বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৩৭
কনকনে শীতের রাতে ঘন কালো কুয়াশা চারদিকে ঘেরা।পুকুর পাড়ে বড় গাছটার নিচে আরহাম সেহের শুয়ে। বরফ শীতল পানিতে ভিতে গায়ের কাপড় শরীরের সাথে ল্যাপটানো ।শীতে দুজনের বেহাল অবস্থা । সেহেরের একটু বেশিই।চোখ মুখ সাদা হয়ে আছে। শরীর বরফ টুকরোর মত ঠান্ডা।শীতের প্রবলতায় দাঁতের সাথে দাঁত বাড়ি খেয়ে কটকট শব্দ হচ্ছে।দুজন ভারী নিশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে । সেহেরের বুকটা ধুকধুক করছে।আজ মরতে মরতে বেঁচেছে । সাঁতার না জানায় পানিতে তার ভীষণ ভয় ছোট থেকে কোন দিন পানিতে নামার সাহস করেনি ।আরহাম না থাকলে আজ নির্ঘাত পুকুরে ডুবে মরণ হতো ।আটলান্টিক মহাসাগরের পানি থেকেও বেশি ঠান্ডা এই পুকুরের পানি ,এখন বুঝছে টাইটানিকে থাকা মানুষ গুলোর কতটা যন্ত্রণা দায়ক ভয়ংকর মৃত্যু হয়েছিলো। সেহের ঘাড়ের উপর শুয়েই হাত মুখে লেগে থাকা কাদা ঝাড়তে শুরু করে।আরহাম সেহেরের দিকে শুয়ে তিরস্কার স্বরে বলল,”আমাকে ছাড়া ঠিক ভাবে এক কদম চলার মুরদ নাই ,সে নাকি আবার আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে! ”
সেহের মুখ ভেংচি কাটল। আরহাম টান দিয়ে সেহেরকে নিজের কাছে আনে। নিজের সাথে মিশিয়ে শক্ত করে গাল চেপে বলল কাঠখোট্টা স্বরে বকে ,”কি আমাকে ভালোবাসো না? আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে? ”
সেহের কোন প্রত্যুত্তর করল না। টলমল চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ জলে টইটুম্বুর।আরহাম গাল ছেড়ে দিলো ।সোজাসুজি উঠে দাড়িয়ে সেহেরকে কোলে তুলে নিলো। বড় বড় পা ফেলে আশ্রমের দিকে অগ্রসর হলো।
এই তীব্র শীতের রাতে দুজন ভিজে একাকার । রাতও ভীষণ গভীর হয়ে এসেছে। এতো রাতে সেহেরকে নিয়ে এই গ্রাম্য পথে বের হওয়া ঠিক হবে না।তাই আরহাম আজকের রাতটা এখানে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।দোতলা বাড়ির উপরের এক স্টোররুমের পাশের কামরাটা খালি। দুপুরের দিকে সেহেরকে এখানে আসতে দেখে সেহেরের থাকার জন্য খালা ঘরটা আগে থেকেই পরিষ্কার করে রেখেছে।যেন সেহেরেরসামান্যতম অসুবিধে না হয়।আরহাম সেহেরকে নিয়ে সরাসরি ঐ ঘরটায় উঠল।সেহের কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে জড়সড় ভাবে আরহামের সামনে দাড়িয়ে । ঠকঠক করে কাঁপছে। আরহাম সেহেরের কাঁপুনি দেখে গম্ভীর স্বরে বলল,”ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও ,আমি গাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে আসছি ”
আরহাম যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে সেহের পেছন থেকে আরহামের হাত আটকে নেয় করুন স্বরে বলে,” প্লিজ ,আমাকে একা রেখে যাবেন না।জায়গাটা নিরিবিলি ভীষণ ভয় করছে। অন্যকাউকে আনতে বলুন। ”
আরহাম ভ্রু কুঁচকে সেহেরের দিকে তাকাল।হাত ছাড়িয়ে ফোন করে কাউকে লাগেজ নিয়ে আসতে বলল।মিনিট পাঁচেক পর দরজায় নক পড়ল। দারোয়ান লাগেজ নিয়ে এসেছে। সাথে একটা ব্যাগ ।সেহের লাগেজ থেকে কাঁপড় বের করতে করতে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত কতে বলল,” এটায় কি? ”
“আমার কাপড় ”
“বাড়ি থেকে সাথে করে এনে ছিলেন? ”
আরহাম সেহেরের বোকামো কথায় ক্ষীণ চোখে তাকিয়ে থাকে। সামান্যতম কমন সেন্স কি মেয়েটার মাঝে নেই? কাঠ কাঠ স্বরে বলল,” রিয়েলি সেহের? বাড়ি থেকে কাপড় আনতে যাবো কেন ! আমি কি আগের থেকেই জানতাম ,এখানে এসে হাঁড় কাঁপা শীতের রা্তে আমাকে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে নাকানিচুবানি খেতে হবে? এগুলো দারোয়ানকে দিয়ে পাশের গ্রামের বাজার থেকে আনিয়েছি …….কোন রকম বাড়ি অবধি যেতে পারলেই হয়”
আরহাম শেষের কথাটা বিরবির করে বলল।সেহের মুখ কালো করে নিলো । সুন্দর সোজাসুজি উত্তর দিলে কি এমন হয়? কিন্তু সেহেরের বেশ আনন্দ লাগছে। অল্প সময়ের জন্য হলেও আরহামকে বেশ জব্দ করতে পেরেছে ।সেহের কথা না বাড়িয়ে কাপড় গুছিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ।
বিশাল আকাশে ইয়া বড় এক চাঁদ । চাঁদের এক ফালি জ্যোৎস্নায় আলোকিত চারিদিক । কুয়াশা ঘেরা জ্যোৎস্না মাখা রাত। বাড়িটা অনেকটা স্কুল রুমের মত । রুমের সামনে বড় বারান্দা ।চাঁদের চাঁদনিতে পুরো বারান্দা আলোকিত ।পুরানো আমলের কাঠের কারুকাজ করা রেলিং।হালকা ছোঁয়াতে নড়বড় করে । এতো বছরের অনাদরে অযত্নে ঘুণে খেয়েছে।দোতালায় তেমন কেউ নেই। বাচ্চারা সহ বাকিরা সবাই নিচেই থাকে।দোতালার একপাশ থেকে অপরপাশে তাকালে মনে হয় অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।হালকা আওয়াজে ও গাঁ ছমছমে উঠে। বাড়িটায় ভৌতিক ভৌতিক একটা ভাব আছে। সেহের ছোট এক ঢোক গিলে কথা গুলো ভাবল ।ফ্রেশ হয়ে আরহামের অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে।মিনিট দশেক আগে লোডশেডিং হয়েছে।এই অন্ধকারে রুমে একা থাকার মত সাহসী মেয়ে সেহের নয়।লোডশেডিং হতেই সেহের লাফিয়ে বাহিরে চলে এসেছে।আরহাম ওয়াশরুমে ফ্রেশ হচ্ছে। আরহাম বের হয়েছে কি না! সেহের বারবার পিছন ফিরে চাইছে।গায়ে পাতলা শাল জড়ানো , ভেজা চুলের পানিতে পিঠ ভিজে।চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরে গায়ের কামিজটাও ভিজছে।বেখেয়ালি সেহেরের কি সেদিকে খেয়াল আছে? আচমকা পেছন থেকে কারো স্পর্শে সেহের কেঁপে উঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আরহাম তয়াল হাতে দাড়িয়ে। সেহেরের চুল মুছে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে,”কেয়ারলেস ”
কথাটা সেহের কান অবধি ঠিক পৌঁছাল।কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া করল না।মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকাল ।আরহাম পেছন থেকে সেহেরের মুখের দিকে তাকাল।মেয়েটাকে ভীষণ মোহিত লাগছে। চোখ ফেরানো কষ্ট সাধ্যি । চন্দ্রকিরণ সৌন্দর্য আরো হাজার গুন বাড়িয়ে দিয়েছে।তীব্র শীতে গাল লাল হয়ে আছে।ভারী ভারী আঁখিপাতা গুলো দূর আকাশের পানে।চোখে মুখে অন্যরকম এক সরলতা। দূর আকাশের চাঁদটা যেন জমিনের চাঁদটাকে হিংসে করছে তাইতো বারবার মেঘের আড়ালে মুখ লুকাতে চাইছে । আরহামের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মোহিত মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে।সেহের হীন এই আরহাম প্রাণহীন।আরহামের অস্তিত্বে প্রত্যেক শিরা শিরা রক্তবিন্দুতে সেহের মিশে।
খানিক বাদে সিড়ি বেয়ে কারো উঠার শব্দ কানে আসতে আরহামের ঘোর কাটে। সেহের আরহাম থেকে দূরে সরে যায়।দুজনের চোখ সিড়ির দিকে। খাবার নিয়ে দারোয়ান এসেছে।নিচে থেকে খালা পাঠিয়েছে । খাবারের ট্রে থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই রান্না করেছে।আরহাম ভেতরে রাখতে বলল।দারোয়ান টেবিলের উপর খাবার রেখে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিচে চলে যায়।আরহাম বলল,”ভিতরে চলো ডিনার করবে ”
সেহের আগের মত সামনের দিকে ফিরে কাঠখোট্টা স্বরে উত্তর দিলো ,”খাব না ,আমার খিদে নেই ”
আরহাম বেশ কিছুক্ষণ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,”জিদ করার পরে করিও ,এখন ভিতরে চলো খাবে। সারাদিন কিছু খাওনি! ”
“আপনার সমস্যা কোথায়? আপনি শুনতে পাননি? বলেছি তো আমি খাবো না ,”
সেহের জোরগলায় বলল। আরহাম কোন কথা না বলে জোর করে সেহেরকে কাঁধে উঠিয়ে নেয়। সেহের নামতে চাইলে আরহাম আরো শক্ত ভাবে চেপে ধরে। রুমে নিয়ে বিছানার উপর ধপ করে ফেলে। সেহের কোমড় ধরে বাঁকিয়ে আহ করে আর্তনাদ করে উঠে।ব্যথাটা বুঝি একটু বেশিই লেগেছে! সেহের ব্যথাতুর আর্তনাদ আরহামের কান অবধি পৌঁছায় না।আরহাম ভয়ংকর রেগে।সেহের কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার পূর্বেই আরহাম চিৎকার করে বলতে শুরু করে,”চুপ একদম চুপ! আর একটাও আওয়াজ নাহ।”
আরহামের হুংকারে সেহের কেঁপে উঠে । জড়সড় ভাবে বসে থাকে।আরহাম খাবার সার্ভ করে খেতে বললে সেহের ত্যাড়ামো করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে।আরহাম বিরক্তি ভারী নিশ্বাস ফেলে সেহের কাছে যেয়ে জোর করে খায়িয়ে দেয়।প্রথমদিকে সেহের মোচড়ামুচড়ি করলেও আরহামের ধমকের প্রকট আওয়াজে ভয়ে খেতে লাগে।অশ্রুভারাক্রান্ত ভারী চোখে সেহের আরহামের দিকে তাকিয়ে । মনে উথালপাতাল ঢেউ ছুটছে । চাপা অভিমান গুলো বুক চিড়ে অশ্রুধারা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেহের কোনরকম নিজেকে চেপে রেখছে। আরহামের সামনে কাঁদবে না।একদম কাঁদবে না! কাঁদবে- ই বা কেন? আরহামকে নিজের মায়ায় জড়াতে? এই মায়ায় জড়িয়ে কি লাভ। আরহামের মন প্রাণ জুড়ে সবটাই তো মিহি । তার সেই বাচ্চা প্রেমিকা । শুধু মাত্র সেহেরের মায়ায় জড়িয়েছে বলেই আরহাম মিহির কাছে যেতে পারছে না। মায়ায় পরে দয়া দেখিয়ে বারবার সেহেরের কাছে আসছে। চাইনা এই ঠুনকো দয়া । অন্যের দয়ায় আর যাই হোক সংসার হয় না। ভালোবাসা হয় না। সেহের উদাসীন মনে কথা গুলো ভাবল ।এসব ভেবে সেহের আরহাম থেকে দূরে সরতে চাইলে। আরহাম কোমড় চেপে সেহেরকে নিজের কাছে আনতে চাইল।কোমড়ে হাত পড়ায় সেহের আবারো ব্যথাতুর স্বরে আর্তনাদ করল।আরহামের সন্দেহ হলো।কোমড়ের চোট দেখতে চাইলে সেহের সরে গেল।মাথা নিচু করে কাঠ কাঠ স্বরে বলল,”আমার কাছে আসবেন না। আপনার স্পর্শ আমার অসহ্য লাগে ”
আবারো আরহামের মাথা বিগড়ে যায় । সেহেরের দিকে রক্তচক্ষু করে তাকিয়ে ।পাশের বড় মাটির ফুলদানীটা সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারে।সাথে সাথে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে চারদিকে ফুলদানীর অংশগুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।সেহের কোন প্রকার প্রতিক্রিয়া করে না। আরহাম রাগে বড়বড় পা ফেলে রুমের বাহিরে চলে যায়। বারান্দায় দাড়িয়ে কাঠের রেলিং এ দুই তিন বার লাথি মেরে রাগ দমানোর চেষ্টা করে ।পকেট থেকে সিগারেট বের করে। কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট জ্বালিয়ে দূর আকাশের পানে উদাসীন চোখে তাকিয়ে শূন্যে বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ে।
চলবে…..❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।