বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :২৯

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :২৯

সেহেরের জ্ঞান ফিরে পরের দিন সকালে।চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে পায়।তাকে ঘিরে চারদিকে বাড়ির সবাই।পিটপিট চোখে সামনে দাদীমাকে দেখতে পায়।ব্যথাতুর শরীর নিয়ে বসতে গেলে ফলস্বরুপ বেডে উপুড় হয়ে পড়ে।হাত পায়ে ব্যান্ডেজ লাগানো মাথায় ব্যান্ডেজ । সারা শরীর জুড়ে ভীষণতর ব্যথা।দাদীমা সেহেরের কাছে এসে ঠিক ভাবে শুয়ে দিতে দিতে আওয়াজ করে বলে,”আহ! এই শরীর নিয়ে উঠছ কেন।”
সেহের ব্যথাতুর স্বরে বলে,”আমি এখানে কি করে? ”
দাদীমা বলল,”গতকাল তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে,উনারা তোমায় নিয়ে এসেছে ”
দাদীমায়ের ইঙ্গিত অনুযায়ী সেহের সামনের দিক তাকাল। গতকালকের কালো পোশাক পরিধানকৃত সেই দুই ব্যাক্তি দাড়িয়ে।সেহের হালকা আওয়াজে বলে,”আপনারা আমার পিছু নিয়েছিলেন কেন? ”
তাদের মধ্যেকার একজন মাথা নিচু করে আমতা আমতা স্বরে বলল,” সরি ম্যাম ,স্যার চব্বিশ ঘণ্টা আপনার আশেপাশে থাকতে বলেছিল। তাই …”
সেহেরের বুঝতে বাকি রইল না এটা আরহামের কারসাজি । সেহেরের অভিমান গাল ভারী । এই সব মিথ্যা দরদের কি দরকার? আজ ষোলদিন কানাডা যাওয়ার পর একবার ঠিকঠাক কথা বলছে না। অথচ সে দেশে গার্ড লাগিয়ে রেখেছে।কে বলেছে এমন কেয়ার করতে?
তেতো মুখ করে ড্যাবড্যাব চোখে বাহিরে তাকায়।দিশা সেহেরের পাশে টুলটায় বসে মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করে,”এখন কেমন লাগছে? ”
সেহের বাহিরের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাঠকাঠ গলায় উত্তর দেয়,”কিছুটা ভালো ”
দিশা মেয়ের দিকে টলটল চোখে তাকিয়ে থাকে।মেয়ের রাগ বিন্দু মাত্র কমেনি।শান্ত মানুষের বুঝি এই বৈশিষ্ট্য ।শান্ত অবস্থায় প্রশান্ত সাগরের মত শান্ত।আর রেগে গেলে জ্বলন্ত অগ্নিগিরির লাভার মত !
সকাল থেকে রাত অবধি সেহের কয়েকবার ফোন চেক করল।নো কল ,নো মেসেজ! আরহাম কি তার অসুস্থতা কথা জানে না? নাকি জেনে ইচ্ছে করে খোঁজ নিচ্ছে না।সেহের গম্ভীর মুখ করে কথা গুলো ভাবল।

মালিহা খানম সারারাত হসপিটালে ছিলো।দিশাও বাড়ি ফিরেনি।গতরাতে গাকেঁপে সেহেরের জ্বর এসেছিল ।নির্ঘুম সারারাত হসপিটালের বেডে কাতরেছে।ভোর বেলায় ঘুমিয়েছে ।সেহেরের সাথে মালিহা দিশা দুজন- ই জেগে ছিলো।দু’চোখের পাতা কেউ- ই এক করেনি। ক্যান্টিন থেকে চায়ের কাপ নিয়ে মালিহা খানম মাত্র বসেছে ।এমন সময় তার চোখ আটকায় সামনের দিকে।বড় বড় পা ফেলে আরহাম আসছে।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।চোখে মুখে আকাশ চুম্বী ক্রুদ্ধতা ছেয়ে।নাকের পাটা ফুলে।মালিহা আরহামের রাগের প্রলয় আঁচ করতে পারছে ।চায়ের মগ রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।আরহামের কাছে যেতে কিছু বলবে ,তার পূর্বেউ আরহাম হাত দেখি থামিয়ে দেয়।ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে বলে,”সেহের আপনার দায়িত্ব ছিলো, এমন কি করে ঘটল? ”
মালিহা আমতাআমতা গলায় কিছু বলতে যাবে আরহাম থামিয়ে দিয়ে বলে ,”ব্যস ,আর একটা কথাও না। কারো উপর আমার আর বিন্দু পরিমান বিশ্বাস নেই। সবাই অকেজো । আপনার কথায় ভরসায় সেহেরকে রেখে কানাডায় গিয়েছিলাম ।আপনি কি করলেন? ইট’স রিয়ালি ডিসিপয়েন্টেড মি! ”
বলেই হুড়মুড় করে কেবিনের ডুকে গেলো।মালিহা দিশা কেউ- ই আর কেবিনে ঢুকার সাহস করল না।কেই বা যেচে যেয়ে বাঘের ক্রোধের মুখোমুখি হতে চাইবে ?

সেহেরের ঘুম কাটল দুপুরের পর।আবছা আবছা চোখ খুলে সামনে কারো ঘোলাটে প্রতিচ্ছায়া লক্ষ করে।ছায়াটা তার বেশ পরিচিত।চোখ পরিষ্কার করে ভালো করে চাইতেই সেই চিরচেনা মুখখানা ভেসে উঠে।আনমনেই ঠোঁটের কোনে মিহি হাসি ফুটে উঠে।স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক খুঁজতে সেহের নিজের হাতে চিমটি কাটল।নাহ,স্বপ্ন না বাস্তব ।তার প্রিয়মানুষটা সত্যি তার সামনে!
আরহাম পলকহীন ভাবে সেহেরের দিকে তাকিয়ে।মৃদু হাতে সেহেরের চুলে বিলি কাটছে। আরহামের আদুরে চাহনি সেহেরের হৃদমাঝারের শান্ত প্রবাহিণীতে উতলা ঝড় বইছে।সেহের টলটল চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে । হাজার বছরের চোখের পিপাসা নিবারণ করছে।দুজনের ঘোর কাটে সেহেরের আলতো স্বরে,”কখন ফিরেছেন? ”
আরহাম আগের মত একই চাহনি রেখে উত্তর দিলো ,”সকালে! ”
“ডাকলেন না যে? ”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই। কেমন আছো? ”
“যেমন ছেড়ে গেছেন , ধীরূজ নিষ্প্রাণ! ”
সেহেরের ধারালো কথা আর তীক্ষ্ণ চাহনি আরহামের হৃদপিণ্ডকে ফালা ফালা করছে।বেশিক্ষণ এই চোখের গহীনে তাকানো যাবেননা অন্যথা কোন এক অদৃশ্য মায়াপুরীতে হারিয়ে যাবে।জোরালো এক নেশায় আবদ্ধ হবে!
আরহাম চোখ সরিয়ে জানালার বাহিরে দূর আকাশে চাইল । সূর্যিমামা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। দিনের আলো প্রায় শেষের দিকে।সেহের আরহামের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে দূর অম্বরে চোখ রাখল।ধীর স্বরে বলল,”না আমার থেকে পালাতে পারছেন।না আমাকে এড়িয়ে চলতে পারছেন ।এই মিছে চেষ্টা কেন ? ”
আরহাম কোন উত্তর দিলো না।সেহেরো উত্তরের আশা না করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বুঝে নিলো!

পরদিন সকালে সেহেরকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করা হলো।আরহাম সেহের এক গাড়িতে।দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা ।গতকাল সেই বিকালের পর দুজনের মাঝে কোন কথা হয়নি।আরহাম দুএক বার চেষ্টা চালালেও সেহের বরাবরের মত মুখে আঠা লাগিয়ে বসে। গাড়ি চলছে তার নিজ গতিতে।সেহের চোখ বুজে সিটে গা এলিয়ে ।হুট করে সেহের কাঁশতে শুরু করে।আরহাম পানির বোতল এগিয়ে দিলে সেহের মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরহাম বেশ কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।রাগ দমাতে গাড়ির স্টিয়ারিং এর উপর সজোরে বাড়ি মারে।সেহের কোন রকম ভ্রুক্ষেপ না করে আগের ভঙ্গিমায় বসে থাকে।যেন কিছুই হয়নি।
গাড়ি থেকে নামার সময়ও সেহের একই জেদ ধরে।সে কোন ভাবেই আরহামের কোলে করে রুম অবধি যাবে না।এই ব্যথাতুর খোঁড়া পা নিয়ে একাই যাবে।আরহামও নাছোড়বান্দা সেহেরকে পাতাল কোল করে রুম অবধি নিয়ে যায়।

সারাদিন দুজনের চোখাচোখি যুদ্ধে পার হয়।প্রত্যেক বেলা খাবার থেকে শুরু করে ঔষধ পর্যন্ত সব কিছু নিয়ে সেহের জেদ ধরছে ।আরহাম তা জোর খাটিয়ে করাচ্ছে।একজন বুনো ওল অন্যজন বাঁঘা তেঁতুল!
রাতে আরহাম পায়ের ড্রেসিং করতে আসলে সেহের চুপচাপ বসে থাকে।কোনপ্রকার কথা বলে না ।না বাঁধা দেয়।গোল গোল চোখ করে আরহামের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে।আরহাম পায়ে মেডিসিন লাগাতে লাগাতে বলে,”এবার বাঁধা দিলে না যে? ”
সেহের তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,”আমি বাঁধা দেওয়ার কে? আদৌ সে অধিকার কি আমার আছে? ”
আরহাম কোণাকোণি চোখ করে সেহেরের দিকে চাইল ।আরহাম বেশ বুঝতে পারছে সেহের কি বুঝাচ্ছে।আরহাম কোনপ্রকার প্রত্যুত্তর করল না।
ড্রেসিং করে সরে যেতে নিলে সেহের পেছন থেকে হাত আটকায়।অশ্রুভরা টলটল চাহনি।ভিতর ভেঙ্গেচুরে কান্না বেরিয়ে আসছে।সেহের কোনরকম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,”কি সমস্যা আপনার? এমন বিহেভ করছেন কেন? ”
আরহাম পেছনে ফিরে সেহেরের হাত ছাড়িয়ে চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল,”অসুস্থ শরীর ,অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো! ”
বলেই কাবার্ডের সামনে কাপড় বের করতে দাড়াল।সেহের কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে খোঁড়া পা নিয়ে আরহামের পিছনে দাড়ায়।শক্ত করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললে,”এমন অসুস্থ হয়ে যদি আপনাকে কাছে পাওয়া যায়। তবে সারাজীবনের জন্য এই অসুস্থতাকে মঞ্জুর।”
আরহাম পেছন ফিরতে চাইল কিন্তু পারল না সেহের শক্তভাবে আরহামকে জড়িয়ে।আরহাম গাঢ় স্বরে বলল,”কেন এমন পাগলামো করছ ? ক্ষত এখনো কাঁচা, কোথাও লেগে যাবে। ”
“লাগলে লাগুক! বাহিরের ক্ষত আপনার চোখে পড়ছে, ভিতরে যে ক্ষণে ক্ষণে এমন হাজারো ক্ষত হচ্ছে তা কি আপনার চোখে পড়ছে না? একবার এই চোখ জোড়ায় তাকান।মনের গভীরত্ব মেপে দেখুন কতটা জলে হাবুডুবু খাচ্ছি ।”
আরহাম সেহেরকে সামনে টেনে আনল।শক্ত করে গাল চেপে।কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে ,চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বলল,”আরেকবার ভেবে দেখো এর পরিনাম কিন্তু ভয়ানক হবে! ”
“ভাবা ভাবির সময় অনেক আগে পেড়িয়ে গেছে,এখন এটাই একমাত্র পথ।আপনাকে আমার প্রয়োজন ,খুব করে প্রয়োজন ”
আরহাম সেহেরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সেহের লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো ।আরহাম এক সেকেন্ডও অতিক্রম না করে সেহেরের ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের ভাজে মিলিয়ে নিলো।মিষ্টি আবেশে দুজন জড়িয়ে রইল।

চলবে….❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here