ব্রোকেন হার্ট পর্ব-১৪

0
898

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখা : মান্নাত মিম

|১৪|
বালুকাময় বীচে ছাউনি ঘেরা রেস্টুরেন্টে হাতে হাতে সকলকে খাবার সার্ভ করছি। দিনের বেশিরভাগ সময়ই এখানে কাটাতে হয়। ভার্সিটিতে যাওয়া হয় সময়সাপেক্ষ। আগের কাজ থেকে এখানের কাজটা বেশ পছন্দের আমার। কারণ কাজটা আমি উপভোগ করতে পারি। নতুন সকল মানুষ আসে ঘুরতে এখানে। তাদের সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগে। নীলাভ-সাদা পানির সমুদ্রে গা ভাসিয়ে তাঁরা উল্লাসে মেতে ওঠে। তাঁদের হাসিখুশি আনন্দে ভরা মুখের চিৎকার শুনে আমার-ও কী যে সুখানুভূতি হয় বলার মতো নয়। অন্যের আনন্দেই তো নিজেদের সুখ সুখ, হাসি মুখ হয়; তারা-ই তো সঠিক মনুষ্যত্বের মানুষ। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এখন পর্যন্ত মন্দ কোনো মানুষের সাথে পরিচিত হতে হয়নি। কাজের সহকর্মীরা-ও বন্ধুসুলভ। আমি-ও আগের মতো চুপচাপ শান্তমুখী হয়ে নই। সবার সাথে হাসিঠাট্টাতে মজে কাজে কাজে দিন পার করে দেই। কিন্তু সকল দিন হাসিখুশিতে কাটলেও এমন একদিন এলো আমার হাসি-হাসি মুখ অন্ধকারে ডুবে গেল। বিশেষত জ্ঞানীরা বলে গেছেন, আসন্ন মন্দ দিনের কথাখান।
_______

“আমার মনে হয়, তুমি কোথাও ভুল করছ বা বুঝছ।”

“না, আমি সঠিক। ক্রিশ্চান নিজ মুখে আমাকে বলেছে।”

আমি কী বলব কিছুই বুঝে ওঠতে পারছি না, এসব কী বলছে ভেরোনিকা। এই তো আজকে বীচে পার্টি রাখা হয়েছে। ভেরোনিকা, ক্রিশ্চান দু’জনেই আমন্ত্রিত। কিছুক্ষণ আগেই গর্জিয়াস সাজে সজ্জিত হয়ে পার্টিতে আমরা খাওয়ার তালে তালে নাচ-গানে মত্ত। এমন সময় আমাকে সকলের মাঝ থেকে টেনে নির্জন স্থানে নিয়ে আসে ভেরোনিকা। গানের শব্দে কথা বলার মতো জো নেই তাই এখন বললাম,

“উফ্! ভেরোনিকা, এভাবে টানছ কে ভাই? আমার ফিস ফ্রাইটা গেল যে।”

অসহায় লুকে বালুতে পড়ে থাকা ফিস ফ্রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম।

“রাখো তো তোমার ফ্রাই। এদিকে আমি যে ক্রিশ্চানকে প্রপোজ করার ট্রাই করছি, সেদিকে মনযোগ দাও।”

আমার দুহাত ধরে বলল ভেরোনিকা। এবার একটু নড়েচড়ে উঠলাম। মন বলছে, সে আমার কাছে প্রপোজ করার জন্য বুদ্ধি চাইবে। হলোও তাই।

“আমাকে হেল্প করা না ইমি, প্লিইইজ। সুন্দর সুন্দর আইডিয়া দাও তো।”

“ওই ঝাঁকড়া চুলের বাঁদরটা গতবার না তোমায় রিজেক্ট করল? এবার-ও কি আগের সাদৃশ্য চাইছ?”

চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বললাম তাকে। কিন্তু বেচারির মলিন হওয়া আকুতিভরা মুখ দেখে খুবই খারাপ লাগল। তাই তাকে স্বান্তনার স্বরে আশ্বাস দিয়ে বললাম,

“আচ্ছা আচ্ছা, মন খারাপ করো না। আরেকবার যেহেতু ট্রাই করতে চাচ্ছাে, তাহলে করে দেখ। ছেলে মানুষের মন বলে কথা। রাজি হয়েও যেতে পারে। সকলের সামনে উষ্ণ চুম্বনে প্রপোজ করে ফেল তাহলে।”

তার কানে কানে বললাম। লজ্জায় বেচারির অসহায়ত্ব ভরে থাকা মুখে এখন উজ্জ্বলতার সহিত লজ্জালুভাব লক্ষণীয়।

“তোমার এই গোলগোল লাল হওয়া গাল আমার ভীষণ পছন্দের।”

ভেরোনিকার গাল টেনে হেসে ফেললাম আমি। সে-ও আমার গাল টেনে দিয়ে বলল,

“চিন্তা করো না। তোমার গালে লজ্জার আভায় লাল করার মতো মানুষ আসবে একদিন। দেখে নিও।”

মনে মনে স্বগোতক্তি করলাম, হাহ্! তা আর বলতে এসেছিল, অবশ্য ছিল সে নেই এখন আর। আকাশ-জমিন তফাতে দাঁড়িয়ে আমরা। ভাবনাতে মশগুল খেয়ালই হলো না ভেরোনিকা চলে গেছে আমার সামনে থেকে সেইক্ষণে। এদিকে আমি অদূরেই আকাশের গায়ে লেপটে থাকা তারার দিকে তাকিয়ে বালুতে নিজের গা এলিয়ে দিলাম। এমন সময় নিজের পাশে কে জানি ধপ করে বসেই জিজ্ঞেস করল,

“লেসবো?”

ছিঃ! এ কেমন কথা! মানুষটাকে দেখে যতোই না অবাক হয়েছি তারচেয়ে দ্বিগুণ অবাকান্বিত, বিস্মায়াবিষ্ট তরা কথাতে।

“আপনার এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

বিস্ময় করা মুখ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম। সে উত্তরে আমার পাশে শুয়ে আস্তেধীরে বলল,

“ওই যে তখন ভেরোনিকার গাল…”

“তাই বলে ভাবনাগুলো এমন?”

নাক-মুখ কুঁচকে নিজের করা প্রশ্নে নিজেই উত্তরে বললাম,

“মেয়েটাকে ভালো লাগে বন্ধু হিসেবে। হাসিখুশি, চঞ্চল, উজ্জীবিত এবং খুবই মিশুকে মেয়ে সে। আমার মতো নয় একাকিনী।”

শেষ বাক্যটা হালকা ও নিরুত্তেজ গলায় উদাসীন হয়ে বললাম। নিজেই নিজে হারিয়ে গেলাম ফের কোন এক কল্পনায়। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা গেল না কল্পনা জগতে এন্ডারসনের জন্য।

“বললে না যে, এখনও সময় আছে কি?”

হঠাৎ একই প্রশ্ন বিব্রত, থতমত আমি। তার একই প্রশ্নে হাঁপিয়ে উঠেছি। উত্তরে নিজেরই জানা নেই তাকে কী বলল?

“আপনার ক্যাপ্রিনার কী খবর?”

প্রসঙ্গ বদলে তার ফিয়ন্সের কথা জিজ্ঞেস করলাম, এমনিও জরুরি জানা, হঠাৎ করে আমার প্রতি তার ভালোবাসার এমন উথলে পড়ার কারণ। হেসে ফেলল সে আমার কথায়। আরে আমি কি হাসার কথা বলেছি না কি? আজব!

“সে তার বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আমেরিকা রয়েছে।”

অবাকের শীর্ষে নিয়ে আমায় মনে হলো কেউ আছড়ে মাটিতে ফেলল। ক্যাপ্রিনার বয়ফ্রেন্ড আছে! ইহাও হওয়ার ছিল? আচ্ছা, আমি কি খুশি এতে? অবশ্যই খুশি। ভেতরে ভেতরে খুশির দাবানল স্ফুলিঙ্গের রূপ নিচ্ছে। কখন না জানি ফেটে পড়ে এন্ডারসনের ওপর। তখনই চোখে-মুখে মাম্মামের দৃশ্য সাদৃশ্য হলো। তাঁর করা সাবধান বাণী। উপরন্তু এন্ডারসনের করা তুচ্ছতাচ্ছিল্য। গম্ভীর হয়ে গেলাম মুহুর্তেই।

“তা আপনি আমাকে ফলো করছেন কেন?”

অতোটা অন্ধকারও না সি-বীচ৷ তবুও যতটুকু আলোতে বুঝলাম, এন্ডারসন আমার কথায় থতমত খেয়ে গেছে। আমি কদিন যাবৎ খেয়াল করেছি, কেউ আমাকে ফলো করেছে। এই খেয়ালটা ছিল, ক্রিশ্চানের সাথে ঘুরতে যাওয়ার কয়েকদিন আগ হতে এমনটা অনুভব হয়েছিল। কিন্তু পরে যখন এন্ডারসনের সাথে পিকনিকে দেখা হলো, তখন বোধগম্য হলো আমার পিছু নিয়ে ছায়া হয়ে থাকা কেউ-টা কে ছিল। তবে কথা হলো, কারণটা কী? সেটা জানার জন্যই আমি উদগ্রীব। এজন্যই প্রশ্ন করা এন্ডারসনকে। তবে সে বোধহয় ভাবতে পারেনি আমার পিছু করার বিষয়ে আমি জেনে যাব। তাও আবার যখন সে আমার পিছু নিয়েছে এটাও।

“যদি বলি, আমার ভালোবাসা ফেরত পাওয়ার জন্য?”

হেসে উঠলাম, এত হাসি পেল যেন বালুতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। হাসতে হাসতেই জবাব দিলাম,

“ফেরত! বাকিতে দিয়েছিলেন না কি যে ফেরত চাইছেন?”

অনেক সময় পেরোনোর পরেও কোন উত্তর এলো না অপরপাশের ব্যক্তির থেকে। আবছা অন্ধকারে দেখলাম, এই প্রথম প্রিয় মানুষের একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। সে দৃষ্টিতে একসাথে খেলা করছিল, মুগ্ধতা ও মাদকতা। এই দৃষ্টিই আমাকে দুর্বল করার জন্য যথেষ্ট ছিল। সে খানিক ঝুঁকে এলো আমার দিকে। উত্তরে সে ফের অন্যভাবেই দিলো। উষ্ণতা সারা শরীর বয়ে বিদ্যুৎ বেগে ছুটতে লাগল। কোন কারণবিহীন আমার চোখ দিয়ে জল ছুটতে লাগল। সেই জলে অন্যকারোরও অশ্রু ফোঁটা মেশানো ছিল। যা আমাকে স্পষ্টতই বুঝালো ও অবাক হতে বাধ্য করালো। কতক্ষণ এভাবে দু’জন একে-অপরের ওষ্ঠে বুঁদ হয়ে ছিলাম কারোরই খবর হলো না। কেমন নিস্তব্ধ পরিবেশ চারিদিকে! সেই স্তব্ধতা ভেদ করে ভেরোনিকার কান্নার শব্দ আমার কর্ণকুহর ঠাহর হলো। সরে এলাম এন্ডারসনের কাছ থেকে। কান্নার শব্দ আমাদের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল। বুঝতে পেরে এন্ডারসনকে শুধু বললাম,

“এখন যান, পরে আপনার সাথে কথা হবে।”
_______

“ক্রিশ্চানকে প্রপোজ করায় সে তো একসেপ্ট করেনি উলটো যাচ্ছে তা-ই বলল। আমাকে ভালো না বাসার কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলল, তার জীবনে না কি ভালোবাসা আছে। এবং সেই ভালোবাসাটা তুমি।”

একে তো এমন তীর ধার কথা উপরন্তু ভেরোনিকার অশ্রুসজল আমাকে সেই তীর বিদ্ধ করে ফালাফালা করে দিচ্ছে। ক্রিশ্চান আমাকে পছন্দ করে জানি। এই জানাটা বন্ধু হিসেবে জানি। কিন্তু তাই বলে, ভালোবাসা! আমি তো তাকে সেই নজরে দেখিনি কখনো। আর সে-ও খুব ভালো করে জানে আমার দূর্বলতা কোথায়। এই তো সেদিনও গাড়িতে আমার বাড়ির সামনে জিজ্ঞেস করল, এন্ডারসনের বিষয়। এরপরেও কথা থাকে কোনো? মাথা ভনভন করছে। ভেরোনিকাকে আশ্বস্ত করলাম, বোধহয় সে ভুল জানে। অথচ সে বলল, ক্রিশ্চান নিজ মুখে সকলের সামনে বলেছে কথাটা। অথৈ জলে ডুবতে থাকা নাবিকের মতো হাঁসফাঁস করতে লাগলাম। কোনো বুদ্ধি তো মগজে এলোই না উলটো কান্নার মতো পথ বেছে নিলাম। যেটা পরিস্থিতি বিগড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এরইমধ্যে আচমকা এন্ডারসন এলো আমাদের সামনে। ভূত দেখার মতো দু’জনেই চমকে তার দিকে তাকালাম। সে যায়নি তাহলে? তাও আবার আমাদের কথা শুনছিল।

“ইমোজিন আমাকে ভালোবাসে।”

চমকের ওপর চমক আজ যেন আমার জন্য বিদ্যমান। কান্না থেমে হাবলার মতো তাকিয়ে রইলাম এন্ডারসনের দিকে। আসলে বুঝার চেষ্টায় রত সে কী বলল এটা?

“আপনি কী বললেন এটা?

” কেন শোনোনি বুঝি?”

“কেন বললেন?”

“মিথ্যে তো নয়। বলো মিথ্যে?”

চুপ করে গেলাম। আসলেই সত্য নিজের অনুভূতিকে মিথ্যে বলার মতো খারাপ নই আমি। যেটা সত্য তা সত্য বলার সাহসিকা রাখি। তবুও পরিস্থিতির বিপাকে অনেক সময় বলতে হয় মিথ্যা। এদিকে ভেরোনিকা এন্ডারসনকে চিনে না তবে নাম শুনেছে। বহুল আলোচিত ক্রাশবয় ভার্সিটির সেজন্য। এবার পরিচিত হয়ে দেখাও করে নিলো। মুহূর্তেই দু’জনের মধ্যে সন্ধিচুক্তি হয়েও গেল। বাহ!

“শোনো মেয়ে, সে আমাকে এবং আমি তাকে ভা-লো-বা-সি। তাই তুমি কান্নাকাটি করো না ক্রিশ্চানকে নিজের অনুভূতির সাথে পরিচয় করাও। সে দ্রুতই তোমার প্রেমে পড়ে যাবে কারণ ইমোজিন তো আমাকে ভালোবাসে।”

তাদের কথাতে যারপরনাই বিরক্তবোধ করছি। সে বুঝ দিচ্ছে ভেরোনিকাকে। হাহ্! নিজেই নিজের অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো কত সময়ের পরে। আরেকজনকে বুদ্ধি দিতে আসে। কিন্তু আমি ভাবছি, ক্রিশ্চানের কথা। নাহ, ছেলেটার সাথে আমার কথা বলতে হবে দেখছি। বন্ধুত্বকে সে অন্যকিছু ভেবে বসে আছে। তার বিবেকে না বাঁধলেও আমার কাছে বিষয়টা লজ্জাকর!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here