন্নতিবিধানের যন্ত্র নয়!”

“স্যার সঙ্গীতা ম্যাডাম ফোন করেছেন। আপনার ফোনে পাচ্ছেন না উনি।” থানার কনস্টেবলের ঝাঁকুনিতে আধো ঘুম আধো জাগরণটা ভেঙে গেল অতনুর। দিনশেষের ক্লান্তিতে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
“হ্যাঁ বলো।” মুঠোফোনটা কোনোমতে কানে চেপে বলে উঠল অতনু। “ট্রাভেল হিস্ট্রি, আর শ্মশান কবরখানার লিস্ট মেইলে পাঠিয়ে দাও শিগগির।”
নির্দেশটুকু দিয়ে বন্ধ থাকা কম্পিউটারটা ঝটপট অন করল অতনু। জাগরণের ক্লান্তি ততক্ষনে উবে গিয়েছে ওর চোখ থেকে। বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে, অবিনাশের চাকরির পাওয়ার পরপরই দুই ভাই মিলে বেরিয়ে পড়তো ঘুরতে। তবে কি চাকরির আছিলায় অবিনাশ ছোট ভাইকে এই পেশার ঢুকিয়ে দিয়েছিল…
চিন্তাটা মাথায় ঘুরতে ঘুরতেই চোখটা পড়লো ডিজিটাল স্ক্রিনের দিকে। অবিনাশ, অরিন্দম দুই ভাইয়ের ট্রাভেল হিস্ট্রি ফুটে উঠেছে সেখানে।
“২০০৮..”সালটা আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠল অতনু। অবিনাশ যে এই সময়ে একজন স্কুলপড়ুয়া তা স্পষ্ট পাশে রাখা মার্কশীটের জেরক্স কপিতে।
“২০০৮,২০০৯ সালে দুইবার, তার পরের বছর তিনবার…” সালের সাথে সাথে যাতায়াত ক্রমশ বাড়ছে দেখে কপালে জেগে থাকা চিন্তার রেখাটা গাঢ় হলো অতনুর। তারপর চোখ পড়ে গেল অরিন্দমের ট্রাভেল হিস্ট্রির দিকে। ২০১৩ সাল থেকে অরিন্দমের বেগুসারাইতে যাত্রা শুরু। এবং অবশ্যই নিজের দাদার সাথে।
“অবিনাশ স্কুলে থাকা অবস্থাতেই এই চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। তারপর কাঁচা পয়সার লোভ দেখিয়ে ভাইকেও টেনে নিয়েছিল এই ব্যবসাতে। যতদিন গিয়েছে যাতায়াত ততো বেড়েছে। তার মানে ব্যবসায় ইনভলভমেন্টও বেড়েছে। কিন্তু এর সাথে নিজের দাদাকে মারার কি সম্পর্ক…” অধৈর্য ভঙ্গিতে এবার অতনু চোখ রাখে পাশের কাগজে। বেগুসারাই এর নিকটস্থ শ্মশান, কবরখানার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য দেওয়া আছে সেখানে। অবিনাশ কে মেরে ফেললে দাহ অথবা মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া যে নিশ্চিত, তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু না, থরে থরে সাজানো ইনফর্মেশনের দিকে পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি বুলিয়েও কোন সূত্র খুঁজে পেল না অতনু। অবিনাশের নামটা নেই সেখানে।
“অরিন্দম মিথ্যা কথা বলতে পারেনা… সত্যি লুকাতে জানে। কিন্তু দাদার মতো মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস নেই ওর।” অস্ফুটে বলে উঠল অতনু। তারপর নিতান্তই অনুমানবশত সম্ভাবনার কথাটা মাথায় দপ করে ফুটে উঠল।
“মনু যাদবের বাড়িতেই মেরে পুঁতে দেয়নি তো!” চোখটা বন্ধ করে অতনু ডুব দিল স্মৃতির মুকুরে। বেগুসরাইতে থাকাকালীন তদন্তের খাতিরে মনুর বাড়িতে যেতে হয়েছিল তাকে। অবিনাশের জামাকাপড়, অগুনতি সিম পাওয়া গিয়েছিল সেখানেই। “মনে পড়ছে না!” অধৈর্যের ভঙ্গিতে অতনু ফের কানেক্ট করলেও সঙ্গীতাকে,”বলছি মনু যাদবের সিল করা বাড়িতে একবার পর্যবেক্ষণ চালাও। আর পাড়া-প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করে দেখো বাড়িটাতে এগজ্যাক্টলি কয়জন থাকতো। আমার মনে হচ্ছে অবিনাশ সত্যিই আর বেঁচে নেই। কারণ তেমনটা হলে অরিন্দম সত্যি বলে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করত না।”
কলটা ডিসকানেক্ট করে অতনু চোখ রাখলো ডেস্কে থাকা অপর কম্পিউটারের দিকে। অরিন্দমের পেটানো শরীরটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এখান থেকে। কি মনে হতে দরজার চাবিটা হাতে নিয়ে অতনু হাঁটা লাগলো সেইদিকে। পায়ের আওয়াজ শুনে ইতিমধ্যেই মেঝেতে বসে গিয়েছে অরিন্দম।
“তোরা দুই ভাই মিলে বেগুসারাই যেতিস.. ওখানের কাজকর্ম সামলাতিস। কিন্তু হঠাৎ এই পথে গেলি কেন। তুই তো পড়াশোনা ভালোছিলিস। চাকরিবাকরি করে দিব্যি সুখের সংসার সামলাতে পারতিস। তবে কেন এই অধঃপতন?” বলে উপযুক্ত সমস্ত তথ্যপ্রমাণ অতনু মেলে ধরলো অরিন্দমের সামনে। তারপর ফের বলে উঠলো,”তোদের দুই ভাইয়ের কর্মকাণ্ড প্রমাণ আমার হাতে। পালাবার পথ নেই। কিন্তু নিজের দাদা হানিমুনে বেরিয়ে যাওয়ার পর তুই কেন ওদের পিছু নিলি? অবিনাশ কি নিজের বউকেও ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত করতে চাইছিল। আর সেই কারণেই তুই…”
“বাহ! দারুন বুদ্ধি স্যার আপনার। অন্তত কেউ তো বুঝলো আমি ঐশীকে ভালোবাসতে পারি!” অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে জবাব দিল অরিন্দম। তারপর অতনুর কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,”আমার দাদা একটা পাষণ্ড লোক। স্কুল কলেজে থাকতে বাপের পয়সা উড়িয়েছে দুই হাতে। মা সারাদিন এটা-সেটা করে খাওয়াতো। পরিচর্চাতে লেগে থাকত, কিন্তু পাষণ্ডটা মাকেও ব্যবহার করত। কি মনে হয় এই লোককে দেখে?” পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল অরিন্দম। উল্টোদিকে বসে থাকা মানুষটি নিশ্চুপ। অবিনাশের ক্যারেক্টার মর্ফলজি জানা হয়ে গিয়েছে তার সূত্র মারফতে।
“কলেজে বহুৎ মেয়ে ছিলো। কিন্তু তার পিছনেই পড়লো যাকে আমার পছন্দ। বললাম দাদা আমি ওকে ভালোবাসি। প্রপোজ করব কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু ঢ্যামনাটা আমার আগেই প্রপোজ করে দিল। আমি যে মেয়েটাকে নিয়ে কবিতা লিখছি গান লিখছি, সব জানতো সব…কিন্তু তবুও নিজের বেইমানি স্বভাবটা ছাড়তে পারলো না। এদিকে আমি যখন ঐশীকে বললাম আমি ওকে ভালোবাসি, তখন দেখি দুইজনের মধ্যে প্রেমপর্ব অলরেডি স্টার্টেড। আমার নিজের দাদা লুকিয়ে গিয়েছে আমার ভালোবাসার মানুষটির সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ।”
সম্পর্কের এই অদ্ভুত সমীকরণ দেখে অতনুর মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। বস্তুত খানিকটা যেন মায়াও জন্মে গেলো অরিন্দমের প্রতি। নিজের অজান্তেই..
“দুজন দুজনকে ভালোবাসল। বিয়ে করল। এর মাঝে দাদা কারবার চালাতে চলে গেল বেগুসারাইতে। আমি কিন্তু বিয়ের পর ঐশীকে একবারও ডিস্টার্ব করিনি। খুব কষ্ট লাগতো। দিনের পর দিন সহ্য করতাম কাঠের পুতুলের মত। এমন সময় মা সম্মন্ধটা নিয়ে আসলো। আমি ভেবেছিলাম নতুন মেয়েকে পেয়ে ঐশীকে ভুলে যাব। কিন্তু বিশ্বাস করুন স্যার শরীরে শরীর মিশিয়েও আমি ঐশীকে ভুলতে পারিনি। তবুও যন্ত্রের মত মিলন চালাতাম বউয়ের ইচ্ছানুযায়ী। ওর তো কোন দোষ নেই বলুন। কিন্তু এরই মধ্যে আমার দাদার আরেকটি রূপ দেখার সৌভাগ্য অর্জন করি।”
অরিন্দমের কথাটা শোনামাত্র নড়েচড়ে বসলো অতনু। মুখ ফুটে বলে উঠলো “তারপর?”
“ব্যবসাতে মন্দা আসছিল। নতুন নতুন শরীরের আশায় তাগাদা দিচ্ছিল ডিলাররা। দর্শকদের মনে একঘেয়েমি এসেগেছিল একই শরীর দেখতে দেখতে। অগত্যা নতুন মেয়ের সন্ধান করতে করতে দাদার পছন্দ হয়ে যায় নিজের বউকেই।”
অনুমান ক্ষমতার সাথে মিলে যাওয়ার পর মুখে হাসি ফুটল অতনুর। অস্ফুটে বলে উঠলো,”তারপর?”
“আমাকে ফোন করে জানালো বাড়ি আসছে। হানিমুন ট্রিপের প্ল্যান করে বউকে নিয়ে যাবে বেগুসারাইতে। খাদে গাড়িটা ফেলে দেওয়ার নাম করে লোকের কাছে প্রচার করবে ঐশী মারা গিয়েছে। তারপর নিজের চক্রের সাথে ভিঁড়িয়ে দেবে ওকে। সেইমতো মেয়েটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে হানিমুন প্ল্যান ফুলফিল করার জন্য দুই দুটো গাড়ি বুক করল লোকটা। ব্রেক জার্নি করলে পুলিশ কিন্তু সচরাচর ট্রেস খুঁজে পায়না..” অতনুর চোখে চোখ রেখে হাসতে হাসতে বলে উঠলো অরিন্দম।
“কিন্তু ঐশীকে চক্রের সাথে এটাচ করতে হলে বিয়ে করতে গেল কেন? প্রেম চলাকালীনই তো ঠেলে দিতে পারতো এই অতলের গভীরে…” হিসেবটা যেন ঠিক মিলতে চাইছিল না অতনুর। যুক্তিবোধটা নড়ে উঠেছিল অরিন্দমের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে।
“অবিনাশ এই পেশায় এসেছিলো কেন বলুন তো?” অতনুর কথাটা শুনে নেওয়ার পর প্রশ্ন করে উঠলো অরিন্দম। লোকটাকে দাদা ডাকতে ইচ্ছে করছে না আর।
“টাকার জন্য!” সহজ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অতনু তাকাল অরিন্দমের দিকে।
“এক্সাক্টলি.. লোকটা টাকা ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না। ঐশিকে বিয়ে করেছিল টাকার জন্য। কিন্তু যখন দেখল শরিকি বাড়ি, আর এনআরআই বাপের অন্যত্র সংসার আছে, তখন ফুটফুটে মেয়েটা ইউজলেস হয়ে গেল ওর কাছে। ব্যাস! ঠিক যেমন দুই ভাইয়ের ভালোবাসা ইউজলেস হয়ে গিয়েছিল ওর কাছে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো অরিন্দম।
“তারপর কি হলো? দাদা বৌদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তুমি বেরিয়ে কি করলে?” গল্পের ফাঁকে ফাঁকে জেরা করার তাগিদে মোক্ষম অস্ত্রটা ছুঁড়ে মারল অতনু। কিন্তু অরিন্দম অত সহজে ধরা দেওয়ার মত ছেলে নয়।
“বেগুসরাইতে গেলাম। প্রমাণ তো আপনার কাছেই আছে স্যার।” বলে পাশে রেখে দেওয়া ট্রাভেল হিস্ট্রিটা অরিন্দম মেলে ধরল অতনুর সম্মুখে।
“সেখানে গিয়ে কি করলি তুই?” অধৈর্য ভঙ্গিতে বলে উঠলো অতনু। দুই দিন বাদে বিয়ে, এদিকে সারা দিন কেটে যাচ্ছে থানাতে…
“নিজে খোঁজো গিয়ে যাও!” মেঝে ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে উঠলো অরিন্দম,”সরকার মাসে মাসে পয়সা দিচ্ছে কি জন্য!”
“কিন্তু ঐশীকে এভাবে ব্ল্যাকমেল করতিস কেন?” মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা জ্যা মুক্ত তীরের মত বেরিয়ে আসলো অতনুর মুখ চিরে। ভালবাসলে কেউ এতখানি নিচে নামতে পারে!
“ভালবাসতাম তাই। আমি চাইতাম ওর শরীর মনে আমার অধিকার হোক!”নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে উত্তর দিল অরিন্দম,”এখন আবার বলবেন না ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। অনেক ত্যাগ করেছিলাম, ফাটা কপাল ছাড়া কিছুই জুটলনা। আর দাদার কাছে ঐশীর প্রচুর প্রাইভেট ক্লিপ ছিলো। রাজি না হলে ব্ল্যাকমেল করার জন্য বাথরুমে ক্যামেরা বসিয়েছিল লোকটা। সবকটা ডিলেট করে দিয়ে আমি একটা রেখেছিলাম নিজের কাছে। যদি ওকে রাজি করানো যায়, তাই আরকি। বিশ্বাস করতাম মেয়েটাকে, ভাবতে পারিনি সোজা মায়ের কাছে চলে যাবে।” দেওয়ালের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে উঠলো অরিন্দম।”আর হ্যাঁ, খাবার দাবার নিয়ে যান। একদিন না খেলে মরে যাবনা।”
“মানছি তুমি সেই অর্থে কারোর ভালোবাসা পাওনি। নিজের মায়ের পক্ষপাতিত্ব, দাদার স্বার্থপরতা আরো অনেক কিছু। হয়ত কেউ ছিলনা তোমার পাশে, কিন্তু তুমি তো ছিলে তোমার পাশে!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো অতনু। তারপর পা বাড়ালো ঘরের বাইরে। টেলিফোনটা বেজে চলেছে ক্রমাগত, সংগীতা ফোন করেছে।

ক্রমশ
আগের পর্ব https://www.facebook.com/114703953643370/posts/190150632765368/
আশা করি ভালো লাগছে সবার সঙ্গে থাকবেন সবাই।
© সম্প্রীতি রায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here