#ব্রোকেন_হার্ট
লেখাঃ মান্নাত মিম
|৮|
“আমাকে তুমি পছন্দ করো। তাই না?”
ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে শুধু দেখছি। এদিকে এতক্ষণ ধরে বাঁধ দিয়ে আঁটকে রাখা চোখের জল যেন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে নামা শুরু করে দিয়েছে। এটা কী হলো? কান্নার আসার আর সময়গোময় পেল না! এখন কী হবে? যদি বুঝে যায়? ধুর বুঝেই তো গেছে। অথচ এই কান্নার কারণটা ছিল অন্যকিছুই।
“কী হলো উত্তর দাও? না ঠিক পছন্দ নয় হয়তো ভালোটালোও বাসো।”
“আপনি এখানে কী করছেন? আমাকে ফলো করছেন কেন?”
“উমম, ঠিক ফলো না। ফলো তো তুমি করেছ, তোমার হৃদয় দিয়ে।”
“হেঁয়ালি রাখুন। সোজাসুজি বলুন কী চাই?”
“আপাতত আমার শুষ্ক ঠোঁটে তোমার ঠোঁটের উষ্ণ, তপ্ত চুমু চাই।”
থমকে গিয়ে ভড়কানো, বিব্রতকর দৃষ্টি আমার। মাথায় ভোঁভোঁ শব্দ হচ্ছে। সামনে দণ্ডায়মান এন্ডারসন না কি অন্যকারো আত্মা ভর করেছে তারউপর যার ফলস্বরূপ এমনতর উলটাপালটা বাক্য নিঃসৃত হচ্ছে তার মুখ থেকে। আচমকা এমন কথায় কে না চমকে গিয়ে থমকে যাবে।
“ম..মানে কী যা তা বলছেন আপনি?”
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গাছের সাথে মিশে গিয়ে বললাম। সেটা দেখে যেন মনে হয় এন্ডারসন মজা পেল আরো। আমার কাছে এসে ইঞ্চি কয়েক দূরত্ব রেখে একহাত গাছের সাথে লাগিয়ে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে গিয়ে বলল,
“কেন? মন্দ বলেছি কি? ভালোবাসতে পারবে সাহস করে চুমু খেতে পারবে না? সো এম্বারসিং!”
এ্যাঁ, এটা আবার কোথায় লেখা আছে জানি না তো। তবে আমাকে সে অপমান করছে কতবড়ো সাহস তার! আমার ভালোবাসার গায়ে প্রশ্ন তুলেছে! চুমু খাওয়া কোন ব্যাপারই না। অথচ না খাওয়াকে শরমের কথা বলছে। দেখিয়ে দেব আমি।
“আমার সাহস আছে।”
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দৃঢ়, শক্ত হওয়া গলায় বললাম। কিন্তু এন্ডারসন আরেক হাত দিয়ে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“তাহলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছ কেন? দেখি তো তুমি কেমন চুমু দাও!”
তার কথায় আমার রাগের পারদ তরতর করে বাড়ছে। শান্ত হয়ে থাকা আমি এখন মন চাচ্ছে, শক্ত চুমু খাওয়ার বদলে দাঁত দিয়ে কামড়ে দেই তার হালকা গোলাপিবর্ণ অধর। চোখ বন্ধ করলাম। এগিয়ে গেলাম এন্ডারসনের মুখের দিকে। অথচ আমার সমুখে কোনো অস্তিত্বের আভাস পেলাম না তখন। তিরতির করে কাঁপতে থাকা চোখের পাতা খোলে দেখি এন্ডারসন আমার কাছ থেকে দুয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। এটা কী হলো! আমার ভাবনাগুলোর ওপর ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে গেল সেখান থেকে। আমি আবারও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে।
______
নিজের রুমে ঘুমে বিভোর হয়ে পড়ে ছিলাম কয়েক ঘন্টা পূর্বে। আপাতত জানালা গলিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকনে ব্যস্ত। ভার্সিটি যাওয়া হয়নি আজও। তাতে মূল কারণ এন্ডারসন’ই। লজ্জায় যেন চোখ তুলে তাকাতে পারব না যদি তার সাথে দেখা হয়ে যায়, এই ভয়ে। আবার ভার্সিটিতে গেলে দেখা না হয়ে উপায়ও তো নেই। উপরন্তু দেখা যাবে অন্যদের দিয়ে সে আমাকে ডেকে পাঠাবে হেনস্তা করতে। বুঝে গিয়েছি, আমি যে তাকে ভালোবাসি সেটা জেনে আমাকে নিয়ে সে মজা নিচ্ছে, বিব্রত করছে। ফাজিল ছেলে! আজ একেবারে সন্ধ্যের সময়ে ক্লাবে যাব ভেবে রেখেছি। পথিমধ্যে ক্রিশ্চানকেও বলব দেখা করার জন্য। আমার ফোনালাপ হয় না খুব একটা। অতি প্রয়োজন ব্যতীত মোবাইল ব্যবহার করার মানুষ নই আমি। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগানুসারে তাল মিলিয়ে চলতে হয় বলেই, হাতে থাকা সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইলটা বিক্রি করা হয়নি এপর্যন্ত। তবে আমার চেয়ে এর ব্যবহার হয় টমাসের হাতে। সে-ই রাখে নিজের কাছে গেম খেলার বাহানায়। আমি-ও না করি না কারণ ছেলেটার লেখাপড়া নেই। ফাঁকা বাড়িতে একা একা করবেটা কী ভেবেই।
মিটিমিটি সন্ধ্যেতারা জ্বলে আকাশে। আমি চেয়ে রই অদূর পানে। দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে সাইকেলে চড়ে রওনা হই ক্লাবের উদ্দেশ্যে। ভেতরে ভেতরে ভয়ের উৎকণ্ঠা কাজ করছে। যদি গতকালের ছেলেগুলো আজও কোন ঝামেলা করে? আঁতকে উঠি আতংকে বারবার। তবে আশ্বাস দেই নিজেকে, আজ ক্রিশ্চান আছে সাথে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটা আমার কাজ করতেই হবে, হাজারো সমস্যা থাকলেও। তবে অবশ্য নিজেকে বিকিয়ে নয়। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের কাজের স্থান বার কাউন্টারে গেলাম। আস্তেধীরে সকলকে ড্রিংকস সার্ভ করতে লাগলাম।
“ইমোজিন!”
পিছু ফিরে দেখি ক্রিশ্চানকে। এসেছে তাহলে। ইশারায় বসতে বলি। দ্রুত হাতে কাজ করতে লেগে পড়ি যাতে ভিড় খানিকটা কমে আসে আর ক্রিশ্চানের সাথে আমার কথা বলতে সুবিধা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে আয়ত্তে এসে পড়ে ভিড় কমে। ক্রিশ্চানের হাতে ড্রিংক ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
“ক্লাসের নোটগুলো দিতে পারবে?”
ড্রিংক গলাধঃকরণ করে ক্রিশ্চান মাথা নেড়ে সায় জানায়।
“এজন্য আসতে বলেছ? ওটা তো আমি এমনিও তোমায় দিতাম।”
আমতাআমতা করছি আসলে আমি যে আরো কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য তাকে ডেকেছি সেটা মুখ ফুটে বলতে পারছি না। কী না কী ভেবে বসে ক্রিশ্চান, এই ভেবে।
“ওহ্! তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।”
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ক্রিশ্চানের পানে কী বলতে ছেলেটা ভুলে গেছে? ভ্রু কুঁচকে এলো তখনই অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ক্রিশ্চান আমার দিকে তাকিয়ে অন্যরকম তবে কাঠিন্য দৃষ্টি নিয়ে বলল,
“এন্ডারসনের সাথে কি রিলেশনে আছ তুমি?”
অবাকান্বিত, আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললাম,
“এমন বলার কারণ?”
অস্ফুট হলেও শুনতে পেল ক্রিশ্চান,
“এন্ডারসন আবারো তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল।”
বলেই আঁড়চোখে সন্ধেহের দৃষ্টিতে তাকায় ক্রিশ্চান। আমার দমবন্ধ দমবন্ধ অনুভূত হচ্ছে। গলা প্রচণ্ড শুঁকনো শুঁকনো লাগছে। আপাতত পানি না নিয়ে ড্রিংক করতে লাগলাম।
“জানি, ছেলেদের আকর্ষিত করার মতো তোমার আকর্ষিণী রূপ রয়েছে। এক দেখায় ভালোলাগা বা ভালোবাসার মতো মেয়ে তুমি। তবুও এন্ডারসনের মতো ছেলের সাথে ঠিক একটা যায় না। বড়োজোর লিভিং হবে এছাড়া আরকিছু নয়। কারণ এন্ডারসনের বিয়ে ঠিক করা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার আদরের ছোটো। তাই তাকে নিয়ে তাঁদের পরিবারের সকলের চাওয়া’টা অনেক। তাঁরা তাঁদের স্ট্যাটাসের সাথে ম্যাচ করে এমন কাউকেই পছন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। সে হিসেবে তোমার অবস্থান তাহলে কোথায় বা ভবিষ্যতে কোথায় হবে ভেবে দেখেছ কি?”
সচ্ছ কাচের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার মতো আমাকে আমার যোগ্যতা দেখিয়ে দিলো ক্রিশ্চান। তার বলা প্রতিটি কথাই সঠিক কিন্তু মন, মন যে মানতে নারাজ। প্রেম, ভালোবাসা তো সবকিছুর উর্ধ্বে। তারা কি আর যোগ্যতা স্ট্যাটাস দেখে আসে? আসে না। আউলা বাতাসে বাউলা বানিয়ে উত্তাল ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে তলিয়ে দিতে চলে আসে আমন্ত্রণহীন মেহমানের মতো। আমার-ও যে একই হাল৷ কোনকিছুতেই মনমস্তিষ্কে এন্ডারসন নামক ব্যক্তিকে ডিলিট দিতে পারছি না। সে যেন পালাক্রমে আরো ঝেঁকে বসছে। আমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ক্রিশ্চান ওঠে গিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু আবার পিছনে ফিরে বলল,
“কাল ভার্সিটিতে অ্যাট্যান্ড করলে ভালো হবে। বন্ধ দেওয়া কোন সমাধান নয়।”
চলে গেলো কিন্তু আমাকে পাথুরে মূর্তি বানিয়ে রেখে গেল। সত্য সর্বদা তিক্ততার মতো হয়। আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। পরবর্তীতে কাজে আর মন বসলো না। একপ্রকার জোর করে বসালেও মাঝেমধ্যে কাস্টমার’দের জন্য বানালে সেই ড্রিংক নিজেও গলাধঃকরণ করি কিছুটা। গলার জ্বলা তখন হৃদয় জ্বলুনির চেয়ে কম অনুভূত হয়। আজ বারোটারও বেশি সময় ধরে রয়ে গেলাম ক্লাবে। তবে কাজের বদলে ড্রিংক করতে করতে মাতাল অবস্থা আমার। আমার সাথের কর্মীরাও দুয়েক বার আঁড়চোখে খেয়াল করেছে আমাকে। তাদের সাথে সখ্যতা নেই৷ তারা আমার চেয়ে এককাঠি ওপরে। অর্থাৎ কথা কম বলে। যার দরুন ফ্রি হয়ে উঠতে পারিনি তাদের সাথে। একপর্যায়ে রাত একটার সময় হেলতেদুলতে বেরিয়ে পড়লাম। সাইকেল হাত নিয়ে চড়তেই পারছি না তাতে। কয়েকবার তো মুখ থুবড়ে পরেও গেলাম সাথে হাতে থাকা সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইলটার রফাদফা অবস্থা। এমন সময় কে জানি আমাকে মাটি থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালো। নিভুনিভু নয়নে পিটপিটিয়ে তাকিয়ে আবছার মতো এন্ডারসনের অবয়ব দেখতে পেলাম। তখন চিৎকার করে মুখ থেকে কয়েক শব্দ নির্গত করলাম,
“আমি তোমায় ঘৃণা করি৷ এন্ডারসন। বুঝেছ?”
একটু থেমে আঙুল উঁচিয়ে ফের বললাম,
“প্রচণ্ড ঘৃণা করি। এতোটাই ঘৃণা করি যে ভুলতে পারি না।”
শেষোক্তি অসহায়ের গলায় বলে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেললাম। এন্ডারসন দু’হাতে আগলে নিয়ে বলল,
“ঘৃণা যে ভালোবাসার চেয়েও বেশি প্রখর। ভুলতে দেয় না সহজে।”
আমাকে মূহুর্তের মধ্যে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির ভেতরে বসিয়ে সিটবেল্ট লাগিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। কিছু সময় পরে ফিরে এসে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করল৷
“তু.. তুমি সেদিন আমার ভাই টমাসকে কেন নিয়ে গিয়েছিলে? হুম, বলো বলো।”
ছোটো-ছোটো চোখ করে ঘাড় বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এন্ডারসনকে। সেই কখন থেকে ‘আপনি’ শব্দ ‘তুমি’তে এসে নেমেছে সেই খেয়াল মাত্রই এন্ডারসনের বোধহয় হলো।
“বাহ! আজ দেখি মাতলামির সাথে তুমিতে নেমে এসেছ!”
এক ভ্রু উঁচিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল সে। তারপর উদাস হওয়া কণ্ঠে বলল,
“তোমার খোঁজ নিতে।”
চলবে…
যারা পড়েন রেসপন্স করার অনুরোধ রইল।