বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৩১

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩১

সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ।কিন্তু এখন অবধি আহ্লাদী রোদের দেখা মিলেনি। রুষ্ট হয়ে কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে আছে।চারদিকে এখনো ধোঁয়ার মত ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে।ঘাসের উপর শিশির কণা মুক্তা দানার মত চিকচিক করছে।কনকনে শীতের সকাল।সেহের উষ্ণ তপ্ত লুইয়ের ভাজে গভীর ঘুমে মগ্ন।আবছা ঘুম কাটতে সেহের বিছানায় হাত বুলিয়ে আরহামকে খোঁজে।আরহামকে না পেয়ে বিরক্তির সাথে চোখ মেলে তাকায়।নিভু নিভু চোখে ঘড়ির দিকে তাকায় সাড়ে সাতটা! আরহামের জগিং টাইম।সেহের বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।শাওয়ার সেরে বারান্দায় দাড়ায়।শীতের প্রবণতায় প্রকৃতি মুড়িয়ে আছে। তবুও অদ্ভুত এক সতেজতা মন ছুঁয়ে যাচ্ছে।ঠান্ডার কঠিনদশায় দাঁতের সাথে দাঁত বাড়ি খেয়ে কটকট আওয়াজ হচ্ছে।বারান্দা থেকে আড়চোখে বাগানের দিকে তাকাতে সেহেরের সব শীত কেটে যায়।বুকে অদ্ভুত এক যন্ত্রণা নাড়া দিয়ে উঠে।কান থেকে তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। আরহাম মিহি বাগানে বসে ,চা পান করছে।মিহির পোশাকে বুঝা যাচ্ছে সেও আরহামের সাথে জগিং এ গিয়েছিলো । দুজন হাসি ঠাট্টায় বেশ মজে। হাসির উচ্চ আওয়াজ বারান্দা অবধি আসছে! সেহেরের ভীষণ মন খারাপ হলো।আরহাম তো বলেছিলো,’ তার প্রত্যেকটা সকাল সেহেরের সাথে শুরু করতে চায়।’ তবে আজ মিহির সাথে কেন? সেহের ভারী মুখ নিয়ে রুমে ডুকে পড়ল।আয়নার সামনে দাড়িয়ে আনমনে বকবক করতে করতে হাতের চুড়ি আর নোসপিন পড়ে নিলো । নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে এমন সময় রুমে দিশার আগমন ঘটে।সেহের কিছুটা চমকাল । সেদিনের সেই কথাকাটা কাটির পর আজ প্রথমবার দিশা সেহেরের রুমে এসেছে।সেহের কিছু জিগ্যেস করবে তার পূর্বে দিশা বলল,”কিছু কথা বলার ছিলো ,তুমি কি ব্যস্ত? ”
সেহের ‘না ‘সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল ,”নাহ ,বলুন! ”
দিশা সেহেরের কাছে এসে দৃঢ় গলায় বলে,”এসব তুমি কি করছ? ”
সেহের কিছুটা চমকে উত্তর দেয়,”আমি কি করলাম? ”
দিশা সেহেরকে বারান্দায় টেনে নিয়ে যায়। আরহাম মিহিকে দেখিয়ে বিরক্তির স্বরে বলল,”মিহি আরহামের নৈকট্য কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না? সেহের আরহাম মিহির টিনেজ লাভ।দুজনের এক সাথে এভাবে টাইম স্পেন্ড করা তোমাদের বৈবাহিক জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ! আস্তে আস্তে মিহি আরহামের উপর নিজের অধিকার জমাবে ।তোমার থেকে কেড়ে নিবে ।সব কিছু তছনছ হবার আগে ,সময় থাকতে নিজের জীবন গুছিয়ে নেও! নিজেদের ভেতর তৃতীয় ব্যক্তিকে দাঁড় করিও না । সবকিছু আরো জটিল করো না। ”
মায়ের কথায় সেহের তাচ্ছিল্য হেসে জবাব দিলো ,”আমার জীবনে কোন কিছুই সহজ ছিলো না।প্রথম থেকে সব জটিল ছিলো ।আরেকবার না হয় জটিলতার মুখোমুখি হই। আর তাছাড়া আমাকে কে জ্ঞান দিচ্ছে?সেই মানুষটা যে নিজেই বিয়ের পর অন্যকার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে! ”
“সেহেররর! ” দিশা ধমকের স্বরে বলল।সেহের শান্ত হলো না। উল্টা উত্তর দিলো ,”আমাকে ধমক দিলেই সত্যিটা পাল্টে যাবে না।”
দিশা সেহেরের বাহু ঝাঁকিয়ে রেগে বলে,”আমাকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া বন্ধ করো । তুমি কতটুকু জানো? প্রত্যেকটা গল্পের দুইটা দিক থাকে । তুমি তোমার বাবা দিকটা তো শুনেছ কিন্তু কখনো কি আমার দিকটা জানার চেষ্টা করেছ? কেন আমি তোমাদের ছেড়ে এসেছি তা জানতে চেয়েছ? ”
সেহের চুপ করে থাকে।দিশা নিজ থেকে বলতে শুরু করে,”ইন্টার পরিক্ষার পর বড় আপার সাথে চিটাগাং থেকে ঢাকায় শিফট হই। আপা বরাবরই আমার খুব কাছের মানুষ ছিলো ।আমার সকল চাহিদা আপার কাছেই ছিলো।আমি ছোট থেকেই স্বাধীন থাকতে পছন্দ করি। কারো অধীনে বেঁচে থাকা আমার ভীষণ অপছন্দ ছিলো।স্বপ্ন ছিলো নিজের যোগ্যতায় কিছু একটা হবো। ঢাকায় আসার পর এখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি হই।নতুন জীবনের পদার্পণ করি।নতুন ক্যাম্পাস ,নতুন বন্ধুমহল সব কিছুকে ঘিরে আমার এক আলাদা দুনিয়া গড়ে উঠে।সৌন্দর্যের জন্য ভার্সিটিতে সেরাদের তালিকায় ছিলাম।চোখ মেলে সবকিছু রঙিন দেখছিলাম। আমার এই রঙিন দুনিয়ায় আমানের আগমন ঘটে।খুব তাড়াতাড়ি দুজন দুজনাকে গভীর ভাবে ভালোবেসে ফেলি। সময়ের সাথে আমাদের সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে।কোনভাবে আমাদের এই সম্পর্কের কথা আমার বাবার কান অবধি পৌঁছে যায়।বাবা জরুরী তলবে চিটাগাং ডাকে।সেখানে যেতেই জানতে পারি বাবা তার পছন্দের ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।বাবাকে আমানের কথা বলতে শক্তভাবে বলে,’রাজনীতির সাথে জড়িত এবং পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিবে না।’বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলে বাবা নাছোড়বান্দা নিজের জেদে আটকে থাকে।তাই কোনপ্রকার উপায় না পেয়ে পাত্র মানে তোমার বাবার কাছে আশ্রয় চাই,তোমার বাবা আমাকে কথা দেয় তিনি এই বিয়ে আটকাবে! কিন্তু বিয়ের দিন তিনি তার কথার খেলাফ করে।আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।আমাদের বিয়ে হয়।কিন্তু বিয়ের পর কখনো তাকে মেনে নিতে পারিনি । তোমার বাবা অভার পসেসিভ ছিলো।তিনি সর্বদা আমাকে বন্ধী রাখতে চেয়েছে । আমার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের নজরবন্দি করে রাখতে চেয়েছে।যা আমার মঞ্জুর ছিলোনা ।আমি ব্যক্তিস্বাধীনতা চেয়েছি কারো অধীনে থাকা আমার মঞ্জুর নয়।যা নিয়ে তোমার বাবার সাথে আমার ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগে থাকত।হ্ঠাৎ একদিন জানতে পারি আমান তার মানুষিক ভারসাম্য হারিয়েছে।যার পেছনে কারণটাও আমি ছিলাম।নিজেকে অপরাধি ভেবে দিন পার করছিলাম। তুমি বলেছিলে তুমি আমার ভুলের ফল ছিলে কিন্তু তুমি ছিলে তোমার বাবার জেদের ফল।।যার কারণে তোমাকে ভীষণরকম অপছন্দ করতাম।অনেক চেষ্টা করেছি সব ভুলে সংসারে মন দিতে কিন্তু আমি পারিনি।যতবার তোমাকে দেখতাম তোমার বাবার সেই অমানুষিক জেদের কথা মনে পড়তো।মানুষিক সমস্যায় দিন পার করছিলাম। এক সময় হাল ছেড়ে দেই ।তোমার বাবা থেকে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেই। তোমার বাবা না চাইলে মরার হুমকি দেই ,যার পর তিনি রাজি হয়।সেই মুহূর্তে আমার কাছে এই পরাধীন জীবন থেকে মৃত্যু অনেক শান্তির মনে হয়েছে।নিজের অনুতাপ নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। আমানের সুস্থতার জন্য এ বাড়ির মানুষ আমাকে আমানের বউ করে আনে। তাদের সম্মানে ভয়ে আমার অতীত আড়াল করতে হয়।আমি আজ অবধি যা করেছি তার পেছনে তোমার বাবাও কোনাকোন ভাবে দায়ী ছিলো।তোমার একার জীবন- ই জটিল ছিলো না।আমার জীবনও কম জটিল ছিলো না।আমার মনে সবসময় তোমার জন্য অনুতাপ কাজ করতো কিন্তু কখনো বুকে টেনে নেওয়ার সাহস করতে পারিনি।তাই তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ- এর জন্য আমাকে এসব করতে হয়েছে। আরহামের নামের সাথে তোমাকে জুড়তে হয়েছে।আমার জায়গায় থাকলে তুমি কি করতে? বন্দি থাকতে কারো পিঞ্জিরায়? মেনে নিতে অন্যের অধীন জীবন? ”
দিশা কথা গুলো বলে থামল।বড় বড় রাগী শ্বাস ফেলছে । সেহের মায়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ।মায়ের প্রতি ঘৃণা না কাটলেও একজন মানুষ হিসাবে সহানুভূতি কাজ করছে!
সত্যি তো এমন পরাধিন জীবন কার চাই? দিশার জায়গায় সেহের থাকলে কখনোই এমন বন্দি জীবন মেনে নিতো না। দিশা সেহেরের দিকে দু’কদম এগিয়ে আসে।সেহেরের মাথায় আলতো হাত রেখে বলে ,”তোমার কথায় আমার রাগ হয়না,কষ্ট হয়!
এখনো সময় আছে নিজের সবটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে গুছিয়ে রাখো ।তোমার রূপ গুন তোমার শক্তি ,এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রিয়মানুষটাকে নিজের কাছে আটকাও! তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী ,আশা করি তোমাকে আর কিছু বলে বুঝাতে হবে না। ”
কথা শেষ করে দিশা দাঁড়াল না। চোখ মুছতে মুছতে বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।সেদিন সারাদিন মায়ের কথাগুলো ভেবে পার করল।মায়ের কথায় কোথাও সত্যতা আছে।পুরুষ মানুষের মন ঘুরতে কতক্ষণ? যদি মিহির ভালোবাসা আবার উথলে উঠে? আরহাম যদি তার ছোটবেলার বান্ধবীর উপর দুর্বল হয়ে পড়ে?
সেহের সারাদিন ভেবে বিকেলে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে।আরহামকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলল।লিয়ার থেকে আউটিং এর জন্য ভালো প্লেস জেনে নিলো । মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজ রাত জেগে আঁধার কুয়াশায় ঘেরা ঢাকা শহর দেখবে । কাবার্ড থেকে নতুন কালো জামদানী বের করে পরল।লতানো চুল গুলোকে পিঠের উপর মেলে দিয়ে ।চোখে গাঢ় করে কাজল এঁকে নিলো।হাত ভরা কাচের চুড়ি আর কপালে ছোট একটা কালো টিপ পরল।নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো।মন্দ লাগছে না! আরহাম কে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট কি?
বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি আরহামের অপেক্ষা করল।আরহাম আসার নাম নেই।পৃথিবীর বুকে কালো আঁধার নেমে এসেছে।ঘড়িতে আটটা বাজছে।সেহের আরহামকে ফোন করল।দুবার রিং বাজতে আরহাম ফোন রিসিভ করল।কত দূর আছে ,জিগ্যেস করতে । আরহাম উত্তর দিলো ,’মিহির সাথে এক কাজে আটকে গেছে,ফিরতে আরো রাত হবে ‘। সেহের কোনপ্রকার প্রত্যুত্তর না করে ফোন কাটল।যদি কথা না রাখতে পারে ,এমন কথা দিবেই বা কেন?
একজন রাজনীতিবিদের সাথে সাইক্রিয়াটিস্টের এতো রাত অবধি এমন কি কাজ থাকতে পারে?
পাথর ভারী কষ্টে বুক চাপা পড়ে।রাগে হাতের চুড়ি গুলো টেনে খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে।ঝনঝন আওয়াজ তুলে চুড়ি গুলো ভেঙে এক এক পার্ট এক এক দিকে ছুটে যায়।সেহের অগ্নিমূর্তি হয়ে শক্ত ভাবে বিছানায় বসে থাকে। কাজল ল্যাপটানো বড় বড় অশ্রুকণা গাল বেয়ে পরল।

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here