ব্যবধান (পঞ্চম পর্ব )
শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য
ব্যস্ততার মধ্যে পার হয়ে গেলো আরও দুটোদিন। কৌস্তভের মাথার আর পায়ের ব্যথাটা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। সকাল থেকেই বর্ষার কালো মেঘ আজ আকাশ জুড়ে। বিকেলে বৃষ্টিটা একটু থামতে, টুলুমাসি পার্কে নিয়ে গেছে রণকে, তার বৈকালিক ভ্রমণে। কৌস্তভকে বিকেলের চা দিয়ে দীপশিখা দোতলায় এল, ওর ভাড়াবাড়ির মালকিন আরতিদেবীর হাতে এবারের বাড়িভাড়ার টাকাটা দিতে। ভীষণ মুখরা মহিলা। টাকা দিতে একদিনও দেরি হলে কথা শোনাতে ছাড়েননা। কলিংবেলটা টিপে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে শিখা। বাংলার পাঁচের মত বিদঘুটে একখানা মুখ করে বেরিয়ে এলেন আরতিদেবী। এই বাড়িতে আসাঅবধি কোনদিন এই মহিলার মুখে হাসি দেখেছে বলে দীপশিখার মনে পড়েনা।
হাসিমুখে দীপশিখা টাকাটা এগিয়ে দিয়ে বলল—–” মাসিমা, এমাসের বাড়ি ভাড়াটা।“
ভ্রুকুন্চিত মুখে টাকাটা হস্তগত করে আরতিদেবী বললেন—-” শোন শিখা, একটা কথা তোমায় বলব ভাবছিলাম, কিন্তু বলা আর হচ্ছিল না। আজ এসেছো যখন, বলেই ফেলি। যদি কিছু মনে না কর।“
—–” না না, কী বলতে চান, আপনি বলুন না মাসিমা।“
—–” আমি যতদূর জানি, তুমি তো ডিভোর্সি। স্বামীর ঘর তো করোনা। আলাদা হয়ে গেছ। তাহলে কী কারণে তোমার বর এতদিন ধরে এখানে পড়ে রয়েছে? এটা তো আমার ঠিক ভালো ঠেকছেনা। এটা একটা ভদ্র পাড়া। আমাদের বাড়ির একটা সুনাম আছে। এই বাড়িতে থেকে, এইধরনের নষ্টামি কিন্তু চলবেনা। “
কথাগুলো শুনে, মুহূর্তে শিখার চোখের সামনে যেন অন্ধকার নেমে এল। হাত-পা কাঁপছে থরথর করে। কথাগুলো হৃদয়ে যেন গরম শলাকার মত বিঁধলো। মুখ-চোখ আরক্ত হয়ে উঠেছে লজ্জায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। খানিকটা খাওয়ার জল পেলে বোধহয় একটু সুস্থ বোধ করে।
কান্নায় বুজে আসা ক্ষীণ কম্পিত গলায় দীপশিখা বলল—-” কিন্তু মাসিমা, কৌস্তভ আমার হাজবেন্ড। অ্যাকসিডেন্টে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে মানুষটা ফিরে এসেছে। শরীরের অবস্থা ভালো নয়। ওকে দেখাশোনার কেউ নেই। তাই কটাদিন আমার কাছে রেখে ওর দেখাশোনা করছি। এতে নষ্টামির আপনি কী দেখলেন?”
আরতিদেবী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন—–“ কীসের হাজবেন্ড তোমার? ডিভোর্স হয়ে গেছে, এরপর আর হাজবেন্ড বলে আদিখ্যেতা দেখিওনা। তোমার কাছে এখন ও পরপুরুষ ছাড়া কিছুই নয়। অতই যদি বরের সেবা করার ইচ্ছে তো শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাও না বাপু। সেখানে আর কেউ কিচ্ছুটি বলবেনা। সাধ মিটিয়ে বরের সেবা করো। কিন্তু এখানে এসব নোংরামি চলবেনা। হয় বরকে চলে যেতে বল। নয় এ বাড়ি ছাড়ো।“
সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে একতলায় নেমে এল শিখা। আরতিদেবীর কথাগুলো শোনার পর থেকেই গা টা কেমন ঘিনঘিন করছে। সারা শরীর গুলিয়ে কেমন পাক দিয়ে উঠছে। এতখানি অপমান! কৌস্তভের কাছে না গিয়ে, নিজের ঘরে এসে খাটের উপর বিধ্বস্তের মত বসে পড়ল। কতক্ষণ বসে আছে, খেয়াল নেই। সম্বিৎ ফিরলো কৌস্তভের ডাকে।
——-” কী হয়েছে শিখা? ঘর অন্ধকার করে এভাবে বসে আছো কেন? তোমার কী শরীরটা খারাপ লাগছে?“
তাড়াতাড়ি চোখের জলটা মুছে উঠে পড়ল শিখা। কিন্তু কৌস্তভের দিকে ফিরতে পারলোনা ভয়ে। ওর চোখমুখের অবস্থা দেখে, যদি কিছু সন্দেহ করে। আরতিদেবীর কথাগুলো কখনোই কৌস্তভকে বলবার নয়। ছেলের কনফ্লেক্সের কৌটোটা খুলে, ওর দুধ গুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু কোন কাজই ঠিক মত গুছিয়ে করতে পারছেনা। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
শিখার এই অসংলগ্ন আচরন দেখে কৌস্তভ ঠিকই বুঝতে পারছে, গুরুতর কিছু একটা হয়েছে। শিখা বলতে চাইছেনা। কৌস্তভ ভালোভাবেই জানে, শিখা ভীষণ চাপা স্বভাবের মেয়ে। শত কষ্ট পেলেও, নিজের মনের কষ্ট কাউকে মুখ ফুটে বলবেনা। শিখার এই দুর্বল মুহূর্তে, কাছে এসে আবেগের বশে দুহাতের বেষ্টনীতে শিখাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে জিজ্ঞেস করল কৌস্তভ—–” আমায় বলবেনা শিখা, কী হয়েছে? তোমার মুখটা এমন শুকনো কেন?”
কৌস্তুভের এই স্পর্শটাই আগুণে ঘৃতাহুতির কাজ করলো। এক ধাক্কা দিয়ে কৌস্তভকে দূরে ঠেলে, ছিটকে সরে গেল শিখা। প্রচন্ড রাগে চিৎকার করে উঠল—–” কোন অধিকারে আমাকে স্পর্শ করলে তুমি? একদম আমায় ছোঁবেনা। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে কৌস্তভ। তুমি এখন আমার কাছে পরপুরুষ ছাড়া কিছুই নও। তুমি স্পর্শ করলে, আমি অপমানিত বোধ করি।“
—–” আমি তোমার কাছে পরপুরুষ শিখা? আমি স্পর্শ করলে তুমি অসম্মানিত হও? এতটাই এখন পর আমি তোমার কাছে?”
——” পর নও তো কী? কীসের সম্পর্ক তোমার সাথে আমার? কোন অধিকার বলে নিজের আধিপত্য দাবি কর আমার উপর? সমাজের কাছে আমাদের সম্পর্কের আগে একটা ‘এক্স’ জুড়ে গেছে কৌস্তভ? সেটাকে আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবোনা।“
——” অবশ্যই পারবো। তুমি আমার সাথে ফিরে চলো শিখা। আমরা আবার নতুন করে পথ চলা শুরু করি। দেখ, আমাদের জীবন খুব সুখের হবে।“
একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল শিখার ঠোঁটে—–” সুখের বৈবাহিক জীবন, তোমার সাথে? আমি দুঃস্বপ্নেও তোমার সাথে সুখের জীবন কল্পনা করতে পারিনা কৌস্তভ। যে মানুষ কোলের ছেলে সহ নিজের স্ত্রীকে ঘর থেকে বার করে দিতে একবারও ভাবেনা, তার সাথে সুখের জীবন কল্পনা করা যায় কৌস্তভ? একবারও সেদিন ভেবে দেখেছিলে, যে মানুষ একা কখনও বাইরে বেরোয়না, স্কুল আর ঘরটুকুই যার জীবন, তাকে ডিভোর্সের ফরমান ধরিয়ে দিয়ে আশ্রয়চ্যুত করলে, সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ছোট্ট শিশু নিয়ে কী করবে? সেদিন আমার কলিগ তনিমা যদি ওর বাড়িতে আশ্রয় না দিত, তাহলে আমি কতখানি বিপদে পড়তাম, কল্পনা করতে পারো তুমি? এরপরে কোন মুখে বল, তোমার কাছে আবার ফিরে যেতে?”
——” আমি জানি শিখা, যে অন্যায় করেছি, তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য। মরমে মরে যাচ্ছি আমি। বড় দেরি করে বুঝলাম নিজের ভুলটা। বলনা শিখা, কী প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমায়? আমার কী শাস্তি চাও তুমি? তুমি যা চাইবে আমি সব করতে প্রস্তুত।“
——-” তাহলে এখান থেকে চলে যাও কৌস্তভ। এখন তুমি অনেকটাই সুস্থ। মনে হয়না তোমার দেখাশোনার জন্য আর আমার কোন প্রয়োজন আছে।“
শিখার দিকে বেশ কিছুক্ষণ বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কৌস্তভ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষীণ কম্পিত কন্ঠে বলল—-” আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছো শিখা? এতটাই তোমার রাগ, অভিমান? একটা প্রায়শ্চিত্তেরও সুযোগ দেবেনা আমায়?”
কোন কথা না বলে, মুখটা ঘুরিয়ে নিল শিখা। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে, কৌস্তভই কথা বলল আবার কিছুটা থেমে থেমে —–“ঠিক আছে। তুমি যা চাও, তাই হবে। আমি এখনই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। শুধু একটাই অনুরোধ, মাঝেমধ্যে ছেলেটাকে দেখবার অনুমতি দিও। বড় মায়া হয়ে গেছে ওর উপর।“
কথাটা শুনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল শিখার ঠোঁটে—-” দেড়বছর অবধি ছেলে তোমার কাছেই ছিল কৌস্তভ। তখন এই মায়া কোথায় ছিল তোমার? আজ মাত্র এই দশদিনেই কী এমন মায়া পড়ে গেল যে ছেলেকে না দেখে তুমি থাকতে পারবেনা? এই ‘ভালোবাসা’, ‘মায়া’ শব্দদুটো তোমার মুখে, বড় বেমানান, বড়ই হাস্যকর।“
——-” তাহলে ছেলেকে দেখবার অনুমতিটুকুও পাবোনা আমি?”
——” সেকথা আমি একবারও বলিনি কৌস্তভ। আমার সাথে সম্পর্ক না থাকলেও, ছেলের সাথে তোমার সম্পর্ক আজীবন থাকবে। তা কখনই আমি অস্বীকার করতে পারবোনা আর অস্বীকার করতেও চাইনা। তোমার আর ছেলের মধ্যে কখনই আমি বাধা হবোনা। তোমার যখন ইচ্ছে ছেলেকে দেখতে আসতেই পারো।“
——” যাক! এই দয়াটুকুর জন্য আর আমার মত একজন বর্বর মানুষকে এই কটাদিন এত যত্ন করবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। তোমার এই ঋণ জীবনে কখনও শোধ করতে পারবো বলে মনে হয়না।“—– বলে উচ্ছসিত ক্রন্দনের দুর্নিবার আবেগকে মনের কঠোর শাসনে অবদমন করে, শিখার রুম থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল কৌস্তভ।
দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ধপাস করে অবসন্ন মনে মাটিত বসে পড়ল শিখা। শূন্য ভাষাহীন চোখদুটোর দৃষ্টি বিহ্বল, উদাস। অসুস্থ মানুষটাকে এতগুলো বাজে কথা বলে দিয়ে তোলপাড় হচ্ছে হৃদয়। কিন্তু যে কথা একবার বলে ফেলেছে, তা আর ফিরিয়ে নেবে কীভাবে? শুনতে পেল দরজা খোলার শব্দ। একরাশ অভিমান নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কৌস্তভ। বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে শিখা। সববুঝেও ঠায় বসে রইল মাটিতে।
খানিক বাদেই দরজা ঠেলে রণকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো টুলুমাসি। দরজা খোলা দেখে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো—-” দরজাটা খোলা কেন দিদিভাই। বাইরে কেউ গেছে? কী জোরে বৃষ্টি পড়ছে। ছেলে কোলে নিয়ে কোনমতে পালিয়ে এলাম।“
শিখা নিরুত্তর। স্তব্ধ হয়ে তখনো বসে আছে মাটিতে।
টুলুমাসি ঘরে ঢুকে রণকে খেলনা দিয়ে খাটে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো—-” কী হয়েছে দিদিভাই? ঘর অন্ধকার করে এভাবে বসে আছ কেন? আর দাদাবাবুও বা কোথায় গেলেন? দেখছি নাতো ঘরে?”
——-” চলে গেছে।“
——কী? বাইরে কী মুসলধারে বৃষ্টি পড়ছে, দেখেছো? এই বৃষ্টির মধ্যে অসুস্থ মানুষটাকে যেতে দিলে কেন? আটকালে না কেন দিদিভাই?”
—–” যে থাকবার নয়, তাকে আটকে কী হবে টুলুমাসি? তার চলে যাওয়াই ভালো।“ ( ক্রমশ )