বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৫০

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫০

সারাদিনের ক্লান্তি ভারী শরীর নিয়ে সেহের এপার্টমেন্টে ফিরে আসে। দরজা খুলতে বুক ফেটে চিৎকার আসছে। ঘরের প্রতিটা জিনিস আশনূহার স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে আশনূহাকে খুঁজছে ।আশনূহার ফ্রেন্ডদের থেকে জানতে পারে কোন এক জোকারের পিছু পিছু আশনূহাকে যেতে দেখা গেছে। জোকারের কোনো খোঁজ মিলেনি।তন্ন তন্ন করে সারাদিন সব জায়গা খুঁজেছে । আশেপাশে আত্মীয় বন্ধুবান্ধব কারো বাড়ি বাদ রাখেনি । কোথাও আশনূহার সন্ধান মিলেনি ।সেহেরের বেঁচে থাকার এক মাত্র কারণ আশনূহা।আশনূহাকে হারিয়ে সেহের বাঁচতে পারবেনা । চোখ জোড়া এখনো ভেজা। ফ্লোরে ধপ করে বসে হাউ মাউ করে কান্না করতে লাগে।সেহেরের বাবা অসহায় দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখছে। সন্তানের কষ্ট দুনিয়াতে ভয়ংকর কষ্ট। বাবা মায়েরাই জানে সন্তানের উপর বিপদ আসলে ঠিক কি পরিমান যন্ত্রণা হয়। পুরো দুনিয়া বিষাক্ত লাগে। বেঁচে থাকাই বৃথা মনে হয়। এই যন্ত্রণা তিনি ভোগ করেছে যখন সেহেরের উপর অচেনা কেউ হ য়ে আরহাম নজর রাখতো। সেহেরের প্রতিদিন ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা উনাকে সেই ভয়ংকর যন্ত্রণার সাথে পরিচয় করিয়েছে। মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত শব্দ তার কাছে নেই! আজ তিনি ভীষণ অসহায়!
হঠাৎ সেহেরের মোবাইল বেজে উঠে। আননোন নাম্বার । সেহের দ্রুত হাতে মোবাইল তুলে নেয়। রিসিভ করেকানে তুলতে অপর পাশ থেকে চিরচেনা এক আওয়াজ ভেসে আসে। অতীতের সেই আওয়াজ চিনতে সেহেরের এক সেকেন্ড সময় লাগল না। থমথমে স্বরে বলল, ” আরহাম? ” অপর পাশ থেকে নিরস কাঠখোট্টা স্বরে বলে ,” বাহ চিনেছ দেখছি! এখনো আমাকে মনে পড়ে? ”
সেহের উত্তর দিল না। এতো বছর পর আরহামের আওয়াজ শুনে সে জমে গেছে। অনুভূতিহীন পাথর । কিরকম প্রতিক্রিয়া করবে তার জানা নেই।আরহাম আবার বলল ,” মেয়েকে হারিয়ে কি রকম অনুভূতি হচ্ছে? কয়েক ঘন্টায় এই হাল! ”
সেহের কিছু বলবে এর পূর্বে- ই আরহামের তেজি আওয়াজ ভেসে আসে,”তোমার সাহস কি করে হলো এতো বছর আমার মেয়েকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার? এখন থেকে আশনূহা তার বাবার কাছে থাকবে । এ জীবনে দ্বিতীয়বার আশনূহার মুখ দর্শনের সুযোগ পাবে না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি ! ”
সেহেরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরহাম ফোন কাটল । সেহের তখনো বিস্মিত।মাথাটা ঘুরছে । এতো বছর পর আরহাম কি করে তাদের খোঁজ পেলো । সেহের তো সবার সাথে সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিল । তবে আরহাম কি করে জানল? আশনূহা আরহামের কাছে? আরহাম কিডন্যাপ করিয়েছে! এতো কিছুর পর আরহাম কি চায়।সেহেরের জীবন তো নষ্ট করেছেই এখনকি শেষ বেঁচে থাকার সম্বলটাও কেড়ে নিতে চায়?
আরহাম যদি সত্যি সত্যি আশনূহাকে নিয়ে যায়? না না সেহের তা হতে দিবে না। আরহামকে কোনভাবেই আশনূহাকে নিয়ে যেতে দিবে না। আশনূহা শুধু সেহেরের।আশনূহার উপর সকল অধিকার শুধু সেহেরের! আশনূহাকে আরহাম থেকে ছিনিয়ে আনতে সেহেরের যা করতে হয় সে করবে।এমন সময় মোবাইলের মেসেজ এলার্ট বেজে উঠে।আরহাম পাঠিয়েছে!

“মেয়েকে দেখতে চাইলে এই এড্রেসে চলে এসো ,নয়টার পর গেট বন্ধ হয়ে যাবে।সো কুইক! ”

সেহের ফ্লোর থেকে উঠে এলোমেলো ভাবে আরহামের পাঠানো এড্রেসে ছুটে চলে।সেহেরের পেছন পেছন তার বাবাও বেরিয়ে পড়ে।

পাঁচবছর পর আরহাম সেহের মুখোমুখি। আরহাম সামনের সোফায় বসে সেহের তার বিপরীতে।আরহামের শক্ত শান্ত চাহনি। সেহের মাথা নিচু করে বসে। ফ্লোরের টাইলসের নকশার দিকে তাকিয়ে। যেন এই মুহূর্তে নকশা দেখাটা ভীষণ জরুরী কাজ।আরহাম বরাবরই হিংস্র যদি আবার আটকে নেয়? নিজের কাছে রাখার জন্য জোর করে? এবারো কি হাত পায়ে শিকল বাঁধবে!সেই জীবন সেহের আর চায়না । আশনূহাকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে স্বাধীন জীবন চায়।
নীরবতা ভেঙে সেহের আমতা আমতা স্বরে বলল,” আশু কোথায়? ডেকে দিন বাড়ি ফিরবো ”
আরহাম তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,””মাত্র কয়েকঘন্টায় এই হাল? আর আমি যে পাঁচটি বছর প্রতি মুহূর্ত সন্তানের মুখ দেখার জন্য ছটফট করেছি?…..এখন থেকে আশনূহা তার বাবাইর কাছে থাকবে।মানে আমার কাছে। ”
আরহামের কথায় সেহের থমকে যায়। কান্না জড়িত স্বরে বলল,” আশনূহা শুধু আমার।আমি ওর মা ,আপনার আশনূহার উপর কোন অধিকার নেই! তাড়াতাড়ি আমার মেয়েকে দিন নাহয় আপনার বিরুদ্ধে কিডন্যাপিং কেস করবো! ”
সেহেরের কথায় আরহাম হাসলো।বলল,”তোমার আশনূহা? তুমি তো বলেছিলে এই বাচ্চা তোমার চাইনা ।খুনির চিহ্ন নিয়ে তুমি বাঁচতে পারবে না! এখন কেন চাই? আর কেস করবে? কিডন্যাপিং? আমি তোমার বিরুদ্ধে এটাম টু মার্ডারের কেস করবো! বলবো পাঁচবছর আগে তুমি আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে আমাকে মারার চেষ্টা করে পালিয়ে এসেছ! যার যথেষ্ট প্রমাণ আমার কাছে আছে। যেমন, বাড়ির কাজের লোকদের সাক্ষী! ”
সেহের অশ্রুভারাক্রান্ত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
“আমি কোর্টে যাবো,আশনূহার কাস্টাডি নিবো । আমার মেয়েকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না! ”
আরহাম আবারো তাচ্ছিল্য হাসল বলল,” কোর্টে নিশ্চয়ই খুনির হাতে বাচ্চার কাস্টাডি দিবে না! ”
“আপনি খুনি ,আমি নিজ চোখে আপনাকে নিষ্পাপ মানুষের প্রাণ নিতে দেখেছি । ”
“প্রমাণ? প্রমাণ তো সেই বাড়ির সাথে জ্বলে গিয়েছে । এখন কি করে তা প্রমাণ করবে? ….তুমি চাইলে আমার বাড়িতে আশনূহার আয়া হয়ে থাকতে পারো ”
সেহের বেশ বুঝতে পারছে আরহাম আশনূহাকে কেড়ে নেবার পুরো ব্যবস্থা করে এসেছে।আরহাম কেন এমন করছে? সেহেরকে ফিরে পাবার জন্য?
সেহের রাগী স্বরে বলল,”আপনি যাই করুন আমাকে ফিরে পাবেন না।আবারো আমি আপনার পিঞ্জিরায় বন্দি হবো না! ”
“আমার তোমাকে চাই না, নাও আ’ম নট ইন্টারেস্টেড উইথ ইউ ! আমার নতুন জীবন হয়েছে। ”
সেহের থতমত খেয়ে গেল।আরহাম বলল,”যাওয়ার আগে মেয়েকে দেখতে চাইলে দেখতে পারো । আমি তোমার মত নির্দয় নই! ”
সেহের তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।আরহামের পিছুপিছু যায়। আরহাম এক কাচের জানালার সামনে দাঁড়াল। আশনূহা ভিতরে খেলছে ।ঘর ভর্তি খেলনা পেয়ে সে ভীষণ খুশি।সেহেরের কথা কি তার মনে পড়ে? কি জানি!
আরহাম পাশ থেকে বলল ,”নূহা তার বাবাইকে পেয়ে ভীষণ ভালো আছে। আমার মেয়ের এখন তোমাকে চাইনা! ”
সেহের ডুকরে কেঁদে উঠলো । কাঁচের উপর থেকে আশনূহার উপর হাত বুলালো।আরহাম চোখ মুখ শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে । কিছুক্ষণ পর রুমে মিহিকে দেখে সেহের চমকে আরহামের দিকে এক পলক তাকায়। আরহাম তখনো সামনের দিকে তাকিয়ে। মিহির হাতে চুড়ি নাকে নোসপিন! তবে কি আরহাম মিহি স্বামী স্ত্রী? মিহিই আরহামের নতুন জীবন? খামাখা বন্ধুত্বের খাতিরে কেউ এক দেশ ছেড়ে অন্যদেশে আসবে নাহ।
সেহের ভাবনায় ডুবে।আনমনেই আরহামকে প্রশ্ন করল ,”মিহি আপনার স্ত্রী? ”
আরহাম শক্ত গলায় বলল,” নাও গেট আউট ,অনেক রাত হয়েছে।নূহা ঘুমাবে! ”
না চাওয়ার পরও সেহেরকে যেতে হলো।গেটে সেহেরের বাবা তার অপেক্ষা করছে। বাবাকে দেখে ,বাবার বুকে কান্নায় ভেঙে পরে। বাবা কোনরকম সেহেরকে গাড়িতে তুলে।দূর থেকে আরহাম মিহি সবটা দেখছে।মিহি বলল,”এতোটা হার্টলেস হইয়ো না! সে আশনূহার মা! ”
“স্যি ডিজার্ভ ইট! ”
আরহাম সেহেরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল।

বাড়ি ফিরে সেহের আশনূহার কাপড় খেলনা জড়িয়ে কাঁদছে। সাড়ে চার বছরে এই প্রথমবার আশু তার থেকে এতো দূর। আরহাম এতোটা হৃদয়হীন কি করে হতে পারে। কেন আবারো ফিরেছে! মিহিকে বিয়ে করেছে তাকে নিয়ে সুখে থাকুক। আশনূহা সেহেরের বাঁচার কারণ, আশনূহাকে কেন ছিনিয়ে নিতে চাইছে? সেহেরের ঘর থেকে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মেয়ের এমন যন্ত্রণা দেখে সেহেরের বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ।আশেপাশে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের সাথে কথা বলবে।এতে যদি কোন রাস্তা বের হয়।
রাত গভীর।সেহের কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। বাহিরে প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে। বাহিরের সব রাস্তা ব্লক! গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! বাবা তখনো বাড়ি ফিরেনি। এপার্টমেন্টের মেইন ডোর খোলা। লক লাগানো হয়নি । সেহের বিছানায় মাথা রেখে ফ্লোরে ঘুমিয়ে। শীতে শরীর থরথর কাঁপছে।কেউ তার শরীরে চাদর জড়িয়ে দেয়। চুলে আলতো করে হাত বুলাতে থাকে!

চলবে….❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here