বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-২৭

0
2018

#বেখেয়ালি_ভালোবাসা,
#পর্ব_২৭
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
মেঘ বাড়ি ফিরে আসার পর মেঘের আম্মু চৌধুরী সাহেব কেমন আছে সেটা জানতে চাই।
মেঘ বলেঃ
—বাবা এখন ভাল আছে ,ডাক্তার রিলিজ করে দিয়েছে । এতক্ষনে সবাই হয়তো বাড়িতেও চলে গেছে।
মেঘের আম্মু ভাল করে কিছু সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে মেয়ের দিকে ভাল করে লক্ষ্য করে বলেঃ
—সত্যি করে বলতো সৈকত আর তোর সাথে কি হয়েছে ?
মেঘ মুখে শুষ্ক হাসি টেনে বলেঃ
—কই কিছু হয়নিতো ।
—মিথ্যা বলছিস!!
—শুধুশুধু মিথ্যা কেন বলবো?
—তোর চোখ বলছে তুই মিথ্যা বলছিস। দেখ মেঘ আমি তোর মা,আমি সব বুঝি।নিশ্চয় তোর আর সৈকতের মধ্য কোন সমস্যা হয়ছে তা না হলে আগের দিন ক্লিনিকে সৈকত তোকে দেখেও কেন কথা বললো না?আর তুই বা কেন কথা বললি না!?
—উুহ মা!তুমি না!!?আচ্ছা ঐরাকম একটা ক্রিটিক্যাল মোমেন্ট এ কি তখন এসব শোনার কথা বলো??তখন বাবার যে অবস্থা ছিল তখনতো কারোও কোন খেয়াল ছিল না।
—বুঝলাম। কিন্তু তুই কেন তাহলে সিকিউরিটি অফিসারদের নিজের পরিচয় দিলি না??
কেন বললি না যে তুই ঐ বাড়ির ছোট বউ!
আম্মুর কথার উত্তর দেবার মতো কোন কথা মেঘ আর খুজে পায় না।
কি বলবে!!?
সত্যিটা কি আম্মুকে বলা উচিত ??
না থাক এসব বললে আবার টেনশন করবে ।
হঠাৎ রাজু এসে বলেঃ
—মেঘ তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ।
—আসছি ভাইয়া।
কি হয়েছে রাজু ?তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
—না মা কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।
—আচ্ছা তোরা দু-ভাই বোন কি শুরু করলি বলতো!!?
—কেন মা কি করেছি আমরা?
—কি করেছিস আর কি করিস নি সেটা তোরা ভাল জানিস। তবে দুজন মিলে যে কিছু একটা লুকাতে চাইছিস সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
—কি যে বলো না মা তুমি!!?আচ্ছা এসব বাদ দাও তুমি আমার খাবারের ব্যবস্থা করো খুব ক্ষুধা লাগছে ।
—হ্যা যাচ্ছি । কোন কিছু বলতে চাস না আমাকে ,থাক বলিস না। তবে মনে রাখিস তোরা যখন বাবা,মা হবি তখন বুঝবি সন্তানের জন্য কতখানি দুশ্চিন্তা হয় কথা গুলো অভিমানী সুরে বলে উঠে চলে যায় মেঘের আম্মু।
মেঘ মুচকি হেসে বলে দেখেছো ভাইয়া আম্মু কেমন অভিমান করলো।
হুম দেখলাম।
শোন আমি রুমে যাচ্ছি তুই আই। আমার কিছু কথা আছে।
—আচ্ছা।
————**——**——**————
সৈকত বাসায় আসার পর থেকে সবসময় ওর বাবার পাশেই থাকছে। বাবার কখন কি দরকার সেসব খেয়াল রাখছে।
হঠাৎ চৌধুরী সাহেব সৈকত কে ডেকে পাশে বসতে বললেন।
সৈকত হাসিখুশি মুখ নিয়ে তার বাবার পাশে গিয়ে বসে ।
—জানো সৈকত এতদিনের আমার মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে। আমি যে আজ কতটা খুশী তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।
সৈকত বুঝতে পারে তার বাবা কি জন্য কথা গুলো বলছে তাই মাথা নিচু করে চুপ করে শুনতে থাকে ।
—আজ এখন যদি আমার মৃত্যু ও হয়ে যায় তবুও আমার নিজের প্রতি আর কোন আক্ষেপ থাকবেনা।
—এসব কি বলছেন বাবা আপনি। আর কেনইবা বলছেন। আজ এতদিন পর আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি আপনাকে আপন করে পেয়েছি আর আপনি কিনা—-
—আমাকে বলতে দাও সৈকত।
তুমি হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না যে আজ আমি এই পৃথিবীর কতটা সুখি মানুষ । শুধু একটা জিনিস আমার অপূর্ণ থেকে গেল।
—কি বাবা সেটা আমাকে বলুন আমি আপনার সব অপূর্ন চাওয়া গুলো পূরণ করতে চেষ্টা করবো।
হঠাৎ ঝিনুক এসে বলে বাবা এখন তোমার রাতের খাওয়ার আগে ঔষুধ খাওয়ার সময় ।
সৈকত উঠে গিয়ে ঔষুধগুলো এনে খাবার খাওয়ার আগের ঔষুধ গুলো চৌধুরী সাহেব কে খাইয়ে দেয় ।
ঝিনুক বলেঃ
—দেখ বাবা তোমার এই ছেলেকে পেয়ে তোমার ঐ মা টাকে যেন ভুলে যেও না।
সৈকত বলেঃ
—কেনরে তোর হিংসা হচ্ছে বুঝি??
—আমার হিংসা হবে কেন??কষ্ট হচ্ছে।
—কষ্ট হচ্ছে !!?কিন্তু কেন!!
—ভাবির কথা মনে করে । বেচারি!! শরীরটা পড়ে আছে বাবার বাড়ি আর মনটা এখানে।
জানো বাবা বাড়ি আসার পর থেকে ভাবি ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করছে । তুমি এখন কেমন আছো, কি করছো ,খাইছো কিনা এসব জিঙ্গাসা করছে শুধু।
এই যে এখন একটু আগে ফোন করে বলে দিল তোমার খাবার খাওয়ার আগের ঔষুধটা খাইয়ে দিতে।
চৌধুরী সাহেব হেসে বললো এই না হলে আমার মা!!?
দুরে বসেও ঠিকই ছেলের খোজ নিচ্ছে।
চৌধুরী সাহেবের কথাটা শুনে হঠাৎ সৈকতের মনটা কেন জানি খারাপ হয়ে যায়।
চৌধুরী সাহেব সৈকতের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ।
সৈকত ঝিনুককে বলে যা বাবার রাতের খাবারটা কাউকে দিরে যেতে বল।
ঝিনুক আচ্ছা বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
—আচ্ছা বাবা একটা কথা জিঙ্গাসা করবো যদি আপনি অনুমতি দেন।
—হ্যা ।
—আপনি কেন এসব কিছু আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখলেন?
চৌধুরী সাহেব সৈকতের কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে কি যেন ভাবেন। তারপর বলেঃ
—আমি চাইনি সন্তানদের চোখে তাদের মা কে ছোট করতে।
আমি চাইনি আমার স্ত্রীর মান সম্মান এতটুুকু ও নষ্টহোক।
—আর সে যে আপনার মান সম্মান নিয়ে খেলা করলো? আপনার সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতের মুখে ঠেলে দিয়েছিল তখন?
—আমার আর মান সম্মান কোথায় নষ্ট হলো!!তবে তোমাদের ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিতের মধ্যে দিয়েই কাটছিল।
আমার ভয় হতো এই ভেবে যে আমি তোমাদের মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে পারবো কিনা। আমার ভয় ছিল তোমরা তোমাদের মায়ের কথা মনে করে তার অনুপস্থিতির কারণে ভুল পথে পা বাড়াও কিনা!! আর এ জন্যেই
আমি তোমাদের তখম বেশি বেশি সময় দিয়েছি।
—আচ্ছা বাবা আপনি যখন বুঝতে পারলেন যে ওই আগুনে ঝলসানো দেহটা অন্যে কারো ছিল তখন কেন অন্যে কোন পদক্ষেপ নিলেন না?
—যখন জেনে ছিলাম তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। আর এ কথাটা ফরেনসিক রিপোর্টে ধরা পড়ে । যখন একথা শুনেছিলাম তখন আমার শুধু মনে হয়েছিল কেন আমি এখনো বেচে আছি ?কেন তাকে আমার জীবন থেকে এভাবে এত কিছু করে চলে যেতে হলো ?
সে যদি বলতো যে তার জীবনে আমার দরকার নেই তাহলে আমি হাসি মুখেই তার জীবন থেকে হয়তো সরে আসার চেষ্টা করতাম কিন্তু—–
চৌধুরী সাহেবের চোখ দুটো ছল ছল করে ওঠে। কন্ঠ বুজে আসে । কথা বলতে কষ্ট হয় ।
তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে তখন চাইলে অনেক কিছুই করতে পারতাম কিন্তু করিনি। আমি তার সুখের পথের বাধা হতে চাইনি। তাকে দূর থেকে ভালবেসেছি তার ভালথাকার জন্য নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি।
সৈকত আর কিছু বলে না ।
কি বা বলবে!!?
বলার জন্য কোন কথাই খুজে পাই না।
যে বাবাকে সে এতদিন খুনি,লোভী আর স্বার্থপর ভেবেছিল আর সেই
কিনা ——-!!??
নিজের কথা না ভেবে দিনের পর দিন আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে একা নিঃসঙ্গ ও নিস্বার্থ ভাবে জীবনটা পার করে দিলেন মনের মাঝে একজনকে রেখে।
আর আমি তাকে কতোটা কষ্ট দিয়েছি দিনের পর দিন আর বছরের পর বছর।
ঝিনুক খাবার নিয়ে আসে ।
সৈকত খাবারটা নিয়ে নিজ হাতে চৌধুরী সাহেবের মুখে তুলে খাইয়ে দেয় ।
তারপর বাকি ঔষুধ গুলো খাইয়ে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত তার বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
সৈকত যখন বুঝলো তার বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে তখন নিঃশব্দে উঠে নিজের রুমে চলে আসে ।
একটা মানুষ যে অন্য একটি মানুষকে এতটা ভালবাসতে পারে তা হয়তো সৈকত বিশ্বাসই করতো না আজ নিজের বাবাকে না দেখলে।
রুমে ঢুকে দেওয়ালে ঝুলানো মেঘ আর নিজের সেই ছবির দিকে তাকিয়ে সৈকতের বুক থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয় ।
ছবিটা দেওয়াল থেকে খুলে এনে দুহাতে ধরে অনেকক্ষন সময় নিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ছবিটার সঙ্গে কথা বলে ।
ইচ্ছে করছে অভিমানী মেয়ে টাকে একটু ছুয়ে দেখতে কিন্তু পারছে না। নিজের অজান্তে ছবিটাতে হাত বুলায় সৈকত । মনে হচ্ছে এতদিনে শুষ্ক মরুভূমি কিভাবে যেন ভিজতে শুরু করেছে——–
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here