বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৩৩

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৩৩

সেহের জানালার কাঁচে চোখ মেলে দূর আকাশের পানে তাকিয়ে।শীত কেটেছে অনেক কাল। বসন্তও কয়েকমাস আগে পাড়ি জমিয়েছে দূরে কোথাও।গ্রীষ্মের শুরু।গ্রীষ্মের আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে।এখনি বুঝি দুনিয়া ঘোর আঁধারে ডেকে কালবৈশাখী তাণ্ডব তুলবে!
সেহের ভারী নিশ্বাস ফেলল।কত মাস ধরে এখানে আটকে? আঙুল দিয়ে হিসাব করার চেষ্টা করল।কিন্তু বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে।গুলিয়ে যাবেনাই বা কেন? কত দিন বাহিরের আলোবাতাস গায়ে লাগেনি ,এই বাড়িতে বন্দি । ।দিবা রাত্রির পার্থক্য এই জানালার কাঁচ দিয়েই দেখছে।আচ্ছা ,বাবা মা কি তাকে মনে করে? এসব ভাবতে সেহেরের চোখ জলে ভরে উঠে!
এমন সময় কারো পায়ের আওয়াজ সেহেরের কানে ভেসে আসে।প্রত্যেকবারের মত ভয়ে কেঁপে উঠে। আরহাম এসেছে। আরহামকে দেখতে সেহের বিছানার মাথার সাথে লেগে বসে।আরহাম সেহেরের মুখোমুখি এসে বসে।সবসময়কার মত মুগ্ধকর হেসে মিষ্টি স্বরে বলে,”গুড মর্নিং লাভ! ”
একটা সময় যখন এই হাসি সেহেরের মুগ্ধতার কারণ ছিলো।কিন্তু এখন এই হাসি তার ঘৃণা হয়।ভীষণরকম ঘৃণা! সেহের ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো।আরহাম খাবারের ট্রে নিয়ে সেহের সামনে বসল।স্পুনে খাবার তুলতে তুলতে বলল,”ট্রায় দিস ,ইউর ফেভারিট হোয়াইট সসেজ পাস্তা”
সেহের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকাল।মুখের সামনে চামচ ধরতেই সেহের ঝাড়ি দিয়ে খাবারের বাটি ফেলে দিলো।আরহামের ভীষণ রাগ হলো কিন্তু প্রকাশ করল না।কাজের লোক ডেকে ফ্লোর পরিষ্কার করে । কিচেন থেকে আবার খাবার নিয়ে সেহেরের সামনে বসল। মুখে হাসির রেখা রেখে বলল,”অনেক বেলা হয়েছে ব্রেকফাস্ট করে নেও! ”
সেহের মুখ ফিরিয়ে ফসফস শ্বাস ফেলছে ।আরহাম আবার বলল ,”গতরাতেও ঠিক ভাবে ডিনার করোনি।এখন ব্রেকফাস্ট না করলে শরীর খারাপ হবে! ”
সেহের এবারো চুপ।আরহাম বেশ কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।সেহেরের জেদ বিন্দু মাত্র কমলো না।আরহাম শক্ত করে সেহেরের গাল চেপে মুখে খাবার পুড়ে দিলো।সেহের ছাড়াবার চেষ্টা করল।কিন্তু পারল না।বড় বড় অশ্রুকণা গাল বেয়ে পরলো।আরহাম একই ভাবে পুরোটা খাবার শেষ করল।আরহাম যেতে নিলে সেহের পেছন থেকে চিৎকার করে বলে,”আমার মুক্তি চাই ,এই বাড়ি থেকে আপনার থেকে মুক্তি চাই। ঘৃণা করি আপনাকে ,প্রচণ্ড রকম ঘৃণা ! শুনছেন আপনি? ”
আরহাম তড়াক করে পিছন ফিরে বাঁকা হেসে বলল,”ঘৃণা করো কি ভালোবাসো ,আই ডোন্ট কেয়ার ।আমার একার ভালোবাসা- ই দুজনের জন্য যথেষ্ট! ”
সেহের তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” খুনির আবার ভালোবাসা? ”
“তোমাকে নিজের কাছে রাখতে যদি আরো হাজারটা খুন করতে হয় তবুও আমি পিছুপা হবো না! ”
কথা শেষ করে আরহাম বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

দুপুরের মাঝামাঝি ।এই সময়টায় আরহাম বাড়ি থাকে না । প্রত্যেকদিনের মত বেরিয়েছে।বাড়িতে সেহের আর দুজন মহিলা কাজের লোক আছে। যারা আরহামের খাস লোক।শ্বাসটাও বুঝি আরহামের কথাতেই ফেলে।সেহের বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পা রাখে।রুম থেকে বের হবার জন্য পা বাড়ায়।সেহেরের কদমের সাথে সাথে লোহার শিকল গুলো বেজে উঠে।বড় লোহার শিকলের সাথে সেহেরের হাত পা বাঁধা।আরহাম খুব বিচক্ষণতার সাথে এই শিকল তৈরি করেছে । যার সীমানা দোতলা অবধি।নিচে যাওয়ার শেষ সিড়িতে পা রাখতে শিকলে টান পড়ে।সেহের আজ মাস খানেক পর রুমের বাহিরে পা রাখছে।এই কয়েকমাস অনেকবার এখান থেকে পালাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই বিফল হয়েছে। কোন না কোন ভাবে আরহামের কাছে ধরা পড়েছে।এতোবার বিফলতার পর সেহের হার মেনে গেছে।ইদানীং শরীরটা বেশ মন্দা যাচ্ছে।এক কামড়ায় থাকতে থাকতে সেহের হাফিয়ে উঠেছে।মাথাটা হুট হাট চক্কর মারে। খাবারে ভীষণরকম অরুচি।খাবারের ঘ্রাণ নাকে আসতেই গা গুলিয়ে আসে।দুর্বল শরীরে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।পুরো বাড়ি দামি দামি ফার্নিচারে সাজানো ।কোন কিছুর সামান্যতম অভাব নেই।যেন ছোট খাটো রাজপ্রসাদ।কাজের লোকেদের ডাকার আগেই তারা হাজির।আরহাম সেহেরকে রাণীর মত রাখলে সেহের একজন বন্দিনীর মত বাঁচছে।হ্ঠাৎ সেহেরের চোখ আটকায় দোতলার অপর কর্ণারে এর রুমের দিকে।রুমের দরজায় সুচারু ভাবে কারুকাজ করা। নকশা গুলো ভয়ানক কিছু নির্দেশ করছে।দরজাটা দেখে সেহেরের ভীষণ চোখে ভাজল।আরহামকে বেশ কয়েকবার এই রুমে ভেতর প্রবেশ করতে দেখেছে।হয়তো এই রুমের ভেতর শিকলের তালার চাবি আছে? এসব ভেবে সেহের সামনের রুমটার দিকে অগ্রসর হয়।দরজা খোলার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা । দরজা লক পাসওয়ার্ড দেওয়া। সেহের বেশ কিছুক্ষণ পাসওয়ার্ড ট্রায় করে কিন্তু প্রত্যেকবারই পাসওয়ার্ড ইনকারেক্ট।সেহের বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিজের নাম দিয়ে ট্রায় করল। অবশেষে দরজা খুলল। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।কোথাও আলোর রেখা নেই। ভীতু পায়ে সেহের ভিতরের দিকে অগ্রসর হয়।আঁধারে কোন কিছু দেখা যাচ্ছেনা ।সেহের কোন রকম সুইচ খুঁজে বের করে।আলো জ্বালাতে- ই সামনের দেয়ালের সিলিং- এর উপর ছোট ছোট লাইট গুলো জ্বলে উঠে। হ্ঠাৎ অন্ধকারে আলোর প্রতিফলনে সেহের চোখ ডেকে নেয়।আলোটা ভীষণ রকম চোখে লাগছে।ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে সামনে তাকাতে সেহের আতংকিত হয়ে যায়।মাথা চক্কোর দিয়ে পড়ে যেতে নিলে পেছনের দেয়াল ধরে দাড়ায়।সামনের দেয়ালে অনেকগুলো মানুষের কাটা হাত, চোখ সংরক্ষণ করে রাখা।হাত গুলো মমি আর চোখ গুলো উঠিয়ে কাঁচের জারে ভরা। প্রত্যেকটার নিচে এদের মৃত্যের কারণ লিখা।প্রত্যেকটা কারণ সেহেরের সাথে জুরে। এদের মধ্যে আদনান নিতান সেহেরের স্কুল টিচার ও আছে! সেহের ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে।থর থর কাঁপছে।মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে।কিন্তু থামছে না বুক চিড়ে হাউমাউ চিৎকারে কেঁদে উঠে।ততক্ষণে আরহাম বাড়ি পৌঁছে গেছে।দ্রুত পায়ে দোতলায় উঠতেই সেহেরের কান্না জড়িত চিৎকারের আওয়াজ পায়।আরহাম সেই রুমটার দিকে ছুটে যায়।ভিতরে সেহেরকে দেখে আঁতকে উঠে।সেহের হাত টেনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে চিৎকার করে বলে,”ভুল করেছ ,অনেক বড় ভুল! তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি।একদম উচিত হয়নি! ”
আরহামের চিৎকারে সেহের দমে না।উল্টো দ্বিগুণ চিৎকারে বলে,”এতোটা বছর ধরে আড়ালে থেকে আপনি সবাইকে খুন করেছেন।আমার জীবনের সব সমস্যার জট আপনি। ছিঃ নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে ।এতোটা দিন একজন খুনিকে ভালোবেসে এসেছি।আপনি মানুষ না জানোয়ার! ”
এতোটুকু বলেই সেহের হাঁপিয়ে গেল। মুখ ভরে বুমি করল।আরহাম ধরতে আসছে সেহের ভয়ে দূরে সরে যায়।আস্তে আস্তে সেহেরের চোখ মুখ উল্টে আসছে।আরহাম দ্রুত সেহেরের কাছে গিয়ে কোলে তুলে নেয়।আরহামকে বাঁধা দিতে চাইল।কিন্তু শরীর মনের সাথে সঙ্গ দিচ্ছেনা! ধীরেধীরে চোখের সামনে সব ঘোলা হয়ে আসে।চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। নিজের অতীতে আবার ডুব দেয়!

অতীত ……

সেহের মিনিট দশেক পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল আরহাম জিং এর জন্য তৈরি হচ্ছে।সেহেরও চুলে রাবার ব্যান বাঁধতে বাঁধতে আরহামে সামনে দাড়িয়ে বলে,”চলুন ”
আরহাম আশ্চর্যজনক চোখে তাকিয়ে বলল ,”তুমি কোথায় চলছ ? ”
সেহের কাঁধ নাচিয়ে উত্তর দিলো ,”কোথায় আবার? আপনার সাথে জগিং- এ! ”
“তোমার জগিং- এর কি দরকার? ইউ অলরেডি ফিড অ্যান্ড ফাইন ”
সেহের গাল ফুলিয়ে ভেংচি কেটে বলল,”তাহলে আপনিও যাবেন না।আপনিও তো পুরোপুরি ফিড অ্যান্ড ফাইন ”
“তুমি কি মিহিকে নিয়ে ইনসিকিউর?”
সেহের মুখ ঘুরিয়ে “না “সূচক মাথা নাড়ল । আরহাম বেশ বুঝতে পারছে সেহের মিহিকে নিয়ে জেলাস। তাই এমন টা করছে।আরহাম সেহেরের কোমড় টেনে নিজের কাছে আনল।কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলল,”তোমাকে কারো মত হতে হবে না। তুমি যেমন তেমনটাই আমার প্রিয় ।তোমার চোখের সরলতা, তোমার উদারতা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে।আমি এই তুমিতেই ডুবতে ,ভাসতে চাই! ”
সেহের লজ্জিত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে।মৃদু হাসল।ফিসফিস করে বলল,”আমিও শুধু আপনাতেই ডুবে থাকতে চাই”
কথাটা আরহামের কান অবধি পৌঁছাল না।সেহের বেশ ধীর স্বরে বলেছে।নিচে থেকে মিহির ডাক পড়তেই দুজন জগিং এর জন্য বেরিয়ে পড়ে!

চলবে….❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here