বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :৫৫
পাঁচ বছর আগে ডিসেম্বর…….
কানাডা……..
বিশাল বড় বিল্ডিং এর সেভেন ফ্লোরে আরহাম মিহি বসে । মিটমিট আলো। জ্বলছে । আবছা অন্ধকার রুমটায় আরহাম মিহি মুখোমুখি। মিহি সামান্য নার্ভাস । এর আগে বহুবার বাবার সাথে এমন কেস হেন্ডেল করলেও এই প্রথম একা সাহস করে কাউন্সিলিং করছে ,বেশ নার্ভাস।মিহির প্রফেশনাল ভাবভঙ্গি নিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলে,” আরহাম আপনার সমস্যা কোথায়? ”
আরহাম নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলো ,মিহির আওয়াজে মাথা তুলে তাকাল বলল, “রাগের বসে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাই।কিছুসময়ের জন্য পুরো মাথা খালি হয়ে যায়। প্রচণ্ড মাথা ধরে।চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে যায়। যখন জ্ঞান ফিরে নিজেকে অন্যকোথাও অন্য কোন বেশভূষায় পাই! ”
“এই সমস্যা কত যাবত আঁচ করতে পারছেন? ”
“দীর্ঘদিন! ছয় সাত বছর বা তারচেয়ে বেশি! প্রায়শই নিজেকে চিটাগাং পাই। অদ্ভুত কালো পোশাকে রক্তাক্ত অবস্থায় কখনো বা কোন লাশের পাশে! ”
“আপনার রাগটা ঠিক কখন বাড়ে?”
“যখন আমার প্রিয় জিনিসের উপর অন্যকারো নজর পড়ে।স্পেশালি সেহেরকে অন্যকারো সাথে দেখলে! ”
মিহি এর আগেও এমন আরো অনেক কেস দেখেছে । কিছু একটা ভেবে আরহামকে নিজের সাথে চলতে বলল। পাশেই ভারী অন্ধকারে ডাকা এক রুমে নিয়ে আসলো। বিভিন্ন ডিভাইসে ভরপুর! আরহামকে একটা চেয়ারে বসানো হলো। সামনে একটা ডিস্ক । মিহি আরহামকে ডিস্কের দিকে তাকাতে বলল। আরহাম তাকাল ডিস্কে বিচিত্র কিছু রঙ ভেসে উঠল। রং গুলো স্থির নয় কুণ্ডলী পাকিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধীরেধীরে নড়ছে।আরহাম বড় বড় করে রাখা চোখ গুলো ধীরেধীরে ছোট হয়ে আসছে। শরীর কেমন জানো হালকা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসছে। আরহাম ধীরে ধীরে চোখ বুজে নেয়। পুরো শরীর নেতিয়ে যায়।মিহি প্রশ্ন করে ,
“আপনার নাম? ”
“আরহাম খাঁন ”
মিহি তার বাবার দিকে ভীতু মুখ করে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করল। বাবা আশ্বস্ত সূচক ইশারা করে পরের প্রসেস শুরু করতে বলল।মিহি আবার বলল,
“ধীরে ধীরে আপনার অতীত থেকে সামনের দিকে আসবো , আপনার পরিচয়? শৈশব কৈশোর যৌবন সবটা বলুন ”
“নাম আরহাম খাঁন।বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান।পিতৃ সূত্রে বাংলাদেশি মাতৃ সূত্রে থাইল্যান্ডের হলেও জন্ম কানাডা। বাবা স্টাডির জন্য কানাডায় আসে এখানেই মায়ের সাথে পরিচয়।এখানে অধ্যায়নরত দুজনের বন্ধুত্ব হয় তারপর গভীর প্রেম।প্রেম থেকে বিয়ে।মা বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতো তাই নিজের পরিবারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিজের ধর্ম পরিবর্তন করে, বাবাকে বিয়ে করেন। মায়ের এমন কাজে পুরো পরিবার তার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে।এদিকে বাংলাদেশ থেকে দাদাবাড়ির সবাই মাকে মেনে নেয়না। বাবার সাথে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে।উনাদের একটাই কথা “আর যাই হোক অন্যজাতের কোন মেয়েকে বাড়ির বউ করবে না। ” বাবাও আর যোগাযোগ রাখেনি । মাকে নিয়ে কানাডায় সেটেল হয়। কানাডার গ্রাম সাইডে দুজনকে ঘিরে দুজনার দুনিয়া সাজায়।এই ছোট দুনিয়ার আমার আগমন ঘটে। বাবা মায়ের বিয়ের দুবছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। সময়ের সাথে পাল্লা ধরে আমার বেড়ে উঠা। বাবা মাকে ঘিরে আমার ছোট দুনিয়া । মাকে ভীষণ ভালোবাসতাম।মায়ের সাথেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো।প্রায় বাবা মাকে চিন্তিত দেখতাম ,আমি তখন খানিক বুঝতে শুরু করেছি।কিছু জিজ্ঞেস করলে বাবা মা প্রতিবার এড়িয়ে যেত।আমিও মাথা ঘামায় নি। তারপর অনেক দিন । আমার জন্মদিনের আগেরদিন বাবাকে অফিসের কাজে শহরে যেতে হলো।বাবাকে সকাল সকাল বেরোতে হলো । জানিয়ে গেল আজ নাও ফিরতে পারে। এতোদিনের সব প্ল্যান ভেস্তে গেল। আমার মন খারাপ হলো ,তা দেখে মা ছোট করে জন্মদিনের আয়োজন করতে শুরু করল। মা তখন পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট । ভারী পেট নিয়ে টুকটাক সাজসজ্জা করছে ।কেক বানাচ্ছে ।আমিও মায়ের সাথে সাহায্য করছি। এমন সময় ডোর বেল বাজল।তখন রাত দশটা পাড় হয়েছে।মা প্রথমে এতো রাতে কে হতে পারে ভেবে ভীষণ ঘাবড়ে গেল।আমাদের বাড়িটা গ্রামের থেকে সামান্য দূর ফরেস্ট এরিয়াতে। আশেপাশে তেমন কোন বাড়িঘর নেই।খুলবে না খুলবেনা বলেও বাবা এসেছে ভেবে আমাকে কিচেনের লুকাতে বলে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।দরজা খুলতে- ই মাস্ক পরিধানরত কয়েকজন দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে। মা ভীষণ ঘাবড়ে যায়। মা কিছু বলার পূর্বে- ই একজন মাস্ক খুলে মায়ের মুখ বরাবর দাড়িয়ে বলে , ” কি প্যাম ,চিনতে পেরেছ? ”
মা ভীতু স্বরে বলল ,” আমি এখন প্যাম নাহ , নির্জরা! ”
“ওকে বিয়ে করে ধর্ম চেঞ্জ করে নাম পেল্টে ফেললেই কি সব বদলে যাবে? তুমি এখনো আমার প্যাম! ”
“কেন এসেছ?ক….কি চাই? ”
“আর যাই হোক তোমাকে চাই না , তোমার আর তোমার ছেলে প্রাণ নিতে এসেছি ।”
“দিপক ভুলে যেওনা আমি তোমার বন্ধুর বউ , চলে যাও! ”
“তুমি যেই হও তাতে কি? তোমাদের খুনের আদেশ উপর থেকে এসেছে! ”
“কে দিয়েছে? ”
“তোমাদের আপন কেউ, তোমার ছেলে কই? সবার আগে ওকে খুন করে তোমাকে ছটফট করতে দেখবো ”
বলেই দিপক বিশ্রী ভাবে হাসল, ছুরি বের করল । মা দিপকের পায়ে পরে প্রাণ ভিক্ষা চাইল দিপক শুনল না।ভয়ে জড়সড় আমি কিচেনের কাবার্ডের ফাঁক থেকে সবটা দেখছি ।বের হবার সাহস হয়নি । মায়ের চুল টেনে সোফায় ফেলল।ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মত মায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ।সবার সামনে মাকে টেনে হিচঁড়ে ছিঁড়ছে । মা পেট ধরে জোরে জোরে কান্না করছে।পা রক্তে মাখা। আমি মায়ের সাহায্যের জন্য আসতে চাইলে মা চোখের ইশারায় না করল।দিপক মাকে নানা ভাবে টর্চার করছে।মা চিৎকার করে কাঁদছে। পাশের লোকরা গুলো শব্দ করে হাসছে। আমি বেরিয়ে আসতে চেয়েও সাহস পেলাম না তখন অনেক ছোট ভয়ে কাবার্ডের ভেতর বসে কাঁপছি। কিছুক্ষণ পর মায়ের কান্নার আওয়াজ পেলাম না।দিপক মায়ের উপর থেকে উঠে দাঁড়াল। বলল, ” মরে গেছে । এবার ওর ছেলেকে মারার পালা। ”
আমি নিজেকে আড়াল করে কিচেনে লুকিয়ে রইলাম। দিপক কাউকে ফোন দিয়ে বলল, “সব প্লান মত হয়েছে। অমিদ বাড়ি নেই! প্যাম মারা গেছে। এবার আরহামকে মেরে পুরো বাড়িতে আগুন দিবো যেন এটা জাস্ট এক্সিডেন্ট মনে হয়! টাকা রেডি রাখুন ”
আমার কান্নার আওয়াজে তারা আমাকে ধরে ফেলল । তাদের একজন কাবার্ড থেকে টেনে হিঁচড়ে মায়ের কাছে আনল। মৃত্যু কি তখনো আমার জানা নেই।মাকে বার বার ডাকছি ,কিন্তু কোন সাড়া নেই। মায়ের নিথর দেহ চোখের সামনে। জড়িয়ে ধরে কাঁদছি ।এমন সময়ই দিপক শক্ত হাতে আমার গলা চেপে ধরে।শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ।ছটফট করছি কিন্তু দিপক আমার যন্ত্রণায় পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে।আমার চোখ নিভু নিভু এমন সময় জানালায় আলো পড়ল।দূর থেকে বাড়ির দিকে গাড়ি আসছে। তা দেখে দিপক আমাকে ছেড়ে দেয়। বাকিদের বলে ,”তাড়াতাড়ি কেরাসিন ছিটা অমিদ আসছে। এখনি আগুন দিতে হবে! ”
সহ বাকি সবাই তার কথা মত পুরো ঘরে কেরাসিন ছিঁটাল আগুন ধরিয়ে দিলো মুহূর্তে পুরো বাড়ি আগুন ধরল। কাঠের বাড়ি হওয়ায় দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।ততক্ষণে তারা পালিয়েছে । আমার নিশ্বাস তখন একটু একটু চলছে। ঘোলা চোখে বাবাকে বাড়িতে ডুকতে দেখলাম। বাবার চোখে মুখে আতংক ভয়। চোখে পানি । আমাকে কোলে তুলে মায়ের কাছে এসে মাকে জোরে জোরে ডাকছে । মায়ের কোন সাড়াশব্দ নেই। নিথর দেহ ফ্লোরে পরে আছে। আগুনের প্রতাপ তখন অনেক। বাবা কাঁশছে সাথে আমিও।আমাকে বাঁচাতে বাবা আমাকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ।কিছুর সাথে মাথায় জোরে আঘাত লাগল । চোখের সামনে সব অস্পষ্ট । ঝাপসা চোখে বাবাকে মায়ের মৃতদেহ বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে বিলাপ করতে দেখলাম।বাড়ির চাল ভেঙে পড়ল। মায়ের সাথে বাবাও সেখানে নিজের জীবন দিলো । ”
হ্ঠাৎ আরহাম হাইপার হয়ে গেল।জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে।মিহি দ্রুত একটা ইঞ্জেকশন পুশ করল আরহাম ধীরে ধীরে শান্ত হলো….
চলবে ….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।