ব্যবধান ( প্রথম পর্ব )

ব্যবধান ( প্রথম পর্ব )
শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য

ধীরে ধীরে জ্ঞান ফেরে কৌস্তভের। চোখ মেলে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে যেটুকু বুঝতে পারলো, কোন এক নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে আছে সে। স্যালাইন চলছে হাতে। গায়ে হাত পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। আস্তে আস্তে ধোঁয়াশা কাটিয়ে, মনে পড়ছে সবকিছুই। অফিসের কাজে কলকাতায় আসবে বলে কাল নিজের শখের কেনা গাড়িখানা করে রওনা হয়েছিল। গাড়িটা প্রথম থেকেই চলছিল দ্রুত গতিতে। নতুন ছোকরা ড্রাইভারটাকে বহুবার বারণ করা সত্বেও, গতি কমায়নি। কোলাঘাটের কাছে একটা বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, গাড়ি গড়িয়ে পড়ে রাস্তার পাশে। কয়েক পাক খেয়ে ঢাল বেয়ে গাড়িটা দ্রুত নেমে যেতে থাকে নিচে। কিছু বুঝে ওঠবার আগেই, কৌস্তভের মাথাটা সজোরে ঠুকে যায় গাড়ির সামনের সিটের লোহার বিটটার সাথে। তারপর আর কিছু মনে নেই। ওর অতি শখের লাল রঙের অল্ট্রোজের মনে হয়, দুমড়ে মুচড়ে দফারফা হয়ে গেছে।

চারদিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে কৌস্তভ। বুঝতে পারছেনা নার্সিংহোমে কিভাবে এল? এই জায়গাটাই বা কোথায়? ঘাড় ঘুরিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতে যাবে, দেখতে পেল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে দীপশিখা। কিন্ত শিখা এখানে কিভাবে? কিছুই যে মাথামুন্ডু বুঝতে পারছেনা!
——- কেমন আছেন মিস্টার রয়? ব্যথাটা কী একটু কমেছে?”—– এগিয়ে এসে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তারবাবু।

প্রত্যুত্তরে সামান্য হেসে মাথা নাড়লো কৌস্তভ।
ডাক্তারবাবু এবার দীপশিখার দিকে ফিরে বললেন—-” এই তো উনি রেসপন্স করছেন। জ্ঞান ফিরে এসেছে। আর চিন্তার কিছু নেই। দুদিনের মধ্যেই ঘরে নিয়ে যেতে পারবেন।“

ডাক্তারবাবু রাউন্ডে চলে গেলে, একটা চেয়ার টেনে শিখা বসল কৌস্তভের বেডের পাশে।
কৌস্তুভ ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো—–” আমার অ্যাকসিডেন্টের খবর তুমি কী করে পেলে শিখা?”
—–তোমার মোবাইল থেকে স্থানীয় লোকেরাই আমার নাম্বারে ফোন করেছিল। তাই আমি জানতে পারি। সেখানে পৌঁছে তাদেরই সহায়তায় তোমায় নার্সিংহোমে ভর্তি করি। অবশ্য এর মধ্যে পুলিশও চলে এসেছিল। ড্রাইভারের অবস্থা বেশ গুরুতর। তাকে কলকাতার কোন এক হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে।“—— প্রেসক্রিপশনের সাথে ওষুধগুলো মিলিয়ে নিতে নিতে বলল দীপশিখা।

একটু ইতস্তত করে কৌস্তভ বলল—-” তোমায় খুব ঝামেলায় ফেলে দিলাম, বলো শিখা?”
——” এতে আবার ঝামেলা কিসের? তুমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরো, তাহলেই নিশ্চিন্ত হবেন মা। ভীষণ চিন্তা করছেন। তোমার জন্য ভেবে ভেবে খাওয়া‌-দাওয়ার ভীষণ অনিয়ম করছেন উনি।“
——” শুধু মা ভাবছে? তুমি আমার জন্য ভাবছো না শিখা? চিন্তা হচ্ছে না তোমার?”

একটু তির্যক হেসে শিখা বলল—-” এই দীপশিখার চিন্তায় কিইবা এসে যায় কৌস্তভ রায়ের? অতিতুচ্ছ এই মানুষটার ভাবনার কোন দাম আছে মোস্ট হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, এক্সট্রভার্ট কৌস্তভ রায়ের কাছে?”

প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কৌস্তভ। কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে শিখা বলল—-“এখন ছাড়ো এই সব অপ্রয়োজনীয় কথা। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে আসছে। আমি এখন আসি। কাজের মাসির কাছে ছেলেটাকে একা ফেলে রেখে এসেছি। আবার কাল সকালে আসবো।“——- বলে কৌস্তভের উত্তরের অপেক্ষা না করেই, বেরিয়ে গেল শিখা।

দীপশিখার চলে যাওয়ার পথের দিকে অপলক নয়নে চেয়ে রইল কৌস্তভ। অতীতের কত কথা মনে ভিড় করে আসছে। অতীতের স্মৃতিগুলো এখন বড় বিদ্রুপ করে অনবরত আঘাত হানে হৃদয়ে। নিজের করা ভুলগুলো বুকের ভেতর যেন শ্বাসরোধ করে চেপে বসে আছে। এই সেই দীপশিখা, যাকে একদিন অপমান করে ডিভোর্স দিয়ে ঘর থেকে একরকম বের করে দিয়েছিল কৌস্তভ।

গ্রামের মেয়ে দীপশিখা। ঘাটাল সাব ডিভিশনের বীরসিংহে ওর বাড়ি। তবে লেখাপড়ায় শিখা অত্যন্ত মেধাবী এবং স্বভাবে ততোধিক বিনয়ী। খড়্গপুরের এক সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। বাড়ি থেকে বাসেই রোজ যাতায়াত করে স্কুলে। কৌস্তভও থাকে খড়্গপুরেই। কৌস্তভের মা সুলেখাদেবী যখন ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন, তখন তাঁরই এক বান্ধবী দীপশিখার কথা বলেন। দেরি না করে ছেলেকে সাথে নিয়ে শিখার বাড়িতে একেবারে সশরীরে হাজির হন সুলেখাদেবী। শিখাকে প্রথম দেখেই ভারি পছন্দ হয় ওঁনার। একরকম পাকা কথা দিয়েই আসেন। কৌস্তভও আপত্তি করেনি। শিখা সুন্দরী, বিদুষী আপত্তি করবার কিছুই নেই। শুভ দিন দেখে বেশ ঘটাপটা করেই সম্পন্ন হয় বিয়েটা। কিন্তু বিয়ের এক-দুমাস পরেই দুজনেই বুঝতে পারে ওদের দুজনের স্বভাবে আকাশ পাতাল পার্থক্য। কৌস্তভ ভীষণ হুল্লোরে, উৎশৃঙ্খল। বন্ধু বান্ধব, আড্ডা, পার্টি, মদ নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। দীপশিখা ততটাই শান্ত, গম্ভীর, স্বল্পভাষী। ওই খানিকটা ইন্ট্রোভার্ট। কৌস্তভের এই উদ্দাম লাগামহীন জীবন ওর পছন্দ নয়। প্রথমে বন্ধুবান্ধবদের সমস্ত পার্টিতে শিখাকে নিয়ে যেত কৌস্তভ। কিন্তু সেখানে সবার সাথে একেবারেই নিজেকে মানাতে পারতোনা শিখা। এক কোনায় বসে থাকতো চুপ করে। কারো সাথে যেচে আলাপ করা তো দূর, কেউ পরিচয় করতে আসলেও কেমন থতমত খেয়ে যেত। শিখার এই আচরনে হাসির খোরাক হতো কৌস্তভ। তির্যক অবজ্ঞা সূচক টীকাটিপ্পনী দেওয়ার এমন সুযোগ কেউই হাতছাড়া করতোনা। গ্রামের মেয়ে বিয়ে করবার খেসারত গুনে গুনে দিতে হতো কৌস্তভকে।

অপমানিত কৌস্তভ ঘরে এসে নিজের সম্পূর্ণ রাগ উগড়ে দিত শিখার উপর। শুরু হলো দাম্পত্য কলহ। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো এই অশান্তি। অবুঝ কৌস্তভকে শিখা কিছুতেই বোঝাতে পারতোনা, যে সমাজে লেখাপড়ার চেয়ে মানুষের অ্যাটিচুডেরই মূল্য বেশি, সেই মূর্খ সমাজের জন্য নিজেকে বদলাবার কোন মানে হয়না। এই মদোন্মত্তো মানুষগুলোর জন্য নিজের এতদিনের শিক্ষা, রুচি কিছুতেই বদলাবে না সে। বেশিরভাগ দিন ড্রিঙ্ক করে বাড়ি ফিরতে শুরু করলো কৌস্তভ। অসংলগ্ন আচরন করতো শিখার সাথে। শিখা ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিলে, তা আরো তীব্র জ্বালা ধরাতো কৌস্তভের শরীরে। শিখার চাপা ঘৃণার দহনে জ্বলে, শিখার উপর ঝাঁপিয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতো কৌস্তভ। জোর করে শিখার শরীরে নিজের হাতের উদ্দাম স্পর্শে জাহির করতো নিজের পৌরষত্ব। কোন বাঁধা দিতোনা শিখা। বিছানায় পড়ে থাকতো শক্ত হয়ে। কৌস্তভ অনেকক্ষণ শিখাকে উত্তেজিত করবার বৃথা চেষ্টা করে, বিফল হতো। শিখার কঠিন অথচ ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে, নেশায় বেসামাল হতাশ কৌস্তভ আস্তে আস্তে এলিয়ে পড়তো বিছানায়।

অথচ বিয়ের পর এই শিখাই কৌস্তভের স্পর্শে একেবারে লজ্জাবতী লতাটির মতই গুটিয়ে মুখ লুকাতো কৌস্তভের বুকে। কত ভালোবাসা, কত আদর। রঙীন নেশার মত কেটে যেত দিনগুলো। তবে সময়ের সাথে সাথে পরতে পরতে খসে পড়তে লাগলো কৌস্তভের বাহ্যিক ভদ্রতার আবরণ। ধীরে ধীরে কৌস্তভের এই উৎশৃঙ্খল জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগল শিখা। মানিয়ে নিতে পারতোনা কিছুতেই। নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো ক্রমশ। যতই নিজেকে কৌস্তভের চেয়ে দূরে নিয়ে যেতে শুরু করলো, ততই বাড়তে লাগলো কৌস্তভের ব্যভিচার। প্রায়দিনই ঘরে বন্ধুবান্ধব ডেকে, শুরু হতো মাতালের হুল্লোর। সুলেখাদেবী অনেক বুঝিয়েও ছেলেকে সংযত করতে পারেননি। বরং তাতে কৌস্তভের জেদ বেড়েছে আরও দ্বিগুণ। সুরাহা হয়নি কিছুই।

সময়ের গতির সাথে তাল মিলিয়ে এইভাবেই কেটে গেল দুটো বছর। শিখার কোলে এখন ছমাসের সন্তান রণ। কিন্তু তাতেও কৌস্তভের কোন হেলদোল নেই। স্ত্রী পুত্রের চেয়ে বন্ধুবান্ধবদের প্রতি আকর্ষণটাই ওর বেশি। মানসিকভাবে ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে শিখা। বিশীর্ণ দেহখানা কৌস্তভের অত্যাচারি স্পর্শ থেকে মুক্তির জন্য ছটফট করছে। মনের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে তা আজ দুটি ভিন্ন মেরুতে পৌঁচেছে। তবুও ছেলের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের কথা ভেবে একরকম মুখ বুজেই পার করলো আরও একটা বছর। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলোনা। এক রাতে কৌস্তভ এসে সরাসরি জানাল ডিভোর্সের কথা। দীপশিখার সাথে থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছেনা। এই সম্পর্ক থেকে সে মুক্তি চায়। প্রচন্ড অভিমানে একবারও আপত্তি জানায়নি শিখা। অশ্রুসিক্ত নির্বাক চোখদুটো শুধু একটাই প্রশ্ন করছিল বারবার, আজ পর্যন্ত স্ত্রী হওয়ার কোন দায়িত্ব সে পালন করেনি? কোন কর্তব্যের অবহেলা করেছে সে? শুধু কৌস্তভের এই উৎশৃঙ্খলতা মেনে নিতে পারলোনা বলেই, এতসহজে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কৌস্তভ? নিজের ছেলেটার কথাও ভাবলোনা একবার?

দুপক্ষের সম্মতিতে মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেল। চোখের জল ফেলা ছাড়া সুলেখাদেবীর আর কিছুই করবার ছিলোনা। জেদি ও ব্যভিচারি ছেলের সামনে তিনি একজন অসহায় মা। কৌস্তভের সব অর্থসাহায্য প্রত্যাখ্যান করে কোলের ছেলে নিয়ে, শিখা উঠে এল এক ভাড়া বাড়িতে।

কয়েকমাস বেশ ভালোই কাটল কৌস্তভের। এখন সে নির্ঝঞ্ঝাট, ঝাড়া হাতপা। প্রাণ খুলে যা ইচ্ছে তাই করবে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বেশ কয়েকটামাস চলল লাগামহীন ফুর্তি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্রমশ ভাটা পড়তে শুরু করলো সেই উচ্ছাসে। অদ্ভুত এক শূন্যতা গ্রাস করতে লাগলো কৌস্তভকে। নিজের ঘরটা, বিছানাটা বড় খালি লাগে এখন। কেউ আর সেভাবে ওর খেয়াল রাখেনা। অফিস টাইমে জামা, জুতো, মোজা, রুমাল যথাস্থানে থাকেনা। আলমারিতে শার্টগুলো বড়ই এলোমেলো, অগোছালো। অফিস থেকে আসলে কেউ আর হাসিমুখে চায়ের কাপটা মুখের কাছে ধরেনা। মনখারাপের সময় কারোর ভালোবাসায় ভরা নরম ঠোঁটের স্পর্শ পায়না গালে। ছেলেটার হাসি, ছেলেটার কান্না সব যেন হারিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে। নিস্তব্ধ নিঝুম ঘরটা এখন যেন গিলে খেতে আসে ওকে। দুদন্ডও এখন টিকতে পারেনা ঘরে। কিন্তু যখন সব ছিল, তখন তার মর্ম বোঝেনি কৌস্তভ। অলীক আনন্দের পিছনে ছুটে বেরিয়েছে ক্রমাগত। আজ সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে তার মর্ম ব্যথা মর্মে মর্মে অনুভব করছে সে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে উদ্দাম উৎশৃঙ্খল জীবনে আর কোন উৎসাহ পায়না। আনন্দ পায়না। মন ছুটে যেতে চায় ছোট্ট ছোট্ট দুটি কোমল হাতের স্পর্শ পাওয়ার জন্য, একজনের ভালোবাসায় ভরা দুটো ঠোঁটের সুধা আহরণের জন্য। কিন্তু তা আবার ফিরে পাওয়ার সমস্ত পথ যে রুদ্ধ। নিজে হাতেই তা সারাজীবনের মত বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আফসোস করে লাভ কি? কোন অধিকারে দাঁড়াবে সে দীপশিখার সামনে? কিসের অধিকারে বলবে, ফিরে এসো আবার আমার জীবনে? ( ক্রমশ )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here