#ব্রোকেন_হার্ট
লেখা : মান্নাত মিম
|১৬|
“কোন দুষ্টুমি নয়। শান্ত বাচ্চার মতো ক্লাস করবে, ঠিকাছে?”
টমাসের মসৃণ চুলে হাত বুলিয়ে বললাম। প্রতিদিনই বলি, তাকে বুঝাই। কিন্তু যেই কে সেই। স্কুলে ভর্তির পর যেন তার দুষ্টুমির হার ক্রমবর্ধমান। অবশ্য ভালো লাগে ছেলেটার উজ্জীবিত হওয়া মুখ, উল্লাসে উচ্ছ্বাসিত হওয়া আনন্দ দেখতে। লেখাপড়ার ভালো আগ্রহ তার। ক’দিন হলো তারমধ্যেই দ্রুততার সহিত সকল পড়া শিখে ও বুঝে নিচ্ছে। আলাদাভাবে তাকে প্রাইভেট পড়তে হয় না। নানান উপদেশ দিয়ে তাকে সকালে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমি কাজে যাই। তবে আজ তাকে স্কুলে দিয়ে আমার গমনপথ আজ পরিবর্তন হলো। উদ্দেশ্য এন্ডারসনের রেস্ট হাউস।
বেঁচে থাকাকালীন সময়, ড্যাড আমাকে একটা লকেট গিফট করেছিলেন। যেটা সর্বক্ষণ আমার গলাতে পরে থাকতাম। লকেটটা সাধারণ হলেও আমার প্রিয়জন কর্তৃক গিফট করা, তাই সেটার মূল্য আমার কাছে বহুগুণ। এন্ডারসনের রেস্ট হাউস থেকে আসার পর খেয়াল হয় সেটা আমার গলাতে নেই। তবে অনেক পরে খেয়াল আসে বিষয়টা যে, সেদিন অন্তরঙ্গ হওয়ার মুহুর্তে এন্ডারসন লকেটটা খুলে রেখেছিল। তাছাড়া সেদিনের ঘটনা আমার মস্তিষ্কে দাগ কেটেছিল। যার দরুন তার সাথে দেখা করে প্রতিশোধ নেওয়ার পাঁয়তারা করে সেটা আবার সংঘটিত করেছিলাম। তবে লকেটের বিষয়টা যখন খেয়ালে এলো ততক্ষণে এন্ডারসন আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। গতকাল সে ভিডিয়ো কলে আসে খালি গায়ে, তবে লকেটটা গলায় ঝুলানো ছিল। আর আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলেছিল, সেটা নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে রেস্ট হাউসে চলে যেতে। আর তাই লকেট নিতে আজ আসা তার দেওয়া লোকেশনে।
_______
সাইকেলটা বাড়ির সমুখেই রেখে হাউসের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। আগের বারের মতোই এবারও নির্জনতায় ঘেরা নিরবতা সর্বত্র ছেয়ে আছে। এমম সময় হাউসের দরজা খট করে খুলে গেল সামনে এন্ডারসন দণ্ডায়মান। কী ব্যাপার কলিংবেল চাপতে হলো না তার আগেই দরজা খুলে গেল!? একই সাথে প্রশ্ন ও বিস্ময়কর চাহনি আমার। ভাবনাগুলো বিঘ্নিত হলো এন্ডারসনের হাসি করা মুখ দেখে। তার সেই সম্মোহন করা হাসি! নিজেকে শক্ত রাখা দায়। চোখমুখ খিঁচে বললাম,
“লকেট ফেরত দিন।”
নাহ,, ছেলেটার নড়চড় নেই। রাগ উঠল এবার। ফাজলামি পেয়েছে অসহ্যকর! কতদূর আসতে হয়েছে যদিও সাইকেল ছিল সাথে। তবুও মন খারাপ কেন জানি সকাল থেকেই। এন্ডারসনকে একইভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে বললাম,
“লকেটটা দিন।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে বাড়িয়ে হাতটা ধরে সে ভেতরে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগে মুখ আমার থমথমাবস্থা। যেকোনো সময় দাবানলের মতো ফেটে যেতে পারে। আমি চাই না তার সাথে কোনপ্রকার খারাপ আচরণ করতে। তাই রাগটাকে চাপিয়ে রেগে ধীর গলায় বললাম,
“দেখুন, সুন্দরভাবে বলছি। লকেটটা দিয়ে দিন। নিয়ে আমি চলে যাব।”
আমার কথা তার ওপর কোন প্রভাব ফেলল বলে মনে হলো না। উলটো কিচেন রুমের দিকে রওনা হলো নিস্পৃহ ও নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে। মেজাজ এবার যারপনাই খারাপ হলো। নেহাতই নিজের প্রয়োজন দেখে তার এই উদাসীনতা সহ্য করছি। নাহলে আমার কোন দায় তো পড়নি। হাহ্!
সোফার রুমে বসে আছি। আমার সমুখ বরাবর বসে আছে এন্ডারসন। দু’জনের হাতেই কফি মগ। এন্ডারসন কফি হাতে দিয়ে বসে আছে চুপচাপ কথা নেই। এদিকে আমি অধৈর্য হয়ে আছি। এখানে একমুহূর্তও থাকতে মন চাইছে না সেদিনের স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে বারবার। শব্দ করে টি-টেবিলে কফির মগ রেখে বললাম,
“আপনার এই নির্লিপ্ততা দেখার জন্য আসিনি। লকেট দিচ্ছেন না তাহলে ডেকেছেন কেন? কী চাচ্ছেন কী আমার কাছে?”
চেঁচিয়ে কথাগুলো বলাতে গলা শেষে খসখসে হয়ে উঠল। সামনে রাখা কফি মগ হাতে নিয়ে গলা ভেজালাম। আঁড়চোখে একবার এন্ডারসনের দিকে তাকালাম। তার ভাবলেশহীন মুখ নজড়ে এলো। তবে এবার সেই মুখের আদলে একটু বিষণ্ণতা, ম্লানতা ছেয়ে আছে। যা মনটা আমার নাড়িয়ে দিলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলব তখনই এন্ডারসনের শব্দগুচ্ছ আমার কানে এলো,
“জানো, আমার ড্যাড আমার মাম্মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে খুবই ভালোবাসা, বিশ্বাস, আন্তরিকতা ছিল। আমরা তিন ভাই। সকলের ছোটোজন আমি। মাম্মা পাগল ছেলে ছিলাম। তখন আট বছর বয়স। একদিন শুনলাম, মাম্মা আমাদের ছেড়ে দূরে চলে গিয়েছেন। আমি তখন দূরে ছেড়ে যাওয়ার মানে হিসেবে মারা যাওয়াকে বুঝতাম। মাম্মা পাগল ছেলেটা যখন রোজ মাম্মাকে না পেত তখন কেমন অবস্থা হতো ভেবে দেখেছ? কেউ স্বান্তনা দিতে এতো না। ড্যাড সেই শোক কাটিয়ে উঠলেন এবং সেটা খুব দ্রুতই। বিয়ে করলেন দ্বিতীয়বার। তবে নাম হলো, ছোটো ছেলে মাম্মা, মাম্মা করে কাঁদে বলেই মাম্মা এনে দিলেন। হাহ্! দ্বিতীয় মাম্মা অবশ্য আমাদের সাথে মন্দ আচরণ করেন না আবার অতোটাও ভালো আচরণ করার দায় এড়িয়ে চলেন সবসময়। বলতে গেলে, অপরিচিতদের মতো তাঁর ব্যবহার। সময় গেল, একা একা বড়ো হতে লাগলাম। বড়ো ভাইয়ের স্বভাব ছোটোবেলা থেকেই গাম্ভীর্যপূর্ণ। মেজো ভাইয়ার সাথে আমার যত সখ্যতা গড়ে উঠল তখন থেকে। ড্যাড তো কাজের কারণে নানান দেশে ঘুরেফিরে সময় কাটিয়ে আসতেন। আমি তখন মাঝেমধ্যে মেজো ভাইয়ার সাথে তো বেশিরভাগ একাই থাকতাম। বছর যখন পনেরো তখন একদিন শুনলাম, আমাদের মাম্মা হাহ্! আদৌও সেই ডাকের যোগ্য তিনি? যাইহোক, তিনি আমাদের সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। আমি তো জানতাম, মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না। এখন কী করে এলো? অবাক এতোটাই হয়েছিলাম যে, পরবর্তী ধাপে সম্পূর্ণ ঘটনা জেনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। তিনি অন্য একজনের সাথে সম্পর্কে ছিলেন। তাই ড্যাডকে ছেড়ে সেই ছেলের সাথে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছিলেন।”
এপর্যন্ত এসে থামল এন্ডারসন। তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল। সেটা দেখেই টেবিলের ওপর থাকা পানির গ্লাস নিয়ে তার পাশে বসে এগিয়ে দেই গ্লাসটা। ছেলেদের কান্না করতে দেখিনি তবে আজ দেখলাম তাদের অশ্রুসিক্ত হওয়া রক্তচক্ষু। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করল সে,
“ড্যাড ভালোবাসাকে এখন ঘৃণার নজরে দেখেন। সেদিনের ঘটনা জানার পর থেকে আমারও তেমন ঘৃণা জন্ম হয়েছে ভালোবাসার প্রতি। ড্যাড কখনোই চাইতেন না যে আমরা অর্থাৎ আমরা তিন ভাইয়েরা ভালোবাসা নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হই। সেজন্য তাঁর পছন্দানুযায়ী মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে চান। বড়ো ভাইয়াকেও তিনি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করিয়েছেন। মেজো ভাইয়া বিয়ে করতে চাচ্ছেন না আপাতত। তবে পরে করলেও ড্যাডের মতেই হবে সবটা। আর আমাকে তাঁর বন্ধুর মেয়ে ক্যাপ্রিনার সাথে এনগেজমেন্ট করিয়েছিলেন। কারণ ভার্সিটির শেষে অফিসে বসতে হবে তাঁর বদলে। এই দায়িত্ব বড়ো ভাই কিংবা মেজো ভাই কেউই নিতে চায় না। যার ফলস্বরূপ অফিসের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপবে। আর আমার তখনো ভালোবাসা নামক বিষয়টার সাথে অতোটা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিচয় ছিল না, যা ছিল কেবল ঘৃণাই। তাই ড্যাডের কথায় রাজি হয়ে গেলাম করে ফেললাম এনগেজমেন্ট হয়ে গেলাম এনগেজড! তবে জানো কী, এই ঘৃণা করা আমার হুট করে পরিবর্তন হয়ে গেল। ভালোবাসার সাথে মিষ্টি-মধুর অনুভূতির পরিচয় করিয়ে দিতে একটা পরি এলো আমার জীবনে। কিন্তু তখনো আমি সে বিষয়ে অজ্ঞাত ছিলাম। বিশ্বাস করতাম না তাকে আর না তার ভালোবাসাকে। কিন্তু মন বলে একটা জিনিস আছে না, সেটাই আমূলে পরিবর্তন ঘটালো আমার। পরিটার স্নিগ্ধ, কোমল রূপের মোহে পড়ে কীভাবে যেন আমার হৃদয়টা বদলে গেল। ভালোবাসতে চাইলো পরিটাকে, আদুরে স্পর্শ করতে চাইল। তবে কী জানো বাঁধ সাধত বিবেক। ভয় হতো ভালোবাসলে কষ্ট পাওয়ার হৃদয় ভাঙার ভয়। যা সর্বক্ষণ আমাকে দংশিত করত। বারবার বলতো, তোর ড্যাড-মাম্মা’কে দেখেও শিক্ষা হয়নি? কিন্তু হেরে গেলাম আমেরিকা গিয়ে মাম্মার সাথে দেখা করতে গিয়ে সেই পরিটার শূন্যতা বুঝতে পারলাম যে, তাকে ছাড়া চলবে না। আমেরিকায় আসার আগে পরিটা যখন আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল, তখনই ভালোবাসা নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আর মাম্মার সাথে এখন মাঝেমধ্যে দেখাসাক্ষাৎ করি। রেগে নেই। তিনিই আমার অস্থিরতা ধরতে পেরে বুঝিয়েছিলেন, আমি প্রেমে পড়েছি। আচ্ছা, তুমি কি জানো পরিটা কে?”
আমি, আমি বিমূঢ়, স্তব্ধ। নিশ্চুপে আমার মনও মস্তিষ্ক। এন্ডারসন আমাকে যে ভালোবাসে কিন্তু নিজের অনুভূতির সাথে লড়াই করছিল সেটা জানি। তবে তার লড়াই করার পেছনের কারণ জেনে হতবাকতায় আবিষ্টমন।
চলবে…
সকলের প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষায়। গল্প পড়ে ভালো-মন্দ উল্লেখ করবেন অনুরোধ রইল। এডিট ছাড়া।