#ব্রোকেন_হার্ট
মান্নাত মিম
|৫|
সময় মানুষকে অনেককিছুই ভুলিয়ে দেয়, যেমন ক্ষত তবে ক্ষতচিহ্ন নয়। তেমনই দারিদ্র্যতা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে, এন্ডারসনের বাস্কেটবলের ফাইনালের ম্যাচ দেখতে যাওয়ার কথা। যাব কি যাব ভেবে মন খারাপের অবকাশ হতে দেয়নি। মাম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হঠাৎ করে। তাঁকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে আমাকে। বাড়িতে টমাস একা। সাহায্যের জন্য কেউ নেই। আশেপাশে প্রতিবেশীর বাড়িঘর খুব একটা নেই। কারণ আমাদের বাড়িটা একটু নিঝুম স্থানে গড়া। সারারাত হসপিটালের করিডোরে বসে থাকতে হয়েছে। চিন্তা করতে করতে কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল খেয়াল ছিল না। যখন চোখ খুললাম কারো স্পর্শে। পাশে তাকিয়ে দেখতে পাই ক্রিশ্চানকে। অবাক বা বিস্ময় যাই হই না কেন, কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না সবকিছু মিলিয়ে।
“আন্টির কী অবস্থা? ডাক্তার কী বলেছেন?”
ধাতস্থ হলাম আগ বাড়িয়ে ক্রিশ্চানের কথায়। দু’হাতের তালুতে মুখ হালকা মেসেজ করে নিয়ে বললাম,
“জ্বর ছিল ভেতরে ভেতরে। তিনি সেটাকে পাত্তা দেননি, গোণায় ধরেননি। মনে করেছিলেন হয়তো সিজনাল ভাইরাস জ্বর কিংবা বাড়ি পাল্টানোর জন্য পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য এই জ্বর। সময় গেলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। আর আজ তাঁর হেলাফেলার কারণে হসপিটালে এখন তিনি ভর্তি।”
হু হু করে কেঁদে ফেললাম ক্রিশ্চানের সামনে। আমার মতো অনুভূতিতে শক্ত থাকা মেয়ে-ও মা’য়ের অসুস্থতায় আজ কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আসলেই কি শুধু অসুস্থতা না কি হাজারো ব্যথা? যাইহোক আমার কান্না দেখে ক্রিশ্চান এগিয়ে এলো, জড়িয়ে ধরল পরম যত্নে। স্বান্তনার বাণীতে বলল,
“কেঁদো না ইমি, শক্ত হও। তুমি ভেঙে পড়লে আন্টিকে, টমাসকে কে সামাল দেবে?”
ক্রিশ্চানের বুকে মাথা রেখে কান্না করলাম কিছুক্ষণ। অতঃপর আমার ফুঁপানো কমলে মাথা উঁচিয়ে বললাম,
“তুমি এখানের খবর জানলে কী করে?”
ক্রিশ্চান সোজা হয়ে বসে বিস্তারিত জানাতে লাগল,
“তোমার জন্য চাকরু খোঁজে পেয়েছি। তুমি বলেছি আর্জেন্ট দরকার। তাই আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ চালিয়ে পেলাম কাজটা।তবে তোমার কোনো খবর নেই দেখে বাড়িতে এলাম তোমাদের। তখন টমাস জানালো আন্টির অসুস্থ হওয়ার বিষয়ে।”
ক্রিশ্চানকে বাড়ির ঠিকানা আমি-ই পরিচয় করার সময় কথায় কথায় জানিয়েছিলাম। ভালোই হয়েছে অসময়ে একটা জিনিস সময় মতো তে হলো। তাই কাজের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাকে,
“কী কাজ?”
“বার কাউন্টারে ওয়াইন সার্ভ করা। পারবে তো?”
আমতাআমতা করে বলল ক্রিশ্চান। পারব না কি জিজ্ঞাসা করছে। এখানে সংশয় থাকলে চলবে না, আমাকে পারতেই হবে। তাই তাকে আশ্বাস ভরা গলায় জানান দিলাম,
“পারবো। তুমি স্থান, সময় বলে দিও।”
অবাক হতে দেখা গেল ক্রিশ্চানকে। তবুও সে সেটাকে সামলে নিয়ে বলল,
“আমি-ই নিয়ে যাব তোমাকে সেখানে। আপাতত বলো, কিছু খেয়েছ?”
মাথা নেড়ে না বোঝালাম। ক্রিশ্চান তখন কপাল চাপড়ে বলল,
“আমি-ও না কী বোকা! এত ঝামেলায় খাওয়াদাওয়া হবে না কি। আবার মাত্রই তোমার ঘুম ভাঙল। আচ্ছা, তুমি এখানে থাকো আমি হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে কিছু নিয়ে আসি।”
ক্রিশ্চান চলে গেল নাস্তার জন্য কিছু আনতে। আমি কিছু বললাম না৷ চিন্তা করছি, হসপিটালের বিল, ওষুধ এসবের খরচাপাতির জন্য পরিমিত অর্থ হাতে নেই। কীভাবে করব এগুলো? বাড়তি হিসেবে তো রয়েছেই বাড়ির ঋণ। মাত্র আসা নতুন চাকরিতে তো আর বেতনটা অ্যাডভান্স চাইতে পারব না। দেখা যাবে শেষে চাকরি থেকে না বাদ পড়ে যাই৷ এদিকে হসপিটালেও আর রাখতে চাচ্ছি না বিল বাড়ার কারণে। ডাক্তারের সাথে কথা বলার তাগিদে ওঠে দাঁড়ালাম।
______
বাড়িতে ফিরেছি সাথে অবশ্য ক্রিশ্চান আসতে চেয়েছিল। আমি-ই না বোধক সম্মতি জানিয়েছি। বাহানা হিসেবে বলেছি, আমার মা’য়ের জন্য সে যথেষ্ট করেছে। আর ঋণ বাড়াতে চাই না। এমনিতেও তার ক্লাসে উপস্থিত থাকা উচিত। পারলে সে যেন আমার অনুপস্থিতে জরুরি পড়া নোট করে দেয়। সে-ও মেনে নিয়ে চলে গিয়েছিল। পরেরদিন তার সাথে দেখা করতে বলেছিল। চাকরির স্থানে নিয়ে যাবে বলে।
“ইমি হসপিটালের বিল কি ওই ছেলেটা দিয়েছিল?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাই। তিনি ধীর ল’য়ে নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকেন৷ অতঃপর আমাকে আগাম সাবধানী কণ্ঠে জানান দেন,
“ভার্সিটি পড়ছ বেশ। তবে মনে রেখ তোমার অবস্থান। আকাশের চাঁদ কুঁড়েঘরে কেবল জ্যোৎস্না ফেলে না কি ধরা দেয়। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ কী বলতে চাচ্ছি? বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।”
আবারো মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। যদি-ও তিনি ক্রিশ্চানের সাথে ক্লোজ হতে না নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তবে সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, বিষয়টা আমার কাছে এন্ডারসনের জন্য মনে হলো। ওঠে চলে এলাম বাইরে। আপাতত মাথা ও শরীরটাকে রিল্যাক্স ফিল করাতে একটা দীর্ঘতম শাওয়ারের প্রয়োজন বোধ করছি। হসপিটালের গন্ধ বুঝি এখনো গায়ে মেখে। যাতে আমার গা গুলানোর মতো অবস্থা। নিজের রুমে যাওয়ার আগে একবার টমাসের সাথে দেখা করার কথা ভাবছি। তবে সেটা আর এগুলো না। ফ্রেশ হওয়াটা জরুরি দেখা গেল। তাই টমাসের সাথে দেখা কিংবা কথা কোনটাই হলো না।
শাওয়ার শেষে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম। গত কয়েকদিন হলো বাজার করা হয়নি। যার দরুন ফ্রিজ খালি পড়ে রয়েছে। টমাসকে বাইরে পাঠানোর জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি তার রুম খালি। বাড়িতে যখন এসেছিলাম মা’কে নিয়ে তখনও খালি ছিল। ভেবছিলাম হয়তো এদিক-সেদিক রয়েছে। পরে এসে পড়বে। কিন্তু নাহ, এখনো ছেলেটার কোনো খবর-পাত্তা নেই। হারিয়ে বা কিডন্যাপ হয়ে যায়নি তো? এমনিতেই কাল সারাাত একা কাটিয়েছে সে। দ্রুত পায়ে বাইরেটাও নজর দিলাম। ছেলেটার কোনো হদিস পেলাম না। আশে-পাশে তেমন একটা বাড়িঘরের অস্তিত্ব নেই যে গিয়ে সেখানে খোঁজ নেব। মা’কে-ও বলা যাবে না, অসুস্থ মানুষ তিনি। তাই যা করার আমাকেই করতে হবে। একসাথে এত ঝামেলা সহনশীলতার বাইরে।
সন্ধ্যাকাশে কেমন মনমরা ভাব! ভার হয়ে আছে আবহাওয়া। বৈরিতা আছে না কি কারো সাথে? আমাদের-ও তো কারো সাথে বৈরিভাবাপন্ন নেই। তাহলে টমাসকে কারা ধরে নিয়ে যেতে পারে? সারা এলাকার রাস্তায় ঘুরে-ফিরে খোঁজ করলাম পেলাম না তাকে। মা’য়ের মুখোমুখি হইনি। হলেই যে তিনি জিজ্ঞেস করে বসবেন, টমাসকে দেখতে চাইবেন। তখন আমি উত্তর কী দেব? এতসব চিন্তায় নিজের রুমের দরজা লক করে বসে আছি জানালার ধার ঘেঁষে। মনটা আমার এতোই বিষণ্ণ কান্না করার ধাত বোধহয় নাই হয়ে গেছে। এমন সময় দেখি টমাসের আগমন। কারো গাড়ি থেকে নামলো দেখা যায়। গাড়িটা চেনা-জানা লাগছে। কোথাও দেখেছি বলে মনে হলেও সেটাতে বেশি জোর দিলাম না। ছুটে নিচে নামতে শুরু করলাম। টমাসকে পেয়েছি এরচেয়ে স্বস্তিকর বিষয় আরকিছু হতে পারে না।
“কোথায় গিয়েছিলি?”
বলার সাথে থাপ্পড় লাগালাম টমাসের গালে। ফর্সা মুখ থাপ্পড় না কি রাগে লাল হয়ে গেল। আমার তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। ছেলেটা আজ যা খেলা দেখিয়েছে না। পারলে গায়ের চামড়া তুলে নেই। কী পরিমাণ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আধমরা অবস্থা হয়েছে আমার, সেটা কি সমুখে দাঁড়ানো অবুঝ বালক বুঝবে? মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশেষে ঠান্ডা হয়ে এলে, বাড়ির গেট থেকে টেনে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলাম টমাসকে। ধীরেসুস্থে জানতে হবে কাহিনি কী? নাহলে দেখা যাবে, ছেলে এখনই বিগড়ে গেছে।
চলবে…