বেখেয়ালি মনে পর্ব-৬

0
819

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-০৬
.
.

গ্রামে আসার পর থেকে ত্রয়ী কেমন মন উদাসী হয়ে উঠেছে। আনমনে সারাক্ষণ ভাবনার জগতে ডুবে থাকে। ত্রয়ীর দাদার বিশাল নারিকেল বাগান আছে। বাগানটা পুকুরের ডান পাশে। ত্রয়ী বাগানে বসে হাতে কাঠি নিয়ে মাটিতে ইনানের নামের প্রথম অক্ষরটা লিখছে। আর একমনে মিটমিট করে হাসছে।

ইনান হন্তদন্ত হয়ে ত্রয়ীর কাছে আসে। পিছন থেকে নিচু স্বরে ডাকে,
-ত্রয়ী!
পিছন থেকে স্পষ্ট কোনো পুরুষ কন্ঠ পেয়ে ওর অবচেতন মনে হালকা মৃদু হাওয়া দোল খায়। অজানা কন্ঠটি অনুসরণ করে পিছন ফিরে তাকায়। উৎফুল্ল কন্ঠে বলে,
– জ্বি! কিছু বলবেন?
ইনান নিজের ঘাড় ম্যাসেজ করতে করতে বলে,
-গ্রামটা ঘুরে দেখার ভীষণ ইচ্ছে জাগছে।

ত্রয়ীর উৎফুল্ল মন নিমিষেই চুপসে যায়। গত পাঁচবছর সে এই গ্রামে আসেনি। এসেছিলো সেই পিচ্চি বেলায় সে নিজেও তো এই গ্রামের আনাচে-কানাচে কী আছে তা জানেনা। পথ-ঘাটও অচেনা। কীভাবে সে এই মানুষটার আবদার পূরন করবে? এমন চিন্তায় ওর মন খারাপ হয়ে যায়।

ইনান পুকুরের একদম কিনারের নারিকেল গাছটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ত্রয়ী চুপ করে আছে দেখে আবার জিজ্ঞেস করে,
-কী হলো বোকাপাখি?

ত্রয়ী তবুও নিশ্চুপ। ইনান আর কিছু বলেনা। মাটি থেকে এক টুকরো মাটি কুড়িয়ে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে। ঢিল ছুঁড়ার শব্দ পেয়ে ত্রয়ী কেঁপে উঠে। গলা টেনে লম্বা করে বলে,
– আ-আ-আসলে আমার নিজেরও গ্রাম ঘুরে দেখার খুব ইচ্ছে। কিন্তু আমিও তো গ্রামের কিছু তেমন চিনিনা।

ইনান হাসলো। বলল,
– তোমাদের গ্রাম আমি তোমাকেই ঘুরে দেখাবো।
ত্রয়ী অবাক হয়। বিচলিত কন্ঠে বলে,
– কীভাবে? আপনি কি এই গ্রামে আগেও এসেছেন?
ইনান মাথা নাড়িয়ে বলে,
– না।
-তাহলে?
ইনান একপাশে ঠোট ছড়িয়ে এক হালকা হাসি হাসে। ত্রয়ীকে আরো বিব্রতবোধ করাতে বলে,
– ম্যাজিক! ম্যাজিক! “চ্যাংকুলি কি ম্যাংকুলি.. ছু!” হাহাহা.. বিকেলে রেডি থেকো আমরা বের হবো।

ত্রয়ী আরো আগ্রহ নিয়ে বলে,
– শুধু আমরা দু’জন?
ইনান হাতের ঘড়ি ঠিক করে বলে,
– তুমি চাইলে অন্যরাও যেতে পারে।
ত্রয়ী মুখ বাঁকিয়ে বলে,
– না, আর কেউ যাবেনা। শুধু আমি আর আপনি থাকবো। কিছু মুহুর্তের জন্য হলেও আপনার সাথে একা থাকতে চাই।
শেষের লাইন দু’টো বিড়বিড় করে বলে। ইনান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,
– কী?
– কিছুনা।
তারপর, অন্যদিকে ফিরে বুকে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ে।

কিছুক্ষন পর দু’জনের মাঝে উপস্থিত হয় হিমা। হিমাকে দেখে ত্রয়ীর মনে আঁধার নেমে আসে। হিমা ইনানকে দেখে লজ্জা পায়। ইনান হিমার চোখাচোখি হয়। ইনান চোখ সরিয়ে নেয়। কেন জানি এই মেয়েটার সামনে ইনান পড়তে চায় না। এমন নয় যে হিমা ইনানকে কিছু বলেছে। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো কথা হয়নি। তবুও হিমা ইনানের সামনে আসলে ইনানের অস্বস্তি হয়।

হিমার সামনে থেকে সরে যাওয়ার জন্য ইনান বলে,
– বোকাপাখি, এখন বরং আসি। একটা আর্জেন্ট কল করতে হবে।
ত্রয়ী নিজেও চাচ্ছিলো যাতে ইনান এখন এখান থেকে সরে যায়। ইনানকে সরানোর জন্য মনে মনে আইডিয়া বের করছিলো। কিন্তু কোনো কিছু ভাবার আগেই ইনান নিজ থেকেই চলে যাচ্ছে। ইনানের কথা শুনে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
– হ্যাঁ! অবশ্যই, আসুন।

ইনান চলে যেতে নিলেই হিমা পিছু ডাকে।
– শুনুন!
ইনান চোখ মুখ খিঁচে হিমার দিকে তাকায়। বলে,
– জ্বি, কিছু বলবেন?
হিমা হেসে বলে,
– আজ বিকেলে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবেন?

হিমার কথা শুনে ইনান ত্রয়ী দু’জনেই বিরক্ত হয়।
এতোদিন হিমার জন্য ত্রয়ীর যে ভালোবাসা ছিলো তাতে ফাটল ধরতে শুরু করে। ইনানকে নিয়ে হিমার এমন আদিখ্যেতা ত্রয়ীর মোটেও ভাল্লাগে না।

ইনান কিছু বলার আগেই ত্রয়ী কিড়মিড় করে বলে,
– হিমাপ্পা.. ইনান ভাইয়া কীভাবে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে? উনি নিজেই তো এই গ্রামে প্রথমবার এসেছেন। গ্রামের কিছুই চেনেন না।

ত্রয়ীর কথা শুনে হিমার মুখ চুপসে যায়। বিষণ্ণ কন্ঠে বলে,
– ওহ! আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে ঢাকায় ফিরে আমরা ঘুরতে বের হবো, কেমন?

প্রশ্নচোখে ইনানের দিকে তাকায় সে। ইনান কী বলবে বুঝতে পারেনা। তবে এই মুহুর্তে হিমার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে এটা ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। জবাব দেয়,
– ঠিক আছে। ঢাকা গেলে তখন সেটা নিয়ে ভাবা যাবে।
ত্রয়ীর মনে জ্বালা ধরলেও সে এই মুহুর্তে সেটা চেপে যায়। তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে যায় ।

হিমা মুচকি হেসে ইনানকে বলে,
– থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ডিয়ার!
ইনান ভদ্রতা বজায় রেখে বলে,
– ওয়েলকাম।
__________________________________________________________

সুফিয়া খান দু’মেয়ের উপর খুব ক্ষেপে আছেন। ক্ষেপার কারণ হচ্ছে, বিদেশে থেকে থেকে তারা দেশের আদব কায়দা সব ভুলে গেছে। কাকে কীভাবে সম্মান করতে হয় তা জানেনা। কিন্তু ছোটো থেকেই সুফিয়া তাদের ভদ্রতা শিখিয়ে বড় করেছে। কিন্তু তারা ভদ্র হওয়ার বদলে দিনকে দিন অভদ্র হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে তিনি খুবই বিরক্ত। এক অসহায় ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তাদের কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য। এটা দেখে হিমা ঐ মহিলাকে বলে,
– আমরা দুটো দিনের জন্য গ্রামে এসেছি, আর আপনি চলে এসেছেন সাহায্য চাইতে। ডিজগাস্টিং!
হিমার কথার সাথে তাল মিলিয়ে ঝুমা বলে,
– হ্যাঁ, ঠিকই তো আমরা তো এখানে দান কর‍তে আসেনি। যত্তসব ভিখারির দল।
ভদ্রমহিলা এদের কথা শুনে চোখের পানি ফেলে চলে যায়।
সুফিয়া ঘরে গিয়েছিলেন টাকা আনার জন্য এই ফাঁকে মেয়েরা এমন কান্ড ঘটিয়ে বসেছে। তিনি হিমার কথা না শুনলেও ঝুমার বলা শেষ কথা টুকু শুনেছেন। সুফিয়া মেয়েদের বকছেন দেখে তনয়া এগিয়ে এসে বলে,
– থাক না ভাবি ছেড়ে দিন। এ যুগের মেয়ে ওরা এসব দান খয়রাত সম্পর্কে এতোটা অবগত নয় তাই ভুল করে ফেলেছে।
সুফিয়া বলে,
– এটাকে ভুল বলে না তনয়া। এটা অভদ্রতা। আর আমি ওদেরকে তো এই শিক্ষা দিয়ে বড় করিনি। ওরা বিদেশে বড় হলেও আমি ওদের দেশের শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলাম।
ত্রয়ী সবার মাঝে উপস্থিত হয়ে বুঝতে পারে হিমা, ঝুমা কোনো ভুল করেছে হয়তো। তাই চুপচাপ সবটা শুনে যাচ্ছে।
কিন্তু সুফিয়ার বকা যেনো থামছেই না। তাই ত্রয়ী বলে,
– জেম্মা ছেড়ে দাও। ওরা বুঝতে পারেনি। আর এমন হবে না দেখো।
সুফিয়া আরো রেগে বলেন,
– ওরা কোনোদিন বুঝবেনা। ওদের বাবার জন্যই এমন অভদ্র, অসভ্য হয়েছে দুটো।
হিমা বলে,
– প্লিজ মম, সব জায়গায় পাপাকে টেনে আনবে না। পাপা কী করেছে?
সুফিয়া কটমট করে বলেন,
– সে তোদের এসব অভদ্রতাকে আশকারা দেয়। আমি কাকে কী বলবো, এখন কি সেটাও তুই আমাকে শিখিয়ে দিবি?
পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে ভেবে তনয়া হিমা আর ঝুমাকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। ত্রয়ী সুফিয়ার জন্য পানি নিয়ে এসে বলে,
– জেম্মা পানি খেয়ে নাও, ভালো লাগবে।
ত্রয়ীর আচার ব্যবহার দেখে সুফিয়া অবাক হয়। মনে মনে তার মেয়ে দুটোর জন্য আফসোস করেন। ত্রয়ীও তাদের বোন, সে বিদেশ না থাকলেও শহরে থেকে বড় হয়েছে। অথচ, মেয়েটার মনে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। কি সাবলীল ভাবে সবাইকে কাছে টেনে নেয়। ধনী-গরিবের মাঝে কোনো ভেদাভেদ করেনা। এমন মেয়ের জন্য মন থেকে দোয়া আসে। সুফিয়া ত্রয়ীর আনা পানি খেয়ে নেয়। তারপর ত্রয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
– অনেক বড় হ মা। অনেক বড় হ।
সুফিয়ার এমন অদ্ভুত ব্যবহার ত্রয়ী বুঝলোনা। তবে উনার করে দেওয়া দোয়ার জন্য মৃদু হাসল।

_________________________________________________________

বিকেলে ত্রয়ী মেরুন রঙের একটা লং স্কার্টের সাথে হোয়াইট রঙের টপস পড়ে। ত্রয়ীর চুল একদম সোজা না আবার একদম কোঁকড়াও না। হালকা কোঁকড়ানো তার চুল তবে খুব ঘন। চুলগুলো উপরে উঠয়ে ঝুটি করে নেয় সে।
কপালে টিপ পড়ে হালকা লিপষ্টিক লাগিয়ে নেয় ঠোঁটে।
ইনান ওয়েট করছে তার জন্য গ্রামের শেষ রাস্তার মোড়ে। ত্রয়ী মাকে বলে বের হয়েছে যে সে পাশের বাড়ির সোনিয়ার সাথে আড্ডা দিতে যাচ্ছে। ফিরতে সন্ধ্যা হবে। এই টুকু সময় যেনো তাকে কেউ খোঁজাখুঁজি না করে।
ইনানের কাছে আসতেই ওর ধুকপুকানি বেড়ে যায়। ইনান পড়েছে ব্ল্যাক শার্ট। হাতে ঘড়ি। চোখে সানগ্লাস। চুলগুলো এখনো কপাল অবধি এসে রয়েছে। সেই মন মাতানো হাসি লেগে আছে ঠোঁটে।
ত্রয়ী কাছে আসতেই ইনান বলে,
– এতো সাজার কোনো দরকার ছিলো না। তোমাকে এমনিতেই দারুন লাগে।
ইনানের মুখে তাকে দারুন লাগে কথাটা শুনে ত্রয়ীর দম বন্ধ হয়ে আসে। নিজেকে ছন্নছাড়া মনে হয়। পাগল করা এক অনুভূতি হৃদয়ের গহীনে উঁকি দেয়। ইচ্ছে করছে লোকলজ্জার ভয় ভুলে গিয়ে ইনানের বুকে জাপটে পড়তে। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব নয়। এটা করলে গ্রামের সবার কাছে সে কলঙ্কিনী হয়ে যাবে। এই মুহুর্তে ইনানের দিকে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকাটাও উচিত হচ্ছে না তার। তাই আপন মনে নিজেকে বলছে,
– এমন করিস না ত্রয়ী। এভাবে মনের ঘরে পরপুরুষের চিন্তা জাগতে দিস না! দিস না। দিবারাত্রির ঘুম হারাম হয়ে যাবে যে।
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here