ব্রোকেন হার্ট পর্ব-১৫

0
882

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখা : মান্নাত মিম

|১৫|
“তোমাকে বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি, আমাকে এড়িয়ে চলছ।”

ক্রিশ্চানের কথায় তবুও চুপ করে রইলাম। উত্তর তার জানা। বন্ধুত্বের মাঝে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে বুঝতেও পারছে। সেদিনের পর থেকেই এই বদলে যাওয়াটা। অবশ্য আমি নিজেই এই দূরত্ব টানতে বাধ্য হয়েছি। সেই পার্টির পর থেকে আমি ভার্সিটি আসিনি সপ্তাহ দুয়েক হবে। ভেরোনিকার সাথে ফোনে কথা হলেও ক্রিশ্চানের কল কখনো রিসিভ করিনি। বাড়ির বাইরে বেশ ক’বার তার পদচারণা লক্ষ করেছি। সে জানে আমাদের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করা তার নিষিদ্ধ। তাই আগানোর সাহস পায়নি। উপরন্তু আমার কাজের জায়গাতেও দূরে দূরেই থেকেছে। কাজের মাঝে তার অযথা হস্তক্ষেপে আমি ক্রোধপূর্বক কাজ ছাড়তেও পারি এই ভেবে। অতঃপর আজ ভেরোনিকার অনুরোধেই ভার্সিটিতে উপস্থিত হলাম। তার ক্রিশ্চান না কি কষ্ট পাচ্ছে আর সে কষ্ট বেচারি সহ্য করতে পাচ্ছে না। আহা কী প্রেম! যাকে সে ভালোবাসে, তার ভালোবাসা আবার অন্যকে ভালোবেসে কষ্ট পায়, তার কষ্টে আবার সে মরণ দশায়। আজব কারবার!

“কারণ নিশ্চয় জানো?”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় ক্রিশ্চান। আমি বুঝলাম এখনই কথা বলার মূখ্য সময়।

“তোমার কাছে তো এটা আশা করিনি ক্রিশ্চান।”

থেমে আটকে থাকা তপ্ত নিশ্বাস ফেললাম। সে-ও নিশ্চুপ। জানে কী বিষয় নিয়ে এখন কথা উঠবে। সে পারেনি তার অনুভূতি লুকাতে, যখন দেখেছে ভেরোনিকা তার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। কিন্তু আমার জানার বিষয়, আমার ও এন্ডারসন বিষয়ে সে অবগত হয়েও কেন আমার দিকে সে ধাবিত হলো? কেন? তার কাছেই উত্তর চাইলাম। প্রত্যুত্তরে সে বলল,

“প্রথম দিন থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগে৷ সেই ভালোবাসা’ই বন্ধুত্বের পরিসীমা অতিক্রম করে। জানোই তো, একজন ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না। বন্ধুত্বের চেয়ে বেশিকিছু থাকে সেখানে। হয়তো ছেলেটা নয়তো মেয়েটা সেই বেশিকিছু উপলব্ধি করতে পারে। সেক্ষেত্রে তুমি অপারগ ছিলে। আমি উপলব্ধি করতে সেখানে সক্ষম। কিন্তু তোমাকে চাওয়ার আগেই তোমার চাহিদা অন্যজনকে নিয়ে বুঝতে পারলাম। তবে কী বলো তো, এন্ডারসনের সাথে তোমার যায় না। বাড়তি হিসেবে সে এনগেজড। তাই ভাবলাম একটা চান্স আছে। সুযোগে বুঝালাম-ও তোমাকে সেই বার কাউন্টারে। কিন্তু এতদিন পর এসেও তার প্রতি তোমার দুর্বলতা আমার কাছে পরিলক্ষিত হলো। অন্যদিকে এন্ডারসনেরও মতিগতি অন্যরকম লাগল। যেটা অবশ্য আমার জানা নেই। তবে তোমার দিক থেকে আমার জন্য ফিলিংস কেবল বন্ধুত্ব হিসেবেই বিদ্যমান। সেটা আমার কাছে কষ্টের খুবই। কিন্তু আমার অনুভূতি তো আর মিথ্যে নয়। আর না মুছে ফেলার মতো। এরমধ্যে ভেরোনিকার প্রপোজাল কাটা গায়ে নুনের ছিটের মতো লাগল। তাই তখন বলে ফেলেছিলাম তাকে তোমার কথা। আর তার থেকে তুমি জেনে আমাদের মাঝের বন্ধুত্বও রাখতে চাচ্ছ না।”

ক্রিশ্চান থামল সবকিছু বলে। আমি তার এত কথা চুপচাপ শোনার পর শেষের উক্তিতে প্রত্যুক্তি করলাম,

“এটাই কি স্বাভাবিক নয়? বন্ধুর সাথে চলাফেরা করব। আর তাকে দেখলেই ভাবনা আসবে, সে আমাকে ভালোবাসে এবং না পেয়ে কষ্ট জর্জরিত। বিষয়টা আমাকে একদিকে লজ্জায় ফেলবে আরেকদিকে তার না পাওয়ার ভালোবাসার কষ্ট আমাকেও ব্যথিত করবে। কারণ আমি-ও ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা বুঝি।”

বেশ লম্বা খানিক কথাবার্তায় হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। ক্লাস শেষে ভার্সিটির বাইরের প্রাঙ্গণে বিশাল ওক গাছের নিচে স্টুডেন্ট’দের বসার জন্য তৈরি বেঞ্চে বসেছিলাম দু’জনে এতক্ষণ সময় ধরে। ভেরোনিকা আমাদের মাঝে ছিল না। স্পেস দিয়ে চলে গিয়েছিল ক্যান্টিনের ভেতর। এখন তাকে আসতে দেখলাম আমাদের দিকে। সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার হাতে থাকা আইসক্রিম আমাদের দিকে এগিয়ে দিলো হাসি মুখে। কিন্তু তার মুখের সেই হাসির পিছনে আমি এক আকাশ বিষণ্ণতায় ঘেরা থমথমে মুখ দেখতে পেলাম।
_______

এন্ডারসনের সাথে সেদিনের পর থেকে দেখা হয়নি। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন সে আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফেলে। অতঃপর কল দেয়। পরিচয় পাওয়া মাত্রই রেখে দেই। তার সাথে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই। আমার জন্য তার যে ফিলিংস সেটা আমার বুঝে আসছে না। সে যেন কোথাও বাঁধাপ্রাপ্ত কিংবা দ্বিধান্বিত আমাকে ভালোবাসতে। এটাই আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। এতদিন তো নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম, ভালোবাসা হয়তো আমার তরফ থেকে একতরফা। সেজন্য সরেও এলাম। কিন্তু মাঝ দিয়ে এখন সে এসে তার ভালোবাসা জাহির করছে, যা আমাকে সামলে রাখার ভিত’টাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি এখন তার ডাকে সাড়া দেই, পরবর্তীতে সে যদি বদলে যায় তখন আমি তো ভেঙে গুড়িয়ে যাব। এসব ভাবনাগুলোই আমাকে সম্পর্ক তৈরিতে আগাতে দিচ্ছে না।

“কী খবর? টমাস কোথায়?”

ড্রয়িংরুমের সোফায় বসেছিলাম। এমন সময় মাম্মাম এলেন কাজ থেকে ফিরে। কাঁধের ব্যাগ সোফায় রেখে আমার পাশে বসলেন।

“টমাস বাইরে গিয়েছে।”

বলতে বলতে আমি সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালাম। ডাইনিং থেকে পানি এনে তাঁকে দিলাম। খেয়ে শান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন চোখ বুঁজে। হালকা নাস্তা এনে সামনে টি-টেবিলে রাখলাম। মাম্মামের এই ক্লান্তিকর দৃশ্য আমার কাছে বেদনাদায়ক। বাড়ির ঋণ দিচ্ছেন তিনি। আমার বেতন দিয়ে সাংসারিক খরচাপাতি চলছে। তারউপর আমার ও টমাসের লেখাপড়ার খরচও চলছে।

“তোমার উচিত হয়নি টমাসকে স্কুলে ভর্তি করানো।”

“মাম্মাম, ওর-ও তো লেখাপড়ার বয়স হয়েছে। এখন না পড়লে কখন পড়বে। খেলাধুলার চেয়ে এটা কি বেশি জরুরি নয়?”

“আমি মনে করি, এটা টাকার চেয়ে জরুরি নয়।”

মাম্মাকে আমি বরাবরের মতোই ভয় পাই। একমাত্র সখ্যতা ছিল ড্যাডের সাথে। তাই মাম্মামের কথার দ্বিরুক্তি করলাম না।

“আচ্ছা শোনো, রাতের ডিনার তৈরি করছ?”

মাথা নেড়ে না বোধক সম্মতি জানালাম। যা দেখে তিনি শোধালেন,

“আজ তুমি বাড়িতে এসেছিলে কখন?”

“বিকেলের দিকে।”

মিনমিন স্বরে বললাম। বীচের কাজটার সময়সীমা রাত পর্যন্ত চললেও আমি আবার অতোটা সময় থাকি না। এপর্যন্ত কখনো বিকেল সন্ধ্যা করে বাড়িতে ফিরে এসে পড়েছি। বেতনটা-ও নগদ হাতে দিয়ে দেওয়া হয়, তবে কত সময় পর্যন্ত কাজ করেছি সেই হিসেব করে। এই কাজটার জন্য ক্রিশ্চানের প্রতি আমার অনেক কৃতজ্ঞবোধ। তাই বলে…

“তুমি তো পারতে তখন ডিনার’টা তৈরি করে ফেলতে।”

আসলেই আমি পারতাম তবে বিকেলের এন্ডারসনের ভিডিয়ো কলের দৃশ্যটা এখনো আমার অক্ষিপটে ঘুরপাক খাচ্ছে। খুব শীঘ্রই তার সাথে দেখা করতে হবে দেখা যাচ্ছে। “আচ্ছা, এখনই তৈরি করছি। একটু অপেক্ষা কর প্লিজ।”

আমার-ই ভুল, উচিত ছিল রাতের ডিনার তৈরি করে রাখা। নাহলে এখন ডিনারের বদলে তাঁকে নাস্তা দিতে হতো না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here