বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :১৫

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :১৫

আরহামকে সামনে দেখে সেহের থরথর করে কাঁপছে।রক্তিম চোখ কঠোর মুখ চেহারায় কেমন জানো হিংস্রতার চমক ।দু’কদম সামনে এগিয়ে আরহাম ধপ করে সেহেরের হাত চাপল।চাপা ভারী স্বরে বলল,”অনেক হয়েছে ,এবার বাড়ী চলো ”
সেহের চাতক পাখির মত ছটফট করছে।হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ভাঙ্গা স্বরে বলে,যাবো না।ছাড়ুন আমাকে ,আমি এই বিয়ে করবো না। ”
সেহেরের কথার তোয়াক্কা না করে আগের মত শক্ত ভাবে হাত চেপে রেখেছে।ভাষাহীন দৃষ্টি অপলকহীন ভাবে সেহেরের দিকে।হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সেহের রাগে কান্না করে দেয়।চাপা কান্না করছে। আরহামের মুখের হাবভাব কোনটাই পরিবর্তন হলো না।তখনো আগের মত একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে ।সেহের অন্যহাতে নিজের মুখ চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।মিনিট দুএকের ভেতর কান্না থামল।ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,”আপনি হাত ছাড়বেন ,নাকি লোক জড় করবো? আপনি কেন বুঝেন না আমি আপনাকে ঘৃণা করি ,ঘৃনা! ”
কথা গুলো শুনে আরহামের মাথা বিগড়ে যায়।সেহেরকে চট করে ছেড়ে দেয়।সেহের ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে।আরহাম রাগে ফোঁসফোঁস করছে।এদিকে ওদিকে দু তিনবার হাঁটা চলা করে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে।কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না।রাগে গরগর করতে করতে সেহেরের ঠিক সামনে এসে দাড়ায়।নিচু হয়ে সেহেরের গাল টিপে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”ঘৃণা করো তাই না? ঘৃণা? আমাকে দেখলে ঘৃণা হয়? …..বিয়ে করবে না? ”
ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে রাগে গজগজ করে সামনে লোহার বেঞ্চটায় উপর অনবরত কয়েকটা লাথি মারে।বেশ শব্দ হয়। আশেপাশের মানুষ বিস্ময় চোখে দেখছে। ছোট খাটো ভিড় জমে গেছে।আরহাম চিৎকার করে বলে,”তামাশা হচ্ছে?এখানে কি? ”
আরহামের ধমকে ভিড় ছুটে।মানুষজন আনাগোনা করতে করতে যার যার কাজে চলে যায়।আরহাম ধপ করে বেঞ্চটার উপর বসে।রাগে দু হাত ঘোষছে।শরীর এখনো কাঁপছে।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কোণাকোণি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে তাকায়।সেহের অশ্রুসিক্ত থমথমে চোখে সবটা দেখছে ।হাতের কনুই ছিঁড়ে রক্ত ঝোরছে। চোখে জলে গাল ভিজে।মুহূর্তেই আরহামের সব অগোছালো হয়ে যায়।বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়।মনে হচ্ছে মাথার সব তার কেউ টেনে ছিঁড়ে ফেলছে।আরহাম নিচু হয়ে মাথা চেপে ধরে।চুল গুলো শক্ত করে ধরে পিছনের দিকে টানছে।চাপা স্বরে আর্তনাদ করছে।অসহ্য যন্ত্রণা! মাথার পিড়া সইতে না পেরে, বামহাতে বেঞ্চের উপর অনবরত ঘুষি দিতে লাগে।ভিতু বিস্মিত চোখে সেহের প্রত্যেকটা কাজ নিখুঁত ভাবে লক্ষ করে।ভয়ংকর হিংস্রতায় ভরা মুখ।রাগী ক্রুদ্ধ রক্তিম চোখ । নিশ্বাস ভারী গর্জনের আওয়াজ।এই বুঝি কারো দেহ থেকে প্রাণ কেড়ে নিবে। এ যেন আরহাম না অন্য কেউ।আরহামের মাঝে অন্যকোন স্বত্বার ঝলক ।ভাবতেই ,ভয়ে সেহেরের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে।এসব কি হচ্ছে? আরহাম এমন করছে কেন? কিসের যন্ত্রণায় এভাবে কাতর হচ্ছে?
একসময় আরহামের হাত ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে।তবুও সে থামছে না। একের পর এক হাতের আঘাত করেই যাচ্ছে। আরহামের এসব কাজে সেহেরের মনে অদ্ভুত ভয় কাজ করছে। মুখ চেপে কেঁদে উঠে ,ভয়ে তড়াক করে উঠে দাড়িয়ে অন্ধকার রেললাইনের রাস্তা ছুটে যায়।স্টেশন ছেড়ে অনেকটাই এগিয়ে গেছে । ডিমলাইটের হলদে ছোট ছোট আলো দেখা যাচ্ছে ।বড় বড় শ্বাস ছেড়ে সেহের উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছুটছে ।কিন্তু ভাগ্যে বেশিদূর সহায় হলো না ।আরহামমের কাছে ধরা পরে গেল । পেছন থেকে তড়িৎ গতিতে আটকে নেয়।সেহের চিৎকার করতে লাগে ,কিন্তু কোলাহলহীন অন্ধকার রেললাইনের নির্জন রাস্তায় সেহেরের বুকফাটা কান্না কারো কান অবধি পৌঁছায় না।অসহায় সেহের হার না মেনে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। চোখের পানিতে গাল ভেসে ।আরহামের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়ানো আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।পাগলের মত হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে।আচমকা আরহামের চওড়া গলার বিকট আওয়াজে সেহের থেমে যায়।ভীতু থমথমে চোখে আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম শক্ত ভাবে গাল চেপে নিজের মুখোমুখি আনল সেহেরের চোখে চোখ রেখে দাঁত চিবিয়ে বলল,”এই ভুল দ্বিতীয়বার করার চেষ্টা করো না।ফল ভয়ংকর হবে! …তুমি আমার মানে আমার! তোমার মন প্রাণ সব কিছুর উপর শুধু মাত্র আমার অধিকার । ক্লিয়ার?”
সেহের পলকহীন থমথমে চোখে আরহামের চোখের দিকে তাকিয়ে।উত্তর না পেয়ে আরহাম ঝাঁকুনি দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,”ক্লিয়ার? ”
সেহের এবারো চুপ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে।শরীরটাও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।চারপাশ কালো অন্ধকারে ঢেকে যায়। সেহের আরহামের বুকে ঢুলে পড়ে।

হল রুমে মাঝ বরাবর সোফাটায় মালিহা বসে।হাতে হাত কচলাচ্ছে।চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম ।সেহের কি শহর ছেড়ে সিলেটের পথে রওনা হয়েছে? নাকি আরহামের কাছে ধরা পরে গেছে! না জানি মেয়েটার সাথে কি হচ্ছে! বারবার সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছে।আরহাম এখনো এলো না যে? কোন বিপদ হলো কি! ভাবতে মালিহা কেঁপে উঠে।এমন সময় বাহির থেকে গাড়ীর শব্দ আসে । মালিহা ব্যস্ত ভঙ্গিতে সদর দরজার দিকে ছুটে যায়।আরহামের কোলে সেহের । বাড়ীর দিকে পা বাড়িয়েছে। সদর দরজায় প্রবেশ করতে আরহাম মালিহা খানম মুখোমুখি হয়।দুজনের চোখাচোখি হতেই আরহাম গাঢ় স্বরে বলল,”পাতালে লুকালেও খুঁজে বের আনবো ,আমার কাছ থেকে ওকে কেউ আলাদা করতে পারবে না”
প্রত্যুত্তরের আশায় না থেকে আরহাম বড়বড় পা ফেলে সিড়ির দিকে পা বাড়ায়। সেহের আরহামের বুকে ঝড়ে গৃহহারা ভেজা কবুতরি মত ল্যাপটে।মায়া মায়া ক্লান্ত চেহারা ,চোখজোড়া এখনো অশ্রু ভেজা।অন্যদিকে আরহামের ঠোঁটের কোণে হিংস্র বিষাক্ত হাসি।কয়েক ঘন্টা পূর্বে সেই অগোছালো এলোমেলো আরহাম কোথাও হারিয়ে গেছে।সামনের মানুষটা অন্যকেউ যে শুধু শর্তহীন ভালোবাসতে জানে। তবে কি আরহাম কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য সেহেরই একমাত্র সুরাহা!
এ কেমন নিয়তি? একজনের প্রেম অন্যজনের বিষাক্ত অনুভূতি! কারো জন্য অমৃত কারো জন্য বিষ।এ কেমন প্রেম?

অন্ধকার রাতের পর আলোক উজ্জ্বল দিনের সূচনা হয়। প্রত্যেকটা সকাল তার সাথে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে আসে।নতুন কোন গল্পের সূচনা ঘটে। সারা শরীরে মচমচে ব্যথা নিয়ে সেহের আড়মোড়া ভাঙে।মাথাটায় এখনো প্রচণ্ড ব্যথা।নিভু নিভু চোখে তাকাতে নিজেকে তার রুমের বিছানায় আবিষ্কার করে।রাতের কথা মনে করতেই তড়াক করে উঠে বসে ।এলোমেলো চুল গুলো বারবার মুখে পরছে। সেহের বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে সামনের দিকে তাকায়।সামনের ডিভানে আরহাম বসে ,গাঢ় চোখে এদিকেই তাকিয়ে।ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।ভারী স্বরে বলল,”হ্যালো লাভ! গুড মর্নিং ”
সেহের কেঁপে উঠে।রাতের কথা মনে বিছানার মাথার সাথে গুটিসুটি মেরে চাপতে থাকে।স্বাভাবিক ভাবে আরহাম সেহেরের দিকে এগিয়ে আসছে।দূরত্ব যত কমছে সেহের তত বেশি কাঁপতে শুরু করেছে।আস্তে আস্তে দুজনের মধ্যকার দূরত্ব মিশে গেল। আরহামে সেহেরের গাঁ ঘেষে।সেহের চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।আলতো হাতে আরহাম কাছে টেনে নেয়। গালে হাত ছুঁয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল ,”কি হয়েছে? কাঁপছ কেন? ”
সেহের তখনো চোখ বুঝে থরথর কাঁপছে।দুহাতের তালুতে সেহের মুখ ছুঁয়ে আলতো স্বরে বলল,”তাকাও আমার দিকে …… ওপেন ইউর আইজ! ”
সেহের চোখ খুলল না আরো শক্ত ভাবে চোখ মুখ খিঁচে রইল।আরহাম আবার বলল,”চোখ খুলবে না? আমাকে অন্য কোন কৌশলে খুলতে বাধ্য করলে তোমাকেই কিন্তু ভুগতে হবে! ”
সাথে সাথে সেহের চোখ খুলে তাকায়। আরহাম এক চিলতে মুচকি হেসে সেহেরের চোখে চোখ রাখে।চোখের দিকে চেয়ে সেহের থমকে যায়।নিষ্পাপ নিবিড় চোখ জোড়ায় গত রাতের হিংস্রতা কোথাও হারিয়ে গেছে।চেহারায় কোন কঠোরতা নেই।হাস্যোউজ্জ্বল মুখ ।এ যেন অন্য কেউ। গোছালো সুস্থ এক জন ।সেহের চোখের দিকে চেয়ে আনমনে বলে,”গত রাতে আপনি….”
সেহেরের কথা কেটে আরহাম বলল,”সরি ,গত রাতের কোন কিছু মনে নেই।…তবে হ্যা তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে ভালো করোনি।আমার রাজত্বে থেকে আমাকেই বোকা বানানো? তোমার মনে ভয় নেই মেয়ে? ”
সেহের কুঞ্চিত ভ্রু করে কিছু জিগ্যেস করতে চাইল।কিন্তু করা হলো না।তার পূর্বেই আরহাম বলল,”সেদিনের হুমকি কে এতো হালকা ভাবে নিলে? কি ভেবেছ তুমি পালালে আমি কিছু করতে পারবো না! ধ্বংস করে রাখবো সব! সবকিছুতে আগুন লাগিয়ে দিবো , সেই আগুনে ক্ষণে ক্ষণে তোমার পরিবার পুড়বে । বুঝলে? ”
সেহের ভিতু চোখে আরহামের দিকে তাকাল। আরহাম আবার বলল,”শুনলাম তোমার বাবার নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছে অলরেডি 1.25 কোটি ইনভেস্ট করেছে । প্রজেক্টে কমপ্লিট করতে আরো এক কোটি প্রয়োজন।ব্যাংকে লোনের জন্য এপ্লাই করেছে আমি অনুমতি দিলে পেয়েও যাবে ,কি বলো অনুমতি দিবো? নাকি রিজেক্ট করবো! ”
সেহের অসহায় চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম সেহেরের কানের পেছনে চুল গোছাতে গোছাতে বলে,”ডোন্ট ওয়ারী লাভ! তুমি কবুল বলার সাথে সাথে অনুমতি পেয়ে যাবে ।এখন সবটা তোমার উপর বিয়েতে রাজি হবে নাকি বাবাকে পথে নামতে দেখবে। কোনটা? চয়েজ ইজ ইউর’স …..
“রাজি …আমি এই বিয়েতে রাজি! প্লিজ আপনি কিছু করবেন না । ”
আরহামের কথা কেটে সেহের থতমত গলায় বলল।আরহাম বাঁকা হাসল। সেহেরের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,”গুড দ্যাট’স মাই গার্ল! ‘

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here