বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :১৬
কথিত আছে অটোমান সুলতানাদের কাছে লাল পবিত্রতার প্রতীক ছিল। অন্যদিকে লালকে অগ্নি বা ধ্বংসের প্রতীক বলেও অনেকে মানেন ।কিন্তু আরহামের কাছে লাল রঙ তার বিষাক্ত প্রেমের অস্তিত্ব।তার বিশাল বিস্তৃত অন্ধকার রাজ্যের অবিচ্ছিন্ন অংশ।আরহাম তার হৃদয়ের রাণীকে লাল রঙে বরণ করতে চায়।তাই বিয়ের মেইন থিম লাল সাদা রেখেছে।মন্ত্রীবাড়ি লাল সাদায় সজ্জিত।মেইন গেট থেকে শুরু করে বাড়ির ভেতরের সুশোভিতকরণ সকল কিছু লাল সাদা কম্বিনেশনে সজ্জিত।গত পরশু বেশ ঘটা করে হলুদের অনুষ্ঠান হয়েছে।বড়বড় এমপি মন্ত্রী থেকে শুরু করে নামীদামী বিজনেস ম্যানদের পরিবার উপস্থিত ছিলেন।নিউজ পেপার সোশ্যাল মিডিয়া বিয়ের তর্ক বিতর্কে ছেয়ে।হবে না- ই বা কেন? শহরের এতো বিত্তশালী পরিবারের বিয়ে বলে কথা! মন্ত্রী সাহেব আর উনার প্রাণপ্রিয় নাতীকে কে না চিনেন।শহরের মোস্ট হ্যান্ডসাম ব্যাচেলর পলিটিশিয়ানের বিয়ের খবর শুনে অনেক মেয়েরই মন ভেঙেছে।এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক সারা শহর জুরে । আরহাম খাঁনের বউ দেখতে পুরো শহর উদ্রেক!
এদিকে যার বিয়ে তার কোন প্রকার কৌতূহল নেই।যন্ত্রের মত কোন প্রকার হাত পা নাড়িয়ে ঠেলে ঠেলে চলছে। মানুষ নয় যেন কোন মোমের পুতুল ,যে যা বলছে তা করছে।সামনের সচ্ছ আয়নাতে লাল টুকটুকে নব বধূর প্রতিবিম্ব ভেসে আছে।গায়ে ওয়াইন রেড ডিজাইনার লেহেঙ্গা।মেঘবরণ লতানো চুল গুলো বড় খোপা করা খোপার ভাজে ভাজে ছোট ছোট আর্টিফিশিয়াল ফ্লোরাল স্টোন বসানো।ঠোঁটে রক্তলাল লিপস্টিক ভারী মেকআপ।গা ভর্তি গহনা । আয়নায় ভেসে থাকা নব বধূর প্রতিবিম্বে সেহের পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে।কি সুন্দর লাগছে!
ছোট থেকে স্বপ্ন ছিল লাল টুকটুকে বউ সেজে স্বামীর ঘরে পা রাখবে। নিজের পরিবার হবে।কত আশা কত স্বপ্ন ছিল দু’চোখে ।অথচ আজ সব কিছু দুঃস্বপ্নের মত লাগছে।অসহ্য বিরক্ত লাগছে সবকিছু ছেড়ে কোথাও যদি পালানো যেত? এসব ভেবে সেহের বুক চিড়ে নিশ্বাস ছাড়ে!
একজন মেকআপ আর্টিস্টের গলার স্বরে সেহেরের ভাবনায় টোকা পড়ে।মহিলাটি সেহেরের থুতনিতে আলতো ভাবে ছুঁয়ে বলল,”বাহ ,কি মিষ্টি দেখতে।এতো সুন্দর বউ দ্বিতীয়টি দেখিনি!
অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোমাকে । ”
সেহেরের ছলছল চোখের চাহনি সরিয়ে হাসার চেষ্টা করল।আজ কাল কৃত্রিমভাবে হাসতে হাসতে প্রকৃত হাসি কেমন হয় ভুলেই গেছে।এমন সময় দরজা ঠেলে মালিহা খানম রুমে প্রবেশ করল।দেখতে এসেছে সেহের পুরোপুরি রেডি কি না।ঐ দিকে লোকজন আসতে শুরু করেছে।মালিহা খানম কে দেখে মেকআপ আর্টিস্টরা মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়।মালিহা খানম সেহেরের দিকে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ।এই তো আর কয়েক ঘন্টা তারপর সবকিছু পাল্টে যাবে।মেয়েটার জীবনের নতুন এক মোরে ঘুরবে ।না জানি মেয়েটার সাথে কি কি হবে?
মালিহা সেহেরের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,”সরি ,শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হচ্ছে ,আমি তোমার সাহায্য করতে পারিনি ! ”
“আপনাকে সরি বলতে হবে না। আমার জন্য অনেক করেছে।মেন্টলি আপনার থেকে যতটা সাপোর্ট পেয়েছি ,এর শতভাগের এক ভাগও মায়ের কাছ থেকে পাইনি ।ধন্যবাদ! ”
সেহের ঠোঁটের কোণে উদাসী হাসি ফুটিয়ে কথা গুলো বলল।মালিহা সেহেরের উদাসীন ভাব লক্ষ করে বলে,”তোমার আগামী দিনের জন্য শুভকামনা রইল।……একটা কথা বলবো? ”
সেহের চোখ তুলে মালিহার দিকে তাকাল।মালিহা বলল,”আরহাম কিন্তু ততটাও হৃদয়হীন নয় যতটা তুমি তাকে ভাবো ।তোমাকে তার পছন্দ ।সামনের দিন গুলো তুমি যে ভাবে সাজাবে তোমার জীবনটাও ঠিক সেই ভাবে গড়বে ।আমি কি বলতে চাইছি তুমি হয়তো বুঝতে পারছ! …”
সেহের হ্যা সূচক মাথা নাড়াল ।
অগণিত লোকের মাঝে কিছু চেনা মুখ ভেসে উঠে।সেহেরের বাবা আর উনার স্ত্রী এসেছেন।বাবা কে দেখে খুশিতে সেহেরের চোখ ছলছল করে উঠে।চিটাগাং থেকে মাত্রই ঢাকা এসে পৌঁছেছে।বিয়ে শেষে রাতের ফ্লাইটে আবার ফিরে যাবেন ।সাদাত আহমেদ স্টেজে উঠে মেয়ের পাশে বসল।বাবার বুকে মাথা রেখতেই সেহেরের অবাধ্য চোখের জল গুলো গাল বেয়ে ঝরল।।বাবা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল । ধীর গতিতে পিঠে হাত বুলাতে লাগল ।সেহের ভাজাভাজা স্বরে বলল,”তুমি এখন আসলে বাবা? আমি কি তোমার এতোই অপ্রিয়! ”
“তুই অপ্রিয় কেন হবি ,তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় অমূল্য সম্পদ! আমার অহংকার ।জানি আমার প্রতি তোর অনেক অভিমান অভিযোগ জমে।আমি এক খুব খারাপ বাবা! তাই না মা? ”
“না বাবা তোমার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই।কাছে না থাকলেও ছোট থেকে তুমি অন্তত আমার পাশে ছিলে । অন্যকারো মত তুমি ছেড়ে যাও নি! !”
মেয়েটার অভিমানের কারণ যে মূলত দিশাকে কেন্দ্র করে তা সেহেরের বাবা বেশ ভালো ভাবে বুঝল।ইচ্ছে করেই তিনি দেরীতে এসেছেন ।প্রাক্তনের মুখোমুখি হতে চায়নি ।মূলত দিশার কারণেরই বিয়ে শেষ হবার পর আজ রাতেই চিটাগাং ফিরে যাবে।শুধু মেয়েটার খুশির জন্য এখানে আসা। না হয় কোন দিন এ বাড়ীতে পা রাখত না। সেহের বাবার সাথে কথা বলছে এমন সময় সেহেরের সৎমা সেহেরকে জড়িয়ে ধরে কুমির কান্না শুরু করে। আহ্লাদী স্বরে বলে,আমার মেয়েটা আজ পর হয়ে যাবে।মাকে ছেড়ে বিয়ে করে অন্যের বাড়ী চলে যাবে। বুক ফেটে কান্না আসছে। ”
সাদাত সাহেব স্ত্রীর দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। স্ত্রীর এসব অভিনয় সম্পর্কে তিনি অপরিচীত নন ।এসব দেখে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছেন।সেহের উনার সাথে ছিল- ই কবে? সৎ মায়ের এসব অভিনয় আর আজগুবি কথায় সেহের তাচ্ছল্য হাসল।আজ এতো আদর আহ্লাদ কেন? সেহের মন্ত্রী বাড়ির বউ হচ্ছে বলে?যখন এসব আদর আহ্লাদ ভালোবাসার প্রয়োজন ছিল কই তখন তো তিনি পাশে ছিল না।দূর দূর করে তাড়িয়েছে।সরাসরি কিছু না বললেও আগেপাছে অনেক কথা শুনিয়েছে ।মানুষের এসব বহুমুখী রূপ সত্যি বেশ অকল্পনীয়।টাকা ,ক্ষমতা ঐশ্বর্যের উপর কি ভালোবাসা পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করে?
মানব জাতির মত ভয়ংকর লোভী জাতি দ্বিতীয়টা হয় না। নিজস্বার্থ ছাড়া তারা এক তিলও বুঝে না।
আরহাম সেহের পাশাপাশি বসে।বিয়েতে আসা প্রত্যেকে তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।সবার মুখে একই কথা “রাজার পাশে রানী”
আরহাম ভারী শেরওয়ানি পরে।চুল তুলো পিছনের দিকে ব্রাশ করা। ফর্সা গালে ব্রাউন দাড়িগুলো চকচক করছে। ঠোঁটের কোণে তৃপ্ত হাসি।হাসি থাকবে নাই বা কেন? এতো বছরের প্রেম আজ স্বার্থক হবে।পূর্নতা পাবে । তার সেহের সারাজীবনের জন্য তার ভালোবাসার পিঞ্জিরাবদ্ধ হবে।আরহাম এখন অবধি ভালো করে সেহেরের দিকে তাকায়নি।তার কাছে খুব অদ্ভুত যুক্তি বিয়ের পর নিজের সামনে রেখে সারারাত মন ভরে দেখবে! এই একটু আকটুতে তার মন ভরবে না! আক্ষেপ থেকেই যাবে । সেহেরের এক হাতে চুমু খেয়ে নিজের হাতের ভাজে নিয়ে।শক্ত ভাবে চেপে আছে।এতে সেহের কোন আপত্তি করে নি । করেই বা কি লাভ? এই মানুষটার কাছে তার হ্যা না কোন কিছুর- ই দাম নেই। যদি দাম থাকত তাহলে আজ এই দিন আসত না।সেহের মোমের পুতুল সেজে চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে।আরহাম সেহেরের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দেয়।সেহের কুঞ্চিত ভ্রু করে আরহামের দিকে তাকায়।আরহামের চোখ সামনের দিকে।সেহের সন্দিহান স্বরে বলে,”এটা কি? ”
“তোমার ফার্স্ট ওয়েডিং গিফট ।”
সেহের ফাইল ওপেন করতে দেখে তার বাবার লোনের এপ্লিকেশন পেপারস ।যা আরহাম সাইন করে দিয়েছে!
বিষন্নতার মাঝে সেহের এক চিলতে হাসল ।আরহাম আড়চোখ করে সেহেরের দিকে তাকাল।আরহামের কাছে এই হাসিটার চেয়ে দামী কিছু নেই ! এই হাসির বিনিময়ে নির্দ্বিধায় হাজার কোটি টাকা খোয়াতে রাজি!
চলবে …..❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।