বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৫৩
গতরাতের কথা ভাবতেই সেহের লজ্জায় চোখ মুখ খিঁচে নেয়।নিজের উপর রাগ হচ্ছে ভীষণ আবার অভিমানও! আশুর জেদ মেনে শহরের বাহিরে ঘুরতে বেরিয়েছিল ।ক্রিসমাসের মাস,সামনে নিউ ইয়ার! নিউইয়র্কের রাস্তাঘাট এখন ভীষণ ব্যস্ত, অন্য সময়ের দ্বিগুণ! বিকালের পর বের হবে বললেও বাড়ি থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা হয়েছে ।মিহিকে সাথে চলতে বললে মিহি কাজের বাহানা দেখিয়ে না করে । সেহেরও আর কথা বাড়ায় নি ।
রাস্তাঘাট বাহারি আলোয় সজ্জিত । সন্ধ্যা হলেও বুঝবার কায়দা নেই। এখানে দিনরাত সমান। রাস্তাঘাট সবসময় ব্যস্ত জাঁকজমকপূর্ণ! সেহের আরহাম পাশাপাশি বসে আশু তার বাবাইয়ের কোলে মাথা হেলিয়ে আছে। সামনে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে ।সেহের আড়চোখে আরহামের দিকে তাকাতে দেখে সে আগে থেকেই সেহেরের দিকে তাকিয়ে । আরহামের স্পষ্ট চাহনি কিছু একটা বলতে চাইছে । সেহেরের বুঝেও না বুঝার মত বসে থাকে।গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে । গাড়ির কাচ বন্ধ থাকার পরও হিমেল হাওয়া থেকে নিস্তার নেই। ভারী গরম কাপড়ের ফাঁকে ফাঁকে কিভাবে জানো ঢুকে পড়ে।আসার সময় হাত মোজা পরতে ভুলে গেছে সেহের। যার মাশুল এখন বেশ ভালো ভাবে পাচ্ছে।হাত ঠান্ডা হয়ে আছে ।হাতে হাত ঘষে ও খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। আঁধারের সাথে সাথে রাত ঠান্ডা দুটাই গভীর হচ্ছে।
গাড়ি থামল কোন এক ফার্ম হাউজে। আহামরি তেমন কিছু নয় । শহরের বাহিরে ছোট এক গ্রামে লেকের পাড়ে ছোট এক কাঠের ঘর।ঘরের সামনে ছোট এক আঙ্গিনা।যেখানে আপাতত সাদা বরফ জমে। লেকের পানি বরফ হয়ে স্বচ্ছ কাচের রূপ নিয়েছে।বাড়ির চারদিকে চিকন চিকন কাঠের বেড়া । হয়তো সীমানা স্থির রাখতে দেওয়া।আজ রাতটা তারা এখানেই থাকবে।সেহের নাকচ করতে চেয়েও পারল না। মেয়ের জিদের সামনে তার চলে কই? এতো বছর পর বাবাইকে পেয়েছে পুরোটা সময় বাবা মায়ের সাথে কাটাতে চায়। প্রতি ছুটিতে যখন আশুর বন্ধুরা পরিবারের সাথে বেড়াতে যেতো আশু খুব আফসোস করে মন খারাপের স্বরে বলতো ,”ওরা কত লাকি তাদের পাপা আছে! ঘুরতে যেতে পারে খেলতে পারে ।
মাম্মাম আমার পাপা কই? পাপার কি আমাদের কথা মনে পড়ে না! ”
সেহের তখন শান্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকত । কি উত্তর দিবে? বলার মত কিছু আছে কি? আজ যখন আশু তার বাবাইকে পেয়ে এতোটা খুশি ,সেহের তা নিয়ে বাঁধা দেয়নি ।সব অপূর্ণতা গুলো পূর্ণতা পাক!
পার্ক ঘুরে ডিনার করে বাড়ি ফিরতে ভীষণ রাত হয়।বাড়ি ফিরে সেহেরের কান্ত ভারী শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। একটা হট শাওয়ার নিলে মন্দ হয় না! সেহের শাওয়ার নিয়ে রুমে ফিরে দেখে আরহাম আশনূহা ঘরে নেই ।পুরো বাড়ি খালি । তবে কি তারা বাহিরে গেছে? সেহের গেটের সামনে আসতে আরহামকে একা বাড়ি ফিরতে দেখল।আতংকিত স্বরে বলল,
“আশু কোথায়? ”
“কেন ,তোমার সাথে ! ”
“আশু বাড়িতে নেই ”
“হোয়াট? মাত্র বাড়ির দিকে এসেছে ! ”
“আশু বাড়ি ফিরে নি! ”
দুজন ঘাবড়ে যায়। ছুটাছুটি করে আশেপাশে খুঁজতে লাগে। আশনূহা কোথাও নেই! দুজন দুদিক দিয়ে খুঁজছে সেহের বাড়ির পাশে লেকের দিকে যেতেই আশনূহার মাফলার পেল ।আশনূহা কি লেকের পাড়ে? সেহের দ্রুত সেইদিকে ছুটে যায়। লেকের পানি বরফ হয়ে আছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । কোথাও আলোর ছোঁয়া নেই। দূর বাড়ি থেকে আবছা আলো দেখা যাচ্ছে।সেহের জোরে জোরে আশনূহা আশনূহা বলে ডাকছে! কোন সাড়া নেই।তবে কি আশনূহা লেকে পড়েছে? সেহের অস্থির হয়ে পড়ে। আরো একটু কাছে যেতেই বরফে স্লিপ কেটে লেকের বরফের উপর পরে । সাথে সাথে আয়নার ন্যায় স্বচ্ছ বরফের উপর বক্ররেখার মত ভাঙ্গন ধরে।বরফ ভেঙে সেহের পানিতে তলিয়ে যায়।সাঁতার জানা না থাকায় সেহের হাবুডুবু খাচ্ছে । হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করছে। আশেপাশে সাহায্যের কেউ নেই! আশনূহা সামান্য দূরে বরফ নিয়ে খেলছিল। মায়ের আওয়াজ পেয়ে দূর থেকে আশনূহা ছুটে আসে । পাড়ে দাঁড়িয়ে মাম্মাম মাম্মাম বলে কাঁদতে লাগে। এদিকের চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে আরহাম ছুটে আসে সেহেরকে লেকে ডুবতে দেখে নিজেও পানিতে ঝাঁপ দেয়। কোনরকম সেহেরকে পাড়ে তুলে আনে। হাত পা প্রচণ্ড ঠান্ডা হয়ে আছে।আশনূহা মাম্মাম মাম্মাম বলে কাঁদছে । সেহের নিভু নিভু চোখে আরহামের দিকে একবার তাকিয়ে পুরোপুরি জ্ঞান হারায়!
জ্ঞান ফিরে পরের দিন ভোরে।গায়ে ভারী কিছু অনুভব করে।ঘুমঘুম চোখ খুলে দেখে আশনূহা ডানপাশে শুয়ে সেহেরকে জড়িয়ে ধরে আছে। বাম পাশ থেকে আরহাম। মাঝবরাবর সেহের সটান হয়ে শুয়ে । বাপ বেটি একই ভঙ্গিতে শুয়ে দুজনের মাথা সেহেরের ঘাড়ের বেশ কাছে ।আরহামকে একই বিছানায় দেখে সেহের ভীষণ চমকায়। আশনূহাকে সরিয়ে মাঝ থেকে যেই উঠতে যাবে অমনি আরহাম কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। দুজনের মাঝে খুব একটা দূরত্ব নেই। নাকে নাক ঠেকে । আরহামের ভারী ভারী নিশ্বাস সেহেরের মুখের উপর পড়ছে । আরহাম থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে আরহাম আরো শক্ত করে চেপে ধরে । সেহের অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে । নিজের দিকে খেয়াল করতে দেখে গায়ে আরহামের শার্ট। সেহের থতমত খেয়ে যায় । কাপড় পাল্টেছে কে? আরহাম? আশু তো নয় ,সে বাচ্চা মানুষ । তবে কি আরহাম চেঞ্জ করে দিয়েছে? লজ্জায় কান থেকে গরম ধোঁয়া বেরচ্ছে । আরহামকে ধাক্কা দিয়ে সরতে নিলে আরহামের ঘুম ভাঙে । ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল ,”ঘুম ভাঙতে না ভাঙতে শুরু? দেখি জ্বর কমেছে কি না! ”
আরহাম কপালে হাত ছোঁয়ায়। সেহের কাঁচুমাচু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।আরহাম আগের মত ভারী গলায় বলল ,” জ্বর ছেড়েছে! ”
সেহের উঠতে নিলে আরহাম ধমকের স্বরে বলে ,”ভোর সকালে উঠছ কেন? শরীর এখনো দুর্বল ,রেস্ট করো! ”
সেহের ধমক শুনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইল। আরহামও বিছানা ছেড়ে উঠল না, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল ।
সেই সকাল থেকে সেহেরের মন খচখচ করছে।ভীষণরকম অপরাধবোধ কাজ করছে।আরহামের সাথে ডিভোর্স না হলেও সম্পর্ক ভেঙেছে পাঁচ বছর । মিহি তার বর্তমান! আরহামের উপর সম্পূর্ণ অধিকার মিহির ।গতরাতে যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি,এতোটা কাছাকাছি একই সাথে থাকা মোটেও উচিত হয়নি। আরহামের সাথে একবার কথা বলে দেখবে কি? কি বলে শুরু করবে?
আরহাম সোজাসুজি বসে কোলে আশনূহা ঘুমিয়ে।সেহের গলা ঝেড়ে বলল, ” ধন্যবাদ , গতরাতে বাঁচানোর জন্য! ”
আরহাম একবার সেহেরের দিকে ফিরল কোনপ্রকার প্রত্যুত্তর না করে মুখ ফিরিয়ে নিলো ।সেহের ভয়ে ভয়ে বলল ,” গত রাতে আমাদের ভেতর কিছু হয়নি তাই না ? মানে সকালে ড্রেস চেঞ্জ……! ”
সেহেরকে থামিয়ে আরহাম ক্ষিপ্ত স্বরে বলল, ” এমন ভাবে বলছো যেন এই প্রথম আমার সাথে রাত কাটালে ! এর আগেও বহুবার এক সাথে ছিলাম , যেমন হোটেলে তুমি ড্রাংক ছিলে তখন কিছু হয়েছে? ”
“তখনকার কথা আলাদা ,এখন আপনার জীবনে কেউ আছে! আমি চাইনা আমার জন্য আপনাদের সম্পর্ক নষ্ট হোক! ”
আরহাম ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,”মাথা ধরছে ,আর একটা কথা বললে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিবো! ”
সেহের কথা বাড়াল না চুপ করে থাকল ।এই লোকের বিশ্বাস নেই ,দেখা যাবে সত্যি সত্যি গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে!
কাউকে কিছু না জানিয়ে বিকাল দিকে আরহাম বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় এয়ার টিকেট নিয়ে বাড়ি ফিরে ।ক্লান্ত ভঙ্গি তে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। সেহের আশনূহা পাশেই ছিল। আরহাম মিহিকে বলল, ” পরশু আমরা দেশে ফিরছি ”
মিহি মন খারাপের স্বর টেনে বলল, ” এখনো কোথাও যাওয়া হয়নি! আর কয়েকটা দিন থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে? ”
“আবার কোন ছুটিতে আসবো , দেশে ফিরতে হবে সামনে নির্বাচন। অনেক কাজ পড়ে আছে! অনেক কষ্টে টিকেট করেছি নিউ ইয়ারের সময় সব আগে থেকেই বুকড! ”
“তবুও ”
মিহি মন খারাপের স্বর টেনে বলল । সেহের পাশ থেকে সবটা শুনল।আরহামের হাতে তিনটা এয়ার টিকেট। সেহের গুনে গুনে দেখল আরহাম , আশু ,মিহির ।তাহলে সেহেরেরটা কই? আরহাম কি চাইছে ।সেহেরকে কি সাথে নিবে না? সে আশুকে ছাড়া কি করে থাকবে ? সেহের তড়াক করে দাঁড়িয়ে যায়। আওয়াজ করে বলে , “আমার টিকেট কই ? আমি যাচ্ছি না? ”
আরহাম কয়েক সেকেন্ড সেহেরের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল ,” না, তুমি যাচ্ছ না ! ”
সেহের ফুলঝুরির মত ফুটে উঠে চেঁচিয়ে বলে , “আমিও দেখবো আপনি আমার মেয়েকে আমার থেকে কি করে আলাদা করেন! ”
মিহি সেহেরের রাগ দেখে মিটমিটে হাসছে।আশুকে কোলে তুলে সেহের রুমে চলে যায় । আরহাম সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস স্বরে বলে , ” ইডিয়ট! ইমম্যাচিউর বাচ্চা! ওঁর থেকে আমার চারবছরের নূহা অধিক বুদ্ধিমতী ”
আরহামের কথা শুনে মিহি কিটকিটে হাসতে লাগে ।
চলবে ….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।