ব্রোকেন হার্ট পর্ব-১২

0
918

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখা : মান্নাত মিম

|১২|
সময় গড়িয়ে যায়, বেলা ফুরায়। রোজকার কাজে অভ্যস্ত আমি প্রায় ভার্সিটি টু পার্টটাইম জব করতে করতে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরি। এরমাঝে ভার্সিটিতে প্রথম কয়েকদিন অফ দিয়েছিলাম, বীচের কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য। সেই সময়কার মধ্যে আর এন্ডারসনের সাথে দেখা হয়নি। ক্রিশ্চানের সাথে সময়ে-অসময়ে দেখা হয়েছে। মাঝেমধ্যে বীচে এসে সে আমাকে সাহায্যও করেছে, অন্যদিকে ভার্সিটির ক্লাসের করা নোটও দিয়ে যেত বাড়ি এসে। তবে সেটা মাম্মার চোখের আড়ালে। তিনি এসব পছন্দ করেন না, অবশ্য আমি-ও তাঁকে দুঃখী করতে চাই না। যার জন্য ক্রিশ্চানকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করতে পারি না। অথচ ছেলেটা বিনা পয়সায় আমাকে কতখানি সাহায্য করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ ছুটি কাজের, গতকাল বলে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ ভার্সিটি যাব ক্লাস অ্যাটেন্ড করতে। ক্রিশ্চানকে ফোনে যখন কথাটা বললাম, সে উচ্ছ্বসিত গলায় গদগদ কণ্ঠে নানা প্ল্যান করল, আমার ছুটি থাকায় কী কী করবে কোথায় কোথায় ঘুরবে। তার পরিকল্পনা শুনে আমি বললাম, সাথে আমাদের নতুন বন্ধু মেম্বার ভেরোনিকাকে সাথে নেব। ফেটে যাওয়া বেলুনের মতো চুপসানো মুখ করে ক্রিশ্চান বলল,

“ওই মেয়েটা কি, হ্যাঁ? তাকে কেন নিতে হবে?”

ভিডিয়ো কলে কথা বলছিলাম ক্রিশ্চানের সাথে তাই তার মুখের ওমন দশা দেখে শব্দ করে হেসে দিলাম। সেটা দেখে ক্রিশ্চান আরো দুঃখী কণ্ঠে বলল,

“হাসো হাসো, হাসবেই তো। শয়তান মেয়েটার পাল্লায় পড়ে তুমি-ও যে গোল্লায় যাচ্ছ। ভালোভাবেই দেখছি।”

ক্রিশ্চানের কথা শুনে আমার হাসি যেন থামছেই না। ভেরোনিকা নতুন ভর্তি হয়ে এসেছে আমাদের সাথের ব্যাচমেট। মেয়েটা খুব খুব মিশুকে। সবচেয়ে মজার কথা হলো, সে ক্রিশ্চানকে দেখে ক্রাশ খেয়েছে প্রথম দিনেই। অবশ্য কাহিনি-ও ছিল এই ক্রাশ খাওয়ার পেছনে। ছেলেটা হেল্প করেছিল তাকে সাইক্লিং করতে গিয়ে পা বাজিয়ে পড়ে যাওয়া ভেরোনিকাকে সাহায্যের করতে গিয়েছিল যখন, তখনই বেচারি মাটিতে না পড়ে ক্রিশ্চানের ওপর ক্রাশ খেয়ে তার বুখে পড়েছিল মুখ থুবড়ে। কিন্তু ক্রিশ্চান ধমকে ধমকে ভেরোনিকাকে বলেছিল, তার থেকে দশ হাত দূরে অবস্থান করতে। তাদের ওমন মিষ্টিমধুর ঝগড়া আমাকে বর্তমানে এন্ডারসনের কথা ভুলিয়ে রাখে। ওহ্, আবারও মনে পড়ে গেল। শুনেছিলাম, সে না কি বর্তমানে আমেরিকায় অবস্থান করছে৷ সেখান থেকে এসেই ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বিদায় নেবে ভার্সিটির পাট চুকিয়ে। আমার অবশ্য এতে মাথা ব্যথা নেই নিজের লাইফ নিয়ে চিন্তিত আমি। মাম্মা, ছোটো ভাই, তাদের ও ঘরের ঋণ সবকিছুর জন্য অদূর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা হয়ে আমার রাত-দিন কাটছে৷ তবুও মনের বদ্ধ ঘরে কিছু একটার আশংকা রয়েই গেছে।

“ইমি! তুমি কোথায় হারালে আবার?”

ক্রিশ্চানের ডাকে ভাবনার বিচরণ ভাঙলো।

“না, না এখানেই আছি। আচ্ছা শুনো, সময় করে পৌঁছে যেও। আমি-ও আসছি।”

থেমে গিয়ে আবার মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বললাম,

“দেরি হলে ততক্ষণে ভেরোনিকার সাথে… বুঝেছ’ই তো।”

ফোনের ওপাশ থেকে তখনই চিৎকার ভেসে এলো,

“ইমিইইইই!”
_______

হলুদ রঙা টি-শার্ট পিঠে ঝুলানো ব্যাগপ্যাক। ব্ল্যাক জিন্সের সাথে হোয়াইট কেডস পরনে আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি ক্রিশ্চান ও ভেরোনিকার। ক্লাস শেষে ঘুরতে যাব বলে দ্রুত বের হলাম। অথচ ভেরোনিকা দরকারি জিনিসপত্র ক্লাসে ফেলে এসেছে৷ ক্রিশ্চানকে সাথে করে রওনা দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই এলো দু’জনে। আমি হতবাক দৃষ্টি মেলে সেদিকে তাকিয়ে ভেরোনিকাকে জিজ্ঞেস করলাম,

“ভেরোনিকা, আমরা জাস্ট একটু ছোটো-খাটো পিকনিকে যাচ্ছি। কোনো যুদ্ধে না। এত বড়ো ঝুড়ি কেন? কী আছে ওতে?”

“কেন দেখতে পাচ্ছ না? এখানে খাবার আছে।”

নির্ভার, নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল ভেরোনিকা। অপরদিকে রোষ্ট দৃষ্টি মেলে ফোঁসফোঁস করতে থেকে ভারি ঝুড়িটা নিয়ে গাড়িতে রাখছে ক্রিশ্চান। মুখ থমথমে হয়ে লালাভ ধারণ করেছে তার। উপরন্তু আজ চমৎকার উজ্জ্বলতা নিয়ে রোদ ওঠেছে।

“এত খাবার! এত দিয়ে কী হবে?”

“এত খাবার কোথায় দেখলে? এগুলো বিকেলের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।”

তা আর বলতে। ভেরোনিকা একটু মোটাসোটা ধরণের। স্লিভলেস কালো হাঁটু সমান ফ্রক পরনে। পায়ে তারও কেডস। হাত নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বলে আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গাড়িতে বসাল। সে সামনের সিটে ক্রিশ্চানের সাথে আমাকে পিছনের সিটে। তাতেই ক্রিশ্চান দম ফাটানো ধমক দিয়ে বসে।

“এই ইমি, পিছন থেকে সামনে বসো। এটার সাথে আমি বসব না। আমার কান খেয়ে দেবে।”

বেচারি ভেরোনিকা গোলগোল গাল নিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়ল। ভেরোনিকার গাল দু’টো খুব ভালো লাগে আমার। ফোলাফোলা গাল দু’টো কেমন লাল চেরির মতো হয়ে আছে! এত সুন্দর মেয়েকে কেন যে ক্রিশ্চানের পছন্দ না সেটাই বুঝি না আমি। হাহ্! দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। যাকে আমরা পছন্দ করি, তাদের পছন্দের মানুষ আগে থেকেই থাকে নাহয় আমাদের পছন্দ হয় না তাদের।

“ক্রিশ্চান প্লিজ, চলো কথা বাড়িয়ও না। মেয়েটার মন খারাপ হচ্ছে।”

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ক্রিশ্চান আঁটকে রাখা দম ছেড়ে বলল,

“হুহ্, তার মন খারাপ’ই তোমার চোখে পড়ে, আমি তো এখন চোখের বালি।”

আসলেই সারা রাস্তা ভরে ভেরোনিকা বকবক করতে করতে এলো। অবশ্য আমার ভালো লাগল, কারণ গাড়ির এতক্ষণের জার্নিতে বোর হয়ে যেতাম। কিন্তু ক্রিশ্চান, সে তো পারে না কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে তাকে৷ মাঝেমধ্যে দুয়েকবার ধমকে চুপ থাকতে বলেছিল৷ তবে মেয়েটা আমার আস্কারায় পাত্তা দেয়নি। কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এসে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। আশেপাশে মেপল গাছের সমারোহ। বেশ অনেকেই এসেছে আজ। অবশ্য প্রতিদিনই কেউ না কেউ এই জায়গাটাতে আসে সময় কাটাতে। শান্তি বহুল স্থান, মেপল পাতার ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আলো তার নিজ দ্যুতি ছড়াচ্ছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমরা মেয়েরা আগে আগে চলতে লাগলাম। ক্রিশ্চান তার গাড়ি পার্ক করতে গেল। বিরাটকার মেপল গাছের নিচেই পিকনিকের জন্য আনা চাদর বিছিয়ে নিলাম। তারউপর ভেরোনিকার আনা ঝুড়ি রাখলাম। ক্রিশ্চান এলো খানিক পরে। তার হাতে ওয়াইনের বোতল সাথে ড্রিংক করার গ্লাস। খুশিতে আমরা দু’জন চিৎকার করে উঠলাম। আশপাশ দিয়ে গল্প করতে করতে মানুষজন ঘাড় বাঁকা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সেটা খেয়াল হতেই বেখাপ্পাভাবে ফ্যাকাশে হাসি দিলাম। এতটাই নির্জন স্থান যে, অনেকে সেখানে নিজ মনে বই পড়ায় মনোনিবেশ করছে। শুধু পাখপাখালিদের শব্দ-ই শোনা যাচ্ছে।

“এই তুমি এটা কোথায় পেলো?”

ভ্রু কুঁচকে এলো ক্রিশ্চানের। ভেরোনিকা যতবারই তার সাথে কথা বলতে যায়, ততোবারই এমন করে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত ভঙ্গি করে তাকায় সে। বুঝি না ছেলেটার এত এলার্জি কেন ভেরোনিকা নামের।

“রাস্তাতে পড়ে ছিলো সেখানেই পেলাম।”

ক্রিশ্চানের উত্তর শুনে অসহায়ভাবে তাকালো ভেরোনিকা আমার দিকে। যার অর্থ, ক্রিশ্চান কি কখনো তার সাথে ভালো করে দু’টো কথা বলবে না? এদিকে আমি মিটিমিটি হাসি দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু নাহ, ঘুরতে এসেও ক্রিশ্চানের ওমন গুরুগম্ভীর মুখ দর্শন করা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। তাই তাকে বুঝিয়ে বললাম,

“ঘুরতে এসেছি প্লিজ, আজকে অন্তত ভালো মুডে থাকো।”

“সেটা হতে দিলো কোথায়?”

বুঝতে অসুবিধা হলো না কথাটা কার উদ্দেশে বলা হয়েছে। এই কথায় বোধহয় বেচারি ভেরোনিকা অপমান বোধ করল। ছলছলে চোখ নিয়ে নতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি কী যে করব, বুঝে ওঠতে পারছি না।

“চলো, ভেরোনিকা আমরা একটু ঘুরে আসি আশপাশ থেকে।”

একহাতে কাঁধ তার জড়িয়ে আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনের দিকে৷ পিছু ফিরে ইশারায় অবুঝ চাহনিতে তাকিয়ে থাকা ক্রিশ্চানকে আশ্বস্ত করলাম এই যে, মেয়টাকে শান্ত করে আসছি একটু পরেই।
_________

স্বচ্ছ নীল পানি বয়ে চলছে লেকে। আমরা দু’জন বসে আছি লেকের কিনারার বেঞ্চিতে। আমার হাতে থাকা কয়েক টুকরো পাথর যেগুলো কুড়িয়ে ছিলাম। একটা একটা করে কিছুক্ষণ পরপর পানিতে ফেলছি আর তাকাচ্ছি ফ্যাসফ্যাস কান্নারত ভেরোনিকার দিকে।

“ভালোবাসলে এভাবে হেরে গেলে চলবে না। শক্ত হতে হবে, তার মন জয় করে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। নাহলে কেমন ভালোবাসো তুমি তাকে?”

“দেখলেই তো তুমি। সে আমার কথা শুনতেও পছন্দ করে না। সারাক্ষণ তোপ মুখে রাগ নিয়ে থাকে। কিছু বললেই ছুঁড়ে মারে আমার দিকে। আমার আরো ভয় করে তখন।”

বলেই উচ্চ শব্দে কান্নার রোল তুলল। ভাগ্যিস এদিকটাতে মানুষজন আসেনি নাহলে তার কান্নায় বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দিতো।

“আহা! কান্না থামাও। আমার কথা শুনো আগে মন দিয়ে। ক্রিশ্চান রাগি নয়। তবে লেখাপড়া নিয়ে সে ভীষণ সিরিয়াস। তাই হয়তো তোমার ভালোবাসার নিমন্ত্রণ রাগ দেখিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। আর পরবর্তীতে যেন তার কাছে যেতে ভয় পাও বা ভয় পেয়ে না যাও, সেজন্য ওমন রেগে রেগে কথা বলে।”

কথাগুলো বুঝল ভেরোনিকা৷ তার বিস্ময়কর চাহনি দেখেই বুঝতে পারলাম আমি। কিছুক্ষণ বাদেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,

“কী সুন্দর বোঝো গো তুমি! ইস! তোমার মতো মেয়েকে যে পাবে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হয়।”

আমি শুনে শ্লেষাত্মক হাসি হাসলাম। আসলেই সুপ্রসন্ন তার ভাগ্য? না কি উলটো অপ্রসন্ন আমার-ই ভাগ্য? হাজারো প্রশ্নের মেলা, অথচ আঁধারে সেগুলো ঢাকা।

চলবে…

যারা পড়েন তাঁদের রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।
#হ্যাপি_রিডিং

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here