ব্যবধান ( চতুর্থ পর্ব )

ব্যবধান ( চতুর্থ পর্ব )
শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য

নার্সিংহোম থেকে সকাল সকাল কৌস্তভকে নিয়ে ঘরে পৌঁছাল দীপশিখা। সামনের ঘরটায় থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে কৌস্তভের। আগেরদিন নিজে হাতে খুব যত্ন করে শিখা গুছিয়েছে ঘরখানা। পরিপাটি করে বিছানা করা। সাদা ধবধবে পাট ভাঙ্গা চাদর পাতা খাটে। খাটের পাশেই খাওয়ার জলের জাগ সাথে গ্লাস। সুলেখাদেবীর কাছ থেকে নিয়ে আসা কৌস্তভের জামকাপড়গুলো ওয়ারড্রবে সুন্দর পাটে পাটে গোছান। জানলার পর্দাগুলো একপাশে সরিয়ে দেওয়া, মুক্ত আলোবাতাসের জন্য।

ঘরে ঢুকেই বহুদিন বাদে সেই পূর্ব পরিচিত পরিবেশের অনুভূতি পেলো কৌস্তভ। একটা ভালোলাগার স্নিগ্ধ বাতাস চকিতে দোলা দিয়ে গেল মনকে। কৌস্তভের প্রতি যত্নের কোনদিনও ত্রুটি ছিলোনা শিখার। আজও নেই। চাইবার আগেই প্রয়োজনীয় জিনিস হাতের কাছে পেয়ে যাওয়াটাই কৌস্তভের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আজও ঘর ময় সেই যত্নেরই ছাপ সর্বত্র। পাশের রুম থেকে শুনতে পাচ্ছে, ছেলেটার হাসি, আদো আদো বুলি। খেলনার টুংটাং শব্দ। বুঝতে পারছে, কিছু খেলনা নিয়ে খেলায় মেতেছে সে। আর তাতেই তার হাসি আর ধরেনা। মুহূর্তেই একটা আনন্দ, ভালোলাগা অনেকখানি সতেজ করে দিল কৌস্তভের মনকে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল হৃদয় জুড়ে।

কৌস্তভকে ঘরে পড়বার জামাকাপড় এগিয়ে দিয়ে শিখা বলল—-” তুমি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি ততক্ষণে তোমার চা বানিয়ে আনি।“
কৌস্তভ বাথরুমে চলে গেলে, শিখা রান্নাঘরে ঢুকলো। টুলুমাসি দুপুরের রান্নায় ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর দুকাপ চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে, পাশের ঘরে ছেলের কাছে বসে আছে কৌস্তভ। দুহাতে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে, অপলক নয়নে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। রণ নিজের ছোট ছোট দুহাতে বাবার মুখের ওপর হাত বুলিয়ে কি যেন বোঝবার চেষ্টা করছে। ঝরঝর করে দুগাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে কৌস্তভের। শিখা ঘরে ঢুকতে গিয়েও, সরে এল। কৌস্তভের এই দুর্বল মুহূর্তে ঢুকে, ওকে অস্বস্তিতে ফেলতে চায়নি শিখা। খানিকবাদে মৃদু গলাখাঁকারি দিয়ে আস্তে আস্তে প্রবেশ করলো ঘরে। কৌস্তভ ততক্ষণে চোখের জলটা মুছে, নিজেকে সংযত করে ফেলেছে অনেকটা। শিখাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সামান্য হেসে বলল—-” এত তাড়াতাড়িই চা হয়ে গেল তোমার?”
—–” দুকাপ চা বানাতে কতটুকু আর সময় লাগে? তুমি লক্ষ করেছো কৌস্তভ, এতদিন পরেও রণ কিন্তু ঠিক তোমায় চিনতে পেরেছে।”
শিখার কথায় ম্লান হেসে কৌস্তভ বলল—–” জানো শিখা, ছেলেটার পাশে বসে আমি খুঁজছিলাম, রণর এত খেলনার মধ্যে কোন খেলনাটা আমার দেওয়া। এমন একটাও খেলনা পেলাম না খুঁজে, যেটা আমার কেনা। তারপর খেয়াল হলো ছেলেটাকে হাতে করে কোন খেলনা কখনতো দিইনি আমি। কেমন অদ্ভুত বাবা আমি! ছেলেটারই দুর্ভাগ্য!”

কৌস্তভের করুণ মুখের দিকে চেয়ে শিখা বেশ বুঝতে পারছে, অনুশোচনায় আজ দগ্ধ হচ্ছে কৌস্তভের হৃদয়।
কথাটা ঘোরাবার জন্য শিখা অন্য প্রসঙ্গ আনলো—-” আজ দুপুরে কি খাবে বল? ঝিরঝির করে বেশ বৃষ্টি পড়ছে, খিচুড়ি বসিয়ে ফেলি?”
কৌস্তভ হেসে বলল—-” তুমি তো জান, খিচুড়ি হলে আমার আর কিচ্ছু চাইনা।“
উৎসাহিত হয়ে উঠল দীপশিখা—-” মনে আছে কৌস্তভ, বিয়ের পর একবার টানা সাতদিন ধরে বৃষ্টি পড়েছিল। তুমি সাতদিনই খিচুড়ি করিয়েছিলে আমায় দিয়ে। খিচুড়ির সাথে কোনদিন ইলিশ মাছ ভাজা, কোনদিন পাবদা মাছ, কোনদিন আবার কষা আলুরদম। জমিয়ে খাওয়া হয়েছিল সেবার। শেষে মায়ের ধমক খেয়ে, আটদিনের দিন বাড়িতে ভাত হলো। কত আনন্দের ছিল বল সেই—-“পুরো কথা শেষ হলোনা। থমকে গেল শিখা। উচ্ছাসের আধিক্যে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে বাধ না মানা স্রোতস্বিনীর মত কৌস্তভের সামনে গড়গড় করে উগড়ে দিচ্ছিল, নিজের মনের গহনস্থলে সযত্নে লুকিয়ে রাখা ওর হৃদযের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সিঞ্চিত আবেগগুলো। কী বলছে এসব? স্বপ্নের ঘোর থেকে হঠাৎ করে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে আছড়ে পড়ল সে। খেয়াল হলো ও কার সামনে কী আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছে সেই থেকে! লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা নিয়ে উঠে পড়ল শিখা। কৌস্তভ দ্রুত শিখার হাতটা শক্ত করে ধরে, অনুনয়ের সুরে বলল— “চলে যেওনা শিখা। আরেকটু বসো আমার পাশে। আজ কতদিন বাদে এইভাবে দুজনে বসে গল্প করছি আমরা।“

শিখা লজ্জায় আনত চোখদুটো না তুলেই বলল—-” দেরি হয়ে যাচ্ছে কৌস্তভ। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।“— বলে আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

একসপ্তাহ কেটে গেছে। শিখার শুশ্রুষায় কৌস্তভ এখন অনেকটাই সুস্থ। শিখার স্কুলের ছুটিও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। প্রত্যেকদিনের মত টুলুমাসি রণকে নিয়ে বিকেলে ঘরের সামনের ছোট পার্কটায় গেছে বেড়াতে। শিখা নিজের ঘরে রণর বিকেলের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত। কৌস্তভ এসে দাঁড়াল দরজার কাছে।
—–” আস্তে পারি?”
শিখা হেসে বলল—“হ্যাঁ, এসো। এতে আবার জিজ্ঞেস করবার কি আছে?”
—– “ ছেলের খাবার তৈরি করছো?”
——” হ্যাঁ, টুলুমাসির সাথে ঘুরে এলে, মহাশয়কে খাওয়াতে বসতে হবে। একঘন্টা চলবে খাওয়া নিয়ে যুদ্ধ। তাই আগেভাগেই সেই যুদ্ধের প্রস্তুতি সেরে ফেলছি।“

—-” তোমার ধৈর্য্য আছে, মানতে হবে শিখা। কী অসীম ধৈর্য্য নিয়ে খাওয়াও ছেলেকে। এদিকে আমার জন্যও তোমার কাজের চাপ এখন কতটা বেড়ে গেছে। অনেকদিন তো অলসের মত আমিও ঘরে বসে রয়েছি। ভাবছি, কাল থেকে অফিস জয়েন করবো।“

—–” একদম নয়। আর কিছুদিন অপেক্ষা কর কৌস্তভ। বেশিক্ষণ হাঁটলে এখনও তোমার মাথা ঘোরে। তারপর কদিন অফিসে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে, সেটা কি ভালো হবে? তার চেয়ে আর কটাদিন বিশ্রাম নিয়ে, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে জয়েন করো।“

——” ঠিক আছে। তাই হবে।“
অনেক কথাই হচ্ছে, কিন্তু আসল যে কথাটা বলবার জন্য ও এঘরে এসেছে, সেটাই বলা হচ্ছেনা। উসখুস করছে মনটা। টুলুমাসি রণকে নিয়ে ফিরে এলে, আর বলাই হবেনা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর, বেশ একটু ইতস্তত করে সসংকোচে কৌস্তভ বলল—-” আমাদের বিবাহিত জীবনকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায়না শিখা? যে অন্যায় আমি করেছি, তার জন্য মনের অন্তস্থল থেকে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। প্রায়শ্চিত্ত করবার একটা সুযোগ, তুমি কি দেবেনা আমায়?”

কথাটা শুনেই বেশ গম্ভীর হয়ে গেল শিখা। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতার পর বলল—-” আমি এখন আমার এই একাকীত্বের জীবনে ভালোই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি কৌস্তভ। ছেলে রণ আর টুলুমাসিকে নিয়ে আমার জীবনটা কিন্তু মন্দ কাটছেনা। তোমার সাথে আবার সম্পর্কে জড়িয়ে, আবার আঘাত খাওয়ার মত মনের সাহস আমার আর অবশিষ্ট নেই কৌস্তভ। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস, ভরসা একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। আর কোনদিনও তা ফিরে আসবে বলেও মনে হয়না। তাই এই নিয়ে কথা বলে, দয়া করে তুমি আমায় বিব্রত করোনা।“

প্রত্যুত্তরে কৌস্তভ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, শুনতে পেলো দরজা খোলার আওয়াজ। টুলুমাসি রণকে নিয়ে পার্ক থেকে ফিরে এসেছে। কৌস্তভ তাড়াতাড়ি শিখার ঘর থেকে বেরিয়ে, চলে গেল নিজের রুমে।

টুলুমাসি রণকে কোলে নিয়ে গজগজ করতে করতে ঢুকল ঘরে—–” দিদিভাই তোমার দস্যি ছেলে নিয়ে আর আমি পারিনা। যতদিন যাচ্ছে, দস্যিপনা তার বেড়েই চলেছে।“
শিখা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রণকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল—” আবার কী কান্ড বাঁধিয়েছেন মহাশয়?”
ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলল টুলুমাসি–” আর বোলোনা। পার্কের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো আমায় সমানে দৌড় করিয়ে ছাড়লে। সেইথেকে একটুও বসতে দেয়নি কো। তোমার ছেলের জ্বালায় কোমরটা এবার আমার খসে পড়বে মনে হয়।“

রাতে শুয়ে কৌস্তভের কিছুতেই আর ঘুম আসছেনা। মনে খালি ফিরে ফিরে আসছে দীপশিখার বলা কথাগুলো। কতটা নিচে নেমে গেছে ও শিখার চোখে। আদৌ শিখার মনে কোনদিন আর নিজের জায়গা করতে পারবে সে? কোনদিন এই ভরসা দিতে পারবে যে আর কখনোই একাকীত্বের অন্ধকারে তোমায় ঠেলে দেবোনা। সব বিপদে ভরসা হয়ে পাশে থাকবো। নিজেকে প্রমাণ করবার একটা সুযোগ, শুধু একটা সুযোগ সে ভিক্ষা চায় শিখার কাছে। কিন্তু কী করে? এই কটাদিন স্ত্রী ও ছেলের সান্নিধ্যে এসে যে সুখ আর শান্তির আস্বাদ কৌস্তভ পেয়েছে, তাকে ওর লোভী মন হারাতে চায়না আর। এই সুখ আবার ফিরে পাওয়ার জন্য এখন সে অতিশয় উদগ্রীব। এই টান ছিন্ন করে কৌস্তভের পক্ষে আবার আগের সেই সর্বহারা শূন্য জীবনে ফিরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। নিজের ভাঙ্গা সংসার আবার জোড়া লাগাতে ও বদ্ধপরিকর। কিন্ত কী উপায়? কীভাবে শিখার মনে নিজের স্থান ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে? কীভাবে শূন্য থেকে আবার শুরু করবে সবকিছু? ( ক্রমশ )

https://www.facebook.com/107986137690507/posts/295927555563030/
তৃতীয় পর্বের লিঙ্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here