#ব্রোকেন_হার্ট
লেখা : মান্নাত মিম
|১১|
নাইট ক্লাব। জ্বলজ্বলে নানা রঙের আলোতে নৃত্যের তালে হারায় নানান ধরনের মানুষ। এখানে সকলে একই পর্যায়ের। ছোটোবড়োর ব্যবধান নেই, সুখ-দুঃখের অনুভূতির ভিড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন খারাপের রেশ নেই। আছে শুধু একে-অপরকে জড়িয়ে রেখে মন জুড়িয়ে যাওয়ার অনাবিল আনন্দ উপভোগ্য ক্ষণ। সেখানে এসেও আমার মনে আনন্দ উপভোগ করার মতো কোনো কারণ খুঁজে পেল না। তবে মন খারাপ হওয়ার খুবই তিক্তদায়ক বিষয় রয়েছে। এন্ডারসন তার ফিয়ন্সে ক্যাপ্রিনার সাথে নৃত্যে মজে রয়েছে। একহাতে মেয়েটার সরু কোমর পেঁচিয়ে আরেক হাতে হাত রেখে ধীরলয়ে দুলছে দু’জনে। মনে আমার আগুন ধরিয়ে তারা আনন্দ, হাসিখুশিতে রয়েছে দেখি! তাদের সুখ আমার গায়ে উত্তাপ সৃষ্টি করছে। সেই উত্তাপে তাদের-ও পুড়াতে মন চাচ্ছে।
এদিক-সেদিক নজর বুলিয়ে কোথাও পেলাম না ক্রিশ্চানকে। তাকে কল করে ডাকার মতো ব্যবস্থাও নেই। অবশ্য কারো ফোন থেকে কল করে কথা বলতে পারি। কিন্তু তা করব না৷ সে যত দেরি করবে ততোই আমার জন্য সুবিধা। আজ কাজ করব না ভাবছি। শেষ দিন সকলের সাথে একটু আনন্দ নেব, ড্রিংক করব। সেজন্যেই লেমন কালার ব্যাকলেস টপস ও ব্লাক শর্টস পরে এসেছি যেটা হাঁটুরও ওপরে সাথে গাঢ় লাল ম্যাট লিপস্টিক। আজকের আমার নজরকাড়া লুক অনেক যুবাদের নজর কাড়তে সক্ষম। ড্রিংক নেওয়ার সময় আমার সাথের সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করেছিল, আজ কাজ করব না দেখে। উত্তর ওই একটাই দিয়েছিলাম, কাজ করব না। ড্রিংক নিয়ে কতক্ষণ বারের সামনে বসে হাতেরটা শেষ করে, আবার গ্লাসে ওয়াইন নিয়ে হেলেদুলে নাচের তালে অন্যদের সাথে পা মেলালাম। নেশা চড়েনি অতোটা। অল্প পরিমাণ ড্রিংক করেছি। নেশা চড়ে গেলে আউটঅফ কন্ট্রোল হলে এন্ডারসনের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া হবে না যে। সেই সুবাদেই অল্পসল্প করেই গলায় ঢালছি।
সময়কাল কাটল কিছুটা হঠাৎই আকস্মিকভাবে গানের সুর পালটালো সাথে সকলের ড্যান্স পার্টনার-ও। আমি তখন মাঝে একা ছিলাম কিন্তু সবকিছুর পালটাপালটিতে কার জানি হাতে গিয়ে পড়লাম। ড্রিংক করার গ্লাসটাও হাত ফসকে গেল, গানের শব্দে অতোটা কারো খেয়ালে এলো না বিষয়টা। তবে যার হাতে গিয়ে পড়লাম সে আমাকে টানতে টানতে অন্যত্রই নিয়ে যেতে লাগল। পিটপিটে চোখে তাকিয়ে এন্ডারসনকে দেখতে পেলাম। ক্লাবের করিডোরে দিয়ে ময়লা পরিত্যাক্ত চিপাগলিতে নিয়ে এসেছে সে আমাকে। হতবাক, বিহ্বলতা ছড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টায় চালাচ্ছি, এ যেন না চাইতে পাওয়া জল। বাহ! নিজেকে কিছু করার প্রয়োজন হলো না শিকার আপনা-আপনি এসে ধরা দিলো৷ মনে মনে স্মিত হাসলাম। তবে আমি প্রথমে বশ্যতা স্বীকার করলাম না। ছাড়াছাড়ির জন্য জোড় লাগালাম। কিন্তু পরক্ষণেই এন্ডারসনের হাতের ধাক্কায় দেয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়লাম। আমাকে চেপে ধরে নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এন্ডারসন। তার সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করলাম। সাথে মনে মনে হেসে স্বগোতক্তি করে বললাম, আমাকে ছলনা করতে ফের হাজির তার সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। এবার তো বাগে আমি তোমায় আনব নিজেকে ধরা না দেব।
“এত সাজগোজ! ক্রিশ্চানের জন্য?”
ভ্রু কুঁচকে এলো। প্রশ্ন অবান্তর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম ক্লাবের করিডোর দেখা যায় আগের গান চলছে এখনো সেই শব্দ কানে লাগার মতো৷ অথচ মন বিভ্রান্ত করতে এন্ডারসন পাকা খেলোয়াড়ের মতো উষ্ণ নিঃশ্বাস ছাড়ছে আমার কাঁধে। নিজের মনমস্তিষ্কের লাগাম হারাতে বেশি সময় লাগবে না আমার দেখা যায়৷ খেলা পালটাতে হলে যা করার এখন করতে হবে। এক ঝটকায় এন্ডারসনকে আমার জায়গায় আনলাম, আমি এন্ডারসনের জায়গাতে অবস্থান করলাম। অর্থাৎ এন্ডারসনের ওপর আমি। তবে পূর্ববর্তী জায়গা থেকে সরে এন্ডারসন অবস্থান করছে ঢাকনিযুক্ত ময়লা ফেলার স্টিলের ঝুড়ির ওপর বসে। অবাক করা বিস্মায়াবিষ্ট দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে এন্ডারসন। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে তার কোলে চড়ে বসলাম। কপালে কপাল ঠেকিয়ে উত্তপ্ত নিশ্বাস ছুঁড়লাম। শিহরণ বয়ে চলেছে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তার-ও একই অভিপ্রায়। খেলাটা নিতান্ত আবেগের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ অভিনয়ে রাখতে চাচ্ছিলাম। হলো উলটো, অন্যকিছুই। অনুভূতি আমার সাথে বেইমানি করল বোধহয়। আবেশ চুম্বন দিলাম তার দু-গাল, কপালে, থুঁতনিতে, ধীরে ধীরে গলার আশেপাশে। চুম্বনরত স্পর্শ করতে করতে আমার দু-হাত কর্মরত তার জ্যাকেটের চেইন খুলতে৷ ভেতরে ধবধবে ফর্সা সিক্সপ্যাক দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমার নরম ওষ্ঠদ্বয়ে তার বুকে ছুঁইয়ে দিতে থাকলাম লাগাতার। প্রেমময়, আবেগপ্রবণ সময় হয়ে ওঠছিল তখনকার ক্ষণ। অপরদিকে গানের-ও রদবদল হচ্ছিল।
“ইউ’র দ্য লাইট, ইউ’র দ্য নাইট
ইউ’র দ্য কালার অফ মাই ব্লাড
ইউ’র দ্য কিউর, ইউ’র দ্য পেইন
ইউ’র দ্য অনলি থিং আই ওয়ানা টাচ
নেভার নিউ দ্যাট ইট কুড মিন
সো মাচ, সো মাচ
লাভ মি লাইক ইউ ডু
লা-লা-লাভ মি লাইক ইউ ডু
টাচ মি লাইক ইউ ডু
টা-টা-টাচ মি লাইক ইউ ডু
হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর?”
তারপরের স্পর্শ সুখকর ছিল না এন্ডারসনের জন্য। সে যখন গানের তালে আমার ওষ্ঠের স্পর্শ বুকের মধ্যে নিয়ে সুখের ভেলাতে ডুব দিচ্ছিল, আর তার শক্ত হাতের চাপ প্রয়োগ করছিল আমার উন্মুক্ত পিঠের নরম চামড়ায়। ফলস্বরূপ তখনই সম্বিত ফিরে মোক্ষম সময়ে সরে এলাম তার কাছ থেকে। এমনই অনুভূতির চূড়ায় নিয়ে আমাকে ছেড়েছিল সে দুই-দু’বার। আজ যখন নিজের বেলায় হয় তখন অনুভব করুক কেমন লাগে?
______
হেঁটে চলেছি অবিরামভাবে। আজ সাইকেল নিয়ে আসিনি বিধায় এখন হাঁটতে হচ্ছে। তবে সাথে বারবার চোখ মোছার কাজেও নিহিত রয়েছি। আমার তো কাঁদার কথা না৷ তবুও বেহায়া মন কেঁদে চলেছে, এন্ডারসনের জন্য। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে প্রচণ্ড। কেন অনুভূতি, ভালোলাগা-ভালোবাসার নিঃশেষ করতে পারি না? এত অসহায়ত্ব, অনুভূতিপ্রবণ হওয়া মানা যায়? অথচ আমি এমনটাই আত্মসম্মান বোধহীন সম্পন্ন একজন যেন। এমনতর ফ্যাচফ্যাচ কান্না নিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে না। নিজেকে নিশ্চিত রূপে ঠান্ডা করে নিয়ে সময় লাগিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলাম।
মাম্মা তো সেই সন্ধ্যাকালে বাড়ি এসে পড়েছেন। এখন সম্ভবত নিজ রুমে অবস্থান করছেন। কারণ বাড়িতে যতটুকু সময় পান সেটাকে ডাক্তার রেস্ট হিসেবে কাজে লাগাতে বলেছেন। চিন্তাভার ছেড়ে বিশ্রাম নেওয়াটাকে মাম্মা শ্রেয় মনে করেই যত দ্রুততার মাধ্যমে বিছানা গ্রহণ করেন। যার জন্য তাঁর সাথে রাতে দেখা হয় না খুব বেশি একটা। অপরদিকে টমাস মাম্মার অসুস্থতার খেয়াল করেই চুপচাপ শান্ত বাচ্চার মতো হয়ে থাকে। কোনপ্রকার শোরগেল না করে নিজের মতো করেই থাকে ছেলেটা। এজন্যই বাড়িতে নিস্তব্ধতা, নিরবতা বিরাজমান। সেই নিস্তব্ধতা চিঁড়ে আমি হাইহিলের ‘খটখট’ শব্দে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। নিজের রুমের দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে অন্ধকার লাইট জ্বালিয়ে হাতে থাকা ক্রিশ্চানের দেওয়া ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলাম। অতঃপর ওয়াশরুমে ঢুকে ঝর্ণার পানিতে দেহ ও মনের দাহ্য জুড়াতে লাগলাম। লম্বা শাওয়ার নেওয়া শেষে বের হয়ে এসে সবার আগে ফোন চালু করলাম। এন্ডারসনের কাছ থেকে আসার পরে ক্রিশ্চান বেশ কিছুক্ষণ পর এসেছিল, হাতে করে আমার জন্য কেনা নতুন ফোন নিয়ে। যেহেতু ফোন ছাড়া ক্রিশ্চানের সাথে সময়ে-অসময়ে যোগাযোগ করতে পারি না বিধায় আমাকে গিফট দিলো। নিতে চাইনি আর কত তার ঋণের বোঝা মাথায় নেব? তবুও জোর করে দিয়ে দিলো। সাথে নতুন কাজের সন্ধান-ও দিলো, বিচের উন্মুক্ত রেস্তোরাঁ। ড্রেস কোড দেওয়া তাদের। দু’জনে ড্রিংক করে ক্লাবের মালিকের সাথে কথা বলে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। এরমাঝে একবার-ও এন্ডারসনের দেখা মিললো না। পথিমধ্যে ক্রিশ্চান বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমার এই ক্ষণটাতে একা থাকা ভীষণ প্রয়োজন ছিল সেজন্য তাকে সাথে নেইনি। সহজ-সরল জীবন চেয়েছিলাম, কিন্তু পদেপদে জীবনটা যেন পাজেলে হারিয়ে ফেলছি। নানান সমস্যা প্রতিনিয়তই আমার অভিমুখে এসে হাজির হয়। তখন অসহায়ত্ব ঝেঁকে ধরে আমাকে একাকীত্ব ভোগ করায়।
চলবে…
যারা পড়েন তাঁদের রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।
#হ্যাপি_রিডিং