বেখেয়ালি মনে পর্ব-১৭

0
638

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-১৭
.
.
ভোলাগঞ্জ থেকে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। বাসায় ফিরে দু’জনেই টায়ার্ড ফিল করে। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু রাত একটায় ক্ষুধার তাড়নায় ত্রয়ীর ঘুম ভেঙে যায়। সেন্টার টেবিলে তাকিয়ে দেখে ওয়াটার পটে পানি নেই। তাই সে ধীর পায়ে রুম থেকে বের হয় নিচে যাওয়ার জন্য।

সিড়ির কাছে আসতেই ইনানের দেখা পায় সে। ইনানও নিচে যাওয়ার জন্য সিড়ি অবধি এসেছে। তাকে দেখেই ত্রয়ী ঢোক গিলে দৌড় দেয় রুমের দিকে। কিন্তু একটু যেতেই ইনান পিছু ডাকে। তার ডাক অগ্রাহ্য করার সাহস নেই ত্রয়ীর। তাই পেছন ঘুরে দাঁড়ায় সে।

– কি হলো? এভাবে পালাচ্ছো কেন?
ত্রয়ী গলা টেনে টেনে বলে,
– ক-ক-কই পালাচ্ছি?
– তাহলে দৌড় দিলে কেন?
ত্রয়ী দু’হাত কচলাতে কচলাতে বলে,
– দৌড় দেই নি তো। আমি তো ব্য-ব্যয়াম করছিলাম।

ত্রয়ীর কথা শুনে ইনান অবাকের সপ্তম আকাশে চলে যায়। বিস্মিত কন্ঠে বলে,
– লাইক সিরিয়াসলি? মাঝ রাতে তুমি ব্যায়াম করছো?

ত্রয়ী নিজের কথায় নিজেই বেকুব হয়ে যায়। এখন কী বলবে ইনানকে সেটাই ভাবতে থাকে। খুব বেশি চালাকি করতে গিয়ে নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে সত্যি বলে দেয় ত্রয়ী।
– আসলে, আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। তাই পানি আনতে যাচ্ছিলাম নিচে।

ইনান হাসে ত্রয়ীর কথায়। বলে,
– আসো, আমারও ক্ষুধা লাগছে। ফ্রিজে খাবার আছে। গরম করে খেয়ে নিবো চলো।

ত্রয়ী আর কথা বাড়ায় না। ইনানের পিছু পিছু যায়। সে ডাইনিং এ বসে ইনানের খাবার গরম করা দেখছে।
কিচেনে কিছুর শব্দ পেয়ে রাবেয়া হকের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি রুমের দরজা খুলে দেখেন ইনান আর ত্রয়ী কিচেনে তাই আর সামনে এগোন না। দূর থেকে ওদের দেখে একটা প্রসন্ন হাসি দেন।

ইনান খাবার গরম করে নিয়ে এসে বলে,
– বোকাপাখি, কাল কিন্তু আমরা ঢাকায় ফিরবো।
ঢাকায় ফেরার কথা শুনে ত্রয়ীর উল্লাসী মন চুপসে যায়। এভাবে আর ইনানকে এতো কাছে পাবেনা ভেবে ভিতরে ভিতরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
ছোট করে বলে,
– ওহ।

তারপর দু’জনেই খাওয়াতে মন দেয়। ত্রয়ী অবচেতন মনে ইনানের কথা ভাবতে থাকে। কী করে সে মানুষটাকে নিজের করে পাবে, এই চিন্তায় তার ঘুম উড়ে যায় চোখ থেকে।

গুন গুন করে আপন মনে গান আওড়ায় সে,
“ঘুম উড়ে যাওয়া এই রাতে
চাই যে তোমাকে ফেরাতে
স্বপ্ন জড়ানো দু’চোখে লুকিয়ে আছে সংশয়!”

__________________________________________________________

সকালে বিষন্ন মন নিয়ে ইনানের রুমে যায় ত্রয়ী। ইনান কিছু একটা লিখছে। ত্রয়ীকে দেখে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
– মন খারাপ?
ত্রয়ী মাথা নাড়িয়ে বলে,
– হুম।
– কেন?
– কাল আপনি আমার একটা পিকও ক্যাপচার করেন নি তাই। কত্তো সুন্দর একটা মুহুর্ত কাটালাম। অথচ, সেটা ফ্রেমবন্দী হয়নি! এর জন্যই মন খারাপ।

ত্রয়ীর এমন পিচ্চিদের মতো ব্যবহারে ইনান হেসে দেয়। তা দেখে ত্রয়ী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। কিছু না বলেই দৌড়ে এসে ইনানের চুল ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। তারপর ইচ্ছেমতো টেনে দেয় চুলগুলো।

ত্রয়ীর এমন কান্ডে ইনান মিনিট দুয়েকের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ত্রয়ী বাচ্চা ঠিক আছে, কিন্তু এতোটা বাচ্চা তা ইনান মোটেও ভাবেনি।
চুল ছেড়ে দিয়ে ত্রয়ী হাঁপাতে থাকে। ইনান হাসছে, কপাল কুচকে ঠোঁট বাকিয়ে হাসছে।

ত্রয়ীর খুব রাগ হচ্ছে। বেডের উপর থেকে একটা বালিশ নিচে ছুঁড়ে মেরে হনহন করে ইনানের রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

তা দেখে ইনান আপন মনে ভাবে,
– এমন পাগলামি করোনা বোকাপাখি, আমার নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়ে যায়। আমি চাইনা আমার বেখেয়ালি মনে, প্রণয়লীলা নামক কোনো শব্দকে প্রশ্র‍য় দিতে।

ত্রয়ী ইনানের রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়ি ছেড়ে আজকে ওর চলে যেতে হবে। খুব কান্না পাচ্ছে। ইনানের রুমে উঁকি দিয়ে ভাবে,
– এই রুমটা আমাদের রুম। হ্যাঁ, আমার আর উনার রুম। এই রুমে অন্যকারো হস্তক্ষেপ আমি একদম সহ্য করতে পারবো না।

একদিন না একদিন ঠিক এই রুম আর উনাকে আমি আমার নিজের নামে দলিল করে নিবো।

___________________________________________________________

বিকেলের পর ওরা চারজন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাবেয়া হক আর মোস্তফা হক একটা কাজের জন্য আজ ঢাকায় যেতে পারবেন না। তাই তিন ছেলে মেয়ে আর ত্রয়ীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাস চলছে তার নিজ গতিতে।

ইফতিহা, ইয়াদ সামনের সিটে বসেছে। ইনান ও ত্রয়ী তাদের দু’সিট পরে বসেছে। বাসে চড়ার কিছুক্ষন পরেই ত্রয়ী ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। ইনান ত্রয়ীর ঘুমন্ত চেহারা পর্যবেক্ষন করছে। রাত বাড়ছে। এদিকে ত্রয়ীর ঘুমের রেশটাও কাটছে না। ইনান ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে গান শুনছে। আর ত্রয়ীর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

আচমকাই বাসের এক ঝাকুনিতে ত্রয়ীর ঘুম ভেঙে যায়। সে ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকানোর আগেই ইনান দ্রুত ত্রয়ীর মাথা থেকে ওর হাত সরিয়ে নেয়। অপ্রস্তুতভাবে নিজের চুলই আঙুল দিয়ে আঁচড়াতে থাকে।

ত্রয়ী ঢুলুঢুলু চোখে এদিক ওদিক তাকায়। এতক্ষণ ইনানের কাধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলো ও। এবার সেটা বুঝতে পেরেই দ্রুত সোজা হয়ে বসে। লজ্জায় তার গাল ব্লাশ করছে। ইনানের দিকে তাকিয়ে বেকুবের মতো একটা হাসি দেয় সে,
-ইয়ে মানে.. দুঃখিত। আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তো। খেয়াল করিনি।
ইনান এক কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ত্রয়ীকে জবাব দেয়,
-না না সমস্যা নেই। ঘুমাতে পারো তুমি।

ত্রয়ী নিঃশব্দে ঠোট খেলিয়ে হাসে। কোনো জবাব দেয় না। ইনান শুধু এক কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছে, অন্য কানেরটা খুলেই রেখেছে। যদি ত্রয়ী কিছু বলে টলে, শুনতে হবে তো!
ত্রয়ী চোখ কচলায়৷ এখন কিছুক্ষণ আর হয়তো ওর ঘুম হবে না। কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থাকলে ঘুম আসতে পারে। জানালার ধারেই বসেছিলো ত্রয়ী। এবার ও ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারদিকে অন্ধকার নামছে। রাস্তার দুদিকের দোকানপাট গুলোতে বাল্ব-বাতি জ্বলে উঠছে। আলোয় মোটামুটি ঝলমল করছে চারদিক। ত্রয়ী সিটে হেলান দিয়ে দিয়ে সেসব দৃশ্যই উপভোগ করছে।

হঠাৎ একটা দোকানের নামের দিকে দৃষ্টি যায় ত্রয়ীর। “জননী স্টোর”। ও চমকে উঠে। ইনানকে দ্রুত অস্থিরভাবে ধাক্কাতে থাকে,
-এই এই আমরা কি আবার সাদা পাথর দেখতে যাচ্ছি?
ইনান অবাক হয়ে জবাব দেয়,
-না তো!
-তাহলে ওখানে একটা যে দোকান দেখলাম, জননী স্টোর! এই দোকানটা তো আমি ভোলাগঞ্জ যেতেও দেখেছি!

ইনান এবার সশব্দে হাসতে থাকে,
-হায় রে বোকাপাখি! সাধে কি আর বোকাপাখি ডাকি তোমায়? দুনিয়ায় কি একটাই ‘জননী স্টোর’ আছে, হ্যাঁ? পাগলি রে!
ত্রয়ী ভেংচি কাটে। বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বলে,
-হুহ! আমি কি রাস্তাঘাট চিনি নাকি? দোকানটা মনে ছিলো শুধু, তাই তো ভাবলাম..

ইনান হাসতেই থাকে ত্রয়ীর কান্ড দেখে। ত্রয়ী মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দেয়।
খানিকবাদে হঠাৎ ত্রয়ী ‘আউচ’ করে উঠে! চোখ চেপে ধরেছে ও। বাইরে থেকে ধূলোবালি ঢুকেছে। ইনান শীঘ্রই ব্যাকুল হয়ে তাকায় ত্রয়ীর দিকে।
-ইশ চোখ জ্বালা করছে।
ইনান দ্রুত ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে একটু সাইড হয়ে বসে। আর ত্রয়ীকেও একটু চেপে বসতে বলে বোতলের মুখটা খুলে এগিয়ে দেয়। অগত্যা বাসের মধ্যেই চোখমুখে পানি দিতে হবে।

ত্রয়ী তা-ই করে৷ চোখে হালকা পানি ছিটায়। আগের থেকে বেটার ফিল করছে সে। তাও কেমন যেন খোঁচাচ্ছে ওর ডান চোখটা।
ইনান চটজলদি ত্রয়ীর মুখ ঘুরিয়ে ওর বাম চোখের পাতাটা মেলে ফুঁ দিতে থাকে। আর সেই সাথে এইটাও দেখার চেষ্টা করতে যে কিছু ঢুকেছে টুকেছে কিনা৷ যদিও বাসের ভেতর অন্ধকারে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

এদিকে ত্রয়ী একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এহেন কান্ডে ওর চোখ এমনিতেই বড় বড় হয়ে গেছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ও ইনানের দিকে। বুকের ভেতরে কেউ যেন ধুমধাম হাতুড়ি পেটাচ্ছে। শ্বাস থমকে গেছে।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here