বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৩০

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩০

সময় তার নিজ গতিতে চলছে।সময়ের সাথে আরহাম সেহেরের সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে।অপ্রকাশিত ভালোবাসার অনুভূতি গুলো যে এতোটা সুন্দর হয় সেহেরের জানা ছিলো না।আরহামের প্রত্যেক কাজ কেয়ার সেহেরের মনে গাঢ় দাগ কাটে ।
সবকিছু ঠিক চলছিল । হুট করে একদিন বাড়িতে অতিথির আগমন ঘটে।
শৈত্যপ্রবাহ চলছে।চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন।আজকাল সূয্যি মামার দেখা খুব একটা মিলে না।মাঝেমাঝে দুপুর দিকে দুএকবার উঁকিঝুঁকি দেয়।কনকনে শীতের সকাল। সেহের গোসল সেরে নিচে নামতে দেখে বাড়িতে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।দাদীমা নিজে দাড়িয়ে থেকে কাজ দেখিয়ে দিচ্ছে ।বাড়ির সবকিছু ঝকঝক চকচক করে পরিষ্কার করিয়েছে।কোনার গেস্ট রুমটাও খুলে দেওয়া হয়েছে।বাড়িতে বিশেষ অতিথি আসছে। আরহামের ছোট বেলার বন্ধু মিহি, কানাডা থেকে দেশে ফিরছে।গতরাত থেকে এ পর্যন্ত সেহের হাজারবার মিহি নাম শুনে ফিলেছে।শ’বার তো দাদীই জপে গেছে। সে সাথে আরহাম তো আছেই ।কোন এক অজানা কারণে সেহেরের মিহি নামক মেয়েটার উপর ভীষণতর জেলাসি কাজ করছে।এর পেছনে মূল কারণ কি তা সে নিজেরও অজানা। হয়তো আরহামের এতো কাছের বন্ধু বলেই! সেহের রাগ আকাশ চুম্বী রূপ নেয় যখন জানতে পারে আরহাম নিজে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে যাবে। না আরহামকে কিছু বলতে পারছিল, না সইতে।শুধু গাল ফুলিয়ে বসে ছিলো ।এতো লোক থাকতে তাকেই কেন যেতে হবে? জীবনে কিছুকিছু সময় আসে না কিছু বলা যায় ,না সহ্য করা যায়।তবুও সবটা মেনে কৃত্রিম হাসতে হয়।সেহেরের সাথেও তাই হচ্ছে।সবকিছু দেখছে মানছে আর কৃত্রিম হাসছে।
আরহাম মিহিকে রিসিভ করতে বেরিয়েছে সেই অনেকক্ষণ।সেহের বারবার ঘড়ির দিকে চোখ রাখছে।বরাবর এগারোটা বাজে, ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে সেই আটটায় । এখনো কেন বাড়ি ফিরছে না? চিন্তায় সেহেরের হাল নাজেহাল । মনে কোথাও ইন্সিকিউর ফিল হচ্ছে।ভয় হচ্ছে ,আরহামের সেই বাচ্চা প্রেমিকা মিহি- ই না হয়ে বসে!

আরহাম বাড়ি ফিরল বরাবর একটায়।গাড়ির শব্দ পেয়ে সেহের তড়িঘড়ি করে নিচে নামে।সিড়ির কাঠ ধরে দাড়াতে দেখে আরহাম সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করছে।পেছনে হয়তো মিহি আরহামের উচ্চতার কারণে তাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না।সেহের ঘাড় বাঁকিয়ে উঁচু করে চাইল।মিহি নামক মেয়েটিকে দেখে সেহের অপ্রত্যাশিত ভাবে হতভম্ব হয়ে রইল।উঁচা লম্বা স্লিম গড়নের এক অপূর্ব সুন্দরী।লম্বায় পাঁচ ফুট চার পাঁচ তো হবে- ই।মেদহীন স্লিম ফিগার।লম্বাটে মুখ।গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা।বিচ ব্রাউন সেমি কার্ল চুলগুলো পিঠ অবধি।পোশাকআশাক সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে হলিউড হিরোইন।ড্রেসিং সেন্সও একদম তুখোড়। জিন্সের সাথে ক্রিম কালার গেঞ্জি তার উপর স্কাই ব্লু জেকেট।মেঝের টাইলসের সাথে হাই হিলের সংঘর্ষে কটকট শব্দ হচ্ছে।সেহের ড্যাবড্যাব চোখ করে মিহির দিকে তাকিয়ে।মিহিকে দেখে মালিহা বেগম সহ বাড়ির অন্যসবার মুখে হাসির রেখা চওড়া হয়।মিহি সবার সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত।সেহের ফাঁক বুঝে কিচেনের দিকে অগ্রসর হয়।জলখাবারে ব্যবস্থা করতে।লতা খালাকে দিয়ে জলখাবার পাঠিয়ে সেহের হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে।বড় হল ঘরটায় হাসিঠাট্টার জোরদার আওয়াজ । সবাই একত্রে গল্প করছে।দিশা,লিয়া সহ সবাই উপস্থিত! সেহের ধীর পায়ে সোফার কোণ ঘেঁষে দাড়াল। দূর থেকে দেখল আরহাম সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে।ক্লান্তির ছাপ মুখে স্পষ্ট ফুটে।কেমন জানো গভীর চিন্তায় বিভোর । আরহামের সাথে চোখাচোখি হতেই সেহের মিষ্টি হাসল।আরহাম আলতো ইশারায় সেহেরকে নিজের কাছে ডাকল । সেহের বাধ্য মেয়ের মত আরহামের পাশে যেয়ে বসল।আরহাম কোণাকোণি চোখে তাকিয়ে রইল।সেহের আলতো স্বরে জিগ্যেস করল,”ফিরতে এতো দেরী হল যে? ”
“ফ্লাইট দুই ঘন্টা ডিলে ছিলো ”
“ভীষণ ক্লান্ত কি ? ”
“উহু, ছিলাম! তোমাকে দেখে সব ক্লান্তি কেটে গেছে! ”
সেহের লজ্জিত ভঙ্গীতে চোখ নামিয়ে নিল।মিহির সেহেরের দিকে চোখ পড়তেই তড়াক করে উঠে দাড়ায়।উল্লাসিত স্বরে বলে,”ইউ মাস্ট বি সেহের ,রাইট? ”
সেহের মুচকি হেসে ‘ হ্যাঁ ‘সূচক মাথা নাড়াল।মিহি শব্দ করে বলল, “ও .এম.জি, তুমি তো কল্পনা থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। পুরো দেসি গার্ল! ”
মিহির মুখে বাংলা কথা গুলো বেশ সুন্দর লাগছে।বেজে বাংলা উচ্চারণ গুলো খুব কিউট সাউন্ড করছে। সেহের মৃদু হেসে হালকা স্বরে বলল,” থ্যাংকস ,আপনিও ভীষণ সুন্দরী! ”
মিহি মন খারাপের ভঙ্গিমা করে বলল,”এসব আপনি বলে স্মবোধন চলবে না ,তুমি বলে ডাকবে ।”আপনি” ইট’স সাউন্ডস ওল্ডি ওল্ডি ,ইউ নো ! ”
সেহের মিহির কথার অর্থ পুরোপুরি না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল চোখে মিহির দিকে তাকিয়ে থাকে।আরহাম আওয়াজ করে বলে,”মিহি ,ডিড ইউ মিন ‘সম্বোধন’ ?”
মিহি জিভ কেটে বলে,””ইয়াহ! স্মবোধন,আই মিন সম্বোধন ”
মিহির কথায় হল ঘর হাসির গুঞ্জনে কেঁপে উঠে।সবাই আড্ডায় ব্যস্ত দিশা আড্ডার এক পর্যায় মিহি জিগ্যেস করে ,”তো মিহি বর্তমানে কানাডায় কি করছ? ”
“আন্টি তোমরা তো জানো মা মারা যাবার পর । বাবা একাই দেখাশোনা করেছে।আজ আমি যা শুধুই বাবা জন্য । বাবার শরীরটাও ইদানীং ভালো যাচ্ছেনা । স্টাডি কমপ্লিট করে ,বর্তমানে সাইকিয়াটিস্ট।বাবার চেম্বারে বাবার এ্যাসিস্টেন্ড হয়ে কাজ করছি!”
আরো কিছুক্ষণ সবাই গল্প করে।আড্ডা শেষে মিহিকে ফ্রেশ হতে তার রুমে যায়।সেহের টেবিলে খাবার লাগিয়ে আরহামকে ডাকতে যায়।রুমের ঢুকতেই হাতে টান পড়ে।সেহের চমকালেও বিন্দু মাত্র ঘাবড়ায় না।সে জানে এটা আরহামের কাজ।আরহাম সেহেরকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা হেলিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলে,”সকাল থেকে এক মুহূর্তের জন্য বউকে কাছে পাচ্ছি না ,এটা কেমন বিচার? ”
“আপনি- ই তো ব্যস্ত ছিলেন! ”
“আর এখন যে তুমি ব্যস্ত ? বাই দ্যা ওয়ে আর ইউ ওকে? ”
মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে সেহের চটজলদি উত্তর দিলো ,”হ্যাঁ ঠিক আছি ,কেন? ”
“মুখ কেমন যেন বুজে আছে,সামথিং মিসিং! ”
“এমন কিছু না।” সেহের ঠান্ডা স্বরে উত্তর দিলো ।
“তুমি কি মিহিকে নিয়ে ইন্সিওর? ”
সেহের হুট করে আরহাম থেকে সড়ে দাঁড়াল।আমতা আমতা মুখ করে কিছু বলতে চাইল।কিন্তু ঠিকঠাক গুছিয়ে উঠতে পারছেনা ।আরহাম সেহেরকে নিজের কাছে টেনে এনে বাহুতে আবদ্ধ করে বলল,”তোমার থেকে কোন কিছু হাইড করবো না।হ্যাঁ ,মিহি আর আমার মাঝে সম্পর্ক ছিলো।জাস্ট স্ট্রং ফ্রেন্ডশিপ ।উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ড নাথিং ইলস! স্কুলের লাস্ট দিকে মিহির আমার প্রতি অন্যকোন ফিলিংস কাজ করলেও আমার দিক থেকে ছিলো শূন্য । এরপর আমি দেশে ফিরে আসি।তারপর বহুকাল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।ততদিনে মিহির টিনেজ আবেগ ফিকে পড়ে যায়।আস্তে আস্তে আবার আগের ফ্রেন্ডশিপে টার্ন করে।সে দেশে কোন এক বিশেষ কাজে এসেছে কাজ শেষে কানাডায় ফিরে যাবে । সো এসব নিয়ে উটকো চিন্তার প্রয়োজন নেই।আমার পুরোটা জুড়ে শুধু- ই তুমি,আমার ওয়াইফ বিস্তৃত ! ”
সেহের আরহামের বুকে মাথা এলিয়ে দিলেও।নিজের মনকে শান্ত করতে পারছে না।মিহিকে দেখার পর তো একদমই না।আরহাম সেহেরের গাল টেনে দিয়ে বলে,”নাও গিভ মি টাইট হাগ”
সেহের মুচকি হেসে আরহামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।ফিসফিস স্বরে বলল,” আই ট্রাস্ট ইউ! ”
আরহাম সেহেরের মাথায় চুমু এঁকে দিলো।সেহের মাথা উঠিয়ে আরহামকে তাড়া দিয়ে বলে,”লাঞ্চ করবেন নিচে চলুন! ”
আরহাম দুষ্টু হেসে ঠাই দাড়িয়ে থাকল ।চোখ চিপে বলল,”আর একটু পর প্লিজ! ”
সেহের আরহামের হাসিকে উপেক্ষা করে ঠোঁটের হাসি চেপে বলল,”অলরেডি অনেক দেরী হয়ে গেছে চলুন! ”
আরহামের হাত টানতে টানতে নিচে নিয়ে আসল।

চলবে….❣️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here