ব্যবধান ( তৃতীয় পর্ব )

ব্যবধান ( তৃতীয় পর্ব )
শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য

ঘরের কলিংবেলটা বাজতেই তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুললেন সুলেখাদেবী। দীপশিখা দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন—-” আমার ছেলে এখন কেমন আছে বউমা? ওর মাথার আর পায়ের ব্যথাটা কমেছে?“

—–” কৌস্তভ এখন অনেকটাই ভালো আছে মা। তুমি এত চিন্তা করোনা। তবে ওর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে, আরও বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আজ আমি সেই ব্যাপারেই তোমার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।“
——–“কী কথা বউমা?”
——–” কাল কৌস্তভকে নার্সিংহোম থেকে ছেড়ে দেবে। ওর ভালোভাবে দেখাশোনার জন্য আমি ঠিক করেছি, ওকে কটাদিন আমার কাছেই রাখবো। তোমার বয়স হয়েছে। ওর দেখাশোনা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেই ব্যাপারেই তোমার অনুমতি চাই।“

——” এতে আবার অনুমতি নেওয়ার কী আছে মা? তুমি কৌস্তভের স্ত্রী। নিজের কাছে রাখতেই পারো। আমার আপত্তি করবার তো কিছু নেই।“
——” তুমি ভুল বললে মা। আমি এখন কৌস্তভের স্ত্রী নই। ওর সাথে আর কোন সম্পর্কই নেই আমার। কৌস্তভ শুধুমাত্র এখন আমার সন্তানের পিতা। ব্যস, এইটুকুই সম্পর্ক ওর সাথে আমার জুড়ে আছে মা। কাজেই তোমার ছেলেকে নিজের কাছে রাখতে গেলে, তোমার অনুমতি নিতে হবে বৈকি।“

——-” এভাবে বলছো কেন বউমা! বাহ্যিক, লোক দেখানো আইনি সম্পর্কটাই সব হলো? মনের সম্পর্কটা কিছু নয়? তোমাদের মধ্যে সব সম্পর্কই যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে কৌস্তভের অ্যাকসিডেন্টের খবর পেয়ে পাগলের মত ছুটে গেছিলে কেন? কোন সম্পর্ক নেই জেনেও, নিজের কাছে রেখে ওর সেবা করতে চাইছো কেন? মনের টান থাকলে, ভালোবাসা থাকলে একটা সম্পর্ক ভেঙ্গেও ভাঙ্গে না বউমা।“

——-” কিন্তু একতরফা মনের টান দিয়ে কী হবে মা? আমার জন্য মনের টান কোনদিনও অনুভব করেছে তোমার ছেলে? স্ত্রী-পুত্রের জন্য ওর মনে কোনই স্থান নেই, ভালোবাসা নেই। নাহলে দেড়বছরের বাচ্চার কথা ভুলে, স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে পারতোনা কখনোই।“

——–” আমি জানি বউমা। যে অপরাধ আমার ছেলে করেছে, তার ক্ষমা হয়না। তবে একটা কথা তোমায় আজ জানাই, বিগত ছমাস ধরে কৌস্তভের অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি আমি। এখন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে হুল্লোর করেনা। আর ওই ছাইপাসও গেলেনা। সর্বক্ষণ কেমন আনমনা, উদাস হয়ে থাকে। বুঝতে পারি কিছু একটা ঝড় তোলপাড় করছে ওর মনের ভেতর। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। কোন উত্তর দেয়না। মৃদু হেসে এড়িয়ে যায়। তবে মায়ের মন তো, সবই বুঝতে পারি। তোমাদের হারিয়ে তোমাদের অভাব এখন ও ভীষণ ভাবে অনুভব করছে। নিজের সন্তানকে, স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্খা দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ওর হৃদয়ে। অথচ মুখে ফুটে কিছু বলতেও পারছেনা। যে অন্যায় ও করে ফেলেছে, তারপর কোন মুখে আর নিজের এই ইচ্ছে প্রকাশ করবে? দিন দিন শরীরখানা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে ছেলেটার। মুখের দিকে আর তাকাতে পারিনা। বউমা, তুমি পারোনা, আমার ছেলেটাকে নিজে গুণে ক্ষমা করে দিতে? আবার ফিরে আসতে ওর জীবনে?”

দীপশিখা সুলেখাদেবীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে একটু হেসে বলল—–” তুমি একজন মা হয়ে নয়, একজন মেয়ে হয়ে বলতো মা, এতকিছুর পরেও আমার কী উচিত তোমার ছেলের জীবনে আবার ফিরে আসা? নিজের সব মান-অপমান-অভিমান ভুলে, কৌস্তভকে ক্ষমা করে দেওয়া কী এতটাই সহজ?”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন সুলেখাদেবী। আর কোন অনুরোধ করলেন না। শিখার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন—-“আমি বুঝি বউমা। আমার ছেলে তোমার অপরাধী। এ ব্যাপারে তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই হোক। আমার আর কিছু বলবার নেই। তবে আমার মনে হয়, যে মানুষ নিজের ভুল বুঝতে পেরে তা শোধরাতে চায়, তাকে একবার সে সুযোগটা দেওয়া উচিত।“

আজ স্কুলে ঢুকেই শিখা বড়দির কাছে ছুটির দরখাস্তটা দিয়ে দিল। প্রথম পিরিয়ডের বেল বেজে গেছে। নিজের ক্লাসে ঢুকতে যাবে, পেছন থেকে ডাকলো দীপশিখার কলিগ তথা বান্ধবী তনিমা।
——-” শিখা, কাল থেকে শুনলাম তুই নাকি ছুটি নিচ্ছিস। কিন্তু হঠাৎ কেন? তোর শরীর ঠিক আছে তো?”
——” আমি ঠিক আছি। শুনেছিস তো কৌস্তভের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। শরীরটা ওর একদম ভালো নেই। ভালো ভাবে রিকভারি হচ্ছেনা। তাই ভাবছি, ওকে আমার কাছে নিয়ে এসে কটাদিন ছুটি নিয়ে ওর দেখাশোনা করবো।“

শিখার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল তনিমা। ———-“বাবা! তোর কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাচ্ছিনারে শিখা। যে মানুষ তোকে বিনা কারণে কোলের ছেলে সহ ডিভোর্স দিয়ে দিতে একবারও দ্বিধা করলোনা, তুই তাকেই ঘরে এনে সেবাযত্ন করবি? তোর কি মান অপমান কিছুই নেই। অদ্ভুত! তুই পারিস বটে।“

——” হ্যাঁ রে, ঠিকই বলেছিস তুই। মান-সম্মানটা আমার বড়ই কম। নিজের ভালোবাসার কাছে বড় অসহায় আমি। আসলে কি বলতো, আমার মস্তিষ্ক আর মনের দ্বন্দ্বে আমার ক্ষেত্রে বরাবরই দেখেছি, মনেরই জয় হয়। আমি মস্তিষ্ক থেকে মনের কথা শুনতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। তাই মনে হয়েছে, যে মানুষটাকে ভালোবেসেছি, তার সুখে নয়, তার বিপদে অন্তত তার পাশে থাকবো আমি। কৌস্তভের উপর অনেক রাগ, অনেক অভিমান করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তবুও তো পারছিনা যে।“

———” তাই ঘরে এনে সেই স্বার্থপর মানুষটার সেবা করতে হবে, এই তো? তবে একটা কথা ভালোভাবে জেনে রাখ শিখা, এইধরনের মানুষেরা কখনও বদলায় না। কৌস্তভ সব সময়ই তোর ভালোবাসার সুযোগ নেবে, দেবে না কিছুই।“

স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে, টুলুমাসির দেওয়া টিফিন নাকেমুখে গুঁজে শিখা চলে এল নার্সিংহোমে। দেখে, কেবিনের সামনের প্যাসেজটায় আস্তে আস্তে হাঁটছে কৌস্তভ।
——” সেকি! এভাবে একা একা হাঁটছো কেন কৌস্তভ? কাউকে তো ডাকতে পারতে?”
——-” ইচ্ছে করেই ডাকিনি। আমাকে তো এবার চেষ্টা করতে হবে, উঠে দাঁড়াবার। আর কতদিন এভাবে পড়ে থাকবো বলো? তুমি এসেছে যখন, আমায় একটু বেডের কাছে নিয়ে চল। অনেকক্ষণ হেঁটেছি, এবার একটু বসব।“

কৌস্তভকে ধরে বেডে বসিয়ে দিয়ে শিখা বলল—–” তোমায় কাল ডিসচার্জ করে দেবে, জানো তো কৌস্তভ?”
—–” হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু রাউন্ডে এসে বলে গেলেন। আচ্ছা, আমার ড্রাইভারের অবস্থা কেমন তুমি জানো কিছু?”
——” হ্যাঁ, সে এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। তবে এরপরেও যদি ও নিজেকে না শোধরায়, ভবিষ্যতে ওর কপালে অশেষ দুঃখ আছে। তবে তুমি কিন্তু ওকে আর রাখবেনা। ওর চিকিৎসার সব খরচ দিয়ে ওকে বিদেয় করো।“
কৌস্তভ একটু হেসে বলল—-” আমার জন্য এখনও এত চিন্তা করো শিখা?”
ম্লান হেসে শিখা বলল——” হ্যাঁ, করি। এটাই যে আমার স্বভাব। চেষ্টা করেও বদলাতে পারিনা কিছুতেই। পারলে হয়তো ভালো হতো। যাক সেসব কথা। তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি ঠিক করেছি, কটাদিন তোমায় আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবো। তোমার শরীরের অবস্থা এখনও ভালো নয়। মায়ের বয়স হয়েছে। তাঁর পক্ষে তোমার দেখাশোনা সম্ভব নয়। তাই কটাদিন তুমি আমার কাছে থেকে, সুস্থ হয়ে তবে বাড়ি ফেরো।“

কৌস্তভ একটু বিস্মিত হয়ে বলল—-” আমি তোমার কাছে গিয়ে থাকবো?
—-” হ্যাঁ, কেনো? আপত্তি আছে তোমার?
—–” না না আমার আবার কিসের আপত্তি? আপত্তি তো তোমার হওয়ার কথা শিখা। আমার মত এমন একজন স্বার্থপর মানুষকে তুমি দয়া করবে কেন?”

——-” বললাম না। আমি আমার স্বভাবের দাস। তবে আমি তোমার উপর কোন দয়া করছিনা কৌস্তভ। এটা আমার বিবেক। তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই থাকতে পারে। কিন্তু তুমি যে আমার সন্তানের পিতা, তাতো অস্বীকার করতে পারবোনা কোনদিন। তাই সুখে না হলেও, বিপদে সবসময়ই তুমি আমায় পাশে পাবে কৌস্তভ।“

কথা বলার ভাষা নেই কৌস্তভের। চোখের অশ্রুবিন্দুগুলো শুধু কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য অনবরত ভীর করে আসছে দুচোখে। এতটা বদান্যতা তো ওর প্রাপ্য নয়। আজ ওর হৃদয়ে শুধু হারিয়ে ফেলার হাহাকার। চিৎকার করে ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছে, ফিরে এসো শিখা আমার জীবনে। সারাটা জীবন বুকে আগলে রাখবো তোমায়। ওর মনের যন্ত্রণাটা একবার যদি শিখা দেখতে পেতো। স্বচক্ষেই দেখছে বুঝছে, দিনের পর দিন যে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেতে ছিল, আজ এই বিপদের দিনে তাদের একজনেরও দেখা নেই। সব ছিল সুখের পায়রা। বিপদে সব উধাও। পাশে রয়েছে সেই অবাঞ্ছিত, অবহেলিত স্ত্রী শিখা। নিঃস্বার্থভাবে সেবা করে যাচ্ছে যে। অথচ সেই মানুষটাকেই ডিভোর্স দিয়ে কত সহজে নিজের জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলেছিল কৌস্তভ। এই ভুলের জন্য যে কোন ক্ষমা হয়না। লজ্জায় আজ ওর নিজের অস্তিত্বটাই মনে হচ্ছে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। শিখার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়ার সাহসটাও বা সঞ্চয় করবে কি ভাবে? কোন স্তুতিবাক্যে নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করবে আজ? ( ক্রমশ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here