বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :২০
বাহিরে ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ ।সোনালী আলো গুলো তির তির করে অন্ধকার ঘরটায় আলো ছড়াচ্ছে ।এসির পাওয়ার তখনো ষোলতে।পুরো ঘর হিমাগারের মত ঠাণ্ডা।আরহাম মাথা চেপে বিছানায় উঠে বসে।মাথাটা চিনচিনিয়ে ব্যথা করছে।সেহেরকে পাশে না পেয়ে পুরো রুমে চোখ বুলাল।কোথাও নেই! ঘড়িতে সবে সাতটা দশ।এতো সকাল সকাল সেহের কোথায় যেতে পারে? আরহাম ভাবল!
খানিকক্ষণ বিছানায় বসে নিদ্রালস ভাব কাটিয়ে ফ্রেশ হতে উঠে পড়ে।ব্রেকফাস্টের পূর্বে সেহেরের দেখা মিলল না।অফিসের জন্য রেডি হয়ে নিচে নামতে সেহেরের দেখা মিলল।দাদী মায়ের সাথে টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে।পরনে সুনীল রাঙা কুর্তি।রক্তিম লাল ওরনাটা একদিকে ঝুলছে ।এলোমেলো শিশির ভেজা চুল গুলো চুয়ে চুয়ে পানি ঝরছে।ঠিক যেন স্নিগ্ধতায় মোড়ানো অপরাজিতা!
আরহাম সিড়ি বেয়ে নামার সময় পলকহীন ভাবে সেহেরের দিকে তাকিয়ে রইলো।মুহূর্তে সব খারাপ লাগা মাথা ব্যথা কোথাও মাথা গুজল।অদ্ভুত এক ভালো লাগা অন্তর ছুঁয়ে গেল। প্রতিটা সকাল এমন সুন্দর স্নিগ্ধকর হলে আর কি চাই? এমন সকাল হাজারবার চাই ,অন্তত কাল চাই!
আরহাম টেবিলে এসে বসতেই সেহের দাদীমায়ের আড়ালে যায়।দুজনের চোখাচোখি হতেই সেহের লাজুক হাসে। জুস আনার বাহানায় কিচেনের দিকে পা বাড়ায় । সকাল থেকে এ পর্যন্ত সেহেরের কাছে কয়েকবার ডাক পাঠিয়েছে। কিন্তু সে আসেনি । প্রত্যেকবার বাহানায় এড়িয়ে গেছে। আরহাম স্পষ্ট বুঝল সেহের তাকে ইগ্নোর করছে।কিন্তু কেন? রাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কি?
সবাই একত্রে নাস্তা করছে। সেহের আরহাম থেকে বেশ দূরত্ব রেখে দূরে এক চেয়ারে বসেছে।লজ্জা মিশ্রিত ভীতু চোখে আড়ে আড়ে বার বার আরহামের দিকে তাকাচ্ছে।মুখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে আরহাম ব্রেকফাস্ট করছে।সেহের কোনরকম নাস্তা সেড়ে নিজের রুমে চলে যায়।কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে যেই বাড়ির বাহিরে পা দিবে এমন সময় মালিহা খানমের ডাক পড়ে।সেহের থেমে যায়।মালিহা খানম ভারী স্বরে জিগ্যেস করে,”কোথায় যাওয়া হচ্ছে? ”
সেহের মুচকি হেসে উত্তর দিল,”ভার্সিটিতে ”
“একাই যাচ্ছ? লিয়া যাচ্ছে না! ”
“নাহ,লিয়ার ওয়াহিদ ভাইয়ার সাথে বের হবে।”
মালিহা খানম কিছু একটা ভেবে বলল,”একা যেতে হবে না। আরহাম ভার্সিটিতে ছেড়ে আসবে ”
মালিহা খানমের কথায় সেহের চমকায়।বড় বড় চোখ করে ততক্ষণাত বলল,”না দাদীমা ,তার দরকার নেই। আমি যেতে পারবো।শুধু শুধু উনার কষ্ট হবে! ”
“বাড়ির বউ একা বের হবে? তাছাড়া সেফটিরও একটা ব্যাপার আছে। ”
“কিছু হবে না ,আমি ম্যানেজ করতে পারবো !”
“আরহাম ছেড়ে আসবে ,আর কোন কথা না ”
“কিন্তু…”
সেহের সুর টেনে এতোটুকু বলতেই মালিহা খানম থামিয়ে দিলো।ভারী গলায় বলল ,”আরহামের যাচ্ছ,ব্যস! কোন কথা শুনতে চাই না! ”
সেহের মায়া মায়া পিটপিট চোখে মালিহা দিকে তাকায়।আরহাম পাশে ছিল।সেহের মালিহার পুরো কথোপকথন শুনছিল কিন্তু এমন ভাব করল যেন কিছুই শুনেনি।
সেহের কোন উপায় না পেয়ে রাগে গাল ফুলিয়ে গাড়িতে আরহামের পাশের সিটটায় বসল।আরহাম সেহেরকে এভাবে জব্দ হতে দেখে মুচকি হেসে গাড়ী স্টার্ড করল। মালিহা দূর থেকে তাদের দেখে মুচকি হাসল।আরহাম সেহেরের সম্পর্ক অনেকটা আগুন পানির মত।একজন জ্বলন্ত আগুন হলে অন্যজন সচ্ছ সরল জল।আরহামকে ক্ষান্ত রাখার জন্য সেহেরকে প্রয়োজন।সেহেরের প্রতি আরহামের ভালোবাসা আকাশ চুম্বী।আরহামের ভালো থাকার জন্য সেহেরের ভালোবাসাটাও প্রয়োজন!
গাড়ী তার নিজ গতিতে চলছে।সচ্ছ আকাশে রক্তিম সূর্য চিকচিক করে আলো ছড়াচ্ছে ।বাহিরের ভাপসা গরম হাওয়া গাড়ীর স্প্রিডের সাথে তাল মিলিয়ে ধীরেধীরে শীতল হচ্ছে। সেহের মুখের সামনে উল্টো বই ধরে আরহামের থেকে লুকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।গায়ে জড়ানো রক্তিম ওরনাটা সামান্য জানালা মাড়িয়ে হাওয়ায় দুলছে।আরহাম সেহেরকে ওরনা গোছাতে বলল ।সেহের না শোনার মত করে চুপি হাতে ওড়না টেনে আবার মুখের সামনে বই ধরল। আরহাম পুরো ঘটনাটা লক্ষ করে মিটমিট করে হাসল।
আরহাম গাড়ী চালাতে চালাতে স্বাভাবিক স্বরে বলল,”সকাল সকাল গোসল করার লজিকটা ঠিক বুঝলাম না। আমার যতটুকু মনে পড়ে গতরাতে আমাদের মাঝে কিছু হয়নি! সত্যি বলতো তুমি কি আমার ঘুমানো সুযোগ নিয়েছ? মানে ঐসব আরকি ……”
আরহামের কথা শুনে সেহেরের হাত থেকে ঠাস করে বইটা পড়ে ।সেহের তড়াক করে ঘাড় ঘুরিয়ে বড়বড় বিস্মিত চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহামের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি।সেহের তখনো থমকে।আরহাম সেহেরের অবাক হওয়া দেখে বলল,”এতো হাইপার হচ্ছ কেন? ইট’স নরমাল। সুযোগ নিলে নিতেও পারো । এতো হ্যান্ডসাম একটা ছেলে তোমার পাশে শুয়ে ।তুমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।এতো কাছাকাছি কিছু একটা ঘটতেই পারে।আগুন আর বারুদ পাশাপাশি সর্বনাশ হবে না,তা কি হয়? ”
সেহের রাগে জিদে কথা বলতে ভুলে গেছে।এই মুহূর্তে আরহামের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।বেশ কিছুক্ষণ রাগে ফোঁসফোঁস করে।রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে কিন্তু কোনভাবেই হচ্ছে না।নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে চেঁচিয়ে বলে,”আমি আপনার সুযোগ নিবো? আমি? দরকার হলে সারাজীবন সন্ন্যাসিনী হয়ে কাটাবো তবুও আপনার সাথে ঐসব …….মানে ….মানে…”
“আমার কাছে আসবেনা না তাই তো! ”
আরহাম কথা কেটে বলল।সেহের সাই দিয়ে উঁচু গলায় বলল,”হ্যাঁ তাই! আপনার কাছে আসবো না।হুহ! ”
আরহাম মুচকি হেসে উত্তর বলল,”কত দিন দূরে পালাবে? ঘুরেফিরে আমার বক্ষ নীড়েই তোমায় ধরা দিতে হবে।”
সেহের ভেংচি কেটে মুখ বাঁকা করে উত্তর দেয়,”হুহ ,এমন কোন দিন হবে নাহ! ”
আরহাম বাঁকা হেসে ড্রাইভিং এ মন দিলো।গাড়ীতে পিনপতন নীরবতা।অনেকটা সময় কাটল।অনেকক্ষণ ধরে সেহেরের মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করছে।জিগ্যেস করবে কিনা না নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।মনকে বুঝাতে না পেড়ে নীরবতা ভেঙে বলল,”একটা কথা জিগ্যেস করবো? ”
“হুহ ”
“গতরাতে কি ঘটেছিল?স্বপ্নে এমন কি দেখেছেন যে এতোটা ভয় পেয়ে গেলেন! ”
আরহাম হুট করে গাড়ী ব্রেক কোষল ।অপ্রস্তুত ভাবে সেহের সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।পেছনের চুল মুখের উপর এসে পড়ে।সেহের চুল গোছাতে গোছাতে ভীতু চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম থরথর কাঁপছে।চেহারায় ভয়ের ছাপ।খানিক পূর্ব অবধি সব ঠিক ছিল ,হুট করে আরহামের এভাবে ভয় পেয়ে যাওয়া বেশ চমকায়।আরহাম সিটে গা এলিয়ে চোখ বুঝে বসে আছে। কিছু জিগ্যেস করতে যেয়ে সেহের থেমে যায়।আরহাম নিজ থেকে ভারী স্বরে বলল,”জানি না কি ছিলো।চারদিকে অনেক আগুন কয়েকটা অচেনা মুখ।তারপর …….উফফ ভাবতে পারছিনা।মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ”
আরহাম শেষের কথা গুলো কাতর স্বরে বলল।সেহের আরহামের যন্ত্রণা দেখে আর কিছু বলল না।বুকের কোথাও ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।চুপচাপ ব্যথাতুর চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল।আরহাম অনেকটা সময় নিয়ে স্বাভাবিক হলো। সোজাসুজি উঠে বসে গাড়ি স্টার্ড দিলো ।সেহের তখনো আগের দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকিয়ে।আরহাম গাড়ি চালাতে চালাতে বেখেয়ালি স্বরে বলল,”কিছু বলবে? ”
সেহের কাচুমাচু স্বরে বলল,”আজ বাড়ী থেকে না বের হলেই বোধহয় ভালো হতো।আপনাকে দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে। ”
“উহু আমি ঠিক আছি! ”
“তবুও…”
সেহের সুর টেনে এতোটুকু বলল।আরহাম প্রত্যুত্তরে কিছু চুপ রইল।গাড়ী ভার্সিটির সামনে থামতে সেহের নামতে চাইলে ।আরহাম হাত টেনে কাছে আনল।কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে বলল,”ক্লাস শেষে অপেক্ষা করো ,নিতে আসবো! ”
সেহের নত মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়াল।লাজুক স্বরে বলল,”আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন”
আরহাম আরেকবার কপাল ছুঁয়ে মুচকি হাসল।সেহের ধীরেধীরে গাড়ি থেকে নেমে ভার্সিটির গেটে দিকে পা বাড়াল । আরহাম সিটে হেলান দিয়ে মুচকি হেসে আদুরে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল!
চলবে….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।