বেখেয়ালি মনে পর্ব-১৬

0
644

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-১৬
.
.
ত্রয়ীর জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। ইনানের দিকে তাকিয়ে এখনি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দেবে মনে হচ্ছে। ভয়ে কপাল আর ভ্রু জোড়াও কুচকে আছে। ইনান ওর বাম হাত দিয়ে কোমরে জড়িয়ে ধরেছে।
ভাগ্যিস! উভয়ই পরস্পরকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরেছে। নাহলে সেই কখনই কুপোকাৎ হয়ে যেতো!

পুরোপুরি না ভিজলেও এমন আচমকা ঘটনায় পানি ছিটকে পড়ে দুজনেরই হাটু ও প্যান্ট বেশখানিকটা ভিজিয়ে ফেলেছে। ইনান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ত্রয়ীর দিকে,
-হয়েছে এখন? মজা পেলে? হুশ কই থাকে তোমার? আমি না এগিয়ে এলে তো এতোক্ষণে ভিজে একাকার হয়ে যেতে।
ত্রয়ী তৎক্ষনাৎ ইনানকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায় আর মুখ ভেংচিয়ে বলে,
-এহ! উপকার করে আবার খোঁচা দিচ্ছেন, তাই না? লাগে না আর এমন উপকার! হুহ ধন্যবাদ।
-আরে আমি কি সেভাবে বলেছি নাকি? ভুল বুঝছো তুমি।

ত্রয়ী মুখ গোমড়া করে আড়চোখে ইনানের দিকে তাকাতেই ওর নজর যায় ইনানের শার্টের দিকে। উপরের দুটো বাটন নেই। হালকা সুতো বের হয়ে আছে৷
দেখামাত্রই সে অস্থিরভাবে নিচে এদিক সেদিক দেখতে থাকে। ইনান হতবাক হয়ে ত্রয়ীকে জিজ্ঞেস করে,
-কী দেখছো এভাবে?
-আপনার শার্টের বাটন! এখানেই কোথাও পড়েছে হয়তো।
বলেই সে আবার খোজাখুজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইনান একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসে,
-ওহ থাক ওটা। এমনিতেও বোঝা যাচ্ছে না। বাসায় গিয়ে মাকে বললে মা এমনিই সেলাই করে দেবে। বাদ দাও। চলো এখন চারপাশটা ঘুরে দেখি আরো।
ত্রয়ী কোনো জবাব না দিয়ে আচমকা চেঁচিয়ে উঠে,
-এইতো পেয়ে গেছি ব্যাটা দুটোকে!

খুশিতে ফিরে তাকায় ত্রয়ী। যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে জমিনে। কিন্তু হায়! ইনান তো শুনতেই পেলো না। ত্রয়ীকে আসতে বলে সে নিজেও তীরের দিকে হাঁটা ধরেছে। ত্রয়ী আবারো পেছন থেকে মুখ ভেঙায় ইনানকে,
-হুহ কি ভাব! দেখো, এমনভাবে হাঁটা ধরেছে, যেমন কোনো রাজা বাদশা নগর পরিভ্রমণে বের হয়েছে।
ব্যাপারটা ভেবে একটা হাসিও দেয় ত্রয়ী। ছেলেটার সব কিছুই দেখার মতো! মন কেড়ে নেওয়ার জন্য এক্কেবারে যথেষ্ট!

হাতের মুঠোটা খুলে ইনানের শার্টের বোতাম দুটোর দিকে তাকায়। ওর মনে হয়, বাটনদ্বয় পাশাপাশি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। বোতামের ফুটো দুটো হচ্ছে চোখ। আর চারদিকের ডাবল রাউন্ড শেপের মধ্যে ছোট ও কাছের বক্ররেখাটা ওদের চওড়া স্মাইল।
ও নাম দেয় ওদের- একটার নাম ‘ইনান বাটন’ আরেকটার নাম ‘ত্রয়ী বাটন’। তারপর আপন মনেই হেসে হেসে বোতাম দুটো ওর নিজের কাছেই রেখে দেয়। ইনানকে আর বলতে যায় না।
____________________________________________________
আরো কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘুরে দেখার পর ত্রয়ীর চোখ যায় কাঁটাতারের দিকে। তার অপরপাশের সড়কে পাথরবাহী মিনি ট্রাকও দেখতে পায়। চমকে থমকে দাড়ায় সে।
ও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ইনান ওর মনের কৌতুহল দূর করার জন্য বলে,
-ওটা ভারত সীমান্ত। বাংলাদেশ-ভারতের বর্ডার!
ত্রয়ী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-এখান থেকে আমরা ইন্ডিয়া যেতে পারবো?
ইনান একটা প্রাণখোলা হাসি দেয়,
-কেন নয়? কিন্তু চোরাই ভাবে তো যাওয়া যাবে না বোকাপাখি।
বলেই আবারো হাসতে থাকে ইনান। ত্রয়ী বিরক্ত হয়ে তাকায় ওর হাসি দেখে৷ সেই সাথে আবার মুগ্ধও হয়। একটা মানুষ এতোটা হাসতে পারে কীভাবে? ভেবে পায় না ত্রয়ী।

দুজনে আবারো হাটতে হাটতে চারদিকের প্রকৃতির হাওয়ার স্বাদ নিতে থাকে। ওদের মাথার উপর সুনীল আকাশ৷ শরৎকাল আসে নি এখনো, তবুও কতো কতো শুভ্র মেঘ তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে! এ যেন এক নীল-সাদা আর সবুজের দুনিয়া! সব মিলেমিশে একাকার! তাকালেই হৃদয়ে এক অনন্য প্রশান্তি অনুভব হয়।

ত্রয়ী মুগ্ধ চাহনিতে দূর দিগন্তে দৃষ্টি রাখতেই অনভব করে, চতুর্দিকের পাহাড়গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওদেরকে। মনে হয় একদম জ্যান্ত পরিবেশ! পাথর গুলোও যেন ভূমিতে মেলা সাজিয়ে বসে আছে। সেই সাথে ধলাই নদের তলেও বালির সাথে ডুবে ডুবে ঝলমল সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে।

-আচ্ছা এখানে এত্ত এত্ত পাথর কোত্থেকে এলো? ইশশ! এত্তগুলো সজ্জিত সুন্দর সুন্দর পাথর একসাথে আমি আগে কখনোই দেখিনি। আমার যে কত্ত ভালো লাগছে দৃশ্যটা, বোঝাতে পারবো না!
ইনান হেসে জবাব দেয়,
-প্রচুর বর্ষনের ফলে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়গুলো থেকেই এসব পাথর পানিপ্রবাহে ধলাই নদের বুকে নেমে আসে৷
-ওহহো!
-তুমি সিলেটের বিছনাকান্দির নাম শুনেছো? গোয়াইনঘাটের?
-হ্যাঁ!
-ভোলাগঞ্জের এই সাদা পাথরের দেশটাকে ঐ বিছনাকান্দির সাথেই তুলনা করা হয় একরকম৷ অনেকে তো এখানটাকে ‘দ্বিতীয় বিছনাকান্দি’ বলেও চিনে।

ত্রয়ী বাচ্চাদের মতো অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করে,
-আপনি বিছনাকান্দি গিয়েছেন? গিয়েছেন?
-আবার জিগায়! হাহা.. তবে কী জানো? আমার এই সাদা পাথরের মনোরম দৃশ্য বিছনাকান্দির থেকেও বেশি মন ভুলিয়েছে। এই জায়গাটা ঘুরে ফেলেছো মানে মনে করো তোমার বিছনাকান্দির সৌন্দর্যও প্রায় অর্ধেকের মতো উপভোগ করে নিয়েছো। যাক! নিজ নিজ জায়গা থেকে অবশ্য এগুলোর মধ্যে এরকম তুলনা একদমই চলে না। সবকটাই তোমার মন ও দৃষ্টি দুটোই কেড়ে নেবে!

ইনানের সাথে যে কোনোদিন এভাবে এতো অপার সৌন্দর্যের দর্শন করতে আসবে, তা যে কল্পনারও অতীত ছিলো ত্রয়ীর৷ মন-প্রাণ সবই যেন চুরি হয়ে গেছে। আর চোর হচ্ছে – এক, ইনান আর এই সাদা পাথরের দেশ। মনোরম প্রকৃতি!

এ যেন আসলেই মন ভোলানোরই এক রাজ্য! রজ্জুপথ, পাথর কোয়ারি, নদী ও পাহাড়ের সমন্বয়ে মিলিত এই অপরূপ লীলাভূমি! ভোলাগঞ্জ! সত্যিই সার্থক এ নাম!

ত্রয়ী ওর মতো করে গেয়ে উঠে,
“গ্রামছাড়া ওই শ্বেত পাথরের পথ
আমার মন ভুলায় রে..”

ইনান মুগ্ধতায় হেসে দেয়।
থেমে থেমে আবার বলতে শুরু করে,
-শুকনো মৌসুমে এখানে মানুষের আনাগোনা আরো বেড়ে যায়। আর জানো? ঐ সময় এলে দেখা যায় কীভাবে মাঝিমাল্লারা গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করে৷ আহ! ৭-৮ ফুটের মতো গর্ত খনন করার পর যখন কোয়ারীতে পানি উঠে যায়, তখনকার দৃশ্যটা একদম দেখার মতো! অসাধারণ লাগে! তারপর ‘শিবের নৌকা’ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনটাও দারুণ।
ত্রয়ী হা হয়ে তাকায় ইনানের দিকে। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আপনি দেখেছেন?
-অনেকবার!
-আমারও দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। খুব খুব।

ইনান হাসে,
-এখন তো ভালোভাবে দেখা যাবে না বোকাপাখি। আচ্ছা, পাথর উত্তোলনের সময় আমি আবার জানাবো তোমায়, কেমন? তুমি তোমার ফ্যামিলি বা ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরে যেও?
শুকনো চেহারায় মাথা নাড়ায় ত্রয়ী,
-ঠিক আছে।
অথচ ওর মন বলছে,
“যদি প্রত্যেকবারই ইনানের সাথে ঘুরতে যেতে পারতো,
তবে দু’জন একসাথে সব সৌন্দর্য উপভোগ করতো!”

_____________________________________________________
বেলা পড়ে আসছে! মুহুর্তরাও থেমে নেই। যাওয়ার সময় হয়ে গেলো বলে।

ইনান আর ত্রয়ী দুজনেই এখন ফেরার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলো। হঠাৎ একটা পাথরের দিকে নজর যায় ইনানের। ও চমকিত চক্ষে একটা অবাক হওয়ার হাসি দিয়ে এগিয়ে যায় ওটার দিকে। ত্রয়ী কিছু বুঝে উঠে না।

ইনান পাথরটা হাতে নিয়ে হেসে ত্রয়ীর উদ্দেশ্যে বলে,
-ত্রয়ী দেখো! হার্ট শেইপড স্টোন!
হৃৎপিণ্ড আকারের পাথর শুনে ত্রয়ীও দ্রুত ইনানের কাছে গিয়ে পাথরটা হাতে নিতে চায়। ইনান পাথরটা ত্রয়ীকে হস্তান্তর করে বলে,
-দারুণ নাহ?
-মারাত্মক!

আসলেই কত্ত সুন্দর পাথর! বেশি ছোটও না, বড়ও না। তবে হাতের মুঠোতে ঢিলাঢালাভাবে খুব সুন্দর এটে যায়। ত্রিমাত্রিক একটা শ্বেতপাথর, যেটা দেখে মনে হচ্ছে, ঠিক যেমন কারোর স্বচ্ছ হৃদয়।

ত্রয়ী বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে। এটা সে এখন ওদের সাথে নিয়ে যাবেই। ইনান ত্রয়ীর হাত থেকে পাথরটা নিয়ে কিছুটা দূরত্বে ছুড়ে ফেলে দেয়,
-উহু.. বাদ দাও! যেখানের জিনিস, সেখানেই সুন্দর। ও থাকুক ওদেরই মধ্যিখানে।

বলেই ও আবার হাঁটা ধরে। কিন্তু ত্রয়ীর হৃদয় তো মানে না। ওর তো খুব মনে ধরেছে পাথরটা! স্মৃতি হিসেবে হলেও, ও এটা ওর সাথে করে নিয়ে যেতে চায়। ইনানের সাথে একাকী ঘুরতে আসার এক সাক্ষী যে এটা!

ত্রয়ী পেছন থেকে লুকিয়ে আবারো ভেংচি কাটে ইনানকে,
“এহ! এত্ত সুন্দর একটা ব্যতিক্রমী পাথর! হাজারে-লাখেও একটা পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ! আর এটা নাকি এখানে এভাবে ফেলে যাবে? হুহ মোটেই না! এটা আমি নিয়েই যাবো!”

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। পাথরটা আবার কুড়িয়ে নেয় সে। মুঠোতে নিয়ে একটা বিশ্বজয়ী হাসি দেয়।

ইনান ত্রয়ীকে পাশে না দেখে পিছন ফিরে ডাক দেয়,
-এই কী হলো? আসো? জলদি ফিরতে হবে তো।
ত্রয়ী অপ্রস্তুত হয়ে মুহুর্তেই হাতটা পেছনে নিয়ে পাথরটা লুকিয়ে নেয়। আর আমতা আমতা করে জবাব দেয়,
-এ.. হ্যাঁ! আ-আসছি!

ত্রয়ী চারদিকটা আবার চোখ বুলিয়ে নেয়। ওর যেতে মন চাইছে না এই যাদুর স্থানটা থেকে। ইচ্ছে করছে, এখানেই পড়ে পড়ে আজীবন প্রকৃতির সৌন্দর্য লুটুক! প্রতি মুহুর্তেই উপভোগ করুক সব নতুনের মতো!

কিন্তু যেতে তো হবেই। উপায় নেই। মনের ভেতর এক রঙিন ছবি এঁকে নিয়েই ফিরে যেতে হবে। এই সৌন্দর্যের রেশ যে কবে কাটবে, জানা নেই ত্রয়ীর। আদৌও কাটবে কি-না কভু, তাও জানে না সে।
ইনানের পাশে হেঁটে যেতে যেতে আবার প্রাণভরা একটা নিঃশ্বাস নেয়। আর চোখ বন্ধ করে ভাবে,
জীবনের একটা চমৎকার অধ্যায় কাটালো সে আজ! ইনানকে নিয়ে, এই সাদা পাথরের দেশে..
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here