বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৫৪

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫৪

সকাল সকাল আরহাম আশনূহার শোরগোলে বাড়ি মেতে ।বাপ বেটি ভীষণ খুশি আগামীকাল দেশে ফিরবে।আশনূহা খুঁটে খুঁটে বাড়ির সবার কথা জিজ্ঞেস করছে। বাপ বেটির আলাপে বাড়ির দারোয়ান চাচাও বাদ যায় নি!
সেহের রুম থেকে কানখাড়া করে রেখেছে ।আশু আরহামের কথা শুনে সেহেরের ভীষণ হিংসা হচ্ছে। মন ভার হয়ে আছে।কোন ভাবেই বইয়ে মন দিতে পারছে না।আগামীকাল তারা দেশে ফিরবে ,তাতে কি সেহেরকে তো আর সাথে নিচ্ছে নাহ!
সেহের একবার ভেবেছে আশনূহাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে! কিন্তু তাতে লাভ কি ? আরহাম তো ঠিক খুঁজে বের করে ফেলবে।যে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা পৌঁছে গেছে,তার কাছে অসাধ্য কি!
মেয়েটার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।এতো বছর মায়ের সাথে থেকে বাপকে পেয়ে মাকে ভুলে গেছে। সারাদিন বাবাইকে নিয়ে পড়ে থাকে।শুধু রাত হলে মায়ের কথা মনে পড়ে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে আরহামের মুখোমুখি সেহের বসে।ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আরহামকে দেখছে ।সেহেরের মুখের ভঙ্গিমা দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারবে ‘সেহের এই মুহূর্তে ভীষণ রেগে । চোখ দিয়ে যদি ভস্ম করা যেত এতোক্ষণে আরহাম নিশ্চিত ভস্ম হয়ে যেত!
আরহাম বেশ মনযোগ দিয়ে নাস্তা করছিল।সেহেরের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দেখে থামল।ভারী শব্দ করে বলল, “কিছু বলবে? ”
সেহের অশ্রুভারাক্রান্ত চোখ নিয়ে মাথা তুলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আরহাম হাতের কাঁটাচামচটা প্লেটের সাইডে রেখে।সিধা হয়ে বসে বলল , “কি বলবে বলো! শুনছি। ”
সেহেরের নিচু অস্পষ্ট স্বরে বলল, “আমিও আপনাদের সঙ্গে দেশে ফিরবো! ”
আরহাম শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।সেহের মুখ তুলে আরহামের দিকে একবার তাকাল।মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে চাইল।কিন্তু ব্যর্থ।আরহাম চোয়াল শক্ত করে বসে। চোখ মুখ ভাষাহীন! সেহের আরো কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষায় রইল। কিন্তু আরহাম বরাবরই আগের মত চোয়াল শক্ত করে বসে। আরহামের চোয়াল শক্ত রাগী মুখভঙ্গি দেখে সেহের ধরে নিলো আরহাম তাকে সাথে নিবে না।
এবার সেহেরের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কান্না গুলো গলায় দলা বেঁধে আছে। বুকে ভারী এক চাপ অনুভব করছে। সেহের না হয় অপরাধ করেছেই তাই বলে এভাবে তাকে শাস্তি দেবে।মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে নিবে? এক বারের জন্যও সেহেরের কথা ভাবল না! এক সময় কিছু না বলে যে সব বুঝে যেত আজ তার এতো পরিবর্তন।পাঁচ বছর কি খুব দীর্ঘ সময়? সেহেরের চোখের জল কি এখন আর আরহামের মন ছোঁয় না?
চেয়ার ছেড়ে সেহের উঠে যায়।আরহাম ফিসফিস আওয়াজে বলে , ” হে আল্লাহ , আমাকে ধৈর্য দিন! ”
মিহি পাশ থেকে আরহামের উদ্দেশ্যে বলল, “মানছি তোমার রাগ করাটা ঠিক! একবার মেয়েটার কথা ভাবো।ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।সত্যিটা বলে দাও! ”
আরহাম মিহির কথা চুপ করে শুনল।কোন প্রত্যুত্তর করল না।
রুমে এসে সেহের মুখ চেপে কাঁদছে। নিজেকে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে স্বাভাবিক রাখতে কিন্তু চোখের জল কি সেই বাঁধা মানে?
সকাল পেরিয়ে দুপুর মাড়িয়ে বিকালে পৌঁছাল। সেহের তার রুমে দরজা বন্ধ করে বসে। এর মাঝে আশু ছাড়া কেউ আসেনি । সেহেরও রুম থেকে বের হয়নি । সন্ধ্যার দিকে বাহির থেকে কথার আওয়াজ ভেসে আসলো । সেহের গায়ে উড়না জড়িয়ে রুমের বাহিরে এসে দাঁড়াল । মিহি এক ব্যক্তিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে শতবছর পর বিচ্ছিন্ন প্রেমিক যুগল এক হয়েছে।সেহের চোখ ফিরিয়ে পাশে তাকাল আরহাম পাশে আশুকে কোলে করে খুব স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে । মুখে কোনপ্রকার রাগ জেদের চিহ্ন নেই।আগে সেহেরের সাথে কাউকে দেখলে তো ভীষণ ক্ষেপত ।বিপরীত পাশের মানুষের নাজেহাল মরণ দশা করে ছাড়ত। তবে মিহির বেলায় ছাড় কেন? সব অত্যাচার শুধু সেহেরের উপর – ই?
সেহের গাল ভারী করে আবার মিহির দিকে তাকাল। মিহি তখনো সেই ব্যক্তির গলা ঝুলছে! কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সেহেরের বিস্ময় আকাশ চুম্বী! সেই ব্যক্তি মিহির কপালে চুমু খাচ্ছে।তাও ভীষণ গাঢ় করে । সেহের হতভম্ব চোখে তাকিয়ে ।মিনিট দুই একের ব্যবধানে সেহের আকাশ পাতাল ভেবে উদ্ধার! সেহেরের ভাবনায় টোকা পড়ল সেই বিদেশি অপরিচিত ব্যক্তির ডাকে।সুগঠন সুঠাম দীর্ঘকায় শরীর , সুশ্রী মুখমণ্ডলে এক গাল হাসি নিয়ে সেহেরের সামনে দাঁড়িয়ে।বলল , “ইউ মাস্ট বি সেহের! আরহাম’স ওয়াইফ ,রাইট? ”
সেহের গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।বিদেশী লোকটা হাত বাড়িয়ে বলল, “আ’ম রবার্ট ,মিহি’স হাসবেন্ড! ”
রবার্টের কথা শুনে সেহের এবার হাজার ভোল্ডের শক খেল।থমথম চোখে একবার মিহির দিকে আরেকবার আরহামের দিকে তাকাল।আরহাম তখনো ভীষণ স্বাভাবিক । মিহি মিটমিট করে হাসছে।মিহি বুঝতে পারছে সেহের ঠিক কোন জায়গাটায় চমকেছে! সেহেরের মাথা চক্কর দিচ্ছে।সাপোর্টের জন্য পাশের চেয়ার ধরে দাঁড়াল । মাথা ঘুরে আবার পরে না যায়!

খানিক আগেই আরহামের সাথে জোরদার ঝামেলা করে এসেছে।আরহামের রুমে যেয়ে বেশ শক্ত গলায় জিগ্যেস করেছে , ” আপনি মিথ্যা বললেন কেন? ”
আরহামের শান্ত উত্তর ,” কি মিথ্যা বললাম? ”
“মিহি আপনার ওয়াইফ! ”
“আমি কখন বললাম? তুমিই তো ধরে নিলে! ”
“আপনি আমার ভুল ভাঙাবেন না? ”
“লাভ কি? কেন ভাঙবো? আর তাছাড়া তোমার মত ইমম্যাচিউর বাচ্চার ভুল ভাঙানো আমার পক্ষে অসম্ভব ! তুমি যা দেখো তারচেয়ে কয়েক গুন দূরের কথা ভেবে নেও।”
“আমি ইমম্যাচিউর বাচ্চা? ”
“হ্যাঁ , তাতে নতুন কি? সেই প্রথম থেকে! ”
“আচ্ছা? আমি এমন কি করেছি? ”
“গোনা শুরু করলে রাত পাড় হয়ে ভোর নামবে তবুও শেষ হবে না। এই যে তুমি কিছু না জেনে না শুনে আমাকে আগুনে ফেলে এখানে চলে আসলে! এটা বড্ড ম্যাচিউরিটির কাজ ছিল তাই না? ”
সেহের বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো ,”আপনাকে খুন করতে দেখেছি? ”
“এর পেছনের কারণ খুঁজেছ? ”
সেহের চুপ । আরহাম প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, ” যাও প্যাকিং করো ,কাল সকাল এগারোটায় ফ্লাইট! ”
সেহের খুশিতে লাফিয়ে উঠে,বলল, ” আমিও যাচ্ছি? ”
আরহাম উত্তর দিলো না। নিজের প্যাকিং এ মন দিলো!

রাত সাড়ে আটটা। সেহের বিছানায় গুটিসুটি মেরে থুতনিতে হাঁটু ঠেকিয়ে বসে।ঘটনা ঘেটে দেখা গেছে রবার্ট মিহির বিয়ে হয়েছে তিনবছর।রবার্ট আমেরিকার বাসিন্দা । মিহির নানাবাড়ির যোগসূত্র ধরে রবার্টের সাথে মিহির পরিচয়।পরিচয় থেকে প্রেম তারপর বিয়ে । এই বাড়িটা রবার্টের। মিহি এখানেই থাকে। আরহাম- ই পোনের বিশদিন পূর্বে সেহেরের খোঁজে এখানে এসেছে । সবকিছু শুনে সেহের এখনো ভীষণরকম হতভম্ব।এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে সেহের চোখ তুলে দেখল।মিহি ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে ল্যাপটপ হাতে দাঁড়িয়ে বেশ মিষ্টি স্বরে বলল, ” আসবো? ”
সেহের বিছানা ছেড়ে হেসে বলল,” অনুমতি নিচ্ছ কেন? আসো! ”
মিহি বিছানায় বসল। সেহের মিহি মুখোমুখি ।সেহের আমতা আমতা স্বরে বলল, ” সরি , আমি আবারো তোমাকে ভুল বুঝেছি! ”
“তুমি সরি বলছ কেন? আ’ম সরি আমার আগে তোমাকে সত্যিটা জানান উচিত ছিল তাহলে হয়তো তুমি আর আরহাম এক সাথে থাকতে ,আজ এসব হতো না।”
“মানে ?”
“সেহের আমি এখন যা দেখাবো যা বলবো সবটা মন দিয়ে শুনবে দেখবে । তারপর তুমি নিজে সবটা ডিসাইড করবে। আমার এটা তোমাকে আরো পাঁচবছর আগে জানান উচিত ছিল, যার জন্য তোমাদের এই বিচ্ছেদ! আরহামের অতীত সম্পর্কে তোমার অনেককিছু অজানা। যা তোমার জানা প্রয়োজন! ”
সেহের মিহির কথার আগাগোড়া বুঝছে না। ভাবুক দৃষ্টিতে মিহির দিকে তাকিয়ে । মিহি হাতের ল্যাপটপ অন করে একটা ফাইলে ঢুকল যেখানে আরো তিনটা ফাইল। তারিখ দিয়ে সেভ করা দুইটা পাঁচ বছর আগের ডিসেম্বরের, আর একটা দুবছর আগের! পাঁচ বছর আগের ডিসেম্বরের কথা মনে করে সেহের চমকাল । এটা তো তখন কার যখন মিহি কানাডা থেকে বাংলাদেশ এসেছিল ।তখন কি সেহেরের আড়ালে কিছু ঘটেছিল যা সেহেরের অজানা?

চলবে ….❣️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here