বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৪০

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৪০

সেহের রিপোর্ট ফাইলটার দিকে ড্যাবড্যাব অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে।রিপোর্ট পজিটিভ ।সেহের প্রেগন্যান্ট ।মুহূর্তেই চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে গেল। মানুষ কখনো অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারেনা যতক্ষণ না সেই একই ঘটনা তার সাথে না ঘটে।যতই বলুক আমি তোমার কষ্টটা বুঝছি! সত্যিকার অর্থে তা এক চিরসত্য মিথ্যা।একজন কখনোই অন্যজনের কষ্ট অনুভব করতে পারেনা।যদি না সে সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এতোটা বছর সেহেরের তার মাকে হৃদয়হীন পাষাণ মহিলা ভেবে এসেছে।মাকে চরম ঘৃণা করেছে। কিন্তু আজ এতোবছর পর মায়ের মত সেই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে সেহের এই যন্ত্রণাকে অনুভব করছে!
না পারছে এই বাচ্চাটাকে নিজের গর্ভ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে না পারছে মেনে নিতে।আরহামের উপর চরম ঘৃণায় কোন ভাবেই এই বাচ্চাটাকে সেহেরের মন মেনে নিতে চাইছে না।মনের কোন এক কোণা থেকে নীরব এক ডাক ভেসে আসছে।ফিসফিস করে বলছে”এটা একটা খুনির বাচ্চা।খুনির অংশ তোর গর্ভে বেড়ে উঠছে । ”
সেহের ধপ করে ফাইলটা বন্ধ করে শান্ত স্বরে বলল ,”এবরশন করবো ,আমার এই বাচ্চা চাইনা । ”
সেহেরের কথায় আরহামের রাগ মাথায় চড়ে বসল।রাগে চিৎকার করে বলল,”তোমার রাগ জেদ আমাদের বাচ্চার উপর ঝাড়বে? এতোটা পাষাণ তুমি? মায়া মমতার ছিটাফোঁটা নেই তোমার মাঝে ? ”
সেহের বাঁকা হাসল।ধীর গলায় বলল,”মায়া মমতার কথা আপনার মত খুনির মুখে মানায় না।আমি একজন খুনির অংশ নিজের মধ্যে কোন দিন পালবো না। আমাকে আপনার কাছে আটকানোর এটা আপনার নতুন ঠাট ।আমার এই বাচ্চা চাই না। একটা খুনির অংশ চাই না। আমি এবরশন করবো ,যদি আপনি বাঁধা দেন তাহলে আমি নিজের জান দিবো ”
সেহের অস্থির উত্তেজিত স্বরে কথা গুলো বলল ।আরহামের রাগ এবার পুরোপুরিভাবে আউট অফ কন্ট্রোল। নিজের ভেতর নেই। আরহামের ভেতর তার অপর সত্তা জেগে গেছে।চোখ মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। অগোছালো এলোমেলো চুল। হুট করে সেহেরের কাছে যেয়ে শক্ত করে তার গাল চেপে ধরল।চিৎকার করে বলল,”তুই মান আর না মান এই বাচ্চা এই দুনিয়ায় আসবে। আমার অংশ তোর গর্ভে বাড়বে। তোকে আমার সাথেই থাকতে হবে।তুই যদি আমার কথা খেলাপ করিস তবে তোর বাবা মা ভাই বোন কেউ আমার থেকে রেহাই পাবে না। সবাইকে শেষ হতে হবে! শুনেছিস! ”
আরহামের জোর ধমকে সেহের কেঁপে উঠে। চোখ থেকে গাল বেয়ে ঝরঝর করে পানি ঝোরছে।থরথর করে কাঁপছে সেহের।আচমকা আরহাম নিজের মাঝে ফিরে এলো ।সেহেরকে কাঁদতে দেখে চট করে গাল ছেড়ে দিলো ।সেহেরের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে ভীতু স্বরে বলল ,”কি হয়েছে তোমার? এভাবে তুমি কাঁদছ কেন? জান আর ইউ ওকে? কেউ কিছু বলেছে ‘”
আরহামের হুট করে এমন পাল্টে যাওয়ায় সেহের ভয় পেয়ে গেল। এই প্রথম না এর আগেও বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে।আরহাম,হুট করে অন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। নিজেকে “আর্বিন্দ” নামে দাবী করে। সেহের কাঁপা কাঁপা হাতে আরহামের হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বলে,” ছুঁবেন না আমাকে। আপনি একটা পাগল ,সাইকো মেন্টালি সিক! চলে যান এখান থেকে চলে যান! ”
সেহের চিৎকার করে কথা গুলা বলল। আরহাম স্থির চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে । সেহের আস্তে আস্তে ভীষণ হাইপার হচ্ছে।আরহাম ঝামেলা না বাড়াতে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আরহাম যেতেই সেহের বেডে বালিশে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।হুট করে তার জীবন কি থেকে কি হয়ে গেল! আরহামের বিষাক্ত প্রেমে আজ নিজের গর্ভের সন্তানকেও বিষাক্ত মনে হচ্ছে! যদি সেদিন এসব না হতো।যদি সত্যটা কোন দিন তার সামনে না আসত । তাহলে আজকের দিন হয়তো অন্যরকম হতো!
সেহের আবার অতীতে ডুব দিলো।

অতীত …….

বাড়ি ফেরার পর অন্যসবাই কিছু না বললেও। দাদাজান দাদীমা সামান্য রাগ ঝেড়েছিল ।গতরাতে বাড়িতে এতো বড় আয়োজন ছিল। আর এদিকে বাড়ির ছেলে বউ- ই বাড়িতে নেই! এনিয়ে সারা পার্টিতে গুঞ্জন ছিল।সবাই আরহামের খোঁজ করেছে। মিথ্যা বলে মিডিয়া সহ অন্যসবাই কে সামাল দিতে হয়েছে।এনিয়ে দাদাজান কিছুটা রেগেছিল কিন্তু আরহাম সবটা সামলে নিয়েছে। সেহেরও নিজের ভুলের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত! যেমন তেমন করে আরহাম বিষয়টা ধামাচাপা দিয়েছে।
দুপুরের শেষ ভাগ।সূর্যের তেজ অনেকটা কমে এসেছে। কোমল রোদ চারদিকে ছড়িয়ে। সেহের আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলে খোপা করে ক্লিপ লাগাতে গিলেও থেমে গেল। খোপা মুক্ত করল। মেঘবরণ লতানো চুল গুলো সুড়সুড় করে মুক্ত পাখির মত কোমড় অবধি ছড়িয়ে পড়ল।সেহের আয়নায় হতাশ চোখে তাকিয়ে। ঘাড়ের কাছে কালো দাগটা ফর্সা চামড়ায় স্পষ্ট ফুটে।যে কারোর দৃষ্টি আকর্ষন করবে।এইতো খাবার টেবিলে লিয়া চোখ টিপে দুষ্টু হেসে কত গুলো কথা শোনাল ।পিঞ্চ করে বলল,”বাহ ,লাভ বাইট? আমাদের আগে বললেই পারতে দুজন হানিমুনে যাচ্ছ ।খামাখা কত চিন্তা হলো। ”
লিয়ার কথা শুনে সেহেরের বিষম কেটে যাই যাই অবস্থা! কোনরকম পানি খেয়ে শান্ত হয়েছে।এ মুহূর্তে আরহামের উপর সেহেরের ভীষণ রাগ হচ্ছে। এক রাতে কি হাল করেছে? এখন সবার সামনে সেহেরকে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে।নিজে তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেশ ঘুরছে । লজ্জায় শুধু সেহেরকে পড়তে হচ্ছে!
সেহের আয়নার সামনে পাকাপোক্ত ভাবে দাড়িয়ে বিরবির করে বলল,”আজ শুধু রুমে আসুন,আপনাকে যদি নাকানিচোবানি না খায়িয়েছি আমার নাম ও সেহের নাহ! হুহ । ”
এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ে। সেহের আরহাম ভেবে বাজখাঁই গলায় বলে,”ভিতরে আসুন ,আজ আপনার একদিন কি আমার একদি….”
যেই না পিছনে তাকাল অমনি সেহের থমকে যায়। আরহাম না। মিহি এসেছে।মিহিকে দেখে সেহের ভীষণ বিব্রত হলো।গত কিছুদিনের ব্যবহারের জন্য সেহের খুব অনুতপ্ত।ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সৌজন্য স্বরে বলল,” দরজায় দাড়িয়ে কেন? ভিতরে আসো । ”
মিহি ঠোঁটের কোণায় হাসি তুলে ভিতরে এসে ডিভানটায় বসল।সেহেরও মুখোমুখি বসে।মিহির সাথে কিভাবে কথোপকথন শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা । নীরবতা ভেঙে মিহি বলল,”বিদায় নিতে এসেছি ,বাবা গুলশানে ফ্লাট বুক করেছে। সেখানে উঠবো ”
মিহির কথায় সেহের ভীষণরকম চমকাল। তড়িঘড়ি স্বরে বলল,” বাড়ি রেখে সেখানে একা ফ্লাটে উঠবে কেন?”
মিহি চুপ। সেহেরের মিহির নীরবতার কারণ ধরতে পেরে অনুতপ্ত মলিন স্বরে বলল,”তুমি কি আমার জন্য বাড়ি ছাড়ছ ।মিহি আ’ম সো সরি।নিজের ইনসিকিউরিটির কারণে রাগের মাথায় সেদিন তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছি।আ’ম রিয়েলি রিয়েলি সরি।আমি সত্যি ভীষণ ভীষণ অনুতপ্ত। ”
মিহি সেহেরের হাতের উপর আশ্বস্ত হাত রেখে বলল,” ডোন্ট বি সরি সেহের। তোমার জায়গায় আমি হলেও এমনই করতাম হয়তো এর চেয়ে বেশি। তুমি যথেষ্ট শান্ত আর ভালো মেয়ে।কোন ওয়াইফ নিজের হাসবেন্ডের সাথে অন্য কোন মেয়েকে সহ্য করবে না। ইট’স নরমাল।বাট ট্রাস্ট মি উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ড।”
সেহের লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নুয়ে নিলো।ঘাড়ের কালচে দাগটা মিহির চোখে পড়ল।মিহি মলিন হাসল। এটা যে আরহামের দেওয়া লাভ বাইট তা বেশ বুঝতে পারছে।মিহি সেহেরের দিকে তাকিয়ে ভেজা ভেজা স্বরে বলল,”নি: সন্দেহে তুমি ভীষণ সুন্দরী। কিন্তু এখন ,আরহামের ভালোবাসা তোমার সৌন্দর্যকে আরো গভীর করেছে । পূর্ন করেছে তোমাকে।”
সেহের মিহির দৃষ্টি দেখে কথা ধরতে পারে চুল দিয়ে দাগ ঢাকতে চাইলে মিহি তা দেখে ফিকে হাসল । বলল ,”আরহাম আমার টিনেজ লাভ।স্কুল লাইফে আরহামের জন্য অনেক পাগলামো করেছি।তখন যদি তোমার সাথে দেখা হতো খুব হিংসে করতাম তোমাকে । হয়তো আরহামকে কেড়ে নিতেও কমতি রাখতাম না।কিন্তু এখন এমনটা হয় না। কারণ আমি বুঝি গেছি ভাগ্যে আর মনের উপর কারো জোর চলে না। ভালোবাসাটা হুট করেই হয়ে যায়। তোমাদের এক সাথে দেখে খুব ভালো লাগে। মন থেকে ব্লেসিং আসে।দুজন একসাথে খুব ভালো থাকবে। ”
বলেই মিহি ডিভান ছেড়ে দাড়ায়।মিহিকে প্রত্যুত্তর করার মত কোন শব্দ সেহের খুঁজে পেল না।মিহি ঠকঠক হিল বাজিয়ে দরজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।সেহের সেদিকে তাকিয়ে । মিহি দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল।পিছন ফিরে সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,”আর হ্যাঁ ,একটা কথা আরহাম তোমাকে খুব ভালোবাসে । অনেক বেশি যা কারো কল্পনাতেও তুলনা হয় না। ইউ আর সো লাকি! নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে রেখ। ”
মিহির অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ জলে টপটপ করছে। সেহের মিহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল ,”তুমিও ভালো থেকো! ”
মিহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে মলিন হেসে দরজার বাহিরে পা রাখে।

কনকনে শীতের রাত।তীব্র ঠান্ডা হাওয়া বইছে।। বারান্দার ঝুলন্ত ফুলদানী গুলো তিরতির করে কাঁপছে।উপরের ফেইরি লাইটটা ঘুরছে। ছেড়ে ছেড়ে আলো ছড়াচ্ছে।আরহামের বুকে হেলান দিয়ে সেহের বেতের চেয়ারে বসে। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া চলায় আরহাম পেছন থেকে সেহেরকে চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। পাশের টেবিলে গরম কফির মগ।মগ থেকে ধীর গতিতে ধোঁয়া উড়ছে ।আরহাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেহেরকে পেছন থেকে লক্ষ করছে। সেহের গভীর চিন্তায় মগ্ন।ঘোর কাটাতে টপ করে সেহেরের গালে চুমু খেয়ে বলল,”কি ভাবছ? ”
সেহের নড়েচড়ে উত্তর দিলো ,”মিহির কথা। ”
“আমি তোমার পাশে বসে আর তুমি মিহির কথা ভাবছ? ”
“এমনটা নয় ।আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ”
“হুম বলো”
“আপনার লাইফে যদি আমি না থাকতাম তাহলে আপনি কি মিহিকে বিয়ে করতেন? ”
“এটা কেমন কথা? তোমার মনে কি এখনো এসব নিয়ে সংকোচ আছে? ”
“উহু ,একদম না।মিহি আপনাকে খুব ভালোবাসে ”
“কিন্তু আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি ।মিহি সবসময় আমার ভালো বন্ধু ছিল । আর তুমি আমার আঁধারের আলো ! ”
সেহের আরহামের কথায় তেমন গুরুত্ব দিলো না। একবার জানতেও চাইল না আরহাম কেন এমনটা বলল।সরল মনে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল । হুট করে আরহাম কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,”আই লাভ ইউ ”
প্রত্যুত্তরে সেহের আরহামের দিকে ফিরে টুপ করে আরহামের গালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলল,”আমার একটা বেবি চাই,এখনি! ”
সেহেরের কথায় আরহাম বিষম খায়। হতভম্ব চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। “আই লাভ ইউর ” উত্তর এমন হয় আরহামের জানা ছিল না। আরহাম জড়সড় গলায় বলল,”আর ইউ অলরাইট? ”
সেহের কিটকিটে হেসে উঠে।

চলবে…..❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here