বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-২৮

0
2161

#বেখেয়ালি_ভালোবাসা,
#পর্ব_২৮
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
.
সৈকত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের ঘুমন্ত শহর টাকে দেখছে ।
আকাশের তারা গুলো মিটমিট করে জ্বলছে । ঠান্ডা বাতাসে কাপুনি ধরে যাচ্ছে তারপরও সৈকত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছে কি করে কি করা যায় !!
যদিও তখন বাবা তার অপূর্ণ ইচ্ছাটা কি সেটা বলে নি । কিন্তু সৈকত সেটা বেশ বুঝতে পেরেছে ।
বাবা তখন মেঘের কথাই বলছিল।
সৈকত ভাবে মেঘ কে এভাবে কষ্ট দেওয়া আমার একদমই উচিত হয়নি।
যে মেয়েটা তার সবকিছু উজাড় করে আমাকে এতটা ভালবাসলো আর আমি তাকে ——!!
শুধুমাত্র বাবার উপর রাগ দেখিয়ে !!
আচ্ছা আমিও যে মেঘকে ভালবাসি সেটা কি মেঘ নিজ থেকে বুঝতে পারে না!??
এতদিন যা করেছি সেটাতো সবটাই বাবাকে ভুল বুঝে করেছি ।
কিন্তু আজ !!?
আমার সব ভুল গুলো ভেঙ্গে দিয়ে যে মানুষটি আমার চোখের সামনে থেকে মিথ্যার জালটা সরিয়ে দিল তাকেই প্রতিনিয়ত কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি—-
না এটা ঠিক করছি না আমি ।
কিন্তু মেঘ সে কেন আমার উপর জোর খাটাল না!?
কেন এখান থেকে আমার কথা মত চলে গেল??
কেন একবারের জন্যেও বললো না যে সে এ বাড়ি ছেড়ে যাবে না,আমাকে ছেড়ে যাবে না!!?
ধুরঃ কি সব ভাবছি।
দোষটা তো আমারই । আমিই তো ওকে এক প্রকার জোর করেই এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছি।
ও তো যেতে চাইনি।
আমি সবসময় ওর সাথে ইচ্ছা করেই খারাপ ব্যবহার করেছি।
আমি যে খারাপ সেটা ওকে মানতে বাধ্য করেছি।
সত্যিই মেয়েটা বড্ড বেশী অভিমানী ।
আজ আমার উপর অভিমান করেই বাবা অসুস্থ হওয়া সত্বেও এ বাড়িতে না এসে ঠিক বাবার বাড়িতেই চলে গেল।
অথচ ওখানে যেয়েও যে মেঘ একটা মুহুর্তের জন্য ও ভাল নেই সেটা আগের দিন ক্লিনিকে দেখেই বোঝা গেছে।
হঠাৎ করে গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে হর্ন বাজাতেই সৈকতের সব ভাবনার জগৎ বিচ্ছিন্ন হয় ।
সৈকত তাকিয়ে দেখে তার অফিসের এক্যাউনটেন্ট ম্যানেজার রাকিবের গাড়ি ।
এত রাতে রাকিব এখানে !!
কি দরকার ??কখনও তো এভাবে অফিসের কেউ বাড়িতে আসেনি। তাহলে আজ হঠাৎ কি এমন হলো!!?
সৈকত আর দাঁড়িয়ে না থেকে নিজেই নিচে চলে যায়।
—কি ব্যাপার রাকিব সাহেব এতরাতে আপনি এখানে??কোন সমস্যা??
—জ্বি স্যার ।
—কি সমস্যা ?কি হয়েছে খুলে বলুন।
—আসলে স্যার আজ দুপুরে পুলিশ নাকি সুইটি ম্যাডামকে থানায় নিয়ে গেছে।
—হোয়াট!!?কি বলছেন আপনি!!?
—হ্যা স্যার সত্যি । প্রথমে আমিও বিশ্বাস করিনি। কিন্তু যখন থানা থেকে ফোন আসলো তখন বুঝতে পারলাম ঘটনা সত্যে।
—হঠাৎ পুলিশ কেন সুইটিকে এরেস্ট করবে??
—জানিনা স্যার ।
—আপনারা থানায় যোগাযোগ করেন নি??
—আসলে স্যার ঘটনা ঘটেছে দুপুরে । কিন্তু আমি জানতে পেরেছি কিছুক্ষণ আগে ।
—ও।
—পুলিশকে রিকুয়েস্ট করে সুইটি ম্যাম আমাকে ফোন দিয়েছিল। তারপর বললো আপনাকে যেন আমি ঘটনাটা বলি আর সকালে উকিল নিয়ে তাকে জামিনে বের করে আনি।
তাই এ কথা জানানোর জন্য আমার এত রাতে এখানে আসা।
—আচ্ছা ঠিক আছে । আপনি এক কাজ করুন আমার যে আইনজীবী আছেন আমার কথা বলে তার সঙ্গে সব যোগাযোগ করুন।
—ওকে স্যার ।
—আমি আগামীকাল সকালে থানায় যাবো।
—ঠিক আছে স্যার ।তবে আরেক টা কথা স্যার ।
—কি কথা?
—আপনি সেদিন সুইটি ম্যাডামকে টাকা দিতে বলেছিলেন।
—হ্যা ,তো ?
—না মানে সেদিন আমি টাকা দিয়ে ছিলাম। তারপর আজ সকালেও উনি আমার থেকে আগের থেকে দ্বিগুন টাকা নিয়েছেন আপনার কথা বলে ।
এ কথা শোনার পর সৈকতের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে।
একটু চিন্তা করে বলে ঠিক আছে কথাটা বলেছেন এ জন্য ধন্যবাদ ।
—স্যার তাহলে এখন আমি যাই।
—ওকে
সৈকত রুমে এসে ভাবতে থাকে হঠাৎ কি কারণে পুলিশ সুইটিকে এরেস্ট করতে পারে !!?আর সুইটি বা কেন আমাকে না জানিয়ে আবার দ্বিগুন টাকা নিল??
মাথায় কিছুই ঢুকছে না।
এরেস্ট যদি করার দরকার হয় তাহলে তো সুইটির এক্স হাজবেন্ড কে করা দরকার । সুইটি কে কেন??
অবশ্য বাবা অসুস্থ হওয়ার পরে সুইটির সঙ্গে আর দেখা হয়নি কথাও হয়নি।
অনেক রাত হয়েছে এখন এসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে । আগামীকাল সকালে পুলিশ স্টেশনে গেলেই বোঝা যাবে ।
সৈকতে পরনের কাপড়টা চেন্জ করে আলমারি খোলে ।
সৈকত ভুল করে আলমারির অন্য কাবার্ড খোলে।
আরে এটা তো মেঘের কাবার্ড !!
খুলতেই সৈকত অবাক হয়ে যায়
কি ব্যাপার মেঘের সব শাড়ি কাপড় এখানে রাখা তাহলে ও যাওয়ার সময় কি কিছুই নিয়ে যায় নি??
নিবেই বা কি ও তো এখনো ঠিক করে শাড়িটাও পরতে পারেনা।
বিয়ের পরের দিন সকালে শাড়ি পরে হোচট খেয়ে পড়েছিল আমার উপর ।
আবার এইতো সেদিন সিলেটে ঘুরতে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছিল ।
ভাগ্যিস আমি ধরে ফেলেছিলাম না হলে—-
সৈকত দেওয়ালের ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে ।
সৈকত মেঘের শাড়ি গুলোতে হাত বুলায় মনে হচ্ছে শাড়ি গুলোতে মেঘের স্পর্শ খুজে পাচ্ছে।
হঠাৎ সৈকতের চোখ পড়ে সেই খয়েরী রঙের শাড়ীটার দিকে ।
সেদিন রাতে যেটা পরে সুন্দর করে সেজে সৈকতের জন্য অপেক্ষা করছিল।
কিন্তু হঠাৎ মোমবাতির আগুন সব শেষ করে দিল——–
সৈকত হাসতে থাকে সে রাতের মেঘের পাগলামি কথা মনে করে ।
যে কোনদিন পানি ছাড়া কিছু খাইনি আর সে কিনা সেদিন হুইস্কির মতো জিনিস খেয়ে ছিল তাও আবার অর্ধেক বোতলের ও বেশী।
সৈকত শাড়িটা বের করে কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে । কি মনে করে শাড়িটা নাকের কাছে দেয় এই ভেবে যে শাড়িটাই হয়তো মেঘের শরীরের গন্ধ লেগে আছে।
কিন্তু——
সেদিন রাতে উগরানোর পর পরিষ্কার করার পরে আর মেঘের শরীরের কোন গন্ধ এতে অবশিষ্ট নেই যা আছে সব ডিটারজেন্টের গন্ধ।
সৈকত শাড়িটা রেখে আরেকটা শাড়ি খুঁজতে শুরু করে যেটা মেঘকে নিজ হাতে পরিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু কই সেটা!!?
কোথাও তো নেই।
কোথায় গেল শাড়িটা??
মেঘ সঙ্গে করে নিয়ে গেল?
না আমার উপর রাগ করে ওটা কাউকে দিয়ে দিল??
সৈকত শাড়িটা খুজতে খুজতে হঠাৎ চোখ পড়ে একটা ডায়েরির উপর ।
সৈকত ডায়েরিটা হাতে নিয়ে দেখে ডায়েরিটা একটু পুরাতন মতো ।
তারমানে এটা মেঘের ব্যক্তিগত ডায়েরি।
এটা পড়া ঠিক হবে না।
সৈকত ডায়েরিটা উল্টে পাল্টে দেখে রেখে দেয় । আবার কি মনে করে ডায়েরিটা বের করে এনে সোফায় গিয়ে বসে ।
মনে মনে বলেঃ
জানি কারো ব্যক্তিগত কিছু অনুমতি ছাড়া দেখতে হয় না । কিন্তু আজ তোমার অনুমতি ছাড়াই আমি তোমার ডায়েরিটা পড়তে যাচ্ছি জানিনা কি আছে এর ভিতরে । পারলে ক্ষমা করো।
প্রথম পৃষ্টা উল্টেই সৈকত একটু ধাক্কা খায় ।
♣ভবিষ্যতের বর ,♣
“এটা তোমার জন্য আমার পক্ষথেকে লেখা আমার অপূর্ন জীবনের কিছু কথা, কিছু স্মৃতি ,কিছু মধুর মুহূর্ত । অপূর্ণ বললাম কেন জানো??তুমি নেই তাই,যখন তুমি আসবে তখন আমার জীবনটা পূর্নতা পাবে ।
এখন তুমি নেই তাই এটাতে সব কিছু শেয়ার করছি ভবিষ্যতে তোমাকে দিব বলে ।তারপর এর ছুটি তখন তুমি হবে আমার একমাত্র ডায়েরি। প্রতিদিনের সবকিছু আমি তোমার সাথে শেয়ার করবো । রাতে যখন আমরা ঘুমাতে যাবো তখন আমি তোমার বুকের বামপাশে মাথা রেখে শুবো। তারপর তোমার ডানহাতের আঙ্গুলের ফাঁকে আমার বামহাতের আঙ্গুল দিয়ে ধরে, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার সারাদিনের না বলা কথা গুলো বলবো। জানি তুমি সারাদিন অফিসের কাজ করে এসে ক্লান্ত হয়ে যাবে তারপরও আমি তোমাকে আমার কথা গুলো শেয়ার করবো। ”
এই
মনে থাকবে??
যদি তোমার ঘুম আসে তাহলে কফি করে খাওয়াবো।
আর এরপরও যদি ঘুম আসে তাহলে তোমাকে ———-
এখন বলবো না পরে বলবো । আগে আমার অপূর্ন জীবনটাকে পূর্ণ করো তারপর —-
সৈকত লেখাটুকু পড়ে হাসতে থাকে ।
পাগলি একটা তা না হলে কি কেউ এভাবে লিখতে পারে!!?
সৈকত পৃষ্টা উল্টায় আর পড়তে থাকে ।
এক এক করে পড়তে পড়তে শেষের দিকে চলে আসে ।
মেঘের জীবনের অনেক কথাই সৈকত ডায়েরি তে পাই।
প্রতিদিনের লেখার ডেট আর সময় দিয়ে ডায়েরিটি লেখা।
সৈকত হিসাব করে বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত মেঘ ডায়েরি লিখেছে ।
“আজ শেষ ডায়েরি লেখা। আগামী কাল থেকে আমার জীবনের ডায়েরিটা হবে একজন মানুষ। জানিনা সে কেমন হবে তবে যেমনই হোক আমি ভালবাসবো আমার সবটা দিয়ে । খুশি রাখার চেষ্টা করবো তাকে। ”
তারপর মাঝের কিছু পৃষ্টা ফাঁকা পড়ে আছে ।
তারপর আবার লেখা—সৈকত মেঘের দেওয়া তারিখটাতে চোখ বুলায় তারা যেদিন সিলেটে গিয়েছিল সেদিন লেখা—
ভাবিনি আবার কিছু লেখার প্রয়োজন পড়বে !!
কিন্তু পড়েছে তাই লিখছি —
বিয়ের দিন আর বিয়ের রাতে মানুষটাকে দেখে খুব রাগ হয়ছিল।
মনে হয়েছিল মানুষটিকে কখনো মন থেকে মানতেই পারবোনা।
এরাকম মানুষের সাথে ঘর করা হলেও মন থেকে কখনো ভালবাসতে পারবো না।
কিন্তু কখন যে এই বদমেজাজী মানুষটার সাথে থাকতে থাকতে এই মানুষটাকে ভালবেসে ফেলেছি তা নিজেও জানিনা।
আমার নিজের সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি তার মধ্যে ।
কিন্তু মানুষটা কেন এমন ??
সবকিছু বুঝেও যেন না বুঝে থাকে ।
কেন এমন??
কেন এত অবহেলা করে ??
মেঘের লেখা গুলো পড়ে সৈকতের বুক থেকে না চাইতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
(চলবে…..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here